আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রিক্সা আকাল

সুখীমানুষ

একটা ঘটনা বলি, সত্য ঘটনা। গত কিছুদিন আগে বিকেল বেলা, এয়ারর্পোট বাস-ষ্টেন্ডে যথারীতি ছিল অনেকগুলো রিক্সার ভিড়। এদের মধ্যে কেউবা সিটের উপর পা তুলে আরাম করছে কেউবা খালি বসে আছে। একজন অসুস্থ রুগী এদেরকে এক এক করে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন কেউ প্রেমবাগান যাবে কি না। কারো কাছ থেকেই কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি আকুতির স্বরে বলতে লাগলেন ’ভাই, আমার শরীরটা খুব খারাপ, তোমারে পনেরো টাকা দিবো।

আমারে নিয়া নামাইয়া দিয়া আসো’। গত ৭/৮ মাস আগেও যে ভাড়া ছিল মাত্র পাঁচ টাকা, তা ঐ দিন পনেরো টাকা দিয়েও কেউ যেতে রাজি হয়নি। পরে ঐ বৃদ্ধ, অসুস্থ লোকটি ”কিচ্ছু করার নাইরে, কিচ্ছুনা...” বলতে বলতে হাটা শুরু করলেন। রিক্সাওয়ালাদের কেউ কেউ এই বৃদ্ধকে বেশ মজার দৃষ্টিতেই দেখতে থাকলো। কিন্তু এ ঘটনাটি বড় দাগ কাটলো আমার মনে।

আমি খুব কাছ থেকে গত কয়েক মাস রিক্সাওয়ালাদেরকে দেখার চেষ্টা করেছি। এদের বেশীর ভাগেরই বিবেক বলতে কিচ্ছু নেই। সমাজের উচ্চ শ্রেণীর কিছু কিছু লোক সুযোগের সদ্বব্যাবহার করে থাকেন। আজকাল রিক্সাওয়ালারাও করছেন। তাদের সাধ্যমত তারাও জিম্মি করে রেখেছেন নিুবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মানুষদেরকে।

আমি নিজে বহুদিন ধরে প্রায় দিনই হেটে হেটে রিক্সার রাস্তাটুকুন যাতায়ত করি। যেদিন খুব বেশী কান্ত থাকি সেদিন হাটি আর রিক্সায় যে ভাগ্যবানেরা উঠতে পেরেছেন তাদের দিকে চেয়ে থাকি। তবু আশা ছেড়ে দেইনা, অর্ধেক রাস্তা হাটতে হাটতে আসার পরেও যদি কোন খালি রিক্সা দেখি, তো ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করি যাবে কি না। কখনোবা উত্তর আসে ’না’ কখনোবা উত্তরও দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনা। আমি মনে মনে আক্রোসে ঐ বৃদ্ধের মত বলি ”কিচ্ছু করার নাইরে, কিচ্ছুনা...”।

চোখের সমনে খালি চলে যাচ্ছে, যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে যাবে কিনা জানতে চাইলেও নিরাশ হতে হয়। এরা মনে হয় আজকাল খালি চালাতেই বেশী মজা পায়। ঐ দিন মহাখালী বন বিভাগের সামনে থেকে যাচ্ছি ওয়্যারলেস গেইট। একটি রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলাম ওয়্যারলেস গেইট যাবে কিনা। সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াতেই ওঠে বসলাম।

কারন ভাড়া আমার জানা আছে, ৪ থেকে ৫ টাকা। কিন্তু সেই রিক্সাওয়ালা অমাকে অবাক করে বলে বসলো, ভাড়া কিন্তু ১২ টাকা! আমি কিচ্ছু না বলে নেমে গেলাম। আস্তে আস্তে সামনে এগোতে থাকলাম এবং এক এর পর এক রিক্্রাও পেতে থাকলাম কিন্তু ভাড়া ১২ টাকার চেয়ে কমার বদলে তা কারো কারো কাছে হয়ে গেল ১৫ টাকা! আমি সোজা হাটা দিলাম, ৪ মিনিটেই পৌছে গেলাম গন্তব্যে। আমার তেমন তাড়া ছিলনা, হাটতেও ছিলনা সমস্যা। কিন্তু যিনি অসুস্থ কিংবা অন্য যে কোন কারনেই হোক তার রিক্সায় যেতেই হবে।

তবে তাকে কিন্তু অবশ্যই ব্ল্যাকমেইল করা হলো। আমার এক বন্ধু অনেক মাস পর আমার বাসায় এসেই মাথায় হাত দিয়ে হাসতে শুরু করলো। কারন জিজ্ঞাসা করাতেই সে হাসতে হাসতে বল্লো, রিক্সায় কিছু না বলেই সে চড়ে বসেছিল। যে ভাড়া সে ৭/৮ মাস আগে ৫ টাকা দিয়ে অভ্যস্ত ছিল তা তার কাছ থেকে রাখা হয়েছে ২৫ টাকা! ওল্টা আরো সেই রিক্সাওয়ালা নাকি বলেছে ”ট্যাকা না থাকলে কন, মাফ কইরা দেই। কিন্তু ল্যাইজ্য (ন্যায্য) ভাড়া দিবার চাইলে ২৫ ট্যাকা দেন”।

যাই হোক, এেেত্র সবচেয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন মহিলারা। কারন উনাদেরকে হেটে হেটে যাওয়া ও সম্ভবনা, একটা যায়গায় অনেন দাড়িয়ে দর-দাম করা ও সম্ভবনা। জিনিস পত্রের ঊর্ধগতি, রিক্সার জমা আগে ছিল ৪০ টাকা এখন হয়েছে ৮০ টাকা, মানলাম। কিন্তু সুন্দর, পিচ-ঢালা রাস্তা যা নাকি হেটে যেতে লাগে ৪ মিনিট তার ভাড়া ১২ থেকে ১৫ টাকা হওয়াটা একেবারে বিবেকহীন কাজ। এবং এরা সবাই মিলে এই ভাড়া ঠিক করে রেখেছে, এ মনোপুলি ছাড়া আর কিছু নয়।

আমি খেটে খাওয়া মানুষদেরকে হেয় ভাবছি না। আমি নিজে রিক্সা ভাড়া নিয়ে আপে করতে অনেককেই দেখছি ইদানিং। এবং খালি বসে থাকবে, খালি চালায়ে যাবে কিন্তু আপনার কথা কানেও তোলবেনা। আপনি একটি সার্ভিস চালু করে কিন্তু কায়েন্টকে অবহেলা করতে পারেননা। যদি কায়েন্টকে ফিরিয়ে দিতে হয় তাহলে অবশ্যই সঙ্গত কারন আপনাকে বলতেই হবে।

মনে করুন, আপনি একটি দোকান এর মালিক। কোন কায়েন্ট গিয়ে যদি আপনার দোকানে একটি পণ্য কিনতে চান তাহলে আপনি কিন্তু বলতে পারবেননা যে বিক্রি করবোন। যদি বলতে হয় তাহলে আপনি সঙ্গত কারন দেখায়ে তবেই বলতে হবে কেন আপনি বিক্রি করতে পারবেননা। তাই আমার কথা হচ্ছে একটা রিক্সাওয়ালা তার রিক্সা নিয়ে রাস্তায় বের হওয়া মানেই সে একটা সার্ভিস নিয়ে রাস্তায় এসেছে। এখন তাকে কোথাও চেতে বল্লে সে যদি না যেতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই সঙ্গত কারন বলতে হবে।

কিন্তু কে করবে এর বিহিত? যে দেশ দূনীতিতে পরপর অনেকবার চেম্পিয়ন হয়, সে দেশে এই সামান্য রিক্সাওয়ালাদের এহেন আচরনকে কেইবা প্রাধান্য দিবেন? তবে হ্যাঁ, তিনি প্রাধান্য দিবেন যিনি সারা দিন অফিস করে কান্ত ভাবে অনুনয় করেও ভাড়া নিয়ে দর-দাম তো দূরের কথা রিক্সাওয়ালা যাবে কি যাবেনা এই উত্তরও না পেয়ে প্রায় প্রতিদিনই হাটতে হাটতে বাসায় যেতে হয়। হয়ত এই রাগ ঝারতে হয় নিজের উপর কিংবা ঘরের লোকদের উপর। আমার বাসার পাশে যে রিক্সা গেরেজ আছে তাতে কিছুদিন কথা বার্তা বলে যা শুনলাম তা হলো, একটা রিক্সাওয়ালার প্রতি দিন নেট প্রফিট হচ্ছে গড় এ ২৫০ টাকা। তার মানে মাসে ৭৫০০ টাকা। এই ঢাকা শহরে বেশীরভাগ আফিসেই অফিস সহকারীর বেতন হয় সাধারণত ২০০০ থেকে ৪০০০ টাকা।

এই টাকা থেকে আবার যাতায়ত ভাড়াও দিতে হয়, খাওয়া দাওয়া ও করতে হয়। তারপরেও দেখা যায় একজন অফিস সহকারীর জীবন যাপনের মান একজন রিক্সাওয়ালার জীবন যাপনের চেয়ে অনেক উন্নত। প্রশ্ন জাগে মনে, এরা তুলনামূলক বেশীই কামাই করছে, তবু কেন এদের জীবন যাপনের মান উন্নত হচ্ছেনা? কেন এদের মানবতাবোধ জেগে উঠছেনা? মানুষকে বিপদে ফেলে পয়সা ইনকাম করাতো অন্যায়! আমি অতি ুদ্র মানুষ, তাই আমার পে গবেষণা করে এর বিহিত বের করা সম্ভব না। তবে এর একটা উপায় বের করা প্রয়োজন। যদি দেখা যায় যে এদের সিন্ডিকেট ভাঙ্গা সম্ভব হচ্ছেনা, তাহলে অবশ্যই অন্য কোন বিকল্প ব্যবস্থা বের করার কথা ভাবতে হবে।

কিছু কিছু বিষয় থাকে যা নাকি খুবই স্পর্সকাতর। এর মধ্যে অন্যতম হলো খেটে খাওয়া মানুষদেরকে নিয়ে কিছু বলা। আমি নিজেও খেটে খাওয়া মানুষ। সারা দিনের কর্ম শেষে যখন বাসায় ফিরি, তখন অনেক অনেক খালি রিক্সা থাকে কিন্তু এদের কেউই যেতে রাজি হয়না। ভাগ্য যদি খুব ভালো হয় তাহলে হয়ত কেউ ভুল করে রাজি হয়ে যান ঠিকই কিন্তু ৫ টাকার ভাড়া ১৫ থেকে শুরু করে ২৫ পর্যন্ত চাইতে ভুল করেননা।

তাই প্রায় দিনই আমাকে হেটে হেটে বাসায় আসতে হয়। এতে আমার সমস্যা নেই, সমস্যাটা হয় যখন শরীর খুবই খারাপ থাকে। আমি তখন ৫ টাকার ভাড়া ২৫ টাকা দিয়েও অসতে চাই কিন্তু কেউ রাজি হয়না। আমি ঐ বৃদ্ধের মত এলোপাথারি পা ফেলে হাটি আর বলি... ”কিচ্ছু করার নাইরে, কিচ্ছুনা...।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।