আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকার যাতায়াত সমস্যা : রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা না করে কিভাবে সমাধান সম্ভব



ঢাকার যাতায়াত সমস্যা : রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা না করে কিভাবে সমাধান সম্ভব (প্রথম পর্ব) ভূমিকাঃ ঢাকা শহরের যানবাহন সমস্যার সমাধান কি আদৌ সম্ভব ? এ প্রশ্ন এখন সবার, বিশেষতঃ ভুক্তভোগী ঢাকাবাসীর মনে । আমরা মনে করি, একটি সৎ এবং নিবেদিতপ্রান সরকার যদি সঠিক ভাবে চেষ্টা করে তাহলে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে । তবে তেমন সরকার আমরা পাবো কি না সেটাই প্রশ্ন । ঢাকার যানবাহন সমস্যা সমাধানে আগের সরকারগুলি সহ এই সরকার যে সম্পূর্নভাবে ব্যর্থ তা এখন সন্দেহাতীত ভাবে প্রমানিত হয়েছে । বর্তমান সরকারের ভূল পরিকল্পনার কারনে আগেকার সরকারগুলির সৃষ্ট এই সমস্যা বেড়ে এখন এমন এক অসহনীয় রূপ নিয়েছে যে এই শহরে বসবাস করাকে এখন অনেকে দোজখে বাস করার সঙ্গে তূলনা করে থাকে।

যে কোন সমস্যার সমাধান সম্বন্ধে আলোচনা করতে হলে সবার আগে তার কারন সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারনা লাভ করা প্রয়োজন । তবে ঢাকাবাসী এই কারনগুলি খুব ভালভাবে জানেন বলে আমরা আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি কারন সংক্ষেপে এবং সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করব । আমাদের আলোচনায় থাকবে প্রধানতঃ নীচের ৩টি বিষয়ঃ (০১) দেশের সমস্যা সমাধানের জন্য কেমন সরকার প্রয়োজন, (০২) কেমন করে এই সমস্যার সৃষ্টি হলো এবং (০৩) বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর একেবারে নিশ্চিত কোন সমাধান আছে কি না । (০১) দেশের সমস্যা সমাধানের জন্য কেমন সরকার প্রয়োজন ঃ যে কোন দেশের প্রধান প্রধান সমস্যার সমাধান এবং জনগনের মঙ্গল করতে পারে একটি সৎ এবং নিবেদিতপ্রান গনতান্ত্রিক সরকার । আমাদের দেশ গনতান্ত্রিক হলেও আমাদের দেশে সৎ এবং নিবেদিতপ্রান সরকার আছে এমন কথা বলা যায় না ।

গনতন্ত্রে জনগন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করেন । এদের উপর দায়ীত্ব থাকে, জনগনের সর্বোত্তম মঙ্গল নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে দেশ পরিচালনা করা। গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এজন্য রাখা হয়েছে নির্বাহী সরকার এবং পার্লামেন্ট বা আইনপরিষদ । আইনপরিষদের কাজ হলো দেশের জন্য যুগোপযোগী আইন প্রনয়ন করা এবং পুরানো আইন সংশোধন বা বাতিল করা । বাংলাদেশের পার্লামেন্টে সদস্যগনের এই দায়ীত্ব পালন এখন গৌন বিষয় ।

তার পরিবর্তে সরকার তাদের উপর ন্যস্ত করেন বিভিন্ন আর্থিক প্রকল্প বাস্তুবায়নের কাজ । তাদের এই দায়ীত্বের পরিবর্তন যে একটি সরকারের সামগ্রিক কর্মকান্ডে কি বিরাট পরিবর্তন এনেছে এবং দেশের সার্বিক কল্যানে বিরূপ ভূমিকা রেখেছে তা দেশবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে । আইন প্রনয়নকারী সাংসদ হিসেবে তাদের দায়ীত্ব থাকতে পারতো, ‘প্রত্যেক সদস্যকে দেশের অন্যান্য পেশাজীবিদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ন ভাবে পাওয়া ছুটি বাদে অন্যান্য দিনসমুহে সংসদে উপস্থিত থাকতে হবে । প্রত্যেক সাংসদকে বৎসরে (ধরা যাক) কমপক্ষে একটি নতুন আইন প্রনয়ন অথবা ৫টি পুরানো আইন সংশোধন করতে হবে । ‘- ইত্যাদি ।

এই নিয়ম প্রচলিত থাকলে বর্তমানে যে ধরনের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তারা একাজে আগ্রহী হতেন না । আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, ব্যবসায়ীরা প্রধানতঃ নিজেদের স্বার্থে কাজ করায় অভ্যস্ত । জনগনের বা দেশের মঙ্গল তাদের প্রধান বিবেচ্য, একথা এখনও প্রমান হয় নি । আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমানে সংসদ সদস্যদের যেভাবে আর্থিক প্রকল্প বাস্তুবায়নের কাজে নিয়োজিত করেছেন তা ব্যবসায়ীক মনোভাব সম্পন্ন লোকদের চাওয়া পাওয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ন । বিগত নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা স্বত্বেও আওয়ামীলীগ সরকার মানুষের মঙ্গল সাধনে ব্যর্থ হবার একটি প্রধান কারন, ‘ব্যবসায়ীদের চাওয়া পাওয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ন ভাবে সাংসদদের কাজ বিন্যাস করা এবং রাজনৈতিক দল চালানোর জন্য তাদের আর্থিক সাহায্যের উপর নির্ভর করা’ ।

গনতান্ত্রিক দেশে সৎ এবং নিবেদিতপ্রাণ সরকার গড়তে চাইলে সেজন্য প্রয়োজন, নিবেদিতপ্রাণ কর্মী । বর্তমানে আমাদের দেশে যে আর্থসামাজিক অবস্থা করছে তাতে দেশে তেমন রাজনৈতিক কর্মী বা নেতা গড়ে ওঠার কোন সুযোগ নেই । এখন যেসব ছাত্র, যুবক এবং পরিণত বয়সের মানুষ প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় রাজনীতি করে তাদের এই কাজের খরচ এবং উপরি আয় তাদের রাজনৈতিক দলটি বহন করে অথবা তার ব্যবস্থা করে দেয়। একেবারে খোলাখুলি ভাবে বলা যায়, জামাতে ইসলামীর মতন ধর্মভিত্তিক দলগুলি একাজের জন্য বিদেশ থেকে সাহায্য পেয়ে থাকে, বি এন পি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) ও জাতীয় পার্টি সরকারে থাকাকালীন সময়ে সঞ্চিত অর্থ থেকে এই ব্যয় নির্বাহ করে থাকে, আর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারে থাকাকালীন সময়ে সঞ্চিত অর্থ থেকে এবং এখন (অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকাকালে) বিভিন্ন স্থান থেকে নানা উপায়ে তারা যাতে অর্থ পেতে পারে তেমন ব্যবস্থার মাধ্যমে এই ব্যয় মিটিয়ে থাকে । এর বাইরে, সমাজতন্ত্রের স্বর্নযুগে যে সব নিবেদিতপ্রান ব্যক্তি রাজনীতি করতেন তারা এখনো অন্তরের তাগিদে তা করে থাকেন ।

তবে তাদের আর্থিক অবস্থা এবং জনসমর্থনের অবস্থা এমন করুন যে অন্যদের কাঁধে ভর না করে তাদের নির্বাচিত হবার উপায় নেই । সঙ্গত কারনেই এ ধরনের নেতা আর নতুন করে সৃষ্টি হবে না । এমন প্রেক্ষাপটে অর্থাৎ, (ক) যেহেতূ সংসদে আইন প্রনয়নের মতন গুরুত্বপূর্ন কাজ করার কোন বাধ্য বাধকতা নেই (যে কারনে বিদ্যাবুদ্ধি বা শিক্ষারও তেমন প্রয়োজন নেই), (খ) বরং আছে লাভজনক প্রকল্পে অংশগ্রহনের সুবিধা, তাই কম ধী-সম্পন্ন ব্যক্তি এবং ব্যবসায়ী, যারা দলকে মোটা চাঁদা দেবার ক্ষমতা রাখেন, তারা সংসদ সদস্য হবার ইচ্ছে পোষন করেন এবং রাজনৈতিক দলগুলি তাদের ইচ্ছা পূরন করে থাকে। সমস্যাটির কথা আর না বলে আমরা বরং এর সমাধানের কথাই বলি । এই সমস্যার সমাধান ঃ সমাজতন্ত্র আর আসবে না ।

এই তন্ত্রে যে মহৎ উদ্দেশ্য ছিল তাও আর মানুষকে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে গরীবের উপকার করার জন্য প্রান বাজী রাখায় উদবুদ্ধ করবে না । এক্ষেত্রে আমাদেরকে ধনতান্ত্রিক গনতন্ত্রের মধ্য থেকেই ভালো রাজনীতিক তৈরী করার ব্যবস্থা করতে হবে । বর্তমানে “নেতার চামচা হয়ে এবং ফুটপাথ বেঁচে রাজনীতিক” হওয়ার যে পদ্ধতি আমাদের দেশে প্রচলিত আছে তা থেকে কোন নিঃস্বার্থ এবং নিবেদিতপ্রান রাজনীতিক জন্ম নেয়ার কোন সম্ভাবনা নেই । বর্তমানে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের মতন ধনতান্ত্রিক গনতান্ত্রিক দেশ সমূহে বড় পুঁজিপতিগন প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে রাজনৈতিক দলগুলির খরচ বহন করে থাকে । এর ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধিগন পূঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষাকারী পরিকল্পনা গ্রহন করতে বাধ্য হয় ।

আমাদের দেশেও যে এই অংশতঃ এবং কার্য্যতঃ এটাই ঘটছে তা বুদ্ধিমান লোকের না বোঝার কথা নয় । নিঃস্বার্থ এবং নিবেদিতপ্রান রাজনীতিক তৈরী করা সম্ভব সম্ভব যদি জনগন আগ্রহী মানুষ এবং রাজনৈতিক দলগুলির রাজনীতি চর্চা করার ন্যুনতম খরচ বহন করে । এ কাজটি করতে হবে সরকারের মাধ্যমে । আমাদের দেশে সরকারী কোষাগার থেকে নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহ করার কথা উঠেছিল । এটি সঠিক পন্থা বলে মনে হয় না ।

আ বিষয়ে আদর্শ পন্থা হতে পারেঃ (ক) রাজনৈতিক দল সমুহের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সর্বোচ্চ ৩ বা ৪ টি দলকে সমগ্র দেশে রাজনীতি করার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেয়া, এই অর্থ খরচের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং প্রধান দলগুলিকে পর্য্যায়ক্রমে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান (যেমন, স্বাধীনতা দিবস ইত্যাদি) পালনের দায়িত্ব দেয়া । (খ) কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের রাজনীতি চর্চা করার জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া । এই অর্থ হবে ছাত্রদের দেয়া সংসদ ফি এর অতিরিক্ত বরাদ্দ । ছাত্রদেরকে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একেবারে সম্পর্কশূন্য হয়ে এই রাজনীতি করতে হবে । অনেকে মনে করতে পারেন, এভাবে রাজনীতির জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ দেয়া হলে জনগগের আর্থিক ক্ষতি হবে ।

আসল ব্যাপারটি হল, তা না করায় বরং জনগনের বেশী ক্ষতি হয় । একটি তুলনামূলক চিত্র দিয়ে আমরা ঘটনাটি বলছ । যদি রাষ্টীয় কোষাগার থেকে রাজনীতি করার খরচ দেয়া হয়ঃ ধরা যাক, বাংলাদেশে পাঁচ কোটি পরিবার, তিন কোটি ভোটার এবং এক কোটি আয়কর দাতা আছে । এক্ষেত্রে ভোটার প্রতি (ধরা যাক) দশ টাকা হারে ধরে সরকার নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলিকে ত্রিশ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে পারে । এর ফলে এক কোটি আয়কর দাতার সর্বোমোট ত্রিশ কোটি টাকা খরচ হবে ।

রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে রাজনীতি করার খরচ দেয়া না হলেঃ আমাদের জানা আছে, একটি রাজনৈতিক দল ‘ডানো’ গুড়া দুধ কোম্পানীর বাংলাদেশী পরিবেশককে টিন প্রতি তাদেরকে একশ’ টাকা দেবার নির্দেশ দিয়েছিল । এর ফলে এই দুধের দাম রাতারাতি এক শ্’ দশ বা বিশ বেড়ে গিয়েছিল । আরেক সরকার এভাবে বানিজ্য করা ছাড়াও ফুটপাথ বানিজ্য করে, রাস্তা মেরামতের ঠিকাদারদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে জনগনকে যে কষ্ট দিয়েছে তা আমদের সবার জানা আছে । ক্ষমতাসীন দল যখন তাদের নিজেদের খরচ জিনিসপত্র সরবরাহকারী বা সেবা প্রদানকারী সংস্থা বা সরকারী প্রকল্প থেকে সংগ্রহ করে তখন জিনিসপত্রের অতিরিক্ত মূল্য বাবদ দেশের মানুষকে বিপুল পরিমান টাকা গচ্চা দিতে হয় । বাংলাদেশে এই টাকার পরিমান ভয়াবহ রকমের বেশী ।

এই ব্যপারটা বোঝার পর যে কোন বাংলাদেশীর উচিত রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে রাজনীতি করার খরচ দেয়ার ব্যপারে পূর্ন সম্মতি জানানো । রাজনীতি করার খরচ এখনকার মতন দলগুলিকে তোলার সুযোগ না দিয়ে সরকার সরাসরি তা দিলে যা হতে পারে তা হলঃ (ক) জনগনের আর্থিক ক্ষতি ও কষ্ট অনেক কম হবে । (খ) রাজনৈতিক দলগুলি স্বচ্ছভাবে টাকা খরচ করতে শিখবে । (গ) জনগন রাজনীতিকদের বলতে পারবে, ‘তোমরা আমাদের টাকায় রাজনীতি করছ, তাই দায়ীত্বশীল আচরন কর’ । (ঘ) নীতিবান, ভদ্র এবং ভালোমানুষ রাজনীতিতে আসার সুযোগ পাবে ।

এখন প্রধানতঃ অর্থলোভী ছাত্র বা মানুষ ক্যাডার হতে উৎসাহী হয় । (ঙ) যারা রাজনীতি করবে তারা স্বাধীন ভাবে দলের ভেতরে বা বাইরে কথা বলতে বা ব্যবস্থা নিতে পারবে । এখন এদেরকে দলীয় প্রধান (যার মাধ্যমে টাকা পাওয়া যায়) এবং প্রধানের আত্মীয় বা চামচাদের মন রক্ষা করে সবকিছু বলতে বা করতে হয় । তাই তাদের স্বাধীন চিন্তা, চেতনা ও মনোভাব বিকশিত হতে পারে না । (দ্বিতীয় পর্ব) কেমন করে ঢাকা শহরে যান বাহন সমস্যার সৃষ্টি হলোঃ উপরের ‘আদর্শ সরকার’ সম্বন্ধীয় আলোচনাটি ঢাকা শহরের যানবাহন সমস্যার সমাধান আলোচনার ক্ষেত্রে আদৌ প্রয়োজন কি না এ প্রশ্নটি অনেকের মনে আসতে পারে ।

আসলে ‘আদর্শ সরকার’ না হলে ঢাকার যাতায়াত সমস্যা কেন, দেশের কোন সমস্যারই সমাধান হবে না । এবারে ঢাকা শহরের যাতায়াত সমস্যার কথায় আসা যাক । রাজধানী শহর হিসেবে ঢাকা শহর গুরুত্বপূর্ন, এটা সবারই জানা । গনতান্ত্রিক দেশে এই শহরটির উন্নয়ন হবে সামগ্রিক ভাবে দেশের এবং দেশের মানুষের স্বার্থে এবং দেশটির সম্পদ ও সামর্থ্যের উপর ভিত্তি করে । রাজধানী হবার সাথেই ঢাকা শহরের গুরুত্ব, জনসংখ্যা, জমি ও বাড়ির মূল্য বেড়েছে ।

এই সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারনে জিনিসপত্র ও সেবার মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে । এই প্রেক্ষিতে দেশপ্রেমিক সরকারের বদলে ব্যবসায়ী মনোভাব সম্পন্ন সরকার প্রচলিত থাকায় তারা চেয়েছে, এই গুরুত্ব বৃদ্ধির সুফল (যেমন জমি, বাড়ি, জিনিসপত্র ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি) যেন প্রধানতঃ তারা এবং তাদের দলের লোকজন ভোগ করতে পারে । এবং ঢাকা শহরকে তারা সেই ভাবেই গড়ে তুলতে চেয়েছে । বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের উন্নতির জন্য সরকারের নীতিনির্ধারকগন বিভিন্ন সময় বিশেষজ্ঞদের উপদেশ চেয়েছেন । উল্লেখ করা প্রয়োজন যে দেশী-বিদেশী ডিগ্রী স্বত্বেও বাংলাদেশের সব বিশেষজ্ঞের জ্ঞান, বুদ্ধি বা সততা কোনটাই প্রশ্নাতীত নয় ।

এদের অনেকের আবার ব্যক্তিত্বের মান এতই নীচু যে নীতিনির্ধারকগন কি চান বা পছন্দ করেন সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তারা উপদেশ দিয়ে থাকেন । নীতিনির্ধারকগন হয়তো প্রশ্ন করেছেন, “বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে কি আরও সম্প্রসারিত করা উচিত ?” কোন বিশেষজ্ঞ হয়তো বলেছেন, “আমাদের দেশটি ছোট, কিন্তু মানুষ অনেক, আর সীমিত সম্পদ । বিদেশীরা সব সময় চেষ্টা করবে কি করে আমাদের সম্পদ তাদের দেশে নিতে পারে । রাজধানী হিসেবে এটি হবে আমাদের দেশের সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপনাকেন্দ্র । এটি হবে বিদেশীদের কাছে আমাদের সংস্কৃতি ও প্রাপ্তির প্রতীক ।

এখানে থাকবে এমন সব প্রতিষ্ঠান যা সারা দেশের সামনে আদর্শ স্থাপন করবে । সারা পৃথিবীর লোক এখানে আসবে আমাদের দেশের আদর্শ জানতে, শিক্ষা নিতে । আর দেশের লোক আসবে দিক নির্দেশনা নিতে । বিদেশীরা আসবে আমাদের সততা, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির স্বাদ নিতে । বাংলাদেশের সকল ধরনের লোকের এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রয়োজন নেই ।

বরং এই শহরের জন্য যাদের থাকা প্রয়োজন, কর্মরত অবস্থায় তারা যাতে এখানে থাকতে পারে তার সব রকম ব্যবস্থা এখানে থাকবে । কাজ শেষ হয়ে গেলে তারা মফঃস্বল শহর বা গ্রামের শান্ত এলাকায় গিয়ে অবসর জীবন যাপন করবেন । এখানে সকল ধরনের সকল বয়সের মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করতে গেলে শহর প্রকান্ড রকম বড় হয়ে যাবে । আমাদের সীমিত সম্পদে তত বড় শহর গড়া সম্ভব হবে না । শহর বেশি বড় হয়ে গেলে দক্ষ ও দ্রুত যাতায়াত নিশ্চিত করা যাবে না, একটি রাজধানীর জন্য যা একান্ত প্রয়োজন ।

তাছাড়া আমাদের উৎপাদন হয় প্রধানতঃ জমি থেকে । রাজধানী শহরে বস্তুগত উৎপাদন তেমন হয় না, বরং অতি প্রয়োজনীয় কৃষি জমি নষ্ট হয় । তাই এর আয়তন যত কম করা যায় ততই ভাল । “ আবার ব্যক্তিত্বহীন কোন বিশেষজ্ঞ নীতি নির্ধারকদের ইচ্ছার কথা বুঝে বলেছেন “আমাদের রাজধানী যত বড় করা যায়, যত বেশি মানুষ এখানে ঠাসা যায় ততই এখানকার জমির দাম বাড়বে, ব্যবসায় বেশী লাভ হবে, যান বাহনে চলার খরচ বাড়বে, দেশ অনেক বেশী বেশী বিদেশী গাড়ী আর তেল ক্রয় করতে পারবে । এতে আমাদের অর্থনীতি জোরদার হবে, বিদেশে আমাদের সন্মান বাড়বে ।

“ বিদেশী দাতা বা প্রকৌশল উপদেষ্টাগন কোনটা চাইবেন তা বলার প্রয়োজন নেই । এমন অবস্থায় ব্যবসায়ী মনোভাব সম্পন্ন আমাদের নীতিনির্ধারকগন কোনটি পছন্দ করবেন ? স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দুইটি সামরিক সরকার এবং চারটি গনতান্ত্রিক সরকার তাদের স্বার্থ আর ব্যবসায়ীক মনোভাবের কারনে আগাগোড়া দ্বিতীয় প্রস্তাবটিই পছন্দ করে এসেছেন । তারা মনে মনে ভেবেছেন, “তাইতো, এমনটি করা হলে ঢাকায় প্রচুর মানুষ থাকবে, প্রচুর গাড়ি চলবে, বাড়ি ভাড়া বাড়বে, অনেক তেল আর গাড়ী আমদানী করতে হবে । প্রচুর কাজ হবে, ব্যবসা হবে । এ থেকে আমরা প্রচুর সম্পদ বানাবো, আর আমাদের রাজনৈতিক যুব ছাত্র চামচাদেরও প্রচুর আয়ের ব্যবস্থা করতে পারবো ।

“ এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক কালে কয়েক লক্ষ একর উর্বর জমি নষ্ট করে অপ্রয়োজনীয় বা বিকল্প প্রক্রিয়ায় কাজ চালানো সম্ভব এমন একটি প্রকল্প (আরও একটি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর) বাস্তুবায়নের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের প্রবল আগ্রহের কথা স্মরন করা যেতে পারে । দেশবাসীর সৌভাগ্য, প্রবল গনআন্দোলনের কারনে সরকার এটি বাদ দিতে বাধ্য হয়েছে । বাংলাদেশে ‘ব্যবসায়ী মনোভাবাপন্ন’ সরকারের নেয়া দেশের স্বার্থবিরোধী অনেক প্রকল্প বাস্তুবায়িত হতে পারে নি শুধুমাত্র গনআন্দোলন, পরিবেশবাদী সহ বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার প্রচার এবং বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপের কারনে । ভাবতে অবাক লাগে, যেখানে সরকারের কাজ হবে দেশের ও জনগনের সার্বিক স্বার্থ রক্ষা করা, সেখানে এটি নিশ্চিত করার জন্য এখন জনগনকে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতে বা বিচার বিভাগকে সরকারকে নির্দেশ দিতে হয় । স্বাধীনতার পর থেকে ‘ব্যবসায়ী মনোভাবাপন্ন নীতিনির্ধারক প্রভাবান্বিত’ এদেশের সরকার তাদের পোষা বিশেষজ্ঞদের উপদেশে উপরোক্ত প্রক্রিয়ায় ঢাকা শহরের সমস্যা একে একে বাড়িয়ে এখন এমন অবস্থা করেছে যে, বলা হচ্ছে আগামী এক দশকের মধ্যেই ঢাকা বসবাস-অযোগ্য নগরীতে পরিনত হবে ।

(০৩) বর্তমান প্রেক্ষাপটে সমস্যাটির একটি সমাধান ঃ সমাধানের কথায় আসা যাক । অনেক দেরী হয়ে গেলেও ঢাকা শহরকে এখনও সমস্যামুক্ত এবং একটি আদর্শ শহর হিসেবে রূপান্তরিত করা সম্ভব । যে কোন সমস্যা সমাধানের প্রধান উপায় হচ্ছে এর মূল কারনটি খুঁজে বের করা । আমরা জানি, ঢাকা শহরের সকল সমস্যার মূল কারন গনতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত দেশটির সরকারের ‘ব্যবসায়ী মনোভাব’ । আমাদের নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে ত্যাগী, নির্লোভ মানুষদেরকে নীতিনির্ধারক হিসেবে না আনা পর্য্যন্ত ঢাকা শহরের সমস্যা কেন, দেশের কোন সমস্যারই সমাধান হবে না ।

এই সরকারের পাঁচ বছর সময়কালের মধ্যে তেত্রিশ মাস চলে গেছে । বিদেশী ঋননির্ভর বড় বড় প্রকল্প গ্রহন ছাড়া সরকার দেশের বা জনগনের মঙ্গলের জন্য আর তেমন কিছুই করতে পারে নি । এই সরকার বরং তাদের ভুল পরিকল্পনা ও কাজের মাধ্যমে আগের সরকারগুলির সৃষ্ট ঢাকা শহরের সমস্যা দিনে দিনে আরও বাড়িয়েছে । এমন অবস্থায় জনগন, বিশেষতঃ ঢাকাবাসীর আর হাত গুটিয়ে বসে থাকার সময় নেই । জনগনের শেষ ভরসা এখন বিচার বিভাগ ।

জনগনের বোঝা উচিৎ, যারা এখন এদেশের রাজনীতিক তারা এই পর্য্যায়ে এসেছেন রাজনৈতিক দলের জন্য কাজ করে, যেখানে তাদের কাজ ছিল ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় ‘বিভিন্ন’ কাজ করে টাকা উপার্জন করা, তারপর তা থেকে দলকে কিছু দিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করা । চূড়ান্ত পর্য্যায়ে অনেক টাকা খরচ করে নির্বাচনে জয়ী হয়ে এখন তাদের কাজ হচ্ছে নিজের, দলের লোকদের এবং দলটির আর্থিক স্বার্থ রক্ষা করা । সরকারের ঢাকা শহর উন্নয়নের যাবতীয় কাজকে এখন থেকে এই দৃষ্টিকোন থেকে দেখতে হবে । তাদের নিজেদের স্বার্থে নেয়া যে কোন পদক্ষেপ দেশ বা জনস্বার্থ বিরোধী মনে হলেই প্রতিবাদ জানাতে হবে বা বিচার বিভাগের আশ্রয় নিতে হবে । এভাবে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালিয়ে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে একটি দেশপ্রেমী সরকারের আগমন পর্য্যন্ত ।

(তৃতীয় পর্ব) দেশপ্রেমী সরকার কি ভাবে ঢাকার সমস্যার সমাধান করতে পারেঃ সব কিছুরই একটা ধারন ক্ষমতা আছে, আর তা অতিক্রম করলেই সমস্যার সৃষ্টি হয় । প্রতিটি দেশেরই রাজধানী হবে ঐ দেশটির সামর্থ্য অনুযায়ী এবং আর্থ সামাজিক অবস্থার অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ন । সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য রাজধানী প্রয়োজন, কিন্তু রাজধানী সরাসরি কোন বস্ত্যতান্ত্রিক জিনিস উৎপাদন করে না । বরং বাংলাদেশের মতন একটি কৃষি প্রধান দেশে প্রচুর জমি দখল করে এটি একদিকে যেমন কৃষি উৎপাদন ব্যহত করে, অন্য দিকে এই শহরের বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য দেশের অন্য এলাকার উপর নির্ভর করে থাকে । এই হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপনা কাজের জন্য নিবেদিত শহর যত ছোট হয়, এতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা যত কম হয়, ততই তা আমাদের মতন দেশের অর্থনীতির পক্ষে অনুকূল ।

ঢাকা শহরের মানুষ এবং প্রাইভেট গাড়ীর ধারন ক্ষমতা অনেক আগেই সীমা অতিক্রম করেছে । তাই দেশপ্রেমী সরকারের প্রথম কাজ হবে ঃ (০১) ঢাকা শহরে বসকারী মানুষের সংখ্যা কমানো । এই আলোচনায় আমরা নৈতিক কারনে অনৈতিক সামরিক স্বৈরশাসক জিয়া এবং এরশাদের কথা না আনতে চেয়েছিলাম । কিন্তু আমরা অবাক হয়ে দেখি, এই দুই স্বৈরশাসক এবং দুই গনতান্ত্রিক শাসক, বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার মধ্যে কেবলমাত্র এরশাদের সময় প্রবর্তিত হয়েছিল “উপজেলা পদ্ধতি”, যা ছিল এ যাবৎকালের মধ্যে দেশের আর্থ সামাজিক বিচারে সবচাইতে মঙ্গলজনক পদ্ধতি । ভালো প্রমানিত হবার কারনে পরের সব সরকারগুলিই এটি রেখে দিয়েছে ।

কিন্তু অন্যরা, বিশেষতঃ বর্তমান সরকার এটি্র সঠিক প্রবর্তনের জন্য তেমন কিছুই করে নি । চিন্তা করলে দেখা যায়, এটির প্রবর্তন তাদের অনুসৃত “নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আর্থিক অবস্থা উন্নয়ন”এর সহায়ক নয় । বাংলাদেশে “উপজেলা পদ্ধতি” ভালোভাবে প্রচলিত হলে স্বাভাবিকভাবেই ঢাকা শহরে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা কমে যেতো । এবারে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির জন্য প্রাইভেট গাড়ী কমানোর কথায় আসি । বড় বড় জনসভা করার সারা মাঠকে একেবারে খোলা না রেখে বাঁশ দিয়ে ছোট ছোট এলাকা বা কম্পার্টমেন্টে ভাগ করা হয় ।

এর কারন, কোন কারনে সব মানুষের ভিড় যাতে এক জায়গায় না পড়ে । এভাবে কম্পার্টমেন্টালাইজেশন না করা হলে অনেক কিছুই ম্যানেজ করা সম্ভব হয় না । বাংলাদেশে যত গাড়ি আছে তার শতকরা এক ভাগ যদি কোন কারনে ঢাকা শহরে আসে তাহলে ঢাকা শহরের অবস্থা কেমন হবে কল্পনা করা যায় ? অথবা ঢাকা শহরে যত গাড়ি আছে তার, ধরা যাক, অর্ধেকও যদি কোন কারনে ধানমন্ডি এলাকায় আসে তাহলে কেমন অবস্থা হবে ? কম্পার্টমেন্টালাইজেশনের মাধ্যমে আমাদের সমস্যা কেমন করে সমাধান করা যায় এবারে আমরা সেই আলোচনায় আসবো । দেশপ্রেমী সরকার যে ভাবে ঢাকা শহরকে বাঁচানোর পরিকল্পনা করতে পারেঃ প্রথমেই আমরা দেখবো, একটি দেশপ্রেমিক সরকার বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপূরক যেমন রাজধানী শহর চাইতে পারে তার একটি কাল্পনিক চিত্র। (ক) বর্তমানে যে এলাকা নিয়ে বৃহত্তর এলাকা ঢাকার মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে তাকে প্রধানতঃ পাঁচটি অংশে ভাগ করা হবে ।

যেমন ঃ (০১) কেন্দ্রীয় ঢাকা, (০২) ঢাকা উত্তর, (০৩) ঢাকা পূর্ব, (০৪) ঢাকা দক্ষিন এবং (০৫) ঢাকা পশ্চিম । (ক) কেন্দ্রীয় ঢাকাঃ কেন্দ্রীয় ঢাকা হবে যথা সম্ভব ছোট – যার পরিসীমা হবে দক্ষিনে বুড়িগঙ্গা নদী, পশ্চিমে তুরাগ নদী, উত্তরে উত্তরা মডেল টাউন এবং হজরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের মাঝামাঝি অবস্থানে তুরাগ নদী থেকে ঢাকা ময়মনসিংহ রোড পর্য্যন্ত আনুভূমিক লাইন এবং পূর্বে ঢাকা ময়মনসিংহ রোড বরাবর বিমান বন্দর রেল ষ্টেশন থেকে বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সেতূ পর্য্যন্ত । তবে পূর্বে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, টেলিভিশন ভবন এবং আনসার সদর দপ্তর এর অন্তর্ভুক্ত হবে । এটি হবে ফেডারেল রাজধানীর মতন, যেখানে শুধুমাত্র বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ন, বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ মানের প্রতিষ্ঠান এবং দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য সর্বোচ্চ পর্য্যায়ের নীতি নির্ধারক এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাজ করা এবং বসবাসের স্থান । এই এলাকার আইন, ভূমি ব্যবহার, যাতায়াত ইত্যাদি হবে একেবারে আলাদা রকমের ।

বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ন ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে গুলশান বনানী এই এলাকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে না । আইনঃ কেন্দ্রীয় ঢাকায় যে কোন অপরাধের জন্য শাস্তি হবে অত্যন্ত কঠিন । কোন অপরাধের জন্য সাধারন ভাবে যে শাস্তি দেয়া হয় একই অপরাধ কেন্দ্রীয় ঢাকা এলাকার মধ্যে করা হলে শাস্তি হবে তার দ্বিগুন । কোন কোন অপরাধের (যেমন, চালকের দোষে সড়ক দূর্ঘটনা) শাস্তি হবে এই এলাকা থেকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বহিষ্কার । কেন্দ্রীয় ঢাকায় বাইরে থেকে আসা সকল রাস্তা হবে নিয়ন্ত্রিত ।

এই এলাকার বিদ্যুত, পানি, গ্যাস, পয়ঃনিকাশী ব্যবস্থা ইত্যাদি সবই থাকবে ঢাকার অন্য এলাকা থেকে আলাদা এবং স্ব-নিয়ন্ত্রিত । ভূমির মালিকানা ও ভূমি ব্যবহারঃ এই এলাকার সমস্ত জমির মালিক হবে সরকার । গুরুত্ব বুঝে সরকার বিভিন্ন স্থানের জমির দাম বেঁধে দেবে । যে বা যারা জমি বিক্রী করতে চাইবে তাদেরকে কেবলমাত্র সরকারের কাছে তা বিক্রী করতে হবে । মৃত ব্যক্তির জমি পরবর্তীতে সরকারের মালিকানায় যাবে, তবে তার উত্তরাধিকারী সরকার নির্ধারিত হারে ক্ষতিপূরন পাবে ।

যে সব জমি বর্তমানে ৯৯ বৎসরের জন্য লীজ দেয়া আছে সেগুলিও শুধুমাত্র সরকারের কাছেই হস্তান্তর করা যাবে । উপরোক্ত প্রক্রিয়ায় যেসব জমি বা বাড়ী সরকারের হাতে আসবে সরকার সেগুলি ঐ এলাকার প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ন হলে ব্যবহার করবে, প্রয়োজনে নতুন করে নির্মান করবে অথবা ক্রান্তিকালীন সময়ে জনগনের কাছে লীজ দেবে । এই এলাকায় থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বোচ্চ পর্য্যায়ের প্রতিষ্ঠান, যারা দেশের অভ্যন্তরের এবং বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করবে । কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠাঙ্গুলির অধীনে থেকে যে সব প্রতিষ্ঠান দেশের অভ্যন্তরে উত্তর, পূর্ব, দক্ষিন বা পশ্চিম এলাকার সঙ্গে কাজ করবে সেসব প্ররিষ্ঠানগুলি যথাক্রমে ঢাকা-উত্তর, ঢাকা-পূর্ব, ঢাকা-দক্ষিন বা ঢাকা-পশ্চিম এলাকায় স্থানান্তরিত বা স্থাপন করা হবে । কেন্দ্রীয় ঢাকায় থাকবে সর্বোচ্চ পর্য্যায়ের গবেষনা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ।

যেমন, সাধারন শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । এখানে শুধুমাত্র মাষ্টার্স, পিএইচডি ও গবেষনার কাজ চলবে। স্নাতক পর্য্যায়ের শিক্ষা চলে যাবে উপরে উল্লিখিত চারটি স্থানে প্রতিষ্ঠিত শাখাগুলিতে । প্রকৌশল, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও একই ভাবে বিন্যস্ত করা হবে । প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কেবলমাত্র উচ্চপর্য্যায়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জন্য থাকবে আবাসিক ভবন ।

কর্মজীবি ও ছাত্র ছাত্রীদের জন্য থাকবে হোস্টেল এবং নিম্ন বেতনের কর্মচারীদের জন্য থাকবে কেবলমাত্র একক (অর্থাৎ পরিবারবিহীন) ভাবে বসবাসের ব্যবস্থা । এই এলাকায় থাকবে সর্বোচ্চ পর্য্যায়ের সংস্কৃতি শিক্ষা ও গবেষনার প্রতিষ্ঠান । এখানে থাকবে লাইব্রেরী, অডিটোরিয়াম সহ সংস্কৃতি চর্চা ও গবেষনা করার জন্য বড় বড় কমপ্লেক্স । তার প্রত্যেকটিতে থাকবে পরিবার-সহ, একক মহিলা এবং পুরুষের, বিদেশী অতিথিদের এবং দেশের অভ্যন্তর থেকে আসা লোকদের থাকার ব্যবস্থা । দেশের মণীষীদের নামে করা এই সব কমপ্লেক্স-এ সারা বৎসর ধরে চলবে নানা অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতা, যেখানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষের আসার এবং সাময়িক ভাবে থাকার সুযোগ থাকবে ।

রাজধানীর সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলির সর্বোচ্চমান বজায় রাখার জন্য সরকারকে সচেষ্ট থাকতে হবে । একই সঙ্গে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলি মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে তাদেরকে অন্যত্র সরে যাবার ব্যবস্থা রাখা হবে । এই এলাকার ভবিষ্যতে নির্মীতব্য সকল ভবন নির্মিত হবেঃ (ক) বাংলাদেশের সংস্কৃতিভিত্তিক স্থাপত্যরীতি অনুসরন করে, (খ) সম্ভাব্য মাত্রার ভূমিকম্প নিরোধক ব্যবস্থা সহ এবং (গ) বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে ভবনের মাঝে ‘ইমপ্যাক্ট ডিসট্যান্স” বজায় রেখে । একটি ভবন কোন কারনে ভেঙ্গে পড়লে তার কারনে আশপাশের ভাল ভবনও ভেঙ্গে পড়ার কথা । এক্ষেত্রে নিরাপদ দূরত্বটিই ‘ইম্পপেক্ট ডিসট্যান্স” ।

বাংলাদেশের সংস্কৃতির সহায়ক নয় বলে এই এলাকায় কোন মদের দোকান, নাইট ক্লাব, পরিবেশ দূষনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান, বৃদ্ধনিবাস, এতিমখানা ইত্যাদি থাকবে না । বর্তমানে এখানে থাকা এই সব প্রতিষ্ঠানগুলিকে ক্রমান্বয়ে অন্য এলাকায় সরিয়ে নিতে হবে । যাতায়াতঃ এই এলাকার সকল রাস্তা কেন্দ্রীয় ঢার আভ্যন্তরীন রাস্তা হিসেবে বিবেচিত হবে । বাইরে থেকে আসা ভারী যানবাহন অন্য কোথাও যাবার জন্য এই এলাকা অতিক্রম করবে না । বর্তমানে যে সব যানবাহনকে তা করতে হয় তাদের জন্য ক্রমান্বয়ে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে ।

বানিজ্যিক মনোভাব নিয়ে নির্মীয়মান এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ঢাকা মহানগরীর যানবাহন সমস্যার সমাধানে কোন ধনাত্মক ভূমিকা নেই । দেশপ্রেমী সরকার এটিকে কেন্দ্রীয় ঢাকার জন্য ‘বাই-পাস’ রোড হিসেবে ব্যবহার করতে পারে । কেন্দ্রীয় ঢাকার বাইরে থেকে আসা বাসগুলিকে গাবতলী, বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সেতূ এবং বিমান বন্দর এলাকায় থামতে হবে । এই কয়টি পয়েন্ট এবং বিমানবন্দর, নৌবন্দর সহ সকল গুরুত্বপূর্ন স্থানে যাতায়াত্ করবে সিটি বাস, যার কেন্দ্রীয় টারমিনাল হবে বর্তমান মহাখালী বাস টারমিনাল । সকল পোর্ট ও টার্মিনালে থাকবে একাধিক লাগেজ বুকিং কোরিয়ার সার্ভিস ।

বাইরে থেকে যারা ঢাকায় আসেন তাদের সঙ্গে যে মালপত্র থাকে (দূর পাল্লার লঞ্চ বা বাসে এগুলি বহনের ব্যবস্থা থাকে) সিটি বাসে তা বহন করা যায় না বলে অন্য যানবাহন (ট্যাক্সি, সিএনজি ইত্যাদি) ব্যবহার করা হয় । লাগেজ বুকিং কোরিয়ার সার্ভিসগুলির কাজ হবে সর্বোচ্চ, ধরা যাক, ২’ X২’X ৩.৫ ফুট আয়তনের লাগেজ গ্রহন করা এবং জরুরী (৬ থেকে ১২ ঘন্টা) বা সাধারন (১২ থেকে ২৪ ঘন্টা)ভিত্তিতে প্রতিটি ব্লকে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা । (খ) ঢাকা উত্তর, ঢাকা পূর্ব, ঢাকা দক্ষিন এবং ঢাকা পশ্চিমঃ এই সব এলাকার আইন, জমির মালিকানা, ভূমি ব্যবহার ইত্যাদি এখনকার মতই থাকবে । কেন্দ্রীয় ঢাকার সরকারী এবং শিক্ষা ও গবেষনা প্রতিষ্ঠানগুলির শাখা, এই এলাকা থেকে সরে আসা শিল্প প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকার জমির ব্যবস্থা করবে । এই এলাকাগুলিতে বাড়ি ভাড়ার আয় থেকে বেঁচে থাকার প্রবনতা নিরুৎসাহিত করতে হবে ।

একজন মানুষ তার নিজের পরিবারের জন্য যত আয়তনের বাড়ি ব্যবহার করে, সে ঐ আয়তনের সর্বোচ্চ দুইটি বাড়ি ভাড়া দিতে পারবে । দোকানের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। একজন লোক বা একটি পরিবার এই সব এলাকায় সর্বোচ্চ কত জমির মালিক হতে পারবে তা সীমাবদ্ধ করে দিতে হবে । যেসব পাবলিক লিমিটেড কোম্পানী “তাদের সম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে মালিকের পোষ্যদের হবে না, বরং সার্বক্ষনিক পরিচালকদের মালিকানায় যাবে” এমন ব্যবস্থা রাখবে তাদেরকে জমি বরাদ্দের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে । ভবন নির্মানের ক্ষেত্রে এখানেও কেন্দ্রীয় ঢাকার নিয়ম অর্থাৎ, (ক) বাংলাদেশের স্থাপত্যরীতি, (খ) ভূমিকম্প নিরোধক ব্যবস্থা এবং (গ) ‘ইমপ্যাক্ট ডিসট্যান্স” মেনে চলতে হবে ।

সেই সঙ্গে একটি বহুতল (ধরা যাক, দশ তলার বেশী) ভবন নির্মান করা হলে তার ১০০০ ফুট দুরত্বের মধ্যে তিন তলার উপর কোন ভবন নির্মান করা যাবে না । (চতুর্থ পর্ব) ঢাকার বিকেন্দ্রীকরনের সম্ভাব্য ফলাফলঃ উপরে কেন্দ্রীয় ও পারিপার্শিক ঢাকার যে রূপরেখা দেয়া হয়েছে তাকে এক কথায় ঢাকার বিকেন্দ্রীকরন বলা যায় । এখানে মূলতঃ মূল ঢাকা, যা বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদী থেকে উত্তরা ও বনানীর সীমান্ত পর্য্যন্ত বিস্তৃত তা বিভিন্ন সরকারের ভূল পরিকল্পনায় যে মারাত্মক সমস্যায় জর্জরিত হয়েছে তার একটি স্থায়ী সমাধান দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে । এই সমস্যাগুলি সরকার প্রধানতঃ দেশী বিদেশী উপদেষ্টা এবং ব্যবসায়ীরদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে নানা ভুল পরিকল্পনার মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন । এখানে উল্লেখ করা যায় যে, বিদেশে উপদেষ্টাগন যেসব পরিকল্পনার মাধ্যমে শহরকে সমস্যাশংকুল করে শেষে বিকল্প স্থানে শহর স্থানান্তরের প্রস্তাব আনেন এখানেও সেগুলিই ব্যবহৃত হয়েছে ।

তারা হয়তো এখন সেই প্রস্তাবটি পেশ করার জন্য অপেক্ষা করছেন । কিন্তু আমরা সেটা চাই না । রাজধানী স্থানান্তরের মতন ব্যয়বহুল কাজে অনেকের স্বার্থ থাকলে ও আমরা মনে করি। বাংলাদেশের মতন একটি দরিদ্র দেশের অর্থনীতির পক্ষে এটি অনুকূল নয় । সেই সঙ্গে আমরা মনে করি, ঢাকার যে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।