আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জর্জ হ্যারিসনকে বিলম্বিত অভিবাদন - পর্ব 2

ব্লগের আমি ব্লগের তুমি ব্লগ দিয়ে যায় চেনা

তিন জর্জ হ্যারিসনকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিলো, "আপনি বীটলস-এর একজন না হলে জীবনে কি হতেন?" জর্জের জবাব, "আমার বোধ-বুদ্ধি হওয়ার বয়স থেকেই তো আমি বীটল। সুতরাং আমার পক্ষে অনুমান করাই সম্ভব নয়, বীটল না হয়ে আমি আর কী হতে পারতাম!" আরেকবার বলেছিলেন, "আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ঘটনা ছিলো বীটলস-এ অন্তর্ভুক্ত হওয়া। আর দ্বিতীয়টি হলো, বীটলস থেকে বেরিয়ে আসা। " প্রকাশ্য কনসার্ট বন্ধ করে দেওয়ার পর জর্জ হ্যারিসন ভারতীয় সংস্কৃতি ও দর্শনে আকৃষ্ট হন, এই অনুরাগ আমৃতু্য অটুট ছিলো। এই সময় তিনি সেতারে রবি শংকরের কাছে দীক্ষা নেন।

জর্জের আগ্রহ ও প্ররোচনায় বীটলস-এর অবশিষ্ট সদস্যরা এবং আরো অনেক রকশিল্পী ও সেলিব্রিটি ভারতে যান প্রাচ্য মিস্টিসিজম-এর টানে। এর প্রত্যক্ষ ফল ছিলো, বীটলস-এর 'নরওয়েজিয়ান উড', 'উইদিন ইউ, উইদাউট ইউ'-সহ বেশ কয়েকটি গানে সেতার ও অন্যান্য ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মিশ্রণের সফল নিরীক্ষা। বীটলস-এর গানের শব্দচয়নে 'জয় গুরুদেব' এবং পরবর্তীতে একক শিল্পী হিসেবে হ্যারিসনের গানে 'হরে রাম হরে কৃষ্ণ' এইসব অনায়াসে ঢুকে পড়েছে। আরো পরে লেননের একটি গানের শিরোনাম হয় 'ইনস্ট্যান্ট কর্ম'।

জর্জ হ্যারিসনের চরিত্র ছিলো অন্তর্মুখী, কিছুটা রহস্যাবৃত থাকতেই ভালোবাসতেন। জন লেনন একবার বলেছিলেন, "জর্জ নিজে কোনো রহস্য নয়, কিন্তু ওর ভেতরে তো অনন্ত রহস্য। " 1974-এ নিজস্ব রেকর্ড কোম্পানির নাম দিলেন 'ডার্ক হর্স'। বলতেন, "যে ঘোড়াটি পেছনে থেকে অকস্মাৎ তীব্র গতিতে আর সবাইকে পেছনে ফেলে রেস জিতে যায়। আমার মনে হয়, সেটাই আমি।

" বীটলস-এর তুমুল জনপ্রিয়তার সময়ে জর্জ বিয়ে করেছিলেন, স্ত্রীর নাম প্যাটি। কিছুকাল পরে হ্যারিসনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন _ এরিক ক্ল্যাপটন _ প্যাটির প্রেমে পড়েন, তাঁকে উদ্দেশ করে রচিত হয় ক্ল্যাপটনের বিখ্যাত গান 'লায়লা'। জর্জের সঙ্গে প্যাটির বিচ্ছেদ হলে এরিক ক্ল্যাপটন তাকে বিয়ে করেন, জর্জ নিজে সেই বিয়েতে উপস্থিত থাকেন। ক্ল্যাপটনের সঙ্গে মৃতু্যর সময় পর্যন্ত হ্যারিসনের বন্ধুত্ব অটুট ছিলো। হ্যারিসন 1977-এ বিয়ে করেন অলিভিয়াকে, তাঁদের একমাত্র পুত্রের নামেও ভারতীয় ছাপ _ ধ্বনি হ্যারিসন।

জর্জ হ্যারিসনের চরিত্রে বৈপরীত্যও ছিলো। শান্তশিষ্ট স্বল্পভাষী বলে পরিচিতি পেলেও ঘনিষ্ঠদের সানি্নধ্যে প্রচুর কথা বলতেন। একজন তো বলেছিলেন, "ওকে থামাবে কে!" আপাত-বিষণ্ন মানুষটি আচমকা চমকপ্রদ রসিকতায়ও পটু ছিলেন। দার্শনিকতায় আগ্রহী হয়েও গাড়ির রেসিং পছন্দ করতেন। তিনি এমন একজন রক-তারকা যিনি বাগানে সার ছড়িয়ে বেশি আনন্দ পেতেন।

তাঁর আত্মজীবনী 'আই, মি, মাইন'-এর উৎসর্গে লিখলেন: "যেখানে যতো বাগানবিলাসী আছে, তাদের সবার উদ্দেশে। " নিজের জীবনদর্শনটির সারাংশ তিনি এইভাবে বিবৃত করেছিলেন, "আমার মনে হয় প্রকৃত সঙ্গীত যাদের জীবনের সর্বস্ব তারা পৃথিবীকে উদ্দেশ করে বলতে পারে, 'আমার ভালোবাসা তুমি গ্রহণ করো, আমার হাসি ও আনন্দটুকু নাও। যা কিছু অসুন্দর সেগুলোকে সরিয়ে রাখো একপাশে, ওসবে তোমার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু আমার সঙ্গীতের শুদ্ধতা ও সুন্দরটি তুমি নাও, কারণ সেটিই খাঁটি ও সর্বোৎকৃষ্ট, এবং এটুকু্ই আমি স্বেচ্ছায় ও সানন্দে বিলিয়ে দিতে পারি'। " চার. বীটলস একত্রিত থাকার কালে জন লেনন ও পল ম্যাকার্টনির মতো অতিকায় প্রতিভার আড়ালে পড়ে ছিলেন জর্জ হ্যারিসন।

নিয়ম অনুযায়ী একেকটি গানের রচয়িতা মূলত গানটি গাইবেন, বাকিরা তাতে সহায়তা ও সঙ্গত দেবেন। লেনন-ম্যাকার্টনির বিপুল সৃষ্টি-উৎকর্ষতার কারণে জর্জের রচনা প্রায়শই বাদ পড়ে যেতো। এ নিয়ে তাঁর খেদ ও দুঃখ ছিলো, তা গোপনও করেননি। বীটলসের একটি অ্যালবামে অন্তর্ভুক্ত তাঁর 'হোয়াইল মাই গীটার জেন্টলি উইপস'-এ তা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছিলো। সেই উৎকর্ষতা জর্জ ক্রমাগত চর্চা ও চেষ্টায় অর্জন করেছিলেন।

বীটলস যুগের তাঁর আরো স্মরণীয় গানগুলির মধ্যে আছে মিষ্টি ও মন-ভালো-করা 'হিয়ার কামস দ্য সান', 'সামথিং' (এই গানটিকে ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমের গান বলে বহুবার উল্লেখ করেছেন)। গীটারবাদনের দক্ষতায় হ্যারিসনের চেয়ে উৎকৃষ্ট তাঁর সমসাময়িক অনেকেই ছিলেন, কিন্তু তাতে তিনি এমন সুন্দর মিষ্টি ও হৃদয় মন্থন করা একটি আবেশ রচনা করতেন যা তুলনারহিত। ওপরে উলি্লখিত দুটি গান ছাড়াও এর উদাহরণ আছে 'লেট ইট বি', 'অল ইউ নীড ইজ লাভ' এবং আরো অসংখ্য গানে। মাত্র কয়েক বছরে বিপুল ও বৈচিত্র্যময় সৃজনশীলতায় বীটলস একটি প্রজন্মকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ষাটের দশকে সারা পৃথিবীতে যে অস্থিরতা ও বিদ্রোহ এবং একই সঙ্গে হিপি আন্দোলনের মতো চরম বৈরাগ্যের সংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে, বীটলস তারই এক প্রতীক ও প্রতিভূ, অনুঘটক ও অংশীদার।

সেই আচ্ছন্নতার রেশ আজও রয়ে গেছে ওই প্রজন্মের জীবিতদের মধ্যে। বীটলস-এর নামে তাঁরা আজও উদাস হয়ে যান, স্মৃতিতাড়িত হন। এমনকি এখনকার নবীন বয়সী যাদের স্মৃতিতাড়িত হওয়ার সুযোগ নেই, তারাও বিস্ময়-বিহ্বলতা নিয়ে বীটলস শোনে। ফলে, জর্জের মৃতু্যতে সব ধরনের মানুষের যে স্বজন বিয়োগের প্রতিক্রিয়া হয় তা অপ্রত্যাশিত লাগে না। প্রতিক্রিয়া জানিয়ে পল ম্যাকার্টনি বললেন, "জর্জ ছিলো আমার ছোটো ভাইয়ের মতো।

... মৃতু্যর মাত্র কয়েকদিন আগে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম, অসুখ-বিসুখ সব ভুলে সে যথারীতি হাসিঠাট্টা করে গেলো, কোথাও বিষাদের চিহ্নমাত্র নেই। খুব সাহসী ও বড়ো হৃদয়ের মানুষ না হলে এটা পারা যায় না। " বিখ্যাত আইরিশ ব্যান্ড ইউটু সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা পোষণ করতেন না জর্জ, তা গোপনও করেননি। ইউটু-র প্রধান পুরুষ বনো-র তা অজানা ছিলো না। 99-এ জর্জ আততায়ীর হাতে ছুরিকাহত হলে বনো বলেন, "মানুষটি আশ্চর্য গীটারবাদক ও সঙ্গীতরচয়িতা।

মিলেনিয়াম উৎসবে লিংকন মেমোরিয়ালে আমাদের নিজস্ব একটি গান গাইতে গাইতে একসময় অবলীলায় জর্জের 'মাই সুইট লর্ড' গাইতে শুরু করি। এই মানুষটিকে আমি ভীষণ ভালোবাসি, যদিও আমি নিশ্চিত নই অনুভূতিটি পারস্পরিক কি না। " বব ডিলান বললেন, "জর্জ ভালোবাসা উস্কে দিতে জানতো, তার ছিলো একশো মানুষের সমান মানসিক শক্তি। সে ছিলো সূর্য, ফুল ও চাঁদের মতো, তার অভাব আমরা অনুভব করতে থাকবো দীর্ঘদিন ধরে। তার অনুপস্থিতিতে পৃথিবী নিদারুণভাবে শূন্যতর হয়ে গেলো।

" বব গেলডফ বলছেন, "জর্জ নিজেই বলতো, জন ও পলের বিশাল প্রতিভার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কীভাবে সম্ভব? কিন্তু আমার তো মন হয়, সে তা দিয়েছে এবং ভালোভাবেই। " জন লেননের বিধবা স্ত্রী ইয়োকো ওনো বলেন, "তার জীবন ছিলো ম্যাজিকাল এবং আমার মনে হয় তার সানি্নধ্যে আসার ফলে আমাদের জীবনেও তার কিছু ছায়া পড়েছিলো। " জন লেনন নিহত হওয়ার পর নিউ ইয়র্কে সেন্ট্রাল পার্কের একটি অংশের নামকরণ করা হয় স্ট্রবেরি ফিল্ড, লেননের একটি গান থেকে নেওয়া হয় নামটি। জর্জের মৃতু্যর খবরে পিট ডেগ্যান নামের এক ভক্ত ভোরের আলো ফোটার আগেই স্ট্রবেরি ফিল্ডে চলে এসেছেন। তাঁর মতে "আজকের দিনটি রক অ্যান্ড রোলের ভক্তদের জন্যে খুব দুঃখের দিন।

" স্ট্রবেরি ফিল্ড-এ আরো অনেক ভক্ত সমবেত হয়েছিলেন। এঁদের একজন, স্টিভ ইয়ালপ, পার্কে জগিং করতে এসে থমকে দাঁড়ালেন। জর্জের 'হোয়াইল মাই গীটার জেন্টলি উইপস' গানটির প্রসঙ্গ টেনে বললেন, "আজ আমি কাঁদছি, আর কাঁদছে আমার গীটার। " 42 বছর বয়স্ক জো ক্যানিন তিন দশক ধরে বীটলস-এর অনুরাগী, বলতে গেলে বীটলসকে সঙ্গী করেই বড়ো হয়েছেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া: "আমাদের সবারই বয়স বাড়ছিলো।

জর্জের প্রস্থানের সময়টি হঠাৎই এলো আর আমাদের মনে পড়ে গেলো, সব সুন্দরই বিলীন হয় মৃতু্যতে। " হুয়ান মাহদালানি নামের এক আর্জেন্টিনীয় ভক্ত লিখছেন, "বীটলসদের আমি কখনো চাক্ষুষ দেখিনি, অথচ তাদের কাছে কী অপরিমেয় আমার ঋণ! তাদের সঙ্গীত আমার প্রতিটি নিশ্বাসে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমি নিজের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি করে নিয়েছি, তাদের সুরকে আমার নিজেরই সুর বলে জেনেছি। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, তারা যে কোনো ধর্মগুরুর চেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিলো আমার প্রজন্মকে। বিদায় জর্জ, আমি জানি এখন তুমি সূর্যের অনেক কাছাকাছি।

" আরেকজন লিখেছেন, "জর্জ, যে গীটারে আমি তোমার গান তুলেছি, সেই গীটার কেঁদে যাবে বাকি জীবন। তোমার মৃতু্যতে আমি আজ এক আত্মার সঙ্গীকে হারালাম, যদিও তুমি তা কখনো জানোনি। "


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.