আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘুরতে গিয়েছিলাম ভারত - ১১

আগের পর্বগুলো - ১ , ২ , ৩ , ৪ , ৫ , ৬ , ৭ , ৮ , ৯ , ১০ সিমলা থেকে রওনা দিলাম মানালির উদ্দেশ্যে। আবারও পাহাড়-খাদের সেই ভয়ংকর সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে আমরা চললাম। বিকালের দিকে সবাই একটু ঝিমিয়ে পড়ছিলাম। হঠাৎ কেউ একজন চিৎকার করে উঠল, বরফ, বরফ! আমরা সবাই বাইরে তাকিয়ে দেখি রাস্তার পাশে পেঁজা তুলার মত বরফ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সবাই না হলেও, চোখের সামনে এই প্রথম বরফ বা তুষার দেখলাম আমরা অনেকেই।

শুনেছি সিমলাতেও বরফ পড়ে, কিন্তু আমরা যে সময় গিয়েছি তখন বরফ ছিল না। দূরে কোনো উঁচু পাহাড়ের চুড়ায় বরফ জমে থাকতে দেখেছিলাম শুধু। এখন দেখছি চোখের সামনে। একজন বলল, বাস থামান, হাত দিয়ে একটু ধরে দেখি। গাইড হাসতে হাসতে বলল, একটু ধৈর্য্য ধরুন, সামনে আরও আসবে, মন ভরে বরফ ধরবেন।

আসলেই বরফের পরিমাণ বাড়তে শুরু করল। এক সময় এমন হল যে রাস্তার পাশে বরফ ছাড়া আর মাটি দেখা যায় না। এরকম একটা জায়গায় বাস থামল। জায়গাটার নাম কুলু। বিখ্যাত কুলু টুপি এখানেই বানায়।

আমরা নেমে আক্ষরিক অর্থে ঝাঁপিয়ে পড়লাম বরফের উপর। প্রথমে যে জায়গায় নামলাম, সেখানে কিছুক্ষণ পর এক দারোয়ান এসে বলল যে এটা প্রাইভেট প্রপার্টি, আমরা যেন অন্য কোথাও যাই। গাইড এরপর আমাদের পাহাড়ের গায়ে ভয়ংকর সরু রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেল নির্জন এলাকায়, এখানে আমাদের কেউ বাধা দেয়ার নেই। শুরু হল আমাদের হুড়াহুড়ি। আমরা সবাই যেন পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চা হয়ে গিয়েছি।

বরফে লুটোপুটি খেতে খেতে আর বরফ ছোঁড়াছুঁড়ি করতে করতে একেকজন ভিজে পান্তাভাত হয়ে গেলাম। এমন কি গাইড আর স্যারও আমাদের সাথে হুটোপুটিতে যোগ দিয়েছিলেন। যা হোক, সময় আমাদের বাঁধা। তাই ফিরে আসতেই হল। সেই সরু রাস্তা দিয়ে আবারও ভয়ে ভয়ে হাঁটতে হাঁটতে সবাই চলে এলাম।

পাহাড়ের উপরই এক জায়গায় এক চাওয়ালা বসেছে। সবাই গরম গরম চা খেলাম মজা করে। এরপর চলে এলাম যেখানে বাস রাখা আছে। সবাই বাসে উঠে শুনলাম বাস ছাড়তে আরেকটু দেরী আছে। কয়েকজন নেমে পড়লাম।

কেউ কেউ আশেপাশে দোকানগুলোতে কেনাকাটা করতে গেল। কেউ কেউ বাসের পাশেই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে থাকল। আমি খেয়াল করলাম দু'জন লোক দুইটা হাঁড়ি নিয়ে কি যেন বিক্রি করছে। কাছে গিয়ে দেখি হাঁড়ির মধ্যে চটপটি। অবশ্য ওরা এটাকে চটপটি বলছিল না, ওরা বলছিল ইমলি-চাট।

তখুনি এক প্লেট কিনে খাওয়া শুরু করে দিলাম। আমার দেখাদেখি অন্যরাও এগিয়ে এসে খেতে থাকল। ভারতের আর কোথাও এত মজার চটপটি পাইনি। গাইড যদিও ভয় দেখাচ্ছিল যে পেট নামলে কিন্তু বাস জার্নি কষ্ট হয়ে যাবে, কে শোনে তার কথা। মুহূর্তের মধ্যেই দুই হাঁড়ি ইমলি-চাট শেষ হয়ে গেল।

লোকগুলো খুব আফসোস করছিল, আগে জানলে আরও বেশি করে বানিয়ে আনত। আফসোস আমাদের বন্ধুরাও করছিল, যারা দোকানে গিয়েছিল। ওরা আসতে না আসতেই সব চটপটি শেষ। যা হোক, আমরা তিনকন্যা এবার দোকানগুলো ঘুরে দেখতে গেলাম। এখানে খুব বেশি দোকানও নেই, দোকানগুলোতেও খুব বেশি জিনিসপত্র নেই।

অনেকেই কুলু টুপি কিনে নিল। এখানে আসলে নাকি সবাই তাই কেনে। আমার বাসায় কুলু টুপি পরার কেউ নেই, তাই আগ্রহ পেলাম না। একটা ব্রেসলেট কিনলাম শুধু। বাস ছাড়ার সময় হয়ে এল।

আমরা আবারও রওনা দিলাম। আবহাওয়া ঠান্ডা হলেও এত শুষ্ক যে আমরা মেয়েরা এতক্ষণ বাইরে ঘোরাঘুরি করতে করতে আমাদের জামা শুকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ছেলেরা পড়ল সমস্যায়। ওদের ভারী জিনসের প্যান্ট আর শুকায় না। এদিকে ঠান্ডায় ভেজা কাপড়ে আরও জমে যাচ্ছিল ওরা।

বেচারা। কেউ কেউ টিস্যু পেপার দিয়ে ডায়াপার সিস্টেম করে নিয়েছিল। এছাড়া আর উপায়ই কী ছিল ওদের। যা হোক, আমাদের মানালির পথে যেতে যেতে দুইবার পাহাড়ের ভিতর দিয়ে টানেল পার হলাম। রাত বাড়লে সবাই একে একে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ভোররাতের দিকে আমার ঘুম ভেঙে গেল। সবাই তখনও ঘুমে। ওই অন্ধকারের মধ্যেই আমি জানালা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করলাম। খুব আবছা একটা দৃশ্য চোখে পড়ল। সারি সারি পাহাড়, আর তার মাঝে বয়ে গেছে নদী।

ভোরের আলো ফুটতে তখনও বেশ দেরী। কিন্তু আমি আর দৃষ্টি সরাতে পারছিলাম না। এটা কি সত্যিই দেখছি না কি কোন আঁকা ছবি টাঙিয়ে রাখা। ভোর হতে হতে একটা ছোট্ট শহরে ঢুকে পড়লাম। আমার সখীদের এতক্ষণে ঘুম ভাঙল।

ওদেরকে বললাম আমি কী দেখেছি। সাথে সাথেই বকাটা খেলাম, আমাদের ডাকিসনি কেন? মানালির হোটেলটাও একটা দেখার মত জায়গা। বাংলো টাইপের ডিজাইনে করা। রুমে ঢুকে তো আরও টাশকি খেতে হল। এটা কি হানিমুন রুম না কি।

আমরা খরচ বাঁচানোর জন্য ডাবল রুমে তিনজন থাকতাম। তো আমাদের তিন কন্যার একজন আবার বিছানার কিনারে ঘুমাতে অস্বস্তি বোধ করে, তাই সে সবসময় ঘুমায় মাঝখানে। কিন্তু এই হোটেলের বিছানায় সেটা ঝামেলা হয়ে যায়, কারণ বিছানাটা বৃত্তাকার। সমস্যা হল আমাদের তিনজনের মধ্যে মাঝখানে ঘুমানোর মানুষটা হল ছোটখাট, আমি মোটামুটি আর বাকী জন বাঙালী নারী হিসেবে যথেষ্ট লম্বা। গোল বিছানায় দুই পাশে আমরা শুলে আমাদের দুজনের পা-ই বিছানার বাইরে চলে যায়।

কিন্তু মাঝেরজন তা শুনবে কেন, সে মাঝখানেই ঘুমাবে। বাধ্য হয়ে আমাদেরকে পা বাইরে রেখেই ঘুমাতে হয়েছিল। বিছানা যেমনই হোক, এই হোটেলের একটা ব্যাপার বেশ ভালো লেগেছিল। হোটেলটার মাঝামাঝি একটা আঙিনার মত আছে। কেউ চাইলে এখানে বারবিকিউ পার্টি করতে পারে।

যা হোক, এর কথায় পরে আসি। আমাদের দুপুরের খাবারের পর নিয়ে যাওয়া হবে সোলাং ভ্যালী। দুপুরে আমাদের একটা নতুন আইটেম দেয়া হল। আমি চিনতে পারছিলাম না এটা কী জিনিস। ছোটুদাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে বলল, এর নাম চিলি সয়া।

তাও বুঝলাম না। পরে আমাদের ছোটখাট সখী বলল, সয়াবিন আছে না? এটা হল সয়াবিন, চিলি সস দিয়ে বানানো। সয়াবিন তেল সব সময় খেলেও আস্ত সয়াবিন আগে কখনও খাইনি, ভালোই লেগেছিল। তো দুপুরে খেয়ে আমরা বের হলাম সবাই। সোলাং ভ্যালী হল এমন এক জায়গা যেখানে পাহাড়ের গায়ে পেঁচানো সিঁড়ির মত রাস্তা দিয়ে উঠতে হয়।

জায়গাটার সৌন্দর্য্যই হল এর আকর্ষণ। তবে একটা মৌসুমী ব্যাপার আছে। যদি বরফ পড়া সময়ে যাওয়া যায়, তাহলে বরফে ঢাকা উপত্যকা দেখা যাবে, কিন্তু একেবারে চুড়ায় যাওয়া যাবে না। আর বরফ পড়ে না এমন সময় গেলে একেবারে চুড়া পর্যন্ত ওঠা যাবে, কিন্তু তখন আবার বরফ দেখা যাবে না। সিনিয়র আপুদের কাছে দেখেছিলাম একেবারে চুড়ায় উঠে সবাই ছবি তুলেছে, অদ্ভূত সুন্দর।

আমরা গিয়েছি বরফের সময়, তাই আমরা ঐ সৌন্দর্য্য থেকে বঞ্চিত হব। কিন্তু আমাদের জন্য এই বরফ-ঢাকা সৌন্দর্য্যও কম ছিল না। বাসে করে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত যাওয়ার পর নেমে যেতে হল। এখান থেকে বিশেষ জীপে করে পাহাড়ে উঠতে হবে। যত উপরে ওঠা হবে, তত বরফ বাড়বে, কাজেই শীতও বাড়বে।

তাই এই জায়গায় বরফে হাঁটার জন্য বুটজুতা, হাত জমে যাওয়া ঠেকাতে গ্লাভস, আর বড় বড় জোব্বা টাইপের পশমী ওভারকোট ভাড়া দেয়া হয়। আমরা দলে দলে ভাড়া করে নিলাম। আমি এমন একটা ওভারকোট নিলাম যেটা বাঘের চামড়ার মত ডিজাইন। বুটজুতা, ওভারকোট আর গ্লাভস পরে বের হয়ে দেখি আমার দুই সখী আমাকে রেখেই জীপে উঠে চলে গেছে। ব্যাপার না, জীপের অভাব নেই, আমি আরেকটায় উঠলাম।

জীপ থেকে নেমে ওদেরকে এক দফা ঝাড়ি দিতে ভুললাম না। যেখানে নামলাম, এখানে শুধুই বরফ আর বরফ, সাদা বরফ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। এবার আরও খানিকটা পথ পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে হবে পায়ে হেঁটে। আমরা হাঁটা শুরু করলাম। পরিশ্রমের কাজ।

কয়েক জায়গায় দেখলাম কেউ কেউ বরফের গায়ে রঙীন লেখা লিখেছে, ডিজাইন করে রেখেছে। এখানে দাঁড়িয়ে কেউ ছবি তুলতে চাইলে দশ রুপি দিয়ে ছবি তুলতে পারে। অবাক হচ্ছিলাম যে বরফের গায়ে রঙ দেয় কিভাবে। কাছে গিয়ে দেখলাম আসলে রঙ না, এগুলো সবই রঙীন টুকরো কাপড়। বরফের গায়ে বসিয়ে বসিয়ে ডিজাইন আর লেখা বানিয়েছে।

আমি আগ্রহ নিয়ে দেখছিলাম দেখে গাইড আমাদের দুইজনকে নিয়ে ছবি তুলল। টাকা দেয়ার সময় একটা ছেলে আমাদের ইশারা করে গাইডকে জিজ্ঞেস করল, গার্লফ্রেন্ড? গাইড তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আরে না না, আমাকে মার খাওয়াবে নাকি, এরা আমার বোন। আরও উপরে উঠতে থাকলাম। অনেক মানুষ এসেছে ঘুরতে। ঠিক যেমন ভিড় আমাদের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে হয়।

এক সময় মোটামুটি একটা সমতল জায়গায় এলাম যার পুরোটা তো বরফে ঢাকাই, চারপাশটাও বরফে ঢাকা পাহাড় দিয়ে ঘেরা। ঠিক যেন সুইজারল্যান্ড। বুঝলাম না, বলিউডের সিনেমায় গানের শুটিং করতে সুইজারল্যান্ডে কেন যায়, ওদের নিজেদের দেশে এত সুন্দর জায়গা থাকতে। পর্যটকদের বিনোদনের জন্য এখানে নানান ব্যবস্থা করা আছে। স্নো-স্কুটার, স্কি, এমন কি প্যারাশুটও।

আমরা স্নো-স্কুটারে উঠলাম। স্কুটারচালক চালায় আর পিছনে দুইজন বসা যায়। আমরা দুইজন উঠে বসতেই এমন জোরে চালানো শুরু করল যে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। চালক এতে অভ্যস্ত, সে জোরে জোরে চালিয়ে এক দিকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠে গেল। এরপর যখন ঐ রকম জোরগতিতেই ঢাল বেয়ে নেমে আসতে থাকল, আর চুপ করে থাকা গেল না, এবার জোরে জোরে চিৎকার শুরু করে দিলাম।

তবে ভয়ের চেয়েও মজা পেয়েছি বেশি। স্কুটার থামানোর পর আমরা আবার একটু ভাব নিলাম। এমন করে স্কুটারে বসলাম যেন আমরাই চালাচ্ছি। এইভাবে ছবিও তুললাম। অবশ্য এত লোকের ভিড়ে ছবিটা বিশ্বাসযোগ্য করা গেল না।

অনেকে স্কি করার চেষ্টা করল, আমি ঐদিকে পা মাড়ালাম না। দেখছিলাম তো অন্যরা কি হাস্যকর পোজে স্কি করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমার নজর পড়ে রইল অন্য একটা খেলায়। এর জন্য দড়ি দিয়ে খাড়া পাহাড় বেয়ে অনেকখানি উপরে উঠতে হয়। সেখানে একটা বড় টায়ারে দুইজন বসে।

এরপর টায়ারটা ঐ খাড়া পাহাড়ের উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়। টায়ারটা পিছলে গড়াতে গড়াতে সমতল জায়গায় নেমে আসে। আমি এক সখীকে নিয়ে দড়ি বেয়ে ওঠা শুরু করলাম। মনে হচ্ছিল শরীরের সমস্ত শক্তি মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল। দড়ি দিয়ে পাহাড়ে ওঠা যে এত কষ্ট কে জানত।

যা হোক, উপরে পৌঁছানোর পর টায়ারে দুই জন বসে পড়লাম। কিছু বোঝার আগেই দিল একটা ধাক্কা। আমার পক্ষে আর চোখ খুলে রাখা সম্ভব হল না। চোখ বন্ধ করে দুজন দুজনকে শক্ত করে ধরে চিৎকার করতেই থাকলাম। ব্যাপারটা ঘটে খুব অল্প সময়ের মধ্যে, খুব বেশি হলে পাঁচ সেকেন্ড।

কিন্তু আমার কাছে এই পাঁচ সেকেন্ডই মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল ধরে শুধু নিচে পড়েই যাচ্ছি আর পড়েই যাচ্ছি। অবশেষে শেষ হল এই ভয়ংকর যাত্রা। স্যার বললেন, আমি এই টায়ারে একবার চড়ে এমন ভয় পেয়েছি যে কানে ধরেছি, আর জীবনেও চড়ব না। আসলেই খুব বেশি ভয়ংকর, কিন্তু তারপরও একটা মজা আছে এই ভয়ের মধ্যেই। আমাদের কয়েক বন্ধু দুই-তিনবার করে চড়েছে।

আমারও ইচ্ছা করছিল, কিন্তু ঐ খাড়া পাহাড় বেয়ে আবার উঠতে হবে এই চিন্তা করে ইচ্ছাটা দমিয়ে রাখলাম। এরপর ছবি তুলে আর বরফ ছোঁড়াছুঁড়ি, হুটোপুটি করেই কাটিয়ে দিলাম বাকীটা সময়। এক জায়গায় দেখলাম বরফের গায়ে তিনটা ছোট ছোট গুহার মত করে কাটা। কাছে গিয়ে বুঝলাম এখানেও এক সময় রঙীন কাপড় দিয়ে ডিজাইন করা হয়েছিল, এখন পরিত্যাক্ত। আমরা তিনকন্যা তিন গুহায় বসে গেলাম।

এখন এখানে ছবি তুলতে কোন খরচ করতে হবে না। এখানেও সিমলার মত স্থানীয় পোষাক ভাড়া দেয়া হল ছবি তোলার জন্য। এবার আরও অনেকে এভাবে ছবি তুলে নিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে কাটিয়ে আমরা ফেরার জন্য রওনা দিলাম। যদিও কারুরই ইচ্ছা করছিল না এখান থেকে যেতে।

হোটেলে ফিরে বরফে ভেজা জামাকাপড় পাল্টে আমরা বের হলাম শপিং করতে। এখানেও শপিং করাটা বেশ সুবিধা। হোটেলে থেকে একটু হেঁটে এগিয়ে গেলেই মার্কেট। আর যত রাতই হোক, সবাই নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারে। এখান থেকে আব্বার জন্য, খালার জন্য শাল কিনলাম।

এখানকার জামার কাপড়গুলো কেনার মত না। ঠান্ডা আবহাওয়া বলে এরা অনেক গরম কাপড়ের জামা পড়ে। জামার কাপড়ই শালের মত মোটা। তবে একটা ব্যাপার বেশ ভালো আছে, এখানে কেউ জামার কাপড় কিনলে একদিনের মধ্যে দর্জির কাছ থেকে বানিয়ে নিতে পারে। রাতের খাবারের পর আমরা হোটেলের সেই ভিতরের আঙিনায় বসলাম সবাই।

ক্যাম্প ফায়ার করা হল। এরপর শুরু হল আড্ডা, গান, কবিতা। দারুণ একটা সময় কাটল। পরদিন সকালের পরিকল্পনা তেমন কিছু ছিল না, বলা হল যে যেমন খুশি ঘুরতে পারে বা শপিং করতে পারে, তবে খুব দূরে যেন কেউ না যায়। সকালবেলা উঠে নাস্তার পর একটা গ্রুপ বের হয়ে গেল শপিং-এ, একটা গ্রুপ হোটেলেই রয়ে গেল বিশ্রাম নিতে।

আমরা ঘুরুইন্যা পার্টির লোকজন স্যার আর গাইডের সাথে বের হলাম। প্রথমেই হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম বৌদ্ধমন্দিরে। এখানে বেশ কয়েকটা বৌদ্ধমন্দির আছে। আমরা দুইটা মন্দির ঘুরে দেখলাম। ছোট হলেও মন্দিরগুলো খুব সুন্দর, মনে হচ্ছিল চীনে চলে এসেছি।

এরপর গেলাম একটা বড় হোটেলে। মানালির সবচেয়ে বড় হোটেল মনে হয় এটাই। হোটেলটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম, এর সামনে বসে ছবি তুললাম। হোটেলের বিশেষত্ব হল এর ঠিক পিছন দিয়ে বয়ে গিয়েছে বরফগলা নদী বিয়াস। মানালির পথে আসতে আসতে এই নদীটাই দেখেছিলাম আমি।

সেখানে অবশ্য অন্যরূপ ছিল, এখানে আরেকরকম। এই জায়গায় এটাকে নদী না বলে খাল বলা যেতে পারে, কিন্তু স্রোত আছে খুব। বেশিক্ষণ আর আমরা নিজেদের সামলাতে পারলাম না। নদীতে নেমেই গেলাম। স্যার প্রথমে খুব সাবধান করছিলেন যে ঠান্ডা লেগে যাবে, একটু পরে দেখা গেল স্যার নিজেই আমাদের সাথে নেমে ঝাঁপাঝাঁপি করছেন।

এই নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি করা অবশ্য সহজ কাজ না। পানি একেবারেই বরফ গলা ঠান্ডা পানি। এক-দুই মিনিট পানিতে দাঁড়িয়ে থাকলেই পা জমে গিয়ে ব্যথা করতে থাকে। এর মধ্যে আমি একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেললাম। সবাই তো পানিতে নেমে আবার উঠে পড়ে, একটু হাঁটাহাঁটি করে আবার নামে।

আমি একটা পাথরের উপর বসে পানিতে পা ঝুলিয়ে দিলাম। ঐ ঠান্ডা পানির স্রোতে পা ডুবিয়ে বসে থাকলাম পুরো দুই ঘন্টা। এরপর অন্যদের বকাবকিতে উঠতেই হল। সবাই বলছিল আজকে আর কারুর না হোক আমার তো ঠান্ডা লাগবেই। আর ঠান্ডা না লাগলেও ফ্রস্টবাইট হবার একটা ভয় ছিল ঠিকই।

পানি থেকে উঠে পা খুব ব্যথা করছিল। আল্লাহর রহমতে কিছুই হয়নি। দিনভর এমন মজার সময় কাটিয়ে আমরা ফিরে এলাম হোটেলে। যারা যায়নি আমাদের সাথে তাদেরকে সব বলতেই তারা আফসোস করতে থাকল, কেন আমাদের সাথে গেল না। বিকালে রওনা হলাম আমরা মানালি ছেড়ে যাওয়ার জন্য।

এইবার সেই বিয়াস নদীর আসল রূপ দেখার পালা। ভোররাতে আবছা আবছা যা দেখেছিলাম, এবার স্পষ্ট হয়ে চোখের সামনে ভাসতে থাকল। নাহ, এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, প্রকৃতি এত সুন্দরও হয়? সবাই মুগ্ধ হয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম। বেশিক্ষণ এভাবে থাকতে পারলাম না, বাস থামিয়ে নেমে গেলাম। সন্ধ্যা পর্যন্ত বসেই রইলাম পাহাড়ের গায়ে রাস্তার ধারে।

বিয়াস নদীর কোলে সূর্যাস্ত দেখে তবেই আমাদেরকে আবার বাসে উঠানো গেল। আফসোস, ছবিগুলো সন্ধ্যার আলোয় তোলা হয়েছিল বলে এই সৌন্দর্য্যের কিছুই আসেনি। আমাদের এবারের গন্তব্য দিল্লী। সেই গল্প আরেকদিন। চলবে.................. (ছবি গুগল থেকে নেয়া।

) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

আমাদের কথায় যা দেখা হয়েছে

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.