আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রফতানি সম্ভাবনাময় চ্যাপা শুঁটকি



ভূমিকা ঃ বাংলাদেশের মধ্য, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকার ব্যাপক সংখ্যক অধিবাসীর রসনা তৃপ্তিতে চ্যাপা শুঁটকি উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। সাধারণতঃ বৃহত্তর সিলেট, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও পাহাড়ী জেলাসমূহের অধিবাসীদের কাছে চ্যাপা শুঁটকি বেশী জনপ্রিয়। তবে নাড়ি-উগলানো উৎকট গন্ধকে অতিক্রম করে একবার মুখে পুরতে পারলে পাগলপরা স্বাদের কারণে কট্টর শুঁটকি-বিমুখ নিরাসক্ত মানুষও চ্যাপার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। চ্যাপা শুঁটকির ভোক্তাকে আকৃষ্ট করার যাদুকরী ৰমতা রয়েছে: নেশা-দ্রব্যের ন্যায় একবার খেলে এর চমৎকার স্বাদ ও গন্ধ বার বারই ভোক্তাকে কাছে টেনে আনে। বাংলাদেশে অন্য কোন খাবারের প্রতি মানুষের এতটা আসক্তি চোখে পড়ে না।

এই সকল কারণে আজকাল চ্যাপা শুঁটির বাজার বহুগুণ বেড়েছে: পূর্বের যেকোন সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশী পরিমাণে চ্যাপা শুঁটকি তৈরি ও বিক্রয় হচ্ছে। প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকাও আদি-নিবাস ছাপিয়ে নতুন নতুন জায়গায় সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে কালের পরিক্রমায় চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটেনি। এখনও সনাতন অ-স্বাস্থ্যকর পরিবেশে চ্যাপা শুঁটকি তৈরি হয়ে থাকে। অথচ উন্নত প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তৈরি হলে এই শুঁটকি রফতানি করাও সম্ভব হবে।

একই নামে ভিন্ন পণ্য ঃ চ্যাপা শুঁটকিকে অনেকে সিধল, সিদল বা সিধল-শুঁটকি বলে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শ্রেণীর হ্যান্ডআউট, ক্লাশ-নোট বা পুসত্দিকাদিতে চ্যাপাকে সিধল-শুঁটকি বলে উলেস্নখ দেখা যায়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট ও কুমিলস্নার গ্রামাঞ্চলে চ্যাপাকে হিদল বলে। হিদলের শহুরে সংস্করণ হিসাবে বই-পুসত্দকে "সিধল" ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে। পার্বত্য জেলার উপজাতীয়রা একে ব্যরমা বলে।

তবে চ্যাপা ও হিদল সমার্থক হলেও বাংলাদেশে চ্যাপা ও "সিধল" বা "সিদঈল" দুটি সম্পূর্ণ বিভিন্ন মৎস্যজাত পণ্য। চ্যাপা বা "হিদল" হচ্ছে বাংলাদেশের পুকুর, ভারত-বিল-জলাশয়ে ব্যাপকভাবে গোচরীভূত মাঝারি আকারের জাতপুঁটি মাছ (Puntius stigma) থেকে তৈরি এক ধরনের আংশিক গাঁজনকৃত শুঁটকি পণ্য। অন্যদিকে সিধল বা সিদঈল নামে আরেকটি উলেস্নখযোগ্য পণ্য হচ্ছে উত্তর বঙ্গে, বিশেষ করে রংপুর/দিনাজপুর অঞ্চলে ছোট মাছের শুঁটকি ও শুকনা কচুর মুখী গুঁড়ার সংমিশ্রণে তৈরি সংরৰণযোগ্য এক বিশেষ ধরনের দানাদার বা পিঠা জাতীয় সুস্বাদু খাবার। সিধল তৈরির পদ্ধতিটি মোটামুটি এরকমঃ মাছের মৌসুমে (শীতকালে) বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ যেমন পুঁটি, ডানকানা, টাকি, টেংরা, খলসে, মেনি, শোল, ইত্যাদি রোদে শুঁটকি করা হয়। রাসত্দার ধারে বা বাড়ীর আশে-পাশে অযত্নে জন্ম নেয়া জংলা কচুর মুখী, ছড়া বা ডাল-পাতা ধুয়ে ভাল করে শুকানো হয়।

এবার ছোট মাছের শুঁটকি ও শুকনা কচু একসাথে ঢেঁকিতে বা কাঠের বড় হামানে মিহি করে পিষানো বা গুঁড়া করা হয়। প্রয়োজনে পিষানো গুঁড়া চাল্নি দিয়ে চেলে নেয়া হয়। পিষানোর সময় স্বাদমতো শুকনা মরিচ, অন্যান্য মশলা ও লবণ দেয়া হয়। এবার শুঁটকি ও কচুর চূর্ণকে দ্বিতীয় বার রোদে শুঁটকিয়ে চিনামাটি বা কাঁচের বৈয়ামে ভরে সংরৰণ করা হয়। অন্য একটি পদ্ধতিতে শুঁটকির মিহি গুঁড়ার সাথে শুকনা কচুর ডগা/পাতার গুঁড়া, রসুনের কোয়া, হলুদের গুঁড়া ও পরিমাণ মতো সরিষার তেল মিশিয়ে কাঠের হামানে পুনরায় পিষিয়ে পেস্টের মতো তৈরি করা হয়।

এই পেষ্ট থেকে ছোট ছোট টিকিয়া বানিয়ে কাপরের ভাঁজে রেখে 2/3 দিন রোদে শুকিয়ে সংরৰণ করা হয়। টিকিয়া তৈরির প্রক্রিয়ায় এতে কিছুটা গাঁজনও সম্পন্ন হয়। ছোট মাছের শুটকি ও কচুর এই দানাদার মিশ্রণ অথবা গাঁজনকৃত টিকিয়া রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে সিধল বা "সিদ্ঈল" নামে পরিচিত। ভাত খাওয়ার সময় সামান্য পরিমাণ সিধল-চূর্ণ পানিতে গুলে প্রয়োজনীয় পিয়াজ, রসুন ও কাঁচামরিচ কুচিসহ চমৎকার সুস্বাদু ভর্তা তৈরি করা হয়। সিধল টিকিয়া পানিতে গুলে রান্নার সময় মাছের ভুনা বা তরকারিতে স্বাদ-বর্ধক হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

টিকিয়াকে আগুনে পুড়ে বা তেলে ভেজে ভর্তাও বানানো যায়। মাছের অ-মৌসুম, আকাল বা মংগার দিনে আমিষের অভাব পূরণে সুস্বাদু সিধল/সিদ্ঈল ঐ সকল এলাকায় বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছে। তবে আজকাল নানা কারণে শীত মৌসুমেও ছোট মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় রংপুর অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী সিধল বিলুপ্তির পথে। প্রকৃতির বৈরিতার কারণে যত পরিবর্তনই আসুক না কেন আবহমান বাংলার সংস্কৃতির শেকড়কে সমূলে স্থিত বা টেকসই করার জন্য ঐতিহ্যবাহী এই সকল খাবারকে টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন। চ্যাপা উৎপাদনের এলাকা প্রাচীন আমল থেকেই বৃহত্তর সিলেট, কুমিলস্না ও ময়মনসিংহের হাওর-বাঁওড় ও নিচু জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণে পুঁটি মাছ ধরা পড়ে।

শীতকালে এই বিপুল পরিমাণ পুঁটির একটি কার্যকরী ব্যবহার পদ্ধতি গড়ে উঠেছে চ্যাপা উৎপাদনের মাধ্যমে। মৌলভী বাজার ও সুনামগঞ্জের হাওর এলাকা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, কুলিয়ারচর ও মোহনগঞ্জের জলমহাল ও মৎস্য অবতরণ স্থান এবং কুমিলস্নার নদী-অববাহিকা এলাকায় সুপ্রাচীন কাল থেকে চ্যাপা শুঁটকি তৈরি হয়ে আসছে। ইদানিং পস্নাবনভূমিতে মৎস্যচাষের আশাতীত সাফল্যের ফলে অন্যান্য মাছের পাশাপাশি জাতপুঁটির উৎপাদনও বহুগুণ বেড়েছে। ফলে ঐসব অঞ্চলেও চ্যাপা শুঁটকির উৎপাদন সম্প্রসারিত হয়েছে। এর মধ্যে দাউদকান্দি, ফরিদপুর ও যশোর অন্যতম।

চ্যাপা শুঁটকির প্রজাতি বাংলাদেশে বেশ কয়েক প্রজাতির পুঁটি রয়েছে। যেমন, সর-পুঁটি (Puntius sarana), পুঁটি বা জাতপুঁটি (Puntius stigma), তিত-পুঁটি (Puntius ticto)। ইদানিং রাজ-পুঁটি (Barbones gonionatus) নামে থাইল্যান্ড থেকে পুকুরে চাষযোগ্য দ্রম্নত-বর্ধনশীল একধরনের পুঁটিমাছ আমদানি করা হয়েছে যা অভ্যনত্দরীণ জলাশয়ে ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। চ্যাপা শুঁটকির জন্য উত্তম প্রজাতি হচ্ছে পুঁটি বা জাতপুঁটি নামে পরিচিত মাঝারি আকারের মাংসল, পরিপুষ্ট ও লম্বাকৃতির পুঁটি মাছটি। কখনও কখনও ভেজাল হিসাবে অন্য প্রজাতি যেমন ঃ বড় আকারের তিতপুঁটিও চ্যাপা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

তবে তিতপুঁটি অপেৰাকৃত চ্যাপ্টা, পাতলা এবং কম মাংসল বলে উৎপাদিত চ্যাপা শুঁটকির গুণগতমানে ব্যাপক পার্থক্য বুঝা যায়। আবার সর-পুঁটি দামী মাছ বলে কখনওই চ্যাপা তৈরিতে ব্যবহৃত হয় না। ইদানিং ছোট আকারের থাই রাজপুঁটি দিয়ে চ্যাপা তৈরি করে জাতপুঁটির চ্যাপার সাথে ভেজার দেয়া হয় বলে বাজারে প্রমাণ পাওয়া গেছে। থাই রাজপুঁটি অপেৰাকৃত পাতলা ও চওড়া, বৰদেশ প্রশসত্দ এবং মাংস কাঁটাযুক্ত। এর স্বাদ আমাদের দেশীয় জাতপুঁটির মত নয়।

চ্যাপার সমঝদারগণ একটু পরখ করলে অতি সহজেই ভেজাল হিসাবে দেয়া থাই রাজপুঁটির চ্যাপাকে বাজারে সনাক্ত করতে পারবেন। আজকাল আশুগঞ্জ এলাকায় সামুদ্রিক ফাইস্সা বা অন্যান্য কাঁটাযুক্ত ছোট মাছ থেকেও চ্যাপার মতো গাঁজনকৃত শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে। তবে এর স্বাদ ও গন্ধ জাতপুঁটির চ্যাপা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রচলিত চ্যাপা-শুঁটকি তৈরির পদ্ধতি শীতকালে শুঁটকির মৌসুমে যখন জলাশয়ের পানি কমে এসে প্রচুর পুঁটি মাছ ধরা পড়ে, তখনই মাছ শুকিয়ে ও পরে আংশিক গাঁজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চ্যাপা শুঁটকি তৈরি করা হয়। উন্নত পদ্ধতিতে চ্যাপা শুঁটকি তৈরি কোন ব্যয়বহুল প্রযুক্তির প্রবর্তন না করে শুধুমাত্র পরিচর্যা ও প্রাকটিসের উন্নয়ন ঘটিয়ে চ্যাপা শুঁটকির গুণগত মান ও সংরৰণকাল অনেক উন্নত করা যায়।

যেমন ঃ 1. ধৃত মাছকে যথাযথভাবে পরিচর্যা করতে হবে। আকার অনুযায়ী বাছাই করার পর পরিষ্কার টিউবওয়েলের পানিতে ভাল করে ধুয়ে সঠিকভাবে বরফ দিয়ে মাছ পরিবহন করতে হবে। 2. মাছের অাঁইস ও পাখনা ফেলে দিতে হবে। 3. পরিষ্কার মাছ থেকে তেল বের করার পর মাছকে আবারও ধুতে হবে। পরিষ্কার পাত্রে তেল নিষ্কাশন ও সংরৰণ করতে হবে।

4. মাটির হাড়ি অবশ্যই পরিষ্কার হতে হবে। প্রয়োজন হলে বা মাছের তেল পর্যাপ্ত না হলে অন্যান্য ভোজ্য তেল, যেমন সরিষার তেল মেখে হাড়িকে ভাল করে শুকিয়ে নেয়া যেতে পারে। 5. মাটিতে বা মাটির ওপর পাটিতে বা চাটাইয়ে রেখে মাছ শুকানো যাবে না। মাছ শুকানোর জন্য অবশ্যই উঁচু মাচা বা মশারী জাল দিয়ে ঢাকা বক্স টানেল/ রিং টানেল ব্যবহার করতে হবে। মাছ শুকানোর সময় কোন অবস্থাতেই কীটনাশক ব্যবহার করা যাবে না।

6. পোকা-মাকড়ের আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য চ্যাপা শুঁটকিতে শতকরা 1 ভাগ শুকনো মরিচের গুঁড়া মেখে দেয়া যেতে পারে। 7. মাছকে খুব ভাল করে শুকাতে হবে, যাতে মাছের দেহে পানির পরিমাণ শতকরা 16-18 ভাগে নেমে আসে। 8. শুকনা মাছকে 30 মিনিটকাল পানিতে ধুতে হবে, বেশীৰণ ভিজিয়ে রাখা উচিৎ নয়। 9. হাড়ির ভিতর শুঁটকিকে কোন প্রকারে পায়ে মাড়ানো যাবে না। ছোট মটকা বা হাড়িতে হাত দিয়ে বা লাঠির অগ্রভাগে কাপড়ের শক্ত কুন্ডলী বানিয়ে চেপে চেপে শুঁটকি ভরতে হবে।

প্রয়োজনে পরিষ্কার লবণসহ হাড়িতে শুঁটকি সাজিয়ে হাড়ির মুখ ভালভাবে বন্ধ করে ঠান্ডা স্থানে রাখতে হবে। 10. গাজন সম্পন্ন হওয়ার পর পণ্যকে বায়ু-নিরোধী পরিথিন প্যাকেটে ভরে সংরৰণ ও বাজারজাত করতে হবে। এতে ইঁদুর-বিড়াল ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ এবং অণুজীব সংক্রমণ ও জলীয় বাষ্প শোষণ থেকে পণ্যকে সহজেই রৰা করা সম্ভব হবে। এতে ক্রেতাগণ পণ্য কিনতে অধিক আগ্রহী হবে, ভোক্তার সংখ্যা বাড়বে এবং গৃহিণীরাও রান্নাঘরে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। 11. প্যাকেটকৃত পণ্য পরিষ্কার, শুকনো ও ঠান্ডা স্থানে গুদামজাত করতে হবে।

কথায় আছে ভূরিভোজন শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে ভোজন-রসিক বাঙালীর জুড়ি নেই। নানা সংস্কৃতির বিলাসী খাদ্যের মিলনমেলায় বাঙালীর খাদ্য-ভান্ডার পূর্ণতা পেলেও চ্যাপা শুঁটকি, সিঁধল বা সিদঈল আমাদের একানত্দ নিজস্ব, আদি ও অকৃত্রিম রসনাতুষ্ট খাবার। এসকল খাদ্য পণ্য বাঙালী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আসুন, সকল সুফলভোগী মিলে এর উন্নয়ন ঘটাই। -(ড. এ কে এম নওশাদ আলম) ঃঃ দৈনিক ইত্তেফাক ঃ 17.01.2007 ঃঃ


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.