আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবনানন্দের উপন্যাস পাঠানুভূতি।



নগ্ন নির্জন হাত যেমন রিক্ততার চিত্রকল্প হয়ে উঠে, যে হাতে শাঁখা নেই, বালা নেই, কোনো স্বর নেই, আদিগন্ত আকাশের মতো উন্মুক্ত, কোনো বন্ধন নেই সেই হাতে- জীবনানন্দের উপন্যাসগুলোও এমন রিক্ত পরাজিত জীবনের চিত্রকল্প। পরাজিত মানুষের গল্প মনে হলো তার প্রথম লেখা 3টা উপন্যাস পড়ে। এমন নয় যে এই 3টির বাইরে জীবনানন্দ কোনো উপন্যাস লিখেন নি, তবে এই উপন্যাস গল্পগুলো লেখার সময়কালটা এমন যে এই সময় জীবনানন্দের স্বকীয় গদ্যের উন্মেষ হচ্ছে। জীবনানন্দের বাক্যগঠন রীতি তৈরি হচ্ছে এই সময় কালে, 1928 থেকে 1933 এই সময় কালে জীবনানন্দ ইচ্ছাকৃত বেকার জীবন যাপন করেছেন, তার বিবাহ হয়েছে, তার সন্তান হয়েছে, এই তথ্যগুলোও এই উপন্যাসপঠনের সাথে মনে রাখতে হবে। জীবনানন্দের কবিতার ভেতরে যেমন নিস্পৃহ জীবনের কথা ভাসে,খানিকটা স্মৃতি,খানিকটা মগ্নতা থাকে,অতীতের সুখময় দিনের বিষাদ ঘিরে রাখে, তেমনই নিস্পৃহ অনাবশ্যক ভগ্নতার চিত্রায়ন এই উপন্যাসগুলো, পরাজিত এবং অলস মানুষের গল্প, যাদের ক্রমাগত মানিয়ে নেওয়ার বদভ্যাস আছে, যারা পরাজয়কে জয় ভেবে আনন্দ লাভ করে এমন মর্ষকামীতার চিত্রয়ন বলেই হয়তো আমার তেমন পছন্দ হয় নি।

উল্লাস, অভিলাষ যেনো অভাবের যাঁতাকলে পিষ্ট দিবানিশি,এমন রিক্ততায় বিবমিষা জাগে,বেঁচে থাকবার প্রয়োজনে মানুষ স্বাপি্নক হয়,একটা রঙ্গিন চাদর ঝুলিয়ে রাখে, আশা আকাংক্ষার ছিটে ফোটা রং লাগে সেই পর্দায়, জীবন জীবনের প্রয়োজনে আশাবাদী হতে শেখে-অথচ মানুষের এই আশাবাদ কোন এক অলীক মন্ত্রে উবে যায় জীবনানন্দের গদ্যে। বিভা উপন্যাসটায় সামান্য চমক থাকলেও সম্পূর্নতা নেই, এমন অভিযোগ হয়তো জীবনানন্দের 3টা উপন্যাস সম্পর্কেরই বলা যাবে, একটা সামান্য উপসংহার আছে তবে সেই উপন্যাস কোনো মতেই চরিত্রগুলোকে কোনো পরিনতির দিকে নিয়ে যায় না। কিংবা আমরা প্রথাগত উপন্যাসে যেমনটা পাই তেমন কোনো পরিনতি নেই জীবনানন্দের উপন্যাসে। বিভা উপন্যাসের কথক কোলকাটা শহরের মেসবাসী একজন মানুষ, যার মেসের বারান্দা থেকে সামনের বাড়ীর একটা জানালা, সেই জানালার ভেতরের ঘরে বসবাস করা এক নারীর জীবনযাপন দেখা যায়, কথক সেই নারীর গল্প বলে যায়। এটা এক নারীর প্রেম কিংবা প্রেমহীনতার গল্প, যে নারী আকাংক্ষিত, যাকে ভালোবসে পুরুষ কাছে আসে, অতীতপ্রেমমগ্নতায় সেইসব প্রেমার্থিদের উপেক্ষা করে যায় সেই নারী।

জীবনানন্দের অনন্য গদ্যরীতির সূচনা আসলে এইসব গদ্য থেকেই, একটা গদ্য নিয়ে নিরীক্ষার একটা পর্যায়ে এই গদ্যের সফল ব্যাবহার সম্ভব হয়েছে জীবনানন্দের কবিতায়। জীবনানন্দ প্রথম জীবনে যেই ধারায় কবিতা লিখতেন তা অনেকটাই নজরূল কিংবা মোহিতলাল মজুমদারের ধারায়। তখন অবশ্য সুধীন, অমিয় ,বিষ্ণু দে লিখছে, মধুসূধনের অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তনের 30 বছর অতিক্রান্ত, রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার পর বাংলা কবিতার মূল অনুকরনীয় ধারা হয়ে গেছেন, এবং জীবনানন্দ সচেতন ভাবে এই ধারার বাইরে যাওয়ার প্রচেষ্টা করছেন, তার 2য় কাব্যগ্রন্থের ভাষায় সামান্য বদল হলেও সেটা আমরা যে জীবনানন্দে মুগ্ধ তার ধারে কাছে নয়। এর পরেই তার চাকরিচুত্যি এবং এই 5 বছরের স্বেচ্ছা বেকারত্ব বরন, বিবাহ কাল এইসব সময়ে জীবনানন্দের ভাষা এবং শব্দ এবং বাক্য নিয়ে নিরীক্ষা, এবং সেই সময়ের কবিতার অনেক ছবিই এইসব সময়ে লিখিত উপন্যাস গল্প থেকে নেওয়া। হয়তো কবিতার আলুথালু ভঙ্গি এবং একই সাথে একটা ভগ্ন জীবনের চিত্রায়ন, 1934 এর কবিতায় যেমন বীভৎসতার চিত্রকল্প, কিংবা আমাদের বনলতা সেন, আমাদের 8 বছর আগের এক দিন, বলিল অশত্থ সেই, বনলতা সেন, মহা পৃথিবী এবং ধুসর পান্ডুলিপির অধিকাংশ কবিতাই এই সময়ে লিখিত হয়েছে।

একটু মনোযোগ দিয়ে এই সময়ে লিখিত গল্প উপন্যাস পড়লে কোনো কোনো কবিতার অংশবিশেষের উন্মেষ চোখে পড়বে,অনুভবের রিক্ততায় উষর এই মনোভূমি,বিভার সেই প্রেমহীন অতীতচারী জীবনযাপনের কোনো সমাপ্তি নেই, তার বাবার তেমন কোনো ব্যাগ্রতা নেই, তাকে আংশিক কন্যাদায়গ্রস্থ মনে হলেও সেই পরিমান প্রবল প্রচেষ্টা উপন্যাসে আসে না,বিভা নিজের হৃদয় তাড়নায় অতিশয় আন্তরিক, তার কষ্টবোধ ফাঁপা হলেও মেয়েলিপনার গ্রাহ্য। তার মৃত ময়নার জন্য শোক এবং পুরুষের কামনা ভালোবাসাকে অনায়াসে হত্যা করার বীভৎসতা পাশাপাশি উপস্থিত। তবে অসমাপ্ত এজন্যই যে এই বারান্দা-জানালার ভূবন ছাড়িয়ে প্রতিবেশী থেকে এগিয়ে কথকের সাথে চরিত্রের কোনো সম্পর্ক বা সংলাপ বিনিময় হয় না, কথক এক পর্যায়ে কোনো রকম ভূমিকা ছাড়াই অন্তর্হিত হয়ে যায়, বিভাও পরিনতিহীন একটা অবস্থানে থেকে যায়। প্রথম উপন্যাস বলেই হয়তো এই ত্রুটিটাকে ক্ষমাযোগ্য মনে হয়েছে। কারুবাসনা বা জীবনপ্রনালী মূলত একই জীবনযাপনের ভিন্ন 2টা চিত্রকল্প।

প্রধান ও কথক চরিত্র তার শিল্পবোধ, বেকারত্ব নিয়ে অনায়াসে পুড়ে যাচ্ছে এবং জীবনের চাহিদা পূরণের জন্য তাকে পিতৃমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে, পিতা এখানে আদর্শবাদী একজন মানুষ-তবে সেই আদর্শাবাদীতার শীর্ষ ঢেকে যাচ্ছে ঋণের অন্ধকারে,চরিত্রটা ভাবতে থাকে আদর্শের কথা জানায়, নিজস্ব ঋণের বোঝা কখনই শুধতে পারবেন না জেনেও আবারও সন্তানের জন্য ঋণ করতে যান, জীবনের প্রতি উদাসীন নন তবে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন একজন চরিত্র এই বাবা। প্রধান চরিত্রের বেকারত্ব আর 1টা মাত্র সন্তানের গল্প,সেই চরিত্রের বয়স জীবনানন্দের সমান। তবে প্রকট প্রতিরোধ হীনতা কিংবা ক্লেশবরনের মর্ষকামীতা বলেই হয়তো আমার জীবনবোধকে আক্রান্ত করেছে এই নিস্তরঙ্গ অভাবের গল্প। যেখানে সবাই সবার অনুভব হত্য করছে, ঐতিহ্য 6 খন্ডে জীবনানন্দ সমগ্র ছাপিয়েছে, সেখানে কালানুক্রমিক ভাবে জীবনানন্দের শিল্পজীবনের বিভিন্ন পর্যায় ধরে রাখা হয়েছে, জীবনানন্দের এই সংকলন পড়ে দেখার মতো। তার অধ্যাবসায় এবং শিল্পের প্রতি নিষ্ঠতা, তার পরিশ্রম এবং তার উদাসীন জীবনযাপনের প্রবল ছাপ একটু কষ্ট করলেই এখানে দেখা যাবে, এমন কি তার যাপিত জীবনের অনেকাংশই উন্মুক্ত এই সমগ্রের পাতায় পাতায়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.