আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবনানন্দের বিয়ের গল্পটা

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ ‘অশ্বত্থের পাতাগুলো পড়ে আছে ম্লান শাদা ধুলোর ভিতর/ এ পথ ছেড়ে দিয়ে এ-জীবন কোনোখানে গেল নাকো তাই। ’ (রূপসী বাংলা) ... যে কবি এ লাইন কয়টি লিখেছেন তাঁর উষ্ণ আর আবেগী হৃদয়ের গড়নটি ঠিক কেমন হতে পারে, বাংলার প্রতি সে কবির ভালোবাসা কতটা প্রগাঢ় হতে পারে, নিবিড় হতে পারে। দীর্ঘদিন হল আমি জীবনানন্দের প্রকৃতিপ্রেমের গভীরতা নিয়ে ভেবে ভেবে একরকম আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছি।

রূসপী বাংলার প্রতি এই নিগূঢ় প্রেমের জন্যই আজও জীবনানন্দের অধিষ্ঠান বাঙালিহৃদয়ের অথই গহীনে। বাংলার প্রতি কবির এ অন্তহীন মমত্ববোধ আমাদের সহৃদয় বাঙালি হৃদয়কে আর্দ্র করে তোলে। সেই সঙ্গে কবির প্রতি আমাদের মনে সৃষ্টি হয় গভীর এক কৌতূহল । এই কৌতূহল থেকেই জীবনানন্দের জীবনের নানা দিক সম্বন্ধে লিখছি। বলছি।

আজ বলব জীবনানন্দের বিয়ের গল্পটা । পড়াশোনার পালা চুকিয়ে কলকাতার সিটি কলেজে পড়াতে ঢুকেছিলেন জীবনানন্দ। অবশ্য ১৯২৮ সালের মাঝামাঝি চাকরি হারান তিনি। (সে এক মহা বিতর্কিত অধ্যায়; এ নিয়ে পরে বিস্তারিত লিখবার আশা রইল। ) ... সে যা হোক।

এর পর জীবনানন্দ খুলনার বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে চাকরি পেলেও সে কলেজে মাস কয়েক- এর বেশি পড়ান নি। এর পর জীবনানন্দ চাকরি পান দিল্লির রামযশ কলেজে। সে কলেজের উপাধক্ষ ছিলেন সুকুমার দত্ত। ইনি বরিশালেরই মানুষ এবং বরিশালের অশ্বিনীকুমার দত্তের ভাইয়ের ছেলে। উল্লেখ্য, ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে অশ্বিনীকুমার দত্ত বরিশাল শহরে ব্রজমোহন ইনষ্টিটিউশন নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন-যে স্কুলে জীবনানন্দের বাবা সত্যানন্দ দাশ পড়াতেন।

এটুকু ভূমিকার পর এবার পাত্রীপক্ষের কথা পাড়ি খানিকটা। বিয়ের আগে জীবনানন্দের স্ত্রীর নাম ছিল লাবণ্যবালা গুপ্ত। বিয়ের পর থেকে অবশ্য লাবণ্য দাশ। লাবণ্যবালা জন্মেছিলেন সেনহাটিতে। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটি ইউনিয়ন কি? আমি কিন্তু নিশ্চিন্ত নই।

... সে যাই হোক। লাবণ্যবালার বাবার নাম ছিল রোহিণীকুমার গুপ্ত। ইনি হিন্দু হলেও এঁর দুই ভাই অমৃতলাল এবং বিহারীলাল ছিলেন ব্রাহ্ম। এঁদের মধ্যে অমৃতলাল ছিলেন ঢাকায় পূর্ব বাংলা ব্রাহ্মসমাজের প্রচারক। ইনি আমাদের এই এক অন্যতম চরিত্র।

লাবণ্যবালা বালিকাবেলায় মাত্র চার মাসের ব্যবধানে মা-বাবা দুজনকেই হারিয়েছিলেন। বালিকার বয়স তখন মাত্র ৭। ভাইয়ের মেয়ের দায়িত্ব নিলেন অমৃতলাল । ভারি রূপসী বালিকা। তবে পড়াশোনাতেও মাথা বেশ পরিস্কার।

স্কুলের পালা চুকিয়ে ঢাকার ইডেন কলেজে আই য়ে ক্লাসে ভর্তি হল, স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি পড়ি অবস্থা, ঠিক তখনই বিয়ের বাদ্যি বেজে উঠল ... এবার জীবনানন্দের দিল্লির জীবন কথা। জীবনানন্দ ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৩০ সালের মার্চ মাস অবধি দিল্লিতে ছিলেন। রামযশ কলেজটি ছিল দিল্লির উপকন্ঠে; জায়গাটির নাম কালাপাহাড়। জীবনানন্দের ভাষায়: উষর, জলহীন আর পাহাড়ি। জীবনানন্দ দিল্লিতে বড় একাকী ও অসুখী বোধ করতেন।

এ কথা বলেছেন রামযশ কলেজেরই এক শিক্ষক- কবির বাঙালি কলিগ প্রভাসচন্দ্র ঘোষ। দিল্লিতে জীবনানন্দের অবশ্য একজন দেশিবন্ধু ছিল । বরিশালের এই বন্ধুটিও ব্রাহ্ম। নাম-সুধীরকুমার দত্ত। ... এখানেই বলে রাখি যে জীবনানন্দের পিতামহ সর্বানন্দ দাশ ছিলেন বিক্রমপুরের লোক এবং তিনি ছিলেন ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী।

সর্বানন্দ দাশ ‘কার্যোপলক্ষে’ বিক্রমপুর থেকে বরিশাল শহরে এসেছিলেন। সর্বানন্দ দাশ সরকারি চাকরি করতেন। বরিশাল শহরে এসে তিনি নব্য ভাবধারায় উজ্জীবিত হন, অর্থাৎ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। ১৮৬১ সালে বরিশালের ব্রাহ্মসমাজটির প্রতিষ্ঠায় সর্বানন্দ দাশ প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছিলেন । এর আগে অবশ্য কলকাতায় ব্রাহ্মসমাজটি গঠিত হয় উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ।

হিন্দু ধর্মের প্রতি ইউরোপীয় মিশনারিদের সমালোচনার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই বহু ঈশ্বরবাদ পরিত্যাগ করে ব্রাহ্মরা উপনিষদের নিরাকার ঈশ্বরে ভজনা করতে থাকে । যদিও ব্রাহ্মদের অনেক আচার খ্রিষ্টধর্মের মতোই ছিল, তবে ব্রাহ্মদের অনেক আচার আবার হিন্দু ধর্মগ্রন্থ সমর্থিত ছিল। ব্রাহ্মধর্মটি ছিল মূলত উনিশ শতকের ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন। কুড়ি শতকে ব্রাহ্মদের ‘নীতিবাগীশ’ বলে ভাবা হত। ব্রাহ্ম শব্দটির বিকৃত রূপ ‘বেম্ম’ বলতে বোঝাত নৈতিক বিশুদ্ধতা।

সে যাই হোক। দিল্লিতে সুধীরকুমার দত্ত এবং জীবনানন্দ রোজ সন্ধ্যায় নিয়মিত দেখা করতেন। কখনও জীবনানন্দ সুধীরকুমার কে রামযশ কলেজের ক্লাবে নিয়ে যেতেন। সুধীরকুমার সম্বন্ধে জীবনানন্দ লিখেছেন: ডিসেম্বর মাস, দিল্লীতে তখন গভীর শীত -পাহাড়ে আরো শীত ...সমস্ত অসুবিধা অগ্রাহ্য করিয়া সে (সুধীরকুমার দত্ত) এই বিমর্ষ পাহাড়ে আমার সঙ্গে আসিয়া থাকিতে লাগিল। দিল্লির ওই প্রচন্ড শীতই সম্ভবত ত্রিশ বছরের এক অনুভূতিময় যুবকের রক্তে নারীর সান্নিধ্য-তৃষ্ণা জাগিয়ে তুলেছিল।

বাংলায় ফিরে বিয়ে করে রামযশ কলেজে ফিরে আসবার পরিকল্পনা করছিলেন জীবনানন্দ। চাকরির মেয়াদ বাড়ানো এবং ছুটি মঞ্জুরের জন্য কলেজের অধ্যক্ষ কে সুপারিশ করার জন্য তিনি সহকর্মীদের অনুরোধ করেন। বেরসিক অধ্যক্ষ সে অনুরোধ প্রত্যাখান করেন। চার মাসের মাথায় জীবনানন্দের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়! আমি যে সময়টার কথা বলছি সে সময়টা ছিল স্বদেশী আন্দোলনের বারুদগন্ধ মেশানো এক উত্তাল সময়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী সর্বাত্মক আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছিল।

কাজেই লাবণ্যবালার জেঠা অমৃতলাল বড় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন তাঁর ভাইঝিটি না- আবার এইসব রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে-এই ভেবে । ঢাকার ইডেন কলেজে আই এ পড়ার সময় লাবণ্যবলা সত্যি সত্যিই স্বদেশী রাজনীতির প্রতি কিছুটা ঝুঁকে পড়েছিলেন। আমি ১৯৩০ সালের কথা লিখছি। ওই সময়ই মাষ্টারদা সূর্যসেন-এর নেতৃত্বে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পরিকল্পনা করছেন। ১৯৩০ সালের ঢাকার গুমোট বাতাসে সে আশঙ্কাই ঘুরপাক খাচ্ছিল।

জ্যাঠামশাই অমৃতলাল ভাইঝির অর্ন্তগত টানটান উত্তেজনা ঠিকই টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারক হওয়ায় অমৃতলাল জীবনানন্দর বাবা-মা সত্যানন্দ দাশ এবং কুসুমকুমারী দাশকে চিনতেন। তিনি তাঁদের প্রভাষক ছেলের সঙ্গে তাঁর ভাইঝির বিয়ের প্রস্তাব দেন। সত্যানন্দ দাশ এবং কুসুমকুমারী দাশ এতে সম্মত হন এবং ছেলেকে দিল্লি থেকে ডেকে পাঠান। অবশ্য তাঁরাও বসে ছিলেন না।

ছেলের জন্য পাত্রী দেখছিলেন। ছেলেকে ব্যারিষ্টারি পড়াবে এমন এক ধনাঢ্য পরিবারের সঙ্গে জীবনানন্দের বিয়ের প্রাথমিক কথাবার্তাও চলছিল। এদিকে অমৃতলাল গোপনে কনে দেখার আয়োজন করতে থাকেন । পাত্রর একবার মা-বাবার পছন্দ করা মেয়েকে দেখাই রীতি। সেই দিনক্ষণও নির্ধারণ করা হল।

দিল্লির রামযশ কলেজের এক তরুণ প্রভাষক ঢাকার অমৃতলালের বাসায় লাবণ্যবালাকে দেখতে আসবেন। এসব কথা অবশ্য লাবণ্যবালা জানতেও পারলেন না। লাবণ্যবালা থাকতেন ঢাকারই এক ছাত্রীনিবাসে। কনে দেখার দিন অমৃতলাল ভাইঝিকে ডেকে পাঠালেন। সেদিনের কথা পরবর্তীকালে লাবণ্যবালা স্মরণ করেছিলেন।

ছাত্রীনিবাস আর তাঁর জ্যাঠামশায়ের বাড়ির মাঝখানে ছিল একটা মাঠ। বর্ষাকাল। বৃষ্টি হওয়ায় মাঠে কাদা জমেছিল। সেদিন লাবণ্যবালার পরনে ছিল নকশি পাড়ের একটি সাধারণ সুতি শাড়ি। মাঠ পেরোনোর সময় শাড়িতে কাদার ছিটে লাগল।

বাড়িতে পৌঁছনোর পর অমৃতলাল ভাইঝিকে বললেন, বাসায় একজন অতিথি এসেছেন, যা, ওঁর জন্য চা-নাশতা বানিয়ে নিয়ে আয়। লাবণ্যবালা রান্নাঘরে ঢুকলেন। চা তো বুঝলাম। কিন্তু লাবণ্যবালা কি নাশতা বানিয়েছিলেন সেদিন ? মানে ১৯৩০ সালে ঢাকার বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরে অতিথি এলে কি নাশতা বানাতো ? তাছাড়া ব্রাহ্মপরিবারের রান্নাবান্নার কি কোনও তফাৎ ছিল? সে যাই হোক। লাবণ্যবালা নাশতা বানাচ্ছেন।

ধরা যাক লুচি আর পায়েস। পরনে সুতি শাড়ি। সে শাড়িতে আবার কাদার দাগ। যা হোক। একটু পর বসবার ঘরে নাশতা নিয়ে ঢুকলেন।

দিনটি মেঘলা ছিল কি? বেতের সোফায় একজন মাত্র অতিথি বসে । তো, সে অতিথি কেমন দেখতে ছিল? বহু বছর পর এক স্বাক্ষাৎকারে পশ্চিমবাংলার কবি কবিতা সিংহকে লাবণ্যবালা বলেছিলেন: বসবার ঘরে লোকটা ছিল ২৮-২৯ বছরের সাধারণ ধুতি-পাঞ্জাবি পরা মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকা কালো রঙের এক লোক। কিন্তু কি ভাবছিলেন জীবনানন্দ? তিনি যাই ভাবুন না কেন- জীবনানন্দের ইডেন কলেজের ছাত্রীটিতে তাঁর ভালো লেগেছিল। তিনি সেই ধনী পরিবারে বিয়ে করেন নি: ব্যারিষ্টারি পড়তে বিলেতেও যান নি । অমৃতলাল আর লুকালেন না।

ভাইঝিকে এবার সব খুলে বললেন । বিয়ে! সে কী! সে কেমন করে হয়! লাবণ্যবালার ফরসা মুখখানি আরক্ত হয়ে উঠল মুহূর্তেই । বিয়ের চেয়ে বিপ্লবীর জীবন বেশি রোমাঞ্চকর নয় কি? কেন তোর বুঝি বিয়ের বয়স হয়নি? অমৃতলালের প্রশ্নে মৃদু শ্লেষ। লাবণ্য গুম মেরে যান। মা-বাবা মরা মেয়েকে বুকে ধরে মানুষ করেছেন যে সিংহহৃদয় মানুষটি তাঁর মুখের ওপর কথা শুনিয়ে দেওয়া অত সহজ নয়।

হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। বিয়ে হল ঢাকায়। তারিখ: ১৯৩০ সালের ৯ মে। স্থান : ঢাকার ব্রাহ্মমন্দির। আমার অনেক সৌভাগ্য যে আমি গত শতকের আশির দশকের শেষে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে আমি ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম ।

পুরনো আমলের রংহীন লোহার রেলিংওলা দোতলা বাড়ি। ওটাই যে ব্রাহ্মমন্দির, তখন সেভাবে আমি উপলব্দি করিনি। ওই সময়ে জীবনানন্দও আমাকে তেমন গভীরভাবে রেখাপাত করেনি। তবে পরবর্তীকালে অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ব্রাহ্মদের নিয়ে বিস্তারিত জানবার সুযোগ হয়েছিল আমার এবং ওই সময় থেকেই জীবনানন্দ আমায় আচ্ছন্ন করতে থাকে । সে যাই হোক।

পুরনো ঢাকার ওই ব্রাহ্মমন্দিরে আমার কিছু দেবতূল্য মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, যাঁদের উষ্ণ আতিথেয়তা এবং আন্তরিক আচরণ আজও আমার গহন সুখের স্মৃতি হয়ে রয়েছে। ব্রাহ্মরীতিতে বিয়ে পরিচালনা করেন জীবনানন্দের পিসেমশাই (ফুপা) মনমোহন চক্রবর্তী। এঁর সম্বন্ধে এবার কিছু কথা বলে নিই। তাহলে জীবনানন্দের পরিপার্শ্বের ছবিটা আরও উজ্জ্বল হবে। জীবনানন্দের বাবা সত্যানন্দ দাশও লেখালেখি করতেন।

কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘মুকুল’ পত্রিকায় লিখতেন সত্যানন্দ দাশ । সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই সম্ভবত তিনি বরিশাল থেকে একটি পত্রিকা সম্পাদনায় উদ্যেগী হয়েছিলেন ১৯০০ সালে। জীবনানন্দ দাশ সে সময় দু বছরের শিশু। সত্যানন্দ দাশ ব্রাহ্মসমাজের মুখপাত্র হিসেবে ব্রহ্মবাদী নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। পত্রিকা সম্পাদনায় তাঁকে সাহায্য করতেন তাঁর ভগ্নিপতি মনমোহন চক্রবর্তী।

পত্রিকাটির প্রথম দিকের বেশ কিছু কবিতা মনমোহন চক্রবর্তীরই রচনা; (জীবনানন্দের শৈশবের পরিমন্ডলের কথা ভেবে বিস্মিত হতেই হয়) তবে ব্রহ্মবাদী পত্রিকার অনেক কবিতাই লিখেছেন জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী দাশ । সব মিলিয়ে শ’ খানেক। কিন্তু, শ’ খানেক কবিতা কীভাবে রচিত হল? সংসারে নানান কাজ ছিল, জটিলতাও কম ছিল না। সে সম্বন্ধে জীবনানন্দ লিখেছেন,‘ (মা) সংসারের নানা কাজকর্মে খুবই ব্যস্ত আছেন ...এমন সময়ে ব্রহ্মবাদীর সম্পাদক আচার্য মনমোহন চক্রবর্তী এসে বললেন, এক্ষুনি ব্রহ্মবাদীর জন্য তোমার কবিতা চাই, প্রেসে পাঠাতে হবে। লোকে দাঁড়িয়ে আছে।

শুনে মা খাতা কলম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে একহাতে খুন্তি আর একহাতে কলম নাড়ছেন দেখা যেত, যেন চিঠি লিখছেন, বড়ো একটা ঠেকছে না কোথাও; আচার্য চক্রবর্তী কে প্রায় তখনই কবিতা দিয়ে দিলেন। ’ (‘আমার মা বাবা’ ) পরবর্তীকালে মনমোহন চক্রবর্তী এলাহাবাদ বদলী হয়ে যান। ওখান থেকে বের করেন বিখ্যাত প্রবাসী পত্রিকা । এতেও জীবনানন্দের মায়ের কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়। জীবনানন্দের বিয়েতে কবি বুদ্ধদেব বসু নেমতন্ন পেয়েছিলেন।

তার কারণ ছিল। ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত কল্লোল পত্রিকায় জীবনানন্দের একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। সে কবিতার নাম ‘নীলিমা’। কবিতার শুরুটা এরকম: রৌদ্র ঝিলমিল, ঊষার আকাশ, মধ্যনিশীথের নীল, অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারেবারে নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে। বুদ্ধদেব বসুর তখন ১৭ বছর বয়েস।

পড়তেন ঢাকার একটি কলেজে। নীলিমা পাঠে মুগ্ধ হয়েছিলেন কিশোর বুদ্ধদেব । পরবর্তীকালে জীবনানন্দর প্রতিভাকে তুলে ধরতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন তিনি। জীবনানন্দের কবিতার প্রতি যখন সাড়া মিলছিল না তখন তাঁরই সম্পাদিত ‘প্রগতি’ পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘তাঁর কবিতা একটু ধীরে -সুস্থে পড়তে হয়, আস্তে আস্তে বুঝতে হয়। ’ এসবই জীবনানন্দের বিয়েতে কবি বুদ্ধদেব বসুর নেমতন্ন পাওয়ার কারণ বলে অনুমান করি ! যা হোক।

বিয়ের কয়েকদিন পর নববিবাহিত দম্পতি লঞ্চে করে বরিশালে পৌঁছান। বরিশালে বগুড়া ও গোরস্তান রোডের মোড়ে ‘সর্বানন্দ ভবন’। টিন সেডের সাদাসিদে বাড়ি। মে মাসের চৌদ্দ তারিখে বৌভাত সে বাড়িতেই হয়েছিল। ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক ক্যারিয়ার তো বটেই বিয়ের পর লাবণ্য দাশ- এর পড়াশোনায় ছেদ পড়ে।

বিয়ের এক বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯৩১ সালে বড় মেয়ে মঞ্জুশ্রীর জন্ম হয়। এরপর লাবণ্য দাশ ১৯৩৫ সালে বরিশালের বি.এম কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এই সংবাদ ব্রহ্মবাদী পত্রিকার ১৩৪২ অব্দের আষাঢ় সংখ্যায় বেরিয়েছিল ‘মহিলাদের কৃতিত্ব’ শিরোনামে। ব্রাহ্মসমাজের শ্রীযুক্ত সত্যানন্দ দাস বি,এ মহাশয়ের পুত্রবধূ অধ্যাপক জীবনানন্দ দাশের পত্নী শ্রীমতী লাবণ্যবালা একটি পাঁচ বৎসরের শিশুকন্যার মা হইয়া আই, এ পাস করিয়ে এবার বি,এম, কলেজ হইতে বি,এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছেন। ১৯৩৮ সালে লাবণ্য দাশ এক ছেলেরও মা হন।

জীবনানন্দের বড় ছেলের নাম সমরানন্দ । বিয়ের পর জীবনানন্দ আর দিল্লি ফিরে যাননি। কেন? কারণ বাংলা তাঁকে টানছিল। অত্যন্ত গভীরভাবে। সনেট লিখে সে অনুভূতি প্রকাশ করছিলেন জীবনানন্দ।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ফকরুল আলম লিখেছেন, 1934: Composes Ruposhi Bangla (Beautiful Bengal) poems, even though theses too will be published after his death. দিল্লিতে আর ফিরে না যাওয়ার কারণটিও তিনি আমাদের একটি সনেটের শেষে জানিয়ে দিয়েছেন এভাবে- ‘অশ্বত্থের পাতাগুলো পড়ে আছে ম্লান শাদা ধুলোর ভিতর/ এ পথ ছেড়ে দিয়ে এ-জীবন কোনোখানে গেল নাকো তাই। ’ (রূপসী বাংলা) তথ্যসূত্র: এই পোস্টটির অধিকাংশ তথ্যই টুকেছি মার্কিন গবেষক ক্লিন্টন বি সিলি-র লেখা 'আ পোয়েট অ্যাপার্ট' (অনন্য জীবনানন্দ) থেকে। বইটির অনুবাদক ফারুক মঈনউদ্দীন যে বই সম্বন্ধে লিখেছেন: মার্কিন গবেষক ক্লিন্টন বি সিলি ষাটের দশকে দুই বছর বরিশালে ছিলেন। কিন্তু তখনো জীবনানন্দ দাশের কবিতার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেনি, পরিচয় ঘটে নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার পর। এই কবি সর্ম্পকে তাঁর গভীর গবেষণালব্দ তথ্য ও অন্তর্দৃষ্টিময় বিশ্লেষণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত হয় আ পোয়েট অ্যাপার্ট ।

যা জীবনানন্দ দাশের জীবন ও কবিতা সর্ম্পকে অপরিহার্য একটি বই। ...এই পোস্টটি লিখতে আরেকটি বই কাজে দিয়েছে; সেটি Fakrul Alam; এর Jibanananda Das Selected Poems with an Introduction , Chronology, and Glossary ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.