আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা (ঝরা পালক)

জন্ম থেকেই জ্বলছি ছায়া-প্রিয়া দুপুর রাতে ও কার আওয়াজ গান কে গাহে, - গান না! কপোতবধূ ঘুমিয়ে আছে নিঝুম ঝিঁঝির বুকের কাছে; অস্তচাঁদের আলোর তলে এ কার তবে কান্না! গান কে গাহে, গান না! সার্সি ঘরের উঠছে বেজে উঠছে কেঁপে পর্দা! বাতাস আজি ঘুমিয়ে আছে জল-ডাহুরের বুকের কাছে; এ কোন্‌ বাঁশি সার্সি বাজায় এ কোন হাওয়া ফর্দা দেয় কাঁপিয়ে পর্দা! নূপুর কাহার বাজল রে ঐ! কাঁকন কাহার কাঁদল পুরের বধু ঘুমিয়ে আছে দুধের শিশুর বুকের কাছে; ঘরে আমার ছায়া-প্রিয়া মায়ার মিলন ফাঁদল কাঁকন যে তার কাঁদল! খসখসাল শাড়ি কাহার! উস্‌খুসাল চুল গো! পুরের বধু ঘুমিয়ে আছে দুধের শিশুর বুকের কাছে: জুল্‌পি কাহার উঠল দুলে! দুলল কাহার দুল গো! উস্‌খুসাল চুল গো! কাঁদছে পাখি পউষনিশির তেপান্তরের বক্ষে! ওর বিধবা বুকের মাঝে যে গো কার কাঁদন বাজে! ঘুম নাহি আজ চাঁদের চোখে, নিদ্‌ নাহি মোর চক্ষে! তেপান্তরের বক্ষে! এল আমার ছায়া-প্রিয়া, কিশোরবেলার সই গো! পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে দুধের শিশুর বুকের কাছে; মনের মধূ-মনোরমা- কই গো সে মোর কই গো! কিশোরবেলার সই গো! ও কার আওয়াজ হাওয়ায় বাজে! গান কে গাহে, গান না! কপোতবধূ ঘুমিয়ে আছে বনের ছায়ায়-মাঠের কাছে; অস্তচাঁদের আলোর তলে এ কার তবে কান্না! গান কে গাহে, গান না! ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল,- ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার রাঙা, আপেলের মতো লাল যার গাল, চুল যার শাঙনের মেঘ, আর আঁখি গোধূলির মতো গোলাপী রঙিন, আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে, স্বপ্নে-কত দিন! মোর জানালার পাশে তারে দেখিয়াছি রাতের দুপুরে- তখন শুকনবধু যেতেছিল শ্মশানের পানে উড়ে উড়ে! মেঘের বুরুজ ভেঙে অস্তচাঁদ দিয়েছিল উঁকি সে কোন্‌ বালিকা ‌একা অন্তঃপুরে এল অধোমুখী! পাথারের পারে মোর প্রাসাদের আঙিনার পরে দাঁড়াল সে- বাসররাত্রির বধু-মোর তরে, যেন মোর তরে! তখন নিভিয়া গেছে মণিদীপ-চাঁদ শুধু খেলে লুকোচুরি,- ঘুমের শিয়রে শুধু ফুটিতেছে-ঝরিতেছে ফুলঝুরি, স্বপনের কুঁড়ি! অলস আঢুল হাওয়া জানালায় থেকে থেকে ফুঁপায় উদাসী! কাতর নয়ন কার হাহাকারে চাঁদিনীতে জাগে গো উপাসী! কিঙ্খারে -গালিচা খাটে রাজবধু-ঝিয়ারীর বেশে কভু সে দেয় নি দেখা- মোর তোরণের তলে দাঁড়াল সে এসে! দাঁড়াল সে হেঁটমুখে চোখ তার ভরে গেছে নীল অশ্রুজলে! মীনকুমারীর মতো কোন দূর সিন্ধুর অতলে ঘুরেছে সে মোর লাগি!-উড়েছে সে অসীমের সীমা! অশ্রুর অঙ্গারে তার নিটোল ননীর গলা, নরম লালিমা জ্ব’লে গেছে-নগ্ন হাত, নাই শাখা, হারায়েছে রুলি, এলোমেলো কালো চুলে খ’সে গেছে খোঁপা তার, বেণী গেছে খুলি! সাপিনীর মতো বাঁকা আঙুলে ফুটেছে তার কঙ্কালের রূপ, ভেঙেছে নাকের ডাঁশা,হিম স্তন হিম রোমকূপ! আমি দেখিয়াছি তারে ক্ষুধিত প্রেতের মতো চুমিয়াছি আমি তারই পেয়ালায় হায়! পৃথিবীর উষা ছেড়ে আসিয়াছি নামি কান্তারে- ঘুমের ভিড়ে বাঁধিয়াছি দেউলিয়া বাউলের ঘর, আমি দেখিয়াছি ছায়া, শুনিয়াছি একাকিনী কুহকীর স্বর! বুকে মোর, কোলে মোর- কঙ্কালের কাঁকালের চুমা! গঙ্গার তরঙ্গ কানে গায়,- ঘুমা, ঘুমা! ডাকিয়া কহিল মোর রাজার দুলাল- ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল, চুল যার শাঙনের মেঘ, আর আঁখি গোধূলির মতো গোলাপী রঙিন; আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে, স্বপ্নে-কত দিন! পতিতা আগার তাহার বিভীষিকাভরা, জীবন মরণময়! সমাজের বুকে অভিশাপ সে যে –সে যে ব্যাধি, সে যে ক্ষয়; প্রেমের পসরা ভেঙে ফেলে দিয়ে ছলনার কারাগারে রচিয়াছে সে যে, দিনের আলোয় রুদ্ধ ক’রেছে দ্বার! সূর্যকিরণ চকিতে নিভায়ে সাজিয়াছে নিশাচর, কালনাগিনীর ফনার মতন নাচে সে বুকের পর! চক্ষে তাহার কালকুট ঝরে, বিষপঙ্কিল শ্বাস, সারাটি জীবন মরীচিকা তার প্রহসন-পরিহাস! ছোঁয়াচে তাহার ম্লান হয়ে যায় শশীতারকার শিখা, আলোকের পারে নেমে আসে তার আঁধারের যবনিকা! সে যে মন্বন্তর, মৃত্যুর দূত, অপঘাত, মহামারী- মানুষ তবু সে, তার চেয়ে বড় –সে যে নারী, সে যে নারী! ওগো দরদিয়া -ওগো দরদিয়া তোমারে ভুলিবে সবে, যাবে সবে তোমারে ত্যজিয়া; ধরণীর পসরায় তোমারে পাবে না কেহ দিনান্তেও খুঁজে কে জানে রহিবে কোথা নিশিভারে নেশাখোর আঁখি তব বুজে! -হয়তো সিন্ধুর পারে শ্বেতশঙ্খ ঝিনুকের পাশে তোমার কঙ্কালখানা শুয়ে রবে নিদ্রাহারা উর্মির নিশ্বাসে! চেয়ে রবে নিষ্পলক অতি দূরে লহরীর পানে, গীতিহারা প্রাণ তবে হয়তো বা তৃপ্তি পাবে তরঙ্গের গানে! হয়তো বনচ্ছায়া লতাগুল্ম পল্লবের তলে ঘুমায়ে রহিবে তুমি নীল শষ্পে শিশিরের দলে; হয়তো বা প্রান্তরের পারে তুমি রবে শুয়ে প্রতিধ্বনিহারা- তোমারে হেরিবে শুধু হিমানীর শীর্ণাকাশ-নীহারিকা-তারা, তোমারে চিনিবে শুধু প্রেম জোছনা-বধির জোনাকি! তোমারে চিনিবে শুধু আঁধারের আলেয়ার আঁখি তোমারে চিনিবে শুধু আকাশের কালো মেঘ-মৌন-আলোহারা, তোমারে চিনিয়া নেবে তমিস্রার তরঙ্গের ধারা! কিংবা কেহ চিনিবে না, হয়তো বা জানিবে না কেহ কোথায় লুটায়ে আছে হেমন্তের দিবাশেষে ঘুমন্তের দেহ! -হয়েছিল পরিচয় ধরণীর পান’শালে যাহাদের সনে, তোমার বিষাদ-হর্ষ গেঁথেছিলে একদিন যাহাদের মনে, যাহাদের বাতায়নে একদিন গিয়েছিলে পথিক-অতিথি তোমারে ভুলিবে তারা- ভুলে যাবে সব কথা, সবটুকু স্মৃতি! নাম তব মুছে যাবে মুসাফের-অঙ্গারের পান্ডুলিপিখানি নোনা ধরা দেয়ালের বুক থেকে খসে যাবে কখন না জানি! তোমার পানের পাত্রে নিঃশেষে শুকায়ে যাবে শেষের তলানি, দন্ড দুই মাছিগুলো করে যাবে মিছে কানাকানি! তারপর উড়ে যাবে দূরে দূরে জীবনের সুরার তল্লাসে মৃত এক অলি শুধু পড়ে রবে মাতালের বিছানার পাশে! পেয়ালা উপুড় করে হয়তো বা রেখে যাবে কোনো একজন, কোথা গেছে ইয়োসোফ্‌ জানে না সে, জানে না সে গিয়েছে কখন। জানে না যে, অজানা সে, আরবার দাবি নিয়ে আসিবে না ফিরে- জানে না রে চাপা পড়ে গেছে সে যে কবেকার কোথাকার ভিড়ে! জানিতে চাহে না কিছু-ঘাড় নিচু করে কে বা রাখে আঁখি বুজে অতীত স্মৃতির ধ্যানে, অন্ধকার গৃহকোণে একখানা শূন্য পাত্র খুঁজে! যৌবনের কোন্‌ এক নিশীথে সে কবে তুমি যে আসিয়াছিলে বনরানি। জীবনের বাসন্তী-উৎসবে তুমি যে ঢালিয়াছিলে ফাগরাগ-আপনার হাতে মোর সুরাপাত্রখানি তুমি যে ভরিয়াছিলে-জুড়ায়েছে আজ তার ঝাঁঝ, গেছে ফুরায়ে তলানি। তবু তুমি আসিলে না, বারেকের তরে দেখা দিলে নাকো হায়! চুপে চুপে কবে আমি বসুধার বুক থেকে নিয়েছি বিদায়- তুমি তাহা জানিলে না-চলে গেছে মুসাফের কবে ফের দেখা হবে আহা কে বা জানে! কবরের পরে তার পাতা ঝরে, হাওয়া কাঁদে হা হা! সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয় চোখদুটো ঘুমে ভরে ঝরা ফসলের গান বুকে নিয়ে আজ ফিরে যাই ঘরে! ফুরায়ে গিয়েছে যা ছিল গোপন- স্বপন কদিন রয়! এসেছে গোধূলি গোলাপীবরণ-এ তবু গোধূলি নয়! সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়, আমাদের মুখ সারাটি রাত্রি মাটির বুকের পরে! কেটেছে যে নিশি ঢের- এত দিন তবু অন্ধকারের পাই নি তো কোনো টের! দিনের বেলায় যাদের দেখি নি-এসেছে তাহারা সাঁঝে; যাদের পাই নি ধুলায় পথের-ধোঁয়ায়-ভিড়ের মাঝে- শুনেছি স্বপনে তাদের কলসী ছলকে, কাঁকন বাজে! আকাশের নীচে- তারার আলোয় পেয়েছি যে তাহাদের! চোখদুটো ছিল জেগে কত দিন যেন সন্ধ্যা-ভোরের নট্‌কান রাঙা মেঘে! কত দিন আমি ফিরেছি একেলা মেঘলা গাঁয়ের ক্ষেতে! ছায়াধূপে চুপে ফিরিয়াছি প্রজাপতিটির মতো মেতে কত দিন হায়! -কবে অবেলায় এলোমেলো পথে যেতে ঘোর ভেঙে গেল, -খেয়ালের খেলাঘরটি গেল যে ভেঙে! দুটো চোখ ঘুম ভরে ঝরা ফসলের গান বুকে নিয়ে আজ ফিরে যাই ঘরে! ফুরায়ে গিয়েছে যা ছিল গোপন-স্বপন কদির রয় এসেছে গোধূলি গোলাপীবরণ-এ তবু গোধুলি নয়! সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়- আমাদের মুখ সারাটি রাত্রি মাটির বুকের পরে! দেখুন

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.