আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মিছিল ও নিখোঁজ

ভালোবাসার ঊর্বশী বুকে লেখা আছে এক নাম- সে আমার দেশ, আলগ্ন সুন্দর ভূমি- বিমূর্ত অঙ্গনে প্রতিদিন প্রতিরাত জেগে ওঠে তার উদ্ভাসিত মুখ

দীর্ঘ তিন মাস পর আজ ভার্সিটি খুলেছে। শীলা তার গ্রামের বাড়ি খুলনার রামপাল থেকে অনেক কষ্টে দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে গতাকাল সন্ধ্যায় রোকেয়া হলে উঠেছে। হলে ছাত্রী ফিরে এসেছে খুব কম। সরকারের হেয়ালী হুকুমে ভার্সিটি বন্ধ হয়েছিলো। আবার সরকারী নির্দেশেই খুলেছে তা।

প্রথম দিনে ভার্সিটিতে ছাত্রছাত্রীদের আগমন তেমন একটা ছিলো না। ক্লাশও তেমন হয়নি। স্যারদের কাছ থেকে শীলা শুনেছে কী কারণে যেন আবারও ভার্সিটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। গতরাত নানা দুঃস্বপ্নে কেটেছে শীলার। আজ তাই মনটা ভালো নেই।

তার অন্তরে বইছে গ্রীষ্মের খররৌদ্রের উত্তাপ। ভার্সিটির এ অনিয়ম তার আর ভালো লাগে না। বিকেলে কী ভেবে একা একাই বের হয় সে। রমনা পার্কের লেকের ধারে একটা বেঞ্চে এসে বসে তারপর। রাজধানীর গণ্ডিবদ্ধ জীবনে গ্রামের সবুজ ছায়ার মতো এ রমনা পার্কও আজ তার ভালো লাগছে না।

অন্তরে কী যেন বিয়োগ ব্যথা বারবার কাতর করছে তাকে। গ্রীষ্মের দুপুরের এ দাউদাউ দহনের সাথে তার মনের একটা মিল খুঁজে পাচ্ছে সে। তার নজর পড়ে লেকে ফোটা রক্তরং শাপলাগুলোর উপর। থরে থরে সাজানো শাপলাগুলোর যেন রক্তাক্ত হৃদপিন্ডের মতো লাগছে তার কাছে। মনের অজান্তেই মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে তার একটি নাম- শিপলু।

রক্তশাপলাগুলোর উপর ভেসে ওঠে শিপলুর রক্তাক্ত মুখের ছবি। শিপলু-শিপলু ডাকতে ডাকতে গলা প্রায় ভেঙ্গে যায় শীলার। শিপলু পেছন ফিরে দেখে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে শীলা তাকে ডাকছে। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে আসে শিপলু। কাছে এসে দেখে শীলার চোখেমুখে হতাশার ছায়া।

শীলা বলে- আগামীকাল নাকি তুমি মিছিলে যাচ্ছো? শিপলু প্রত্যুত্তর করে- হঁ্যা, কেন? এসো সামনে হাঁটি। কিছুক্ষণ ক্যাম্পাসে হাঁটাহাঁটি আর আলাপচারিতার পর শিপলু শীলাকে হলে যেতে বলে। কারণ দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে। শীলা এখনও চিন্তিত। শিপলুকে বলে- আজ বিকেল সাগে চারটায় রমনা পার্কে লেকের ধারে দেখা হবে কেমন? এখন আসি।

কালকের মিছিল নিয়ে আজ নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় শিপলুরও তেমন ভালো লাগছিলো না। কী কারণে যে শীলাকে জীবনে জড়াতে গেলো! ঢাকা কলেজ থেকে পাস করা মেধা তালিকার প্রথম দিকের ছাত্র ছিলো শিপলু। ভার্সিটি জীবনে পরিচয় ঘটে শীলার সাথে। শিপলুদের গ্রামের বাড়িও খুলনাতে। কিন্তু ওর বাবা-মা ঢাকাতেই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে।

মাঝে মাঝে শিপলু দীর্ঘ ছুটিতে দাদার বাড়ি বেড়াতে যায়। সেখানে শীলার সাথেও দেখা হয়। এভাবেই ভালোলাগা থেকে ভালোবাসার সূত্রপাত হয় দ'ুজনার মনে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে রমনা পার্কে এসে পেঁৗছায় শিপলু। শীলা তাকে দেখে বসতে বলে।

শিপলুকে যেন আজ অন্য মানুষ মনে হচ্ছে শীলার। খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে। শিপলুর মাথা তার কোলে টেনে শুইয়ে দেয় তাকে বেঞ্চের উপর। অপলক চেয়ে থাকে দু'জন দু'জনার দিকে। একসময় নিরবতা ভেঙ্গে শীলা বলে- আচ্ছা সাহেব, কালকে কেন মিছিলে যাওয়া হচ্ছে শুনি? শিপলু আকাশের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে- দেখো আমরা বাঙ্গালীরা ক'বছরই বাঁচি? বিদেশে নিচের ক্লাশ থেকেই প্রত্যেক ছেলেমেয়ে তার পছন্দ অনুযায়ী সাবজেক্ট নিয়ে পড়ে।

আমাদের দেশে সে নিয়ম তো নেয়ই বরং মাধ্যমিক পর্যন্ত আরও দু'বছর বাড়িয়ে সবাইকে ইচ্চার বিরুদ্ধে পড়ানো হবে। এরকম সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকারের শিক্ষা কমিশন। আর সিলেবাস যে কী হবে তাতো ভালো করেই জানো। চাকরির বয়সসীমা বাড়ছে না অথচ শিক্ষাজীবন বাড়ছে। একটা ছেলেমেয়েকে স্নাতকোত্তর পাস করতে কতো বছর লাগবে হিসেব করে দেখো।

এতোক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে শীলা। তারপরও বলে- আচ্ছা, তুমি না আমাকে বলেছিলে রাজনীতি করবে না। শিপলু তেমন গম্ভীর কণ্ঠেই বলে- এটাতো শুধু রাজনিিতর ব্যাপার না, এটা হলো ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। নিষ্পেষিত, শোষিত মানুষ যারা তাদের ছেলেমেয়ে মানুষ করতে চায় তাদের জন্য এ সংগ্রাম। এ সংগ্রাম নিপীড়িত মানুষের সংগ্রাম বলেই তো সব রাজনৈতিক দল এক হতে পেরেছে।

প্লীজ, এতে আমাকে বারণ ক'রোনা লক্ষ্মীটি। শীলা অশ্রুসজল চোখে আদরের চুম্বন দিয়ে শিপলুকে বলে- কেন বারণ করবো? আরে এতো সবারই সংগ্রাম। রাজনীতির প্রতি যে ঘৃণাটা শীলার ছিলো তা তখন শ্রদ্ধায় রূপ নেয়। এতোক্ষণে যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে তারা দুজন টেরই পায়নি। শীলা বলে- চলো উঠি, সন্ধ্যা হয়ে গেছে।

তারা রমনা থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে সোজা ভার্সিটি চলে আসে। শিপলু তাকে রোকেয়া হলের করিডোর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। দু'জনের কণ্ঠ থেকে একই সাথে বেরিয়ে আসে- খোদা হাফেজ! পরদিন শুরু হয় বিশাল মিছিল। হাজার হাজার ছাত্রজনতার ভিড়ে রাজপথ লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। রিক্সা-গাড়ি-বাস বন্ধ হয়ে যায়।

মিছিল শিক্ষাভবনের দিকে এগুতে থাকে। কিন্তু হাইকোর্টের সামনে এসেই পুলিশের ব্যারিকেডে বাধাপ্রাপ্ত হয়। নির্লজ্জ সরকার আগে থেকেই আজকের মিছিলের কথা শুনলেও কোনো আলোচনায় বসেনি। বরং পুলিশকে দিয়ে রাখে নির্মম আদেশ। চলে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, গরম পানি ছিটানো আর ছাত্রছাত্রীদের সাথে ধস্তাধস্তি ও পিটুনি।

সবশেষে ঘাতকরা নির্বিচারে ছাত্রদের প্রতি গুলি চালায়। এতে কয়েকজন সাহসী প্রাণ ঝরে পড়ে অকালে। আর নিহত লাশের উপরও চলে পাশবিক অত্যাচার। হল থেকেই শীলা গুলির আওয়াজ শুনতে পায়। প্রানটা তখনই তার আঁতকে ওঠে।

কিছুক্ষণ পর কলাভবনের সামনে মিছিলের স্ল্লোগান শুনতে পায়। সে বারান্দা থেকে স্পষ্ট দেখতে পায় একটা লাশ মিছিলের সামনে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে ছাত্ররা। তাড়াতাড়ি নিচে এসে শীলা ছোটে কলাভবনের দিকে। টলতে টলতে সে কলাভনের সামনে এসে দাঁড়ায়। শিপলুর কথা ভেবে তার পায়ের তলার মাটি যেন সরে যাচ্ছে।

যে লাশটি ছিনিয়ে এনেছে ছাত্ররা সহস্র লোকের ভিড়ে সে লাশটির মুখও দেখতে পাচ্ছে না। ইতোমধ্যেই আবার সেখানে শুরু হয় পুলিশের হামলা। সবাই যে যেদিকে পারে পালিয়ে বাঁচে। শীলা কোনোমতে নিজেকে বাঁচিয়ে ভার্সিটি ছেড়ে গ্রীনরোডের গ্রীনকর্ণারে তার বান্ধবীর বাসায় ওঠে। রাতে সে খবর পায় ভার্সিটির হল থেকে নাকি সব ছাত্র-ছাত্রীদের বের ক'রে দেয়া হয়েছে।

ছাত্রদের পিটিয়েছেও অনেক। মেয়েদের সাথেও নাকি পুলিশ অশালীন ব্যবহার করেছে। শিপলুদের বাসায় ফোন করেও তাকে পায় না শীলা। শিপলুকে নাকি খুব খোঁজাখুঁজি চলছে, সে বাড়ি ফেরেনি। ব্যর্থমনে পরদিন সে তার বান্ধবীর সহায়তায় খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

মনটা তার অজানা বেদনায় কাঁদতে থাকে। এর পরদিন থেকে সমস্ত ঢাকা শহরে চলে কারফিউ। শীলা গ্রাম থেকেই খবর পায় বেশ কয়েকদিন চলেছে এ অবস্থা। এরপর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে। শীলা শিপলুদের বাসায় ফোন ক'রে জানতে পারে তাকে নাকি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বাসায়ও ফেরেনি, কেউই বলতে পারেনি তার কথা। এতোক্ষণ শীলা রক্তশাপলাগুলোর দিকেই তাকিয়েই ছিলো। আর ডুবে গিয়েছিলো অতীতের অতলান্তে। কখন যে সন্ধ্যা নেমেছে টের পায়নি সে। তার সহপাঠি রাজিব এসময়ে শীলাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়।

জোরে চিৎকার দিয়ে ডাকে তাকে। সম্বিৎ ফিরে পায় শীলা। হঠাৎ কঁকিয়ে ওঠে- শিপলু! শিপলু!! আর তার চোখে বেয়ে পড়তে থাকে অঝোর জলের ধারা। 07.04.1983

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.