আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাবুল: বারী ভাই, চলার পথের সবচে' বড় বন্ধু আমাদের

সময়, কবিতা, ছোটগল্প, দেশ, দেশাচার

আফগানিস্তানের কাবুলে আমরা চারজন। দু'দিন আগে ঢাকা থেকে দিল্লী হয়ে এখানে এসেছি। উদ্দেশ্য ইরানী ভিসা জোগার করে ইরান, তুরস্ক হয়ে গ্রীস। সেখানে জাহাজে কিছুদিন চাকুরী করে পয়সা জমিয়ে ইউরোপের পছন্দসই কোন দেশে পড়াশোনা। সম্বল একশো পাউন্ড ও একটি স্কটিশ ডলার আর বুকভরা সাহস।

সস্তা একটি হোটেলে উঠলাম। তবে আমাদের জন্যে যথেষ্ট দামী। ইরানী দুতাবাসে ভিসা চাওয়ার পর বললো, গো ব্যাক টু বাংলাদেশ এন্ড কালেক্ট ভিসা। আমাদের সাহস তখনই অর্ধেক হয়ে গেল। এখন যাব কোথায় ? দেশে ফিরে যাব শুরতেই? ঠিক করলাম বাংলাদেশ দুতাবাসে যাব ও অনুরোধ করবো একটি নোট দেবার জন্যে।

বাংলাদেশ দুতাবাসে গিয়ে ওখানকার ভারপ্রাপ্ত এ্যামবেসেডারকে কথাটি বলতেই রেগে গেলেন নোয়াখালীর এই ভদ্রলোক। "হেরা তো আংগোরে ফহির মনে করে, মিসকিন মনে করে, আই লেখলেও হেইডাই কইব। আন্নেরা দেশে চলি যান, আই কিছু করবার পাইরত্বাম না"। অনেক অনুরোধ করলাম, যতই করি ততো বেশী রেগে যান। শুকনো মুখে দুতাবাস থেকে বেরুনোর সময়েই দেখা হলো বারী ভাই এর সাথে।

আমাদের আমাদের সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করলেন ও ঠান্ডা মাথায় শুনলেন। শুনে তার বাড়ীতে দেখা করতে বললেন আমাদের। তার বাড়ীতে যাবার পর ওনি এ্যামবেসেডারে সাথে কথা বলবেন বলে জানালেন, সেই সাথে তার বাড়ীতে ড্রয়িংরুমে আমাদের থাকার জায়গা দিলেন। আমরা তো হাত চাদ পেলাম। হোটেল খরচ দিতে দিতে আমরা তো ক'দিনেই ফতুর প্রায়।

প্রথম দিনই আমাদের একান্ত আপন করে নিলেন ওনি। আমাদের মাঝে বয়েসে বড় বন্ধুটি দেশে সাংবাদিকতা করতো, তাকে ডাকতেন সাংবাদিক বলে, একজনের নাম হলো সাহিত্যিক, আরেকজনের নাম ফিলোসফার। আর আমি সর্বকনিষ্ঠ, নাম দিলেন নটি বয়। আর এই নটি বয়টিকেই ভালবাসতেন সবচেয়ে বেশী। বারী ভাই একাই থাকতেন কাবুলে।

দেশে স্ত্রী কন্যা থাকলেও এখানে আনাতে পারেন নি। দুতাবাসের একজন সাধারণ অফিসারের বেতনে সবাইকে নিয়ে সংসার চালানো সম্ভব ছিলনা। তাছাড়া পরিবারের অন্যান্য সদস্যের প্রতিও দ্বায়িত্ব পালন করতে হতো। তবে তারা ওনার স্ত্রী কন্যার প্রতি সে দ্বায়িত্ব পালন করতেন না বলে ভীষন মানসিক কষ্টে ভুগতেন বারী ভাই। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই বলতেন, নটি বয়, চলো বাজারে যাই।

আমিও ছুটতাম তার পেছনে পেছনে। একগাদা মাংস, শাকসবজী কিনে ফিরতাম আম দু'জনে। আমাদের সাহিত্যিক রান্নায় পটু। তাকে রান্নার দ্বায়িত্ব দিয়ে বলতেন, ভালো করে রান্না করবে, বিকেলে এসে খাব একসাথে। কিন্তু বিকেলে এসেই বারী ভাই ঢুকতেন শোবার ঘরে মদের বোতল নিয়ে।

তখন অনেক ডাকডাকি করলেও বেরুতে চাইতেন না। যখন বেরুতেন, দেখতাম চোখে জল। কোনক্রমে খাবারটুকু খেয়েই আবার ঢুকতেন শোবার ঘরে। তার যন্ত্রণা, অসহনীয় কষ্ট আমরা টের পেতাম, সমব্যথী হতাম, কিন্তু তা লাঘবের কোন ক্ষমতা ছিল না আমাদের। বারী ভাইএর অনুরোধে এ্যামবেসেডার নোট দিলেন।

আমরা তা নিয়ে আবার ইরানী দূতাবাসে গেলাম। ওরা আমাদেরকে বারোশ ডলার যে সাথে আছে, তার দেখাতে পারলে ভিসা দেবে বললো। আমার মাথায় হাত দিয়ে বসলাম। বারোশ ডলার আমাদের কাছে তখন পাহাড় প্রমান অংক। আমাদের কাছে তো নেইই, বারী ভাইএর কাছেও নেই।

ইতিমধ্যে সাংবাদিক বন্ধু এক আফগানী সাংবাদিকের সাথে পরিচিত হয়েছিল। একদিনে সে আফগানী সাংবাদিক আমাদের এক সংবাদপত্রের অফিস ও কাবুল শহর ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। আমাদের সাংবাদিক বন্ধু তাকে একটা হাতির দাঁতের (বাংলাদেশ থেকে আনা) আংটি দিয়ে বলেছিল, ইয়ে হ্যায় মেরা পেয়ারকা নিশানা'। আমাদের টাকার সমস্যা শুনে উধাও হলেন ইনিও। তখন নটি বয়ের নটি পরামর্শ কাজে লাগলো।

কাবুল থেকে বেশ কিছু বিলাসবহুল বাস ইরানের মেশাদ শহর অবধি আসাযাওয়া করে। নটি বয়ের বুদ্বি হলো, আমরা যদি এমনি কোন এক বাস কোম্পানীর টিকিট কিনব বলে কথা দিই আর ওরা তার বিনিময়ে টাকাটি যদি একদিনের জন্যে আমাদের ধার দেয়। বারী ভাইএর বাসার সামনে থেকেই বাস ছাড়তো ও এক বাসমালিকের সাথে পবিচয়ও ছিল তার। আমরা সবাই মিলে তার কাছে গেলাম। আমাদেরকে একটা কাগজে অনেক কিছু লিখে সই করতে হলো, টাকাও পেলাম।

পরদিন টাকা নিয়ে ইরান দুতাবাসে। ওরা টাকার কথা জানতে চাইলো, আমি পকেট দেখিয়ে দিলাম। ওরা তা দেখলোও না, পকেট দেখেই সন্তুষ্ট, ভিসা দিয়ে দিল। আমরা আনন্দে বিভোর হয়ে বাড়ী পিরে এলাম। আমরা চলে যাব শুনে সেদিন সন্ধ্যায় বারী ভাই কাঁদলেন খুব।

আমিও চোখের জল চেপে রাখতে পারলাম না। পরদিন বাস কোম্পানীকে টাকা ফিরিয়ে দিলাম। ওরা আমাদের অবস্থা বুঝে আমাদেরকে সস্তা কোন বাস কোম্পানীর টিকিট কেনার অনুমতি দিল। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাচলাম, কারন এ বাসের টিকিট কেটে প্রায় ফতুর হতে হতো আমাদের। বারী ভাই আমাদের আরো একদিন থেকে যেতে বললেন।

আমরা সানন্দে ওনার কথা রাখলাম। বিদায়ের দিন সকালে বাস ষ্টেশানে রওয়ানা হবার কথা। ট্যাকসি ভাড়া বাচানোর জন্যে অনেকটা দুরে হেটে যেতে হবে। তাই বেশ একটু আগেই ঘুম থেকে উঠলাম। বারী ভাইও উঠলেন।

ওনি আমাদেরকে তাড়াহুড়ো না করতে বললেন। নিজে ট্যাকসি নিলেনও আমাদের সাথে বাস ষ্টেশন অবধি আসলেন। বিদায়ের সময় জড়িয়ে ধরে কেঁদে যে কোন অবস্থাতেই সাহায্য করবেন বলে জানালেন। আমরা চোখের জল মুছে বাসে উঠে মেসাদের দিকে তিনদিনের যাত্রাপথে পা ফেললাম। আজ এত বছর পর এ ঘটনার কথা লিখতে এখনও মন ভারী হয়ে আসছে আমার।

আমার নাবিক জীবনের কথা কিছুটা লিখেছি। আমরা চারবন্ধু তিন জাহাজে। চিঠিপত্র পেতে দেরী হতো বেশ। চিঠি পৌছুত জাহাজ কোম্পানীতে। সেখান থেকে পাঠানো হতো বন্দরে।

সৌদী আরবের গিজান বন্দরে চিঠি পেলাম এক বন্ধুর। শোকে পাথর হয়ে গেলাম আমরা দ'ুজন চিঠিটি পড়ে। বারী ভাই ছিলেন আমাদের এই চড়াই উতরাই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু। আমাদের প্রিয় সেই ভাই তার কাবুলের বাড়ীর বাবান্দা থেকে নীচে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.