আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিপিএলে গ্ল্যাডিয়েটরস-লজ্জা

২০১২ সালে বিপিএলের প্রথম আসর নিয়েও বিতর্কের শেষ ছিল না। এ-জাতীয় টুর্নামেন্টে যেটি বিতর্কের অপরিহার্য অনুষঙ্গ, যথারীতি সেই ফিক্সিংও ছিল এর মধ্যে। তবে ম্যাচ পাতানো বিতর্ক নিয়ে ঝড় ওঠে গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বিপিএলের দ্বিতীয় আসরে। ২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরস-চিটাগং কিংস ম্যাচটিই ছিল সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত। তবে আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের (আকসু) সন্দেহের তালিকায় ছিল ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের আরও দুটি ম্যাচ।

১১ ফেব্রুয়ারি মিরপুরে খুলনা রয়্যাল বেঙ্গলস ও পরদিনই বরিশাল বার্নার্সের বিপক্ষে সেই দুটি ম্যাচেও ফিক্সিংয়ের প্রমাণ পেয়েছে আকসু।
২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে চিটাগং কিংসের কাছে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের পরাজয়টা যে পূর্বনির্ধারিত ছিল, সেটি ওই ম্যাচের দর্শকদের না বুঝে উপায় ছিল না। অভিনয়টা ছিল এমনই কাঁচা।
শেষ মুহূর্তে মাশরাফিকে সরিয়ে আশরাফুলকে অধিনায়ক করা, ঢাকার ইনিংসে শুরুতেই ব্যাটসম্যানদের আউট হয়ে যাওয়ার ব্যগ্রতা, পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে মাত্র ১৫ রান, ইংলিশ ব্যাটসম্যান ড্যারেন স্টিভেনসের অদ্ভুতুড়ে রানআউট, ১৯তম ওভারে আউট হওয়ার আগে আশরাফুলের স্বভাববিরুদ্ধ ৪৮ বলে ৩৩ সন্দেহের ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছিল তখনই। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আকসুর কাছে আশরাফুল স্বীকার করেছেন, গ্ল্যাডিয়েটরসের মালিক সেলিম চৌধুরী এবং তাঁর বড় ছেলে শিহাব চৌধুরী ম্যাচের আগেই বলে দিয়েছিলেন, এই ম্যাচে হারতে হবে।

শুধু ম্যাচ হারাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না এই ‘ফিক্সিং’। সঙ্গে স্পট ফিক্সিংয়ের দুটি ব্যাপারও ছিল। যার কোনোটিতেই অবশ্য ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকের ইচ্ছা পূরণ হয়নি।
প্রথম স্পট ফিক্সিংটা হয়েছিল ৫-৬-৭—এই তিন ওভার নিয়ে। যাতে ৩৫ বা এর বেশি রান দিতে হবে।

এই তিন ওভার কাকে কাকে দিয়ে বোলিং করাতে হবে, সেটিও আশরাফুলকে বলে দেওয়া হয়—এক বিদেশিকে দিয়ে শুরু করে বাংলাদেশের দুই আন্তর্জাতিক বোলার মাহবুবুল আলম (রবিন) ও মোশাররফ হোসেন (রুবেল)। ওই তিনজনের সঙ্গে সব ঠিক করা আছে বলেও আশরাফুলকে জানান ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিক। কথা অনুযায়ী আশরাফুল এই তিনজনকে ওই সময়ই বোলিংয়ে আনেন। কিন্তু বোলারদের রান দিতে আপ্রাণ চেষ্টার পরও ওই তিন ওভারে চট্টগ্রামের ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় ২৮ রানের বেশি হয়নি।
মোশাররফ ও মাহবুবুল অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

কাল মুঠোফোনে মোশাররফ প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘জানি না কীভাবে এসব ছড়াচ্ছে। হতে পারে কেউ ষড়যন্ত্র করছে। আমাকে এ রকম কোনো প্রস্তাবই কেউ কখনো দেননি। ’ মাহবুবুলের দাবি, ‘এ রকম কোনো কিছুই ঘটেনি। যা শুনেছেন ভুল শুনেছেন।

আমি এ রকম কোনো অফার পাইনি। এ রকম কিছু করিওনি। ’
চিটাগং কিংসের বিপক্ষে ম্যাচে দ্বিতীয় স্পট ফিক্সিংটা ছিল ১৬ থেকে ১৯—এই চার ওভারে ৬০ বা এর বেশি রান দিতে হবে। স্পট ফিক্সিংয়ের জন্য নির্ধারিত ওভারগুলো একটা কাগজে লিখে আশরাফুলকে দিয়ে দিয়েছিলেন ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকের ছেলে। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই সর্বশেষবার ঢাকায় এসেছিলেন আকসু প্রতিনিধিরা।

এই চার ওভারের প্রথম তিনটিতে মাত্র ১৩ রান ওঠার পর ১৯তম ওভারটি করতে আসেন আশরাফুল। সেই ওভারে মাত্র ১ রান দিয়ে একটি উইকেটও পান। আশরাফুল হয়তো বোলিংয়ে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছেন। কারণ, স্পট ফিক্সিং যে ব্যর্থ হতে যাচ্ছে, সেটি তো ওই ওভারের আগেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। এক ওভারে ৪৭ রান দেওয়া তো আর সম্ভব নয়!
মজাটা হলো, যে মোশাররফ রুবেলের রান দেওয়ায় বড় ভূমিকা পালন করার কথা ছিল বলে অভিযোগ, ব্যাটসম্যানদের ‘ব্যর্থতায়’ উল্টো মাত্র ১৭ রান দিয়ে তিনি ২ উইকেট পেয়ে যান।

এই ম্যাচে স্পট ফিক্সিংয়ের অংশটুকু চিত্রনাট্য অনুযায়ী না হলেও ম্যাচ হারতে সক্ষম হওয়ায় ঢাকায় ফেরার পর আশরাফুলকে ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিক ১০ লাখ টাকার একটি চেক দেন।
আশরাফুলের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় খুলনার বিপক্ষে ম্যাচে শুধু স্পট ফিক্সিংই হয়েছিল। সেটি হলো ৪-৫-৬—এই তিন ওভারে ৩৯ রান করতে হবে। সেটি নিশ্চিত করার জন্য ওপেনার ও টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের ছক্কা মারার জন্য বিশেষ পুরস্কারও ঘোষণা করেছিলেন গ্ল্যাডিয়েটরসের মালিক। কিন্তু ওই তিন ওভারেই উইকেট পড়ায় ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরস ১৩ রানের বেশি করতে পারেনি।

৪৫ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে উল্টো ঢাকার হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত আশরাফুলের সেঞ্চুরিতে ঢাকা সেই ম্যাচ জেতে, তবে তাতে প্রতিপক্ষ খুলনা দলেরও ভূমিকা ছিল কি না, এ নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ এবং কিছু প্রমাণও পেয়েছে আকসু। এই ম্যাচে জেতার পরও ঢাকার ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকের বিমর্ষ ভাব সাংবাদিকদের মধ্যেও তখন আলোচনার খোরাক হয়েছিল। ম্যাচ জেতার চেয়ে যে ৪-৫-৬ ওভারে ৩৯ রান দেওয়াটা তাঁদের অর্থাগমের জন্য বেশি জরুরি ছিল।
পরদিনই অর্থাৎ ১২ ফেব্রুয়ারি বরিশালের বিপক্ষে ম্যাচে ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিক ও তাঁর ছেলে প্রথমে আশরাফুলকে হারার কথা বললেও পরে ঠিক হয়, ঢাকা জেতার জন্যই খেলবে।

তবে স্পট ফিক্সিং অনুষঙ্গ এখানেও ছিল: ৬-৭-৮—এই তিন ওভারে ৩৫ বা এর বেশি রান করতে হবে। এখানেও বোলাররা ‘ব্যর্থ’, ওই তিন ওভারে রান হয়েছে মাত্র ১৪। এই ম্যাচের আগে আবার ভারতীয় এক বুকির কাছ থেকে আশরাফুলের কাছে প্রস্তাব আসে, এই ম্যাচ হারাতে পারলে ৮০ লাখ টাকা দেওয়া হবে। প্রথম আলোর কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, আকসুর কাছে আশরাফুল দাবি করেছেন, এই প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তবে সেই ম্যাচেই সাকিব আশরাফুলের দোষে রানআউট হন, আশরাফুল নিজে করেন ৩১ বলে ২০ এবং ঢাকা হেরে যায়।


বরিশালের সঙ্গে ম্যাচে স্পট ফিক্সিং চিত্রনাট্য অনুযায়ী কাজ না করায় এবং ম্যাচ হেরে যাওয়ায় আশরাফুল অন্য কোনো বুকির হয়ে কাজ করছেন কি না, মালিকপক্ষের মনে এই সন্দেহ জাগে। যে কারণে ১৪ ফেব্রুয়ারি চিটাগং কিংসের বিপক্ষে পরের ম্যাচে মাশরাফি অধিনায়ক হয়ে ফেরার পর আশরাফুলকে ব্যাটিং অর্ডারে নামিয়ে দেওয়া হয়। প্রথমে ব্যাটিং করে ঢাকা ৬ উইকেটে ১৬৮ করে। আশরাফুলকে ব্যাটিংয়ে পাঠানোই হয়নি।
আকসুর কাছে বিপিএল-সংক্রান্ত আশরাফুলের স্বীকারোক্তিতে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের মালিক সেলিম চৌধুরী ও তাঁর ছেলে শিহাব চৌধুরী ছাড়াও দলের ইংলিশ কোচ ইয়ান পন্ট, বাংলাদেশের দুই বোলার মোশাররফ হোসেন (রুবেল) ও মাহবুবুল আলমের (রবিন) নাম এসেছে।

এসেছে দুই শ্রীলঙ্কান খেলোয়াড়ের নামও। পন্ট অবশ্য দুই দিন আগে ইংল্যান্ডের এক পত্রিকার কাছে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ঘটনার শুরু অবশ্য এবারের বিপিএল শুরুর আগেই। আকসুকে আশরাফুল জানিয়েছেন, এ বছর বিপিএলের নিলামের আগে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের মালিক সেলিম চৌধুরীর কাছে ২০১২ বিপিএলের পাওনা চাইলে তিনি তাঁকে বনানীতে তাঁর অফিসে যেতে বলেন। সেখানে সেলিম চৌধুরী আশরাফুলকে বলেন, এবার বিপিএলে বেশ কয়েকটি ম্যাচে ইচ্ছা করে হারতে হবে।

তাহলে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরস দলের খেলোয়াড়দের গতবারের বকেয়াসহ এবারের চুক্তির সব টাকা সময়মতো পরিশোধ করতে পারবে।
ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের প্রধান নির্বাহী গওহর রাওয়াতও এই চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে ঘোর সন্দেহ আছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড যেখানে বছরের পর বছর ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী দিয়ে কাজ চালিয়ে যায়, সেখানে গত বিপিএলে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের প্রধান নির্বাহী নিয়োগ দেওয়াটা একটু বিস্ময় হয়েই এসেছিল। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবর ইঙ্গিত দিচ্ছে, বাজিকরদের সঙ্গে মালিকের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করার জন্যই গৌরব নামে বেশি পরিচিত রাওয়াতকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের মালিকানার অংশীদারিও গওহর রাওয়াতকে দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।

রাওয়াত নিজেও বুকি কি না, এ নিয়েও সন্দেহ আছে। এই রাওয়াত আবার শ্রীলঙ্কা প্রিমিয়ার লিগের (এসএলপিএল) দল রুহুনা রয়্যালসের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। যে দলে খেলে এসেছেন মোহাম্মদ আশরাফুল।
বিপিএলে ফিক্সিং নিয়ে আশরাফুলের স্বীকারোক্তিতে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের সংশ্লিষ্টতা মোটামুটি প্রমাণিত হয়ে গেছে। অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোও যে ধোয়া তুলসী পাতা, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।

এই সূত্র ধরে আকসুর তদন্ত আরও ডালপালা ছড়ালে এটি প্রমাণিত হতেও হয়তো সময় লাগবে না যে, বিপিএল যতটা ক্রিকেট, তার চেয়ে বেশি ‘জুয়ার আখড়া’। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.