আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আত্মসম্মান

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। আত্মসম্মান মোহাম্মদ ইসহাক খান রাস্তার পাশে বসে বসে ইট ভাঙছে অনেক শ্রমিক, ঠক ঠক আওয়াজ হচ্ছে। ধুলোয় ধূসরিত জায়গাটা, প্রায়ান্ধকার।

আমার সেখানে দাঁড়ানোর কথা নয়, দ্রুত পার হয়ে যাওয়ার কথা। তবুও আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। একটা বিষয় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। অনেক শ্রমিকের মধ্যে বসে বসে কাজ করছেন একজন অশীতিপর বৃদ্ধ। তাঁর পরনে একটা ছেঁড়া লুঙ্গি, মাথায় বাঁধা গামছা, খালি গা, পাঁজরা গোণা যায়, কঙ্কালসার শরীর।

এই বয়সে কড়া রোদে পুড়ে কাজ করছেন, তাও আবার এমন খাটুনির কাজ, আমার কৌতূহল হল। বাঙালীর আর কিছু থাকুক আর না থাকুক, কৌতূহলটা থাকে। আমি উনার পাশে এসে দাঁড়ালাম, তিনি আমাকে আড়চোখে এক নজর দেখেই আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। আমি গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, "ও চাচামিয়া। " তিনি হাতুড়ি দিয়ে ইটে আরেকটা ঘা মেরে বললেন, কী বলবেন বলেন।

এই বয়সেও মজুরের কাজ করছেন? করতেছি। আপনের কোন অসুবিধা? না না, অসুবিধা হবে কেন? এই বুড়ো বয়সে তো একটু বিশ্রাম করার কথা। আপনার ঘটনাটা একটু বলবেন? কোন ঘটনা নাই। বলেন না, চাচা। আমার শুনতে বড় ইচ্ছা হচ্ছে।

মানুষটি আমার বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রহ দেখে হাতুড়িটা রেখে দিলেন। কপালের ঘাম মুছলেন। তারপর বললেন, আমার বাড়ি যমুনার পাড়। আট কেলাস (ক্লাস এইট) পর্যন্ত পড়ছি। তারপর বাপ মইরা গেল, আর লেখাপড়া হয় নাই।

ঢাকা শহরে আইলাম, রিশকা চালানো, চা বিক্রি এইসব শুরু করলাম। তারপর একসময় পাকাপাকি দিনমজুর হইয়া গেলাম। মাঝে মইদ্ধে দেশের বাড়িতে যাইতাম, বউ-পোলাপানের লগে সময় কাটাইয়া আইতাম। কিন্তু যমুনার ভাঙ্গনে ভিটামাটি সব হারাইলাম। ঢাকা শহরে পাকাপাকি চইলা আইলাম।

বস্তিতে থাকতাম, দিনমজুরি করতাম। এক পোলায় মইরা গেল জ্বরে, পরিবার মইরা গেল বাসের তলে পইড়া। আরও দুই পোলা আছিল, এহন বিয়া কইরা দুইজনে কই চইলা গেছে জানি না, খবর লয় না। তারমানে এখন আর আপনার কেউ নেই? না। আমি লক্ষ করলাম, কেউ নেই বলতে বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর একটুও কাঁপল না।

আমি বলবো না বলবো না করে বলেই ফেললাম, কিন্তু আপনার বয়সীরা তো ... ... তিনি আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, কাজ কইরা খায় না, এই তো? ভিক্ষা কইরা খায়। কিন্তু আমি ভিক্ষা করমু ক্যান? নবীর শিক্ষা কোরোনা ভিক্ষা, মেহনত করে খাও, জানেন না? বৃদ্ধের ফোকলা মুখে একটু হাসি খেলে যায়। তিনি আবার বললেন, এই বুড়ার শরীরে এহনো জোর আছে মিয়াভাই, আঁতুর হইয়া ঘরে পড়ি নাই। তাছাড়া কেউ খোঁজখবর লয় না, আমি কেমন আছি, কী খাই। কাম না কইরা বয়সের কথা চিন্তা করলে তো আর প্যাট ভরবো না।

আমি কিছু বললাম না। সত্যিই তো, মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা তার পেট, উদর, খিদে। এটা ঠিক তো বাকি সব ঠিক। আর এটাতে দুর্বলতা তো সবকিছুতেই সমস্যা, গোলমাল। সবার আগে তাই মানুষ চিন্তা করে সে কীভাবে খাবার জোটাবে; শিক্ষাদীক্ষা, উন্নত জীবনযাত্রা পরের কথা, আগে খেয়ে তো বাঁচি।

বৃদ্ধ বলে চললেন, শুনেন ভাই, আমি অতি দরিদ্র মানুষ। বুড়া, দুর্বল। বাম চোখে ছানি পড়ছে, দেখি না। পরিবার, বিষয়-আশয় সব গেছে, কিছুই নাই। কিন্তু আমার একটা মান-সম্মান আছে, ওইটা যায় নাই।

না খাইয়া রাস্তায় পইড়া পইড়া মরলেও আমি কারো কাছে হাত পাতুম না, গতর খাটাইয়া যতদিন খাইতে পারি, ততদিন খামু, আর না পারলে না খাইয়া থাকুম, "উপাস"। এবার বৃদ্ধ বোধহয় ভাবলেন, একজন অপরিচিত পথচারীকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় দেয়া হয়ে গেছে। তিনি হাতুড়ি নিয়ে আবার খটখট শুরু করলেন। আমি চলে এলাম। ভাবছি, এই দরিদ্র্য বৃদ্ধের আত্মসম্মানবোধ কতটা প্রবল হলে এখনো এই কথা বলতে পারেন।

বয়স হয়েছে, ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে জরা আর মৃত্যু, কিন্তু তিনি শিরা বের হওয়া দুর্বল হাত দুটি দিয়ে এখনো জীবন নামের বুড়ো ষাঁড়টির সাথে লড়াই করে চলেছেন, এবং তাঁর কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়াই করে যাবেন। যে সন্তান দুজন আছে তারা তাঁকে ত্যাগ করেছে, তাতে তিনি নুয়ে পড়েন নি, একবারের জন্যও ভাবেন নি যে তিনি হেরে গেছেন। কেন যেন আমার মাথা নিচু হয়ে আসে। এমন একজন মানুষকে জীবন কখনো পরাজিত করতে পারে না। মৃত্যু যখন তাঁর দরজায় কড়া নাড়বে, তখন সে-ও হয়তো একটুক্ষণ দাঁড়াবে, মাথা নুইয়ে এই বৃদ্ধকে সম্মান দেখাবে।

(১৬ ডিসেম্বর, ২০১২) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।