আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গার্মেন্ট শ্রমিকরা কি মানুষ নয়!

বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের গোড়াপত্তন স্বাধীনতার পর থেকে। ক্রমান্বয়ে এই সেক্টর বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শ্রমিক নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে ৩০-৩৫ লাখ শ্রমিক এই শিল্পে কাজ করে। দেশের জন্য বিরাট অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে এই শিল্প। সহজলভ্য সস্তা শ্রমই হচ্ছে এই শিল্পের দ্রুত উপরে ওঠার প্রধান ভিত্তি।

এই সস্তা শ্রম এতই সস্তা যে, শ্রমিকদের যে মজুরি দেওয়া হয়, তা কোনো বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য নয়। এই মজুরি দ্রব্যমূল্য, ঘরভাড়াসহ কোনো কিছুর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অন্যদিকে গার্মেন্টপণ্য উৎপাদনকারী দেশগুলোর শ্রমিকের মজুরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা সর্বনিম্ন। বর্তমানে ভিয়েতনামে সর্বনিম্ন মজুরি ৯২ ডলার, ভারতে ১০৬ ডলার, চীনে আরও বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র ৩৮ ডলার।

১৯৯৪ সালে একজন গামের্ন্ট শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি ছিল ৯৩০ টাকা। তখনো এই মজুরি দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। বর্তমানে দ্রব্যমূল্য, ঘরভাড়া কমপক্ষে ৮-৯ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৯৪ সালের মজুরিকে ভিত্তি ধরলে বিদ্যমান মজুরিও ৮-৯ গুণ বৃদ্ধি করা দরকার। সেই হিসাবে সর্বনিম্ন মজুরি দাঁড়ায় নিম্নতম আট হাজার টাকারও বেশি।

অথচ লুটেরা মালিকদের একটি অংশ বর্তমান মজুরির সঙ্গে মাত্র ৬০০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। গার্মেন্ট মালিকদের এই অবিবেচনাপ্রসূত চিন্তা ভুখা-নাঙ্গা বঞ্চিত শ্রমিকদের রোষানলে ঘি ঢেলেছে। তার ফল দেখা গেছে গত মাসের শেষ দিনগুলোতে। নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও সাভারসহ গার্মেন্ট শিল্পঅধ্যুষিত এলাকায় শ্রমিকরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন, সড়ক অবরোধ করেছেন। নির্যাতন ও নিপীড়িত শ্রমিক শ্রেণী যখন বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নামে তখন হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে কিছু সুযোগসন্ধানী ভাঙচুর করে থাকে।

এর পাশাপাশি পবিত্র ধর্মকে ব্যবহার করে ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তি যারা নারীদের ঘরে আবদ্ধ রাখতে চায়, নারী শ্রমিকদের রুটি-রুজির ওপর লাথি মারতে চায়, তাদের উসকানিতে এসব ভাঙচুর করে এবং শ্রমিকদের পথভ্রষ্ট করার সুযোগ নেয়। মালিকরা বরাবরের মতোই এসব ঘটনার পেছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে লাখ লাখ শ্রমিকের সমস্যা, তাদের নূ্যনতম চাহিদা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবি নস্যাৎ করা যাবে না, আইএলও কনভেনশনের ভিত্তিতে তাদের নিজস্ব সংগঠন করার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা যাবে না।

বিজিএমইএ বর্তমানে বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ ও ক্ষমতাশালী মালিক সংগঠন। বিজিএমইএ তাদের সদস্যদের মুনাফার অঙ্ক বাড়ানো, সরকারি ট্যাক্স মওকুফ, সরকার তথা জনগণের টাকা থেকে নগদ সহায়তা, কর অবকাশ, খেলাপি ঋণ সুদ অবলোপনসহ নানা দাবি আদায়ে শক্তিশালী প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করে।

এসব মালিক আবার শাসকগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের দাবি সরকার থেকে সহজে আদায় করে নেন। অথচ লাখ লাখ শ্রমিক, তাদের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার মজুরি আদায়ের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী সংগঠন করার অধিকার দাবি করলে মালিকরা গেল গেল রব তোলে এবং শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির পরিবর্তে মাস্তান ও আইন নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে। মালিকদের ভূমিকা দেখলে সেই চিরাচরিত বাংলার প্রবাদটির কথা মনে পড়ে। 'নিজের বেলায় ১৬ কাঠি, পরের বেলার দাঁত কপাটি। ' অর্থাৎ শ্রমিকের সস্তা শ্রমে তারা কোটি কোটি টাকা মুনাফা করবেন।

কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়ায় তাদের সেকেন্ড হোম বানাচ্ছেন এবং অবৈধ পন্থায় অনেকে কোটি কোটি টাকা পাচার করছেন। শ্রমিকের বেঁচে থাকার মতো মজুরি তারা দেবেন না। মালিকরা ট্রেড ইউনিয়ন আইনে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে সব সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেন, কিন্তু শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে ছলে-বলে-কৌশলে বঞ্চিত রাখেন। ক্ষেত্রবিশেষে বলপ্রয়োগে তা দমন করবেন। তাদের বাঁচার মতো নূন্যতম মজুরি তারা দেবেন না।

চট্টগ্রামে কিছু গার্মেন্টের ক্ষেত্রে জানা যায়, শ্রমিকরা ইউনিয়ন করায় মালিকপক্ষ ইউনিয়ন নেতাদের দমন করার জন্য মাসিক দুই লাখ টাকা বেতন দিয়ে কয়েকজন গুণ্ডা-সন্ত্রাসী নিয়োগ দিয়েছে। ইউনিয়ন নেতাদের চাকরিচ্যুত করে শ্রম আইন অনুযায়ী ক্রিমিনাল অপরাধ করেছে। কিন্তু তাদের টিকিও কেউ ছুঁতে পারবে না। না সরকার, না শ্রম দফতর, না শ্রম আদালত। এরা আইন-আদালত কিছুই মানেন না।

বাস্তবতা বোধ বিবর্জিত নব্য মালিক গোষ্ঠীর একটি অংশের কাছে শ্রমিকরা মানুষ হিসেবে গণ্য নন। প্লেটোর দর্শন অনুযায়ী এসব মেহনতি মানুষ সচল মেশিন ছাড়া আর কিছুই নয়। মালিকরা জানেন, অচল মেশিনকে এক ফোঁটা তেল/মবিল কম দিলে মেশিন সচল হবে না। সেই তেল/মবিলের দাম যতই বৃদ্ধি হোক কিন্তু তাদের বিবেচনায় সচল মেশিনরূপী মানুষকে সামান্য কিছু দিলেই তারা বাধ্য হবেন দাসের মতো শ্রম দিতে। শ্রমিকরা প্রতিবাদ করলে আছে গুণ্ডা-সন্ত্রাসী বাহিনী, জুট ব্যবসায়ী, পুলিশের লাঠিপেটা এই দাওয়াই দিয়ে তাদের বাধ্য করা হবে মেশিন চালাতে।

পোপ বলেছেন, বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের জীবন, দাস যুগের দাস শ্রমিকের মতো। এতটুকু বাড়িয়ে বলেননি মহামান্য পোপ। তাজরীন, রানা প্লাজায় হাজার হাজার শ্রমিক জীবন দিয়ে পোপের কথা প্রমাণ করেছেন। রানা প্লাজার ঘটনা বিশ্বের বিরল ঘটনা, মালিকের লোভের বলি হলো ১১ শতেরও বেশি শ্রমিক। শুধু মালিকদের খামখেয়ালি, অবহেলা এবং নূ্যনতম দায়িত্ব বোধের অভাবেই এসব মর্মান্তিক ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে।

এ ধরনের ঘটনায় এটাই প্রমাণিত হয়, এ দেশের গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদের মানুষ মনে করেন না। শ্রমিকদের প্রতি ওদের ব্যবহার অমানবিক। পুনরুৎপাদন ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য যে মজুরি দরকার তাও মালিকরা দিতে নারাজ।

বর্তমান বাজারমূল্যে আট হাজার টাকা নূ্যনতম মজুরি মোটেই বেশি চাওয়া নয়। কিন্তু বিজিএমইএ যেন ৪০ লাখ শ্রমিকের প্রতি মশকরা করছে।

সম্পূর্ণ অভাবিতভাবে মাত্র ৬০০ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়ার পাঁয়তারা করছিল তারা। যেখানে নির্মাণ শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ১০ হাজার টাকা, চাতাল শ্রমিকদের সাত হাজার। সেই বিবেচনায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের আট হাজার টাকা নিম্নতম মজুরির দাবি বেশি কিছু নয়। গার্মেন্টে বিদ্যমান উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য শ্রমিকরা দায়ী নয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব খুঁজেও লাভ নেই।

গার্মেন্ট মালিকরা বলছেন, শ্রমিকরা ওভার টাইম করার জন্য উদগ্রীব থাকেন। কিন্তু কেন থাকেন সে সম্পর্কে তারা ভাবেন না। দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করে যে মজুরি তারা পান, ঘরভাড়া ও দোকানের বাকি পরিশোধ করে তাদের হাতে আর কিছুই থাকে না। তাই তারা ওভার টাইম করে কিছু বাড়তি আয়ের চেষ্টা করেন। শ্রম ছাড়া বাড়তি আয়ের আর কোনো পথ নেই।

কিন্তু চকচকে চেহারার মালিকদের উপরি আয়ের বহু রাস্তা খোলা আছে। শ্রমিক ঠকিয়ে, ন্যায্য মজুরি না দিয়ে, ব্যাংক ঋণ লোপাট করে, নগদ সহায়তা নিয়ে, অবৈধ উপায়ে কর ফাঁকি দিয়ে তারা তাদের উপরি আদায় করে নেন।

দশকের পর দশক ধরে নির্মম শোষণ-নির্যাতন শ্রমিকদের দিশাহারা করে ফেলে। ৮-১০ বছরের বেশি একজন শ্রমিক গার্মেন্টে কাজ করতে পারেন না বা করতে দেওয়া হয় না। যাওয়ার সময় গ্র্যাচুইটির টাকা পান না।

নানা ফন্দিফিকির করে শ্রমিকদের পত্রপাঠ বিদায় করা হয়। চাকরির নিরাপত্তা ও জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার জন্য নিম্নতম মজুরি আট হাজার টাকা নির্ধারণ এবং শ্রমিকদের দাবি-দাওয়াসমূহ তুলে ধরার আইন অনুযায়ী সংগঠন করতে দিলে নির্বাচনের মাধ্যমে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করে দর কষাকষির সুযোগ নিশ্চিত হলে শ্রমিকরা কথায় কথায় রাস্তায় নেমে আসবেন না। কাজেই মালিকদের উচিত এই পথে হাঁটা। অনেক হয়েছে, বঞ্চনার পাহাড় জমেছে। ঐক্যবদ্ধ লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে এই শোষণ-বঞ্চনার পাহাড় ভাঙতে হবে।

শ্রমিকের সমস্যা সমাধান না করে শিল্পে শান্তির আকাঙ্ক্ষা দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি)

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.