আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুলতানের অজানা ছবির খোঁজে

খোঁজ মিলেছে শিল্পী এস এম সুলতানের আঁকা অদেখা ৮৬টি চিত্রকর্মের। সেসব ছবি নিয়ে বেঙ্গল গ্যালারিতে চলছে ‘অদেখা সুষমা’ শিরোনামে প্রদর্শনী। কীভাবে খোঁজ মিলল অমূল্য এসব ছবির? লিখেছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ

‘শিল্পী এস এম সুলতান আমাকে বলতেন কাসেম ভাই আর তাঁকে আমি ডাকতাম সুলতান ভাই বলে। তিনি বয়সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট। তাঁকে প্রথম দেখেছিলাম যশোরের ফটিক সরদারের বাড়িতে—গেরুয়া রঙের শাড়ি পরা।

প্রথম পরিচয়েই মনে হলো, তিনি অন্য রকম—ভিন্ন ধারার মানুষ— এরপর আমাদের বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি। আমরা কিন্তু পরস্পরকে তুমি সম্বোধন করতাম। একদিন তাঁকে বললাম, “শালা, তুমি ছবি আঁকো না, খালি নেশা করো, টোব্যাকো খাও, যে তোমাকে টোব্যাকোর টাকা দেয় তাকেই ছবি এঁকে দাও— তোমাকে মেরে আজ মাথা ফাটিয়ে দেব। তুমি চেনো আমাকে? এরপর আমার দিকে তেড়ে এলেন সুলতানও। বেশ সময় ধরে চলল আমাদের দুজনের হম্বিতম্বি।

তারপর একসময় সুলতান আমাকে বললেন, কাসেম ভাই, দুটো সাইক্লোন পরস্পর মুখোমুখি হয়ে ঘুরে ঘুরে শান্ত হয়ে গেল—ইট ইজ অ্যা বিউটিফুল মোমেন্ট!”’

কথা বলছেন ৯৬ বছর বয়সী আবুল কাসেম জোয়ারদার, যশোর এম এম কলেজের একসময়ের শিক্ষক, এস এম সুলতানের বন্ধু। তাঁর কথায় এই ২০১৩ সালে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে বেঙ্গল গ্যালারির সুপরিসর ঘরটি যেন হয়ে উঠেছে নড়াইলের লালমিয়াময়। ঘরের চারপাশে ঝলমল করছে লালমিয়ার (এস এম সুলতানের ডাকনাম) আঁকা অজস্র ছবি। যে ছবি আমরা এর আগে কখনো দেখিনি—এ ছবিতে আমাদের সামনে হাজির হয়েছেন নতুন-অজানা এক সুলতান।

 

বিউটিফুল মোমেন্ট

প্রদর্শিত মোট ৮৬টি ছবির মধ্যে অধিকাংশই চারকোলে আঁকা।

কিছু ছবির মাধ্যম কালি-কলম এবং কয়েকটি আঁকা হয়েছে জলরঙে। ‘অদেখা সুষমা’ শিরোনামে গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে বেঙ্গল গ্যালারিতে তিন সপ্তাহব্যাপী এই ছবিগুলোর প্রদর্শনী চলছে।

কিন্তু এত দিন পর কীভাবে পাওয়া গেল শিল্পী এস এম সুলতানের এতগুলো ছবি? সেই গল্প জানতেই আবুল কাসেম জোয়ারদারের মুখোমুখি আমরা। কেননা, ছবিগুলো এতকাল তিনিই তো আগলে রেখেছেন যক্ষের ধনের মতো! তাঁর কথায় ফিরে আসে যশোর, ১৯৫০-৫১ সালের আলো-হাওয়া।

‘এখন ঠিক মনে নেই, সম্ভবত পঞ্চাশের দিকের ঘটনা।

একদিন সুলতানের দিকে তালের লাঠি নিয়ে তেড়ে গেলাম। তিনিও আমার দিকে ধেয়ে এলেন হরিণের শিং হাতে। মাঝেমধ্যে তাঁর প্রতি আমার খুব রাগ হতো। কারণ, তিনি ছিলেন খুব এলোমেলো। ঠিকমতো ছবি আঁকতেন না...হা হা হা...কত যে স্মৃতি!’—আবুল কাসেম জোয়ারদারের মুখে হালকা হাসির আভা।

আমরা ফিরে যাই ১৯৫০-এর কোনো এক দিনে। দেখতে পাই, যশোরের নির্জন এম এম কলেজের শিক্ষক কোয়ার্টারের ভেতরে চলছে দুই ব্যক্তির উচ্চ স্বরে ঝগড়া। বয়সে তখন তাঁরা দুজনই তরুণ।

এর পরের গল্প মিলনাত্মক—শেষ হলো ‘বিউটিফুল মোমেন্ট’ দিয়ে। তবে শেষের পরেও অনিঃশেষ থেকে যায়—যশোরের রেল রোডের শিল্প ভান্ডার থেকে বন্ধু সুলতানের জন্য আবুল কাসেম জোয়ারদার একদিন মোটা কার্ট্রিজ পেপার কিনে নিয়ে এলেন।

খাতা বানালেন। তারপর বন্ধুকে বললেন, ‘নাও ধরো, এখন থেকে তুমি এই খাতায় ছবি আঁকবে। ’

 

সময়-অসময়ে

ধূসর হয়ে যাওয়া সেই খাতাটির প্রচ্ছদে লেখা ‘সময়-অসময়ে’। পরের চরণেই আছে ‘সুলতান’। তারপর তারিখ—‘১৯৫১-৫২ ইং’।

আমাদের জানতে ইচ্ছা করে, খাতার প্রচ্ছদের এই লেখাগুলো কে লিখেছিলেন? কিন্তু সেসব আজ আর মনে নেই আবুল কাসেম জোয়ারদারের। তাঁর সূত্রে জানা যায়, ১৯৫১-৫২—এই এক বছরে ওই খাতায় অজস্র ছবি এঁকেছিলেন লালমিয়া—চারকোলের গতিময় রেখায় নারীর মুখ, কমনীয় নারীর লাবণ্য...আরও কত ছবির গড়ন!

‘আমার ঘরে পাটির ওপর বসে ছবি আঁকতেন। খাতাটি থাকত আমার কাছে। নড়াইল থেকে যশোর এসে যখন তিনি আমার কাছে থাকতেন, তখনই আঁকতেন ছবি। সে সময় তিনি মাসে তো ১০-১৫ দিন থাকতেন আমার সঙ্গে।

এরপর আমি খাতাটি নিজের কাছে রেখে দিই। আমার ঘরে বসে তিনি একটি বাঁশিও বানিয়েছিলেন। বাঁশিটি তাঁর হাতে নকশা করা। ওটিও এ প্রদর্শনীতে আছে। ’

আমাদের চোখ এতক্ষণে বাঁশিটির ওপর।

প্রায় আড়াই ফুটের বাঁশিটি এখন কাচের বাক্সোবন্দী। আমরা আবার ফিরে যাই ছবিগুলোর কাছে—কেমন করে ছবিগুলো অদেখা ছিল এত দিন?

এই প্রশ্নের উত্তরেও আছে অনেক বড় গল্প। আপাতত ছোট্ট করেই বলি—আবুল কাসেম জোয়ারদার যশোর ছেড়ে রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা হন ১৯৭৯ সালে। এর মধ্যে ২০০১ সালে তাঁর সঙ্গে সখ্য হয় টাঙ্গাইলের ‘আনন্দপাঠ’-এর সংগঠক সৈয়দ আমিনুল হক কায়সারের।

আমরা যখন বেঙ্গলে বসে আবুল কাসেম জোয়ারদারের কাছে ছবিগুলোর তত্ত্ব-তালাশ করছি, কায়সারও আছেন আমাদের সঙ্গে।

সুলতানের ছবিগুলো কাসেম জোয়ারদারের কাছ থেকে নিয়ে বেঙ্গলের মাধ্যমে এ প্রদর্শনী আয়োজনে তাঁর ভূমিকা সূত্রধরের। এবার কায়সারের মুখ থেকেই শোনা যাক বাকি অংশ: ‘কাসেম সাহেবকে আমি মামা বলে ডাকি। তিনি প্রায়ই সুলতানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা, আড্ডাবাজির কথা বলতেন। একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “মামা, আপনি সুলতানকে নিয়ে এত কথা বলেন, আপনার কাছে সুলতানের আঁকা কোনো ছবি নেই?” কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন তিনি। বললেন, তুমি কিছু দিন পরে আসো।

আমার কাছে একটি খাতা থাকলেও থাকতে পারে। খুঁজে দেখি। পরে তাঁর পড়ার ঘরের বইপত্রের স্তূপের মধ্য থেকে উদ্ধার করে একটি খাতা দিলেন আমাকে। এটা গত বছরের কথা। খাতার অবস্থা তখন বেহাল—ধুলোমলিন, কাগজগুলো খুলে খুলে গেছে।

আমি খাতাটি বেঙ্গলের সুবীরদার (সুবীর চৌধুরী) কাছে নিয়ে এলাম। তিনিসহ শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী ও শিল্প সমালোচক মঈনুদ্দিন খালেদ ছবিগুলো দেখলেন। আসলেই এগুলো সুলতানের আঁকা কি না, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন। বেশ কয়েকটি ছবি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেগুলো মেরামত করা হলো।

এরপর তো...। ’

এর পরের কাহিনি সবার জানা। নতুন এক অদেখা লালমিয়া অন্য রকম সুষমা নিয়ে এখন দাঁড়িয়েছেন আমাদের সামনে, ছবির পর ছবিতে।


এস এম সুলতান

বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। বাংলার কৃষক-শ্রমজীবী মানুষ তাঁর ছবিতে অবয়ব পেয়েছে নতুন রূপে, অনন্য আকার-গড়নে।

এই শিল্পীর জন্ম ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট, নড়াইলের মাসিমদিয়া গ্রামে। পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান। ডাকনাম লালমিয়া। ১৯৪৬ সালে ভারতের সিমলায় প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী হয় তাঁর। ১৯৫০ সালে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এমব্যাংকমেন্টে আয়োজিত দলগত প্রদর্শনীতে পাবলো পিকাসো, সালভাদর দালি প্রমুখ শিল্পীর সঙ্গে সুলতানের ছবিও প্রদর্শিত হয়।

১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোরের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান এই শিল্পী।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.