আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৌচাক ও সেই বাড়িটাঃ ইটালো কালভিনোর গল্প

দূর থেকে এই জায়গা দেখতে পাওয়া বেশ শক্ত । তবে কেউ যদি এসেও পড়ে ফিরে যাবার পথ সে মনে করতে পারবেনা । একটা সময় এখানে পথ ছিল অবশ্য, তবে আমি কাঁটা গাছের ঝোপ লাগিয়ে সব পথের নিশানা মুছে ফেলেছি । বেশ জঙ্গুলে একটা জায়গায় করেছি বাড়িটা । বাড়িটাকে রাঙিয়েছি মলিন চকের রঙে, জানালা গুলো করেছি লালচে ।

উপত্যকার ওপাশ থেকে কেউ দেখতে পাবেনা একতলা বাড়িটা । বাড়ির পাশে কিছু জমি পড়ে আছে । কিন্তু আমি কিছুই চাষ করিনি ওখানে । আমার দরকার পড়েনা। আমার জন্য একচিলতে শামুকে খাওয়া লেটুস পাতার বাগানই যথেষ্ট।

একটুখানি মাটি খুড়ে বেগুনী আলু লাগিয়ে দাও, ব্যাস। আমি খাটি শুধু নিজে খাবার জন্য, কারোর সাথে ভাগাভাগি করে খাওয়ার ঝামেলা আমার নেই। কাঁটাঝোপ গুলো আমি কাটি না, বাড়তে দিচ্ছি ইচ্ছে মত। হিমবাহের মত ওগুলো ঢেকে ফেলছে আমার বাড়ি, আমার জমি, জানলা, দরজা সব কিছু। ফেলুক সব ঢেকে ফেলুক।

আমাকে শুদ্ধু ঢেকে ফেলুক, একেবারে কবর দিয়ে দিক। আমার বাড়ির দেয়ালে ফাটল ধরেছে, ঐ ফাটলে বাসা বেধেছে টিকটিকি, মেঝের ইটের তলায় গড়ে উঠেছে পিঁপড়েদের নগর। আমি প্রতিদিন নতুন ফাটল দেখার অপেক্ষায় থাকি, আর ভাবি, কবে যে মানুষের গড়ে তোলা নগর গুলোকে আগাছা গ্রাস করে ফেলবে। বাড়ি থেকে অল্প দূরে কিছু রুক্ষ তৃণভূমি আছে। ওখানে আমার ছাগল গুলো চরে।

মাঝে মাঝে ভোরে খরগোশ তাড়া করতে করতে দুয়েকটা কুকুর ছুটে আসে। ঢিল ছুড়ে ওগুলোকে আমি তাড়িয়ে দেই। মানুষের প্রতি কুকুরের হীন আনুগত্য আমি ঘৃণা করি। কোন ধরনের গৃহপালিত পশুপাখিই আমার সহ্য হয় না। মানুষের উচ্ছিষ্ট খাওয়ার ওই ভড়ং আমার দুচোখের বিষ।

ছাগলরাই কেবল ওই রকম কোন আশায় মানুষের সাথে মেশে না। তাই ওদেরকেই আমার শুধু সহ্য হয়।
আমার শেকলে বাধা কোন প্রহরী কুকুরের দরকার নেই। দরকার নেই কোন বেড়া বা পাঁচিলের, দরকার নেই তালা চাবি আর মানুষের যাবতীয় সব ভুজুঙ ভাজুঙের। আমার জমির চারপাশ মৌচাকে ঘেরা, আর মৌচাক গুলো এমনই এক বেড়া শুধু আমিই ওটা পার হতে পারি।

মৌমাছি গুলো যখন রাতের বেলা ঘুমিয়ে পড়ে তখনও আমার বাড়ির পথ কেউ মাড়ায় না। আমাকে মানুষজন খুব ভয় পায়। নানারকম রটনা আছে আমার নামে, ভয়ঙ্কর সব রটনা, ভয় পাওয়ানো সব রটনা। বিশ্বাস করুন সব মিথ্যে রটনা ওগুলো। তবে আমি চাই লোকজন আমাকে ভয় পাক।

আমাকে তাদের ভয় পাওয়া দরকার। সকালের দিকে আমি যখন চূড়ার দিকে যাই আমি দেখতে পাই নীচে পড়ে থাকা উপত্যকা। আমি দেখতে পাই আমার আর আমার পৃথিবীর চারপাশে ফণা তোলা সুউচ্চ সমুদ্র। আমি দেখতে পাই সমুদ্রের ধারে গড়ে ওঠা মানুষের বসতি মিথ্যা সামাজিকতা নিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। আমি দেখতে পাই তামাটে শহর, চকচকে বাতায়ন আর আগুনের ধোঁয়া।

একদিন এই শহর কাঁটাঝোপ আর ঘাস লতায় ভরে যাবে, সমুদ্র এসে শহরকে পাথুরে ধ্বংসাবশেষে পরিণত করবে। আমার সাথে কেবল ওই মৌমাছি গুলোই আছে। আমি ওদের চাক থেকে মধু নিই, ওরা আমাকে কামড়ায় না। মাঝে মাঝে ওরা আমার গায়ে এসে বসে, আমার মুখে তখন দাঁড়ির মত হয়ে যায়। বন্ধু আমার মৌমাছি গুলো, ইতিহাসহীন প্রাচীন জাতি।

বছরের পর বছর আমি কাটিয়ে দিচ্ছি ওই ছাগল আর মৌমাছিগুলোর সাথে এই কাঁটাঝোপের মধ্যিখানে। আগে দেয়ালে দাগ কেটে বছরের হিসেব রাখতাম। সেসব কবে মুছে গেছে গুল্মলতার আড়ালে। কেন আমি মানুষের মাঝে থাকব, কেন ওদের জন্য কাজ করব ? ওদের ঘামে ভেজা চটচটে হাতে হাত মেলাতে আমার ঘেন্না হয়। তাদের অসভ্য সব রীতি, তাদের গির্জা, তাদের নাচের উৎসব, তাদের মেয়েমানুষদের মুখরা স্বভাব এর সব কিছু আমি ঘৃণা করি।

বিশ্বাস করুন ওরা যে রটনাগুলো রটায় সব মিথ্যে, সব। মিথ্যেবাদী শুয়োরের জাত সব! আমি কাউকে কিছু দিইনা, কারো কাছ থেকে কিছু নিইও না। বৃষ্টির রাতে আমি সমুদ্রের ধার থেকে কুড়িয়ে আনা বড় শামুক রেঁধে খাই, তাছাড়া স্যাঁতসেঁতে মাটিতে জন্মানো মাশরুম তো আছেই। বন থেকেই আমি আমার প্রয়োজনীয় সবকিছুই পাই, আগুন ধরাবার জন্য খড়ি, পাইন কোণ আর চেস্টনাট। আমি শিকার করি খরগোস, পাখি।

মনে করবেননা পশু পাখির প্রতি আমার কোনো মায়ামমতা আছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি আমার কোন মোহ আছে। এগুলোকে আমার সস্তা জোচ্চুরি মনে হয়। আমি জানি এই পৃথিবীতে একে অপরকে খেয়েই বেঁচে থাকা লাগবে। যোগ্যতমই টিকে থাকবে। আমার প্রয়োজনেই আমি পশুপাখি ধরে খাই, ফাঁদ পাতি।

বন্দুক আমি ব্যবহার করিনা, কারণ ওতে কুকুর বা অন্য মানুষের সাহায্য লাগে শিকার তুলে আনতে। মাঝে মাঝে বনের মাঝে কাঠ কাটতে আসা মানুষদের সাথে আমার দেখা হয়ে যায় অসাবধানতাবশত । আমি ওদের না দেখার ভান করি। ওরা বনের ভিতর এসে গাছ গুলোকে একেবারে কচুকাটা করে। তারপর গাছ গুলোকে দড়ি দিয়ে টেনে লোকালয়ে নিয়ে যায়।

এর ফলে মাটিতে তৈরি হয় গর্ত, আর গর্তে জমে পানি। এর ফলে দেখা দেয় ভূমিধ্বস। আমি চাই ধ্বসে পড়ুক মানুষের শহর এভাবেই। আপনার নিশ্চয়ই অবাক লাগছে এই ভেবে যে কখনও কি আমার এই একাকীত্ব আমার নির্জনবাস আমার উপর চেপে বসেনি ! দীর্ঘ গোধূলির দিনগুলোর কোনো একটিতে কি আমি গন্তব্যহীন ভাবে হেঁটে যাইনি মানব বসতির দিকে! গিয়েছিলাম বটে! এক উষ্ণ গোধূলিতে আমি হেঁটে গিয়েছিলাম দেয়ালে ঘেরা ওই বাগান গুলোর দিকে, কিছুদূর আমি হেঁটেও ছিলাম তরুপল্লব শোভিত রাস্তা দিয়ে। কিন্তু যখনই আমি একটা মেয়ের উচ্ছল হাসি আর একটা বাচ্চার চিৎকার শুনলাম আমি তক্ষুনি ফিরে এসেছিলাম।

ওই শেষ, তারপর আর যাইনি। তারপর থেকে এখানে একাই আছি। মাঝে মাঝে ভয় হয় আবার কবে ভুল করে বসি।
আমাকে ভয় পাচ্ছেন বুঝি ? তা ভয় পাওয়া উচিত। তবে ওই ঘটনাটার জন্য নয় নিশ্চয়ই।

ব্যাপারটা ঘটেছে কি ঘটেনি এখন আর তা কোনও অর্থ বহন করেনা। সে তো অনেকদিন আগের কথা।
ওই কালো মেয়েলোকটা সেদিন এখানে কাস্তে হাতে কাজ করছিল। আমার মন তখনও মানবিক আবেগে পূর্ণ। আমি তাকে ঢালে কাজ করতে দেখলাম, সে আমার দিকে হাত নাড়ল।

আমি কোন উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেলাম। আমার মন ভর্তি ছিল আবেগ। মনের ভিতর একটা পুরনো রাগও কাজ করছিল। এমন নয় যে ওই মহিলার প্রতিই আমার রাগ ছিল, ওর মুখটাই আমার মনে নেই ভালো ভাবে। তবু ওই রাগের বশেই পিছন দিক থেকে গিয়ে মহিলার উপর চড়াও হলাম।


দেখুন, লোকজন আমার নামে যেসব রটিয়ে বেড়ায় সেসব গুজব মাত্র। কারণ ওই সময় দিন শেষ হয়ে আসছিল আর পুরো উপত্যকায় কেউই ছিলনা। আমি যখন ওর গলায় হাত দেই তখন ওর চিৎকার কেউ শুনতে পায়নি। আমার পুরো ঘটনাটা খুলে বললেই সব বুঝবেন আপনারা। নাহ, থাক ওই বিকেলের কথা কথা আর তোলার দরকার নেই।

আমি শামুকের সাথে লেটুস পাতা ভাগ করে খাই, মাশরুম কোথায় পাওয়া যায় জানি, কোন মাশরুম খাওয়া যায় আর কোনটা বিষাক্ত তাও জানি। এখন আর ওই বিষাক্ত মেয়েলোকদের কথা একদম ভাবিনা। আর চরিত্রবান হওয়া একটা অভ্যাসগত ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই না। ওই কাস্তে ওয়ালা কালো মেয়েলোকটাই আমার শেষ। মনে পড়ে সেদিন আকাশে কালো কালো মেঘের আনাগোনা ছিল।

ওইরকমই একটা আকাশের নীচেই মানুষের প্রথম বিয়েটা হয়েছিল। আমার মতে একটা মানুষের সাথে আরেকটা মানুষের সম্পর্কে কেবল লজ্জা আর ভয়ই থাকে। বিশ্বাস করুন আমি শুধু ওই মহিলার চোখে ভয় আর লজ্জা দেখতে ছেয়েছিলাম, শুধু ভয় আর লজ্জা। শুধু এই কারণেই আমি কাজটা করেছিলাম। আমাকে কেউ কিচ্ছু বলেনি এই নিয়ে।

কারোর কিচ্ছু বলারও নেই। কারণ ওই সন্ধ্যায় পুরো উপত্যকা ছিল শূন্য, একদম শূন্য। কিন্তু প্রতি রাতে যখন পাহাড়ে রাত নেমে আসে, যখন লণ্ঠনের আলোয় আমি কোন দুর্বোধ্য প্রাচীন বই পড়ি, যখন আমি অনুভব করি নিচের শহরের মানুষের কোলাহল, গান, নাচ তখন মনে হয় সবাই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলছে। কিন্তু আমাকে দেখে ফেলার মত কেউ ওই সময়ে উপত্যকায় ছিলনা। কেউ আমাকে দেখেনি।

তারা এই সব বলে বেড়ায় কারণ মেয়েলোকটা আর বাড়ি ফিরে যায়নি। আর যদি দেখেন কোন কুকুর এদিক দিয়ে যাবার সময় একটা নির্দিষ্ট জায়গায় মাটি শুঁকছে, মাটি আঁচড়াচ্ছে বুঝবেন ওখানে একটা পুরনো ছুঁচোর গর্ত আছে। বিশ্বাস করুন, কসম কেটে বলছি ওটা একটা পুরনো ছুঁচোর গর্ত।
............................................................................................................................................................................................................ THE HOUSE OF THE BEEHIVES মুলঃ ইটালো কালভিনো অনুবাদঃ তাহসিন রেজা
তাহসিন রেজা

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।