আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একথালা ভাত ও রাষ্ট্র

আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা । দিনটি রৌদ্রোজ্জ্বল ছিলো । আর অন্যান্য দিনের মত আত্মকেন্দ্রিক , হিপোক্রেট জনগণের চলাচলে রাস্তাটি ব্যস্ত থাকবে এমনটাই হত স্বাভাবিক । কিন্তু ক্যালকুলেশন দ্বারা সবসময় সবকিছু চলেনা । আগের রাত থেকে আবছা পুর্বাভাসের কথা বাতাসে এদিকে – ওদিকে ভেসে বেড়ালেও মানুষ তাতে বিশেষ রা করেনি ।

বেশীরভাগ মানুষের তা নিয়ে ভাবার সুযোগও নেই । পেটের ধান্দায় সর্বদা যুঝতে থাকা মানুষগুলোর কাছে তা স্রেফ বিলাসীতা ব্যতীত আর কিছু নয় । এমন অবস্থায় মারমার কাটকাট পরিস্থিতির সূচনা হলো । প্রথমেই নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিয়ে কতিপয় বরাহ নিমেষে কিছু গাড়ির গ্লাস ভাঙলো । এসব পরিস্থিতিতে সচরাচর যা হয় তাই হলো ।

প্রবল জোশে নিস্পৃহ , অপদার্থ আম-জনতাও এমন সময়ে ‘ বিক্ষুব্ধ ‘ বনে তাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা প্রমানে তৎপর হয় । তবে তখনও তারা সর্বদাই সচেতন থাকে যেন আক্রমনের শিকার কোন তালেবর আর তার ছানাপোনাদের হতে না হয় । তাদের ধরাবাধা শিকারী ওই এক শ্রেণীর বেয়াড়ার হদ্দরাই । খুঁজে – খুঁজে সব ফকিন্নীর পুত , ঝিকেই তারা বধ করে । এখানেও তাই হলো ।

মাত্র প্যাসেঞ্জার নামিয়ে ঝামেলা দেখে তড়িৎ রিকশা ঘোরাতে গিয়ে পাবলিকের রোষানলে পড়লো হতদরিদ্র রিকশাওয়ালা । নিমেষের মধ্যে দেখা গেলো তার লুঙ্গি নেমে এসেছে হাটুর কাছাকাছি , নোংরা গেঞ্জি অসংখ্য টুকরায় মাটিতে লুটাচ্ছে । ঠেলাগাড়ি করে ঘরের জন্য কিছু শাকসবজি নিয়ে যাওয়া ঠেলাওয়ালাকে মাটিতে শুইয়ে ফেলার পর এলোপাথাড়ি লাথি তার উপর পড়তে লাগলো ক্রমাগত । রাস্তাটি ততক্ষণে রণক্ষেত্রে পরিনত হয়েছে । সবাই যার যার সুবিধামত যা পারছে করছে ।

তাই ঠেলাগাড়িওয়ালা চোখের পলকে ‘ ক্যাজুয়াল্টি ‘ হয়ে যাবার পরেও কিছুমাত্র সমস্যা হলোনা । সাংবাদিকেরাও তার ছবি তুলে রাতারাতি সেলিব্রেটি বনে যাবে এমন সুযোগটিও তাদের মিললোনা । বাস থেকে যাত্রীদের নামিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হলো ২টি বাস । বাস চালক সাথে সাথেই সটকে পড়েছিলো । সব মিলিয়ে বহুদিন পর এমন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে ।

আগুনে পুড়ছে বাস , গাড়িওয়ালারা দ্রুত নিজ সম্পত্তি বাঁচাতে সরে যাচ্ছে মুহূর্তের মাঝে । তখন পুলিশও নেমে পড়েছিলো তান্ডবলীলায় অংশ নিতে । পুলিশও বরাবরই শক্তের ভক্ত নরমের যম থিউরী মেনে কোমর বেঁধে নেমে পড়লো । প্রথমেই রাস্তার এক পরিচিত ভিক্ষুককে রাইফেলের বাট দিয়ে মাথায় আঘাত করে রক্তাক্ত করলো । প্রবল গন্ডগোলের সময়ে দৌড়াতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া তরুণীর শরীরকে কিছু বরাহ ঘেঁটে নিলে তখন পুলিশ তরুণীর কাছেই বখরা চেয়ে বসে ।

বরাহদের মধ্যে ২ জনকে পুলিশ দেখেই সাথে সাথে বুঝেছে তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে জীবন নিয়ে আজকে বাড়ি ফিরতে পারবেনা । তার চেয়ে ভিকটিমের কাছে বখরা চেয়ে কেস ক্লোজড করে দেওয়াকে তারা শ্রেয়তর মনে করলো । আর সেই সুযোগে কাছ থেকে তরুণীর শরীরের মাপজোক করে নেওয়াটাও নিঃসন্দেহে বোনাস । এমনই এক অস্থির সময়ে যখন সঠিক – বেঠিককে সংজ্ঞায়িত করা যায়না , তখন ঘটনাস্থল থেকে কিছু দূরে একটি ব্যতিক্রমী দৃশ্য দেখা গেলো । রাস্তায় পড়ে থাকা একথালা ভাত আর এদিকে – ওদিকে ছড়িয়ে – ছিটিয়ে পড়ে থাকা তরকারীসমূহ একজন মধ্যবয়ষ্ক নারী তার কাছে সংগ্রহ করছে ।

নারীটির পরনের পোষাকের অবস্থা স্পষ্টতই বলে দেয় সে ‘ আনরিকগনাইজড ‘ পার্ট অব দি সোসাইটি । তরকারী আর ছড়ানো ভাত সংগ্রহ করে সে এগিয়ে যেতে থাকে সামনে । ফুটপাথের শেষ প্রান্তে এসে অবশেষে থামে । ধীরে ধীরে রাস্তার নোংরা - ময়লা ভাত – তরকারী মেখে তুলে দেয় ক্ষুধার যন্ত্রনায় অঝোরে কাঁদতে থাকা মানবসন্তানের দিকে যার এখনো পৃথিবীর নির্মমতা বোঝার ক্ষমতা হয়নি । সেই বয়স হলে তার কান্না আগেই থেমে যেতো ।

অবশেষে তার মুখে দানাপানি যায় । মন্ত্রমুগ্ধের মত একদৃষ্টিতে নোংরা পোষাকের নারীটি চেয়ে থাকে তার পানে । সেদিন হাড় – হাভাতে কেউই রক্ষা পায়নি । তারাও পেলোনা । পরক্ষণেই সংগ্রহ করা ভাত আর তরকারী লাথির তোড়ে ছিটকে পড়লো ।

মানবসন্তানের থেমে যাওয়া ট্যা ট্যা কান্না পুনরায় আরম্ভ হয় । প্রচন্ড ক্রোধে সিভিলাইজড সমাজের জন্য অমার্জিত বলে বিবেচিত হওয়া ভাষায় নারীটি বলে উঠে “ খানকীর পুতগুলা নিজেগো পুটকী কামড়াইতে কামড়াইতে কুত্তা হইয়া গেছে । খাতি দিলোনা আমার ছাওয়ালডারে । “ ফকিন্নীর ঝির গালি হজম করলে আর মর্দ কিসের ? কিছু লাত্থি – উষ্ঠার পর নারীর জামা – কাপড় ছিড়ে গেলে পুলিশগুলার মনে আসলো মালটাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া যায়না । একে নিয়ে আরো বহুকিছু করা যায় ।

সেই ‘ বহুকিছু ‘ করার খায়েশে তাকে টেনে নিয়ে দূরে নির্জন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় । তান্ডবের তোড়ে সেখানে এখন কেউ নেই । কার্য সমাধা হলে পুলিশগুলার প্রত্যেকে নিজেদের ঠিকঠাক করে । কেউ ঝাকি দিয়ে ‘ জিনিস ‘ ঠিক করে , কেউ পানি খায় । প্রত্যেকেই হাঁফাচ্ছে , বড্ড পরিশ্রম গেলো কিনা ।

এদিকে কাঁদতে কাঁদতে সেই মানবশিশু ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে । ঘটনাক্রমে প্রায় ২৫ বছর পরে জানা যায় ট্যা ট্যা করে কাঁদতে থাকা মানবশিশুটিকে রাষ্ট্রের নিকট ‘ বিপদজনক ‘ মনে হওয়ায় তাকে এক নির্জন স্থানে গভীর রাতে হত্যা করা হয়েছিলো । শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সে পেটপুরে একথালা ভাত খেতে চেয়েছিলো কেবল । ২৫ বছর আগের সেই বিক্ষুব্ধ দিনে তাকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিলো । শেষবারও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।