আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংলাপই সংকট উত্তরণের পথ

মুসাফির। হাঁটছি পৃথিবীর পথে পথে, অনিশ্চিত গন্তব্যে। কাগজের নৌকা দিয়ে সাগর পাড়ি দেবার দুরন্ত প্রয়াস।

নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০১৪ সাল আমাদের কাছে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা কোনদিকে বাঁক নেবে বলা যায় না। ইতিহাস ও বর্তমান ঘটনাবলী আমাদের বলে, আশার চেয়ে আশঙ্কাই বেশি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতের চোখ দিয়ে ২০১৪ সালকে যেমন দেখা যাচ্ছে তা কেউ লিখতে সাহস করবে না। আর সামগ্রিকভাবে দেখলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বই আজ ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন; মহাসংকটে নিপতিত। আল্লাহ না করুন, যদি শিগগিরই বিশ্বনেতাদের পারস্পরিক মতানৈক্য ও দূরত্ব কমানোর উদ্যোগ নেয়া না হয়, তাহলে মানবজাতির জন্য সম্ভাব্য এক মহাবিপর্যয় অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশ যে ইতিমধ্যেই খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে এতে সন্দেহ নেই। তাই আমাদের অতীত ও বর্তমানের তিক্ত বাস্তবতা পর্যালোচনা করে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় দীর্ঘদিন ধরেই বিশিষ্টজনেরা সরকার ও বিরোধীদলকে সংলাপে বসার জন্য চাপ দিয়ে আসছেন।

জনগণেরও একই চাওয়া। সাম্প্রতিক সময়ে পত্র-পত্রিকা ও মিডিয়ায় সংলাপের বিষয়টি এক বিশেষ স্থান দখল করেছে। কিন্তু দুই নেত্রী যার যার অবস্থানে অটল। এর কারণ কি? রাজনৈতিক দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে হয় সংলাপের কার্যকারিতা অস্বীকার করা হোক, না হয় এর বিকল্প হাজির করা হোক- যে বিকল্প উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে সুস্পষ্ট পথ নির্দেশক। পুরো একটা জাতিকে এভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝুলিয়ে রেখে ক্রমাগত সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়া কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়।

সমস্যা যত গভীরই হোক এবং এর মাত্রা যে সীমায়ই পৌঁছে থাকুক, বিরুদ্ধবাদী শক্তির সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদী মুখোমুখি বৈঠক ও উন্মোক্ত আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব- এটা আমাদের উপলব্ধিজাত বিশ্বাস ও পরীক্ষিত সত্য। যারা ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত, দলীয়, জাতীয় ও ধর্মীয় অবস্থান থেকে বিভিন্নমুখি ও পরস্পরবিরোধী মত-পথের অনুসারী এবং সবাই যার যার মত-পথ ও দাবির ওপর দৃঢ়; তাদের মধ্যে প্রতিনিধিত্বের স্তরে দীর্ঘমেয়াদি পর্যায়ে সংলাপ আহ্বান, অংশগ্রহণ ও উন্মোক্ত প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে সমন্বয় ও মীমাংসার পথ অনুসন্ধানের বিকল্প নেই। এর দ্বারা হয়ত এমন ব্যক্তিগণ বেরিয়ে আসবেন যারা স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সর্বস্তরের সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান পেশ করতে সক্ষম। সুতরাং এ সূত্রে জ্ঞানগত চ্যালেঞ্জ প্রদান ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণে বাধা কোথায়? প্রতিদিন একাধিক সংবাদপত্র ও মিডিয়ায় দুই নেত্রীর সংলাপের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে স্থান পাচ্ছে। একটু পেছন থেকে দুএকটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি।

যদিও পাঠকের সামনে তাজা উদ্ধৃতির অভাব নেই। গত ০৮.০১.২০১৩ দৈনিক যুগান্তরে বিশিষ্ট কলামিস্ট এম আবদুল হাফিজ ‘আপস নিষ্পত্তির কোন বিকল্প নেই’ শিরোনামে অত্যন্ত মূল্যবান একটি কলাম লিখেছেন। এ ছাড়া ০৪.১২.২০১২ কালের কণ্ঠের সম্পাদক, জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন তার পত্রিকার প্রথম পাতায় বিশেষ সম্পাদকীয় লিখেছেন ‘দেশের মানুষ চায় দুই নেত্রীর সমঝোতা’ শিরোনামে। ২৭.১২.২০১২ কালের কণ্ঠে বিশিষ্ট কবি ও কলামিস্ট আহমদ রফিক ‘সংঘাতের রাজনীতি নয়, সমঝোতার সংলাপই সঠিক পন্থা’ এবং একই সংখ্যায় এম আব্দুল হাফিজ ‘সম্ভাব্য সংকটের মুখে কিছু দেশচিন্তা’ শিরোনামে কলাম লিখেছেন। এ লেখাগুলোতে আমাদের রাজনীতির সংকট আরো করুণভাবে ফুটে উঠেছে এবং শ্রদ্ধেয় এ তিনজনই দুই নেত্রীর সংলাপে বসার প্রতি জোর দিয়েছেন।

আহমদ রফিক তার এ লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ থেকে দলনিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদ, পেশাজীবী, রাজনীতিমনস্ক বিশিষ্টজন সবাই একনাগাড়ে বলে চলেছেন রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা, যুক্তি ও সৌহার্দ্যরে সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য। এমনকি দলবিশেষের কোনো কোনো জ্যেষ্ঠ সমর্থকও বলছেন : না, এ অবস্থা চলতে পারে না। দেশের স্বার্থে দুই প্রধান দলের মধ্যে সৌহার্দ্য না হোক অন্তত সহিষ্ণু সৌজন্য গড়ে তোলা জরুরি। এতে দুই দলেরই দায়িত্ব রয়েছে। ’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা’ থেকে আইনজীবীদের বিশিষ্টজনও একই কথা বলছেন।

তাঁদের মধ্যে দুই প্রধান দলের সমর্থকও রয়েছেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তাঁদের এক সম্মেলনে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও একই সুরে কথা বলেছেন। তাঁদের বক্তব্য : যেকোনো মূল্যে ‘সংঘাত এড়াতে দুই নেত্রীর সংলাপের বিকল্প নেই। ’ ব্যারিস্টার হক বলেছেন, ‘প্রয়োজনে এমন জনমত বা পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে তাঁরা বসতে বাধ্য হন। ’ এরপর জনাব রফিক আক্ষেপ করে বলেন, ‘সাধু প্রস্তাব।

এমন কথা বেশ কিছুদিন থেকে নানাজনের মুখে শুনে আসছি। কিন্তু এ পর্যন্ত কিছুই হয়নি, কোনো সুফল মেলেনি। স্বভাবতই প্রশ্ন : দুই নেত্রীকে সংলাপে বসতে বাধ্য করবে যে জনমত সে জনমত তৈরি করবে কে বা কারা? এ ব্যাপারে জনাব হক কিছু বলেননি। তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, ‘মতৈক্য দূরে থাক, সেখানে পৌঁছতে যে প্রাথমিক বৈঠক বা আলোচনা দরকার সেই মূল জায়গাটিতেই তো পৌঁছা যাচ্ছে না-মতামতের ঐক্য-অনৈক্য দূরস্থ। আর এ লক্ষ্যে পরামর্শ, প্রস্তাবও কম আসছে না।

কিন্তু কোনোদিকেই বরফ গলছে না, গলতে শুরুই করছে না। সবকিছু অনড়, জমাট হিমশিলার মতো। ’ এম আব্দুল হাফিজ অন্য এক লেখায় বলেছেন, দুই নেত্রীর সংলাপে বসার আন্দোলনে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক একজন নিঃসঙ্গ সৈনিক। প্রকৃতই দুই নেত্রীর সংলাপে বসার প্রসঙ্গটি সামনে এলে সর্বগ্রে যে নিঃসঙ্গ মানুষটি আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠেন তিনি আর কেউ নন, সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। সংলাপের বিষয়টি যদিও দুই নেত্রীর উপরই নির্ভর করছে, বিশেষ করে প্রথম উদ্যোগ সরকারের তরফ থেকেই আসা উচিত এবং সম্ভবত সাংবিধানিক দায়িত্বও, তবুও আমি মনে করি সংলাপের প্রেক্ষাপট, বিষয়বস্তু, কার্যকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা কেবল দুই নেত্রী বা প্রধান দুচারটি দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।

ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সংলাপ এক আপরিহার্য বিষয়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এর চর্চা করি না বলেই বিরোধী শক্তির সঙ্গে সংলাপে বসা আজ আমাদের জন্য এত কঠিন। এখন যদি নিজেরা চর্চা শুরু করে দিতে পারি, তাহলে সবকিছু সহজ হয়ে আসবে আশা করা যায়। সবশেষে দুনেত্রীর সংলাপে বসার ব্যাপারে হাইকোর্টের রুল জারি করা নিয়ে বিজ্ঞমহলে ইতোমধ্যেই বিতর্ক জমে উঠলেও সবাই এর কার্যকারিতা দেখতে উৎসুক হয়ে আছেন। আর খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ আছেন চরম উৎকণ্ঠায়।

এর শেষ কবে কীভাবে হবে জানে না কেউ। জাকির মাহদিন : ২ এপ্রিল ২০১৩, সাপ্তাহিক লিখনী

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।