আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৬

নারদের বুদ্ধিতে একেক ভাইয়ের ঘরে দ্রৌপদীর বার্ষিক পালা ঠিক হইবার পর অর্জুন যাইচা অপরাধ করে পাঁচ বচ্ছরের নির্বাসন-শাস্তি নিয়া পথে পথে তিনটা বিবাহ কইরা শেষে ফিরছিল দেশে। আর বনবাসের শুরুতেই আবার সে অস্ত্র সংগ্রহের নামে আরো পাঁচ বচ্ছরের লাইগা চইলা যায় দ্রৌপদী থাইকা দূরে। তাই এইবার অর্জুন ফিরা আসলে সমস্ত পালাটালা ভাইঙ্গা যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীরে বরাদ্দ দেয় অর্জুনের ঘরে। কিন্তু এই অর্জুন তো আর সেই অর্জুন নাই। পাঁচ বচ্ছরের অস্ত্রসংগ্রহকালে কোথায় যেন কী করতে গিয়া বিচি হারাইয়া ফিরতে হইছে তারে...
দ্রৌপদী হাসে- থাউক।

সময়কালে দূর কইরা দিয়া অসময়ে কাছে আসার দরকারই বা কী?
আগে গেছে ছয় বছর। এখন আরো গেলো চাইর। এগারো বছরের শুরুতে ভীম কয়- এইবার তো আমাগের প্রস্তুতি নেওয়া লাগে। যুধিষ্ঠিরও যুক্তি মানে। ভীমের সংবাদ পাইয়া আবার আইসা হাজির হয় ঘটোৎকচ।

অর্জুন খুইটা খুইটা ভাতিজার যুদ্ধ কৌশল দেখে। অর্জুনের যুদ্ধ করে লক্ষ্য নির্দিষ্ট কইরা। নির্দিষ্ট শত্র“ লক্ষ্যের ভিতরে না আসলে অস্ত্র উঠায় না সে। যেইখানে ভীমের কৌশল হইল গণমাইর; কে মরল আর কে বাকি থাকল তা দিনের শেষে গিয়া হিসাব করে সে। ...ঘটোৎকচ বাপের গণমাইর কৌশলের সাথে আয়ত্ব করছে তার মাতৃবংশের মায়াযুদ্ধের কৌশল।

অর্জুন যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকায়- ঘটায় কিন্তু কর্ণরে ফাইট দিবার যোগ্যতা রাখে...
খুশিতে ডগমগ করে ভীম। ফকিন্নির পোলা কর্ণ তারে মাকুন্দা কইয়া গালি দিলেও সে তার কিচ্ছু করতে পারে নাই কোনোদিন। তার পোলায় যদি কর্ণরে কিলাইতে পারে তয় ভীমের থাইকা বেশি খুশি হইব না কেউ...
লোমশ থাইকা গেলেন গন্ধমাদনে। পাণ্ডবরা রওয়ানা দেয় ফিরতি পথে। সতিনের পোলা ঘটার কান্ধে চইড়া ফিরতে ফিরতে মুখ লুকাইয়া কান্দে পাঁচ পোলার জননী দ্রৌপদী।

যুধিষ্ঠির কৃষ্ণ অর্জুন সকলেই সর্বদা কর্ণরে ফাইট দিবার মতো যোদ্ধা খোঁজে। কৃষ্ণ আগে ইঙ্গিত দিয়া গেছে ঘটার শক্তি বিষয়ে। এইবার অর্জুন সেই ইঙ্গিতরে প্রায় সিদ্ধান্তে নিয়া গেছে; অর্জুনের আগে পাণ্ডব বংশের কেউ যদি কর্ণের মুখামুখি খাড়ায়; তবে নিশ্চিত সে হইব ঘটোৎকচ। ...কিন্তু দ্রোণ আর পরশুরামের শিষ্য কর্ণের সামনে কতক্ষণ টিকব স্বশিক্ষিত ঘটার রণ-কৌশল? ঘটার কান্ধে বইসা নিঃশব্দে তড়পায় দ্রৌপদী। তার অভিশাপ কি তবে সত্যিই ফলে যাবে একদিন?
বৃষপর্বার আশ্রমে এক রাইত আর বদরিকায় একমাস থাইকা সকলে কিরাতরাজ সুবাহুর রাজ্যে উপস্থিত হইলে ঘটা বিদায় নেয়।

ভীম তার কান্ধে চাপড় দেয়- যা বেটা। পোলাগোরে নিয়া তৈয়ার হ। সংবাদ পাঠামু যুদ্ধের আগে...
ঘটোৎকচ বাপ-কাকা আর মায়েরে পেন্নাম কইরা গিয়া যুধিষ্ঠিরের সামনে খাড়ায়- তোমার ভাতিজা এখনই যুদ্ধের লাইগা তৈয়ারি জ্যাঠা; খালি নির্দেশখান বাকি....
যুধিষ্ঠির বুকে বল পায়। ঘটোৎকচের বাহিনী আসন্ন মহাযুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষের নিশ্চিত প্রথম বাহিনী; কর্ণের সামনে খাড়াইবার মতো প্রথম যোদ্ধাও ঘটোৎকচ। যুধিষ্ঠির ঘটারে জড়ায়ে ধরে- সময় আসুক বাপ...
ঘটা বিদায় নিবার পর তারা আইসা উপস্থিত হয় যমুনার উৎপত্তিস্থান বিশাখযুপ।

বিশাখাযুপে একবছর বাসকালে এইখানেও ঝামেলা করতে গিয়া ভীম বান্ধা খায় নহুষ বংশের কাছে আর আবারও যুধিষ্ঠির গিয়া হাত জোড় কইরা তারে ছাড়াইয়া আইনা সইরা আসে দ্বৈতবনে...
বারো বচ্ছর পূর্ণ হইবার মাত্র কয়েকমাস আগে কৃষ্ণ আবার আইসা হাজির হয় পাণ্ডবদের কাছে। এইবার সত্যভামা ছাড়া কাউরে সে সাথে আনে নাই। সকলরে সকলের কুশল বিনিময় কইরা কৃষ্ণ তাকায় যুধিষ্ঠিরের দিকে- মহারাজ। যাদবসেনারা যুদ্ধের লাইগা এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। চাইলে এখনই আমরা যুদ্ধ কইরা আপনারে আপনের রাজ্য জয় কইরা দিতে পারি।

আপনি ইচ্ছা করলে সেই রাজ্যে এখনই যাইতে পারেন আবার চাইলে বনবাসের মেয়াদ শেষ কইরাও হস্তিনাপুর ফিরতে পারেন...
তয় এইবার যুধিষ্ঠিরের অনুপস্থিতিতে কে তার রাজ্য শাসন করব সেই দিকে যায় না কৃষ্ণ। যুধিষ্ঠির তেমন কোনো উৎসাহ দেখায় না কৃষ্ণের কথায়। সে হালকাস্বরে বলে- অতদিন যখন অপেক্ষা করছি বাকি কয়টা দিন না হয় অপেক্ষায়ই করলাম। খামাখা কয়টা দিনের লাইগা আর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ না করি...
মুনি মার্কেণ্ড আইসা পড়ায় কথা আর বেশিদূর আগায় না। কৃষ্ণ আর পাণ্ডবেরা শুনতে থাকে মুনি মার্কেণ্ডের পুরাণ কথা আর সত্যভামা দ্রৌপদীরে নিয়া গিয়া আড়ালে খাড়ায়- তুমি তো পাঁচ পাঁচটা স্বামীরে সামলাইয়া রাখো; আমারে একটু বুদ্ধি দেওতো বইন যাতে কৃষ্ণরে আমি ধইরা রাখতে পারি?
দ্রৌপদী হাসে- ভাতার যদি টের পায় তুমি তারে বাইন্ধা রাখতে চাও তাইলেই কিন্তু সে পলাই পলাই করব।

তুমি বরং স্বাভাবিক থাইকো। ...তয় মাঝে মাঝে যদি তারে বুঝাইয়া দিতে পারো যে তারে ছাড়া তুমি দুনিয়ার কাউরে পোছো না তাইলেই সোনায় সোহাগা। তবে একটা কথা; স্বামীর সামনে নিজের পোলাদেরও কিন্তু বেশি খাতির কইর না কোনোদিন...
বারো বচ্ছরের বাকি সময় পাণ্ডবরা দ্বৈতবনেই ঘর তুইলা থাকে। সংবাদ পাইয়া দুর্যোধনের মনে হয়- যাই নিজের চোক্ষে একবার পাণ্ডবগো দুর্দশা দেইখা আসি...
পাণ্ডবগো আস্তানার কাছেই ছিল দুর্যোধনের গোপপল্লী। দুর্যোধনের প্রস্তাব নিয়া কর্ণ আর শকুনি যায় ধৃতরাষ্ট্রের কাছে- এই বছর পালের গরুবাছুর তো গোনাগুনতি দরকার।

মৃগয়ার জন্যও সময়টা উপযুক্ত। তাই দুর্যোধনের ঘোষযাত্রা আর মৃগয়ার অনুমতি প্রার্থনা করি মহারাজ...
আন্ধা ধৃতরাষ্ট্র চোখ পিটপিট করেন- প্রস্তাব ভালো আর দরকারিও বটে; কিন্তু শুনেছি গোপপল্লীর কাছেই এখন পাণ্ডবরা থাকে। যুধিষ্ঠির ঠান্ডা মানুষ; তোমাদের দেখলে সে কিছু বলব না। কিন্তু ভীমের মেজাজ আর পাঞ্চালীর রাগের কথা ভাইবা আমার বড়ো ডর লাগে। তোমরা সেইখানে গিয়া লাফালাফি করবা আর তারা বইসা থাকব এইটা ভাবতে আমার কষ্ট হয়।

তাছাড়া শুনছি এর মধ্যে অর্জুন নাকি বহুত অস্ত্রও জোগাড় কইরা ফালাইছে...
শকুনি কয়- কথা দেই মহারাজ; পাণ্ডবরা যেইদিকে আছে সেইদিকে আমরা পাও বাড়াব না। আমরা খালি পালের গরুবাছুর গোনাগুনতি কইরা দুই চাইরটা শিকার সাইরা আবার ফিরা আসব ঘরে...
ধৃতরাষ্ট্র মিনমিন কইরা অনুমতি দিলেও দুর্যোধনরে ডাইকা কন- তোর যাওয়ার কাম নাই বাপ। তুই বরং ঘোষযাত্রায় অন্য লোকরে পাঠা...
কিন্তু অন্যের চোখ দিয়া কি আর ছাল-বাকলা পরা পাণ্ডব আর দ্রৌপদীর দুরবস্থা দেখা যায়? দুর্যোধন বরং বাড়ির সব বৌদের বস্ত্রে অলংকারে সাজুগুজু করাইয়া সাথে নিয়া রওয়ানা দেয় মৃগয়ায়। কৌরবদের শান শওকত দেইখা নিশ্চয় মনের জ্বালা আরেক কাঠি বাইড়া যাবে পাণ্ডব আর পাঞ্চালীর...
গেছে গরু বাছুর গুণতে আর শিকার করতে। তাই হাতেগোনা কিছু দেহরক্ষী আর কামলা গোছের মানুষ ছাড়া দুর্যোধনের লগে তেমন সৈন্যসামন্ত নাই।

তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারে নাই যে পাণ্ডবদের আশেপাশেই মৃগয়ার নামে সৈন্যসামন্ত নিয়া অর্জুনের দোস্ত গান্ধর্বরাজ চিত্রসেন পাহারা দিতাছে তাদের। ...ঝামেলাটা সেইখানেই ঘটল। দুর্যোধনের খেলাধুলার ঘরবাড়ি বানাইতে গিয়া তার কামলারা মারামারি বাধইল চিত্রসেনের আর্মিগো লগে আর চিত্রসেন আইসা দিলো সব তছনছ কইরা। রথ হারাইয়া কর্ণ দিলো চম্পট আর চিত্রসেন দুর্যোধনরে লগে বাড়ির সব মেয়েদের বাইন্ধা রওয়ানা দিলো নিজের শিবিরে...
দুর্যোধনের চ্যালারা আইসা পড়ল যুধিষ্ঠিরের পায়- রক্ষা করেন মহারাজ। আপনার পরিবারের মেয়েদের ধইরা নিয়া গেছে চিত্রসেন।

ভীম কয়- খারাপ কী? আমরা যা করতে চাই; চিত্রসেন তা আগেই কইরা ফালাইছে। ভালৈতো। কিন্তু বংশের নারীদের নিয়া চিত্রসেনের টানাটানি পছন্দ করে না যুধিষ্ঠির। সে ভীম আর অর্জুনরে পাঠায় তাগোরে উদ্ধার কইরা আনতে। অর্জুনরে দেইখা চিত্রসেন হাসে- কও দোস্ত।

কী করতে হইব? অর্জুন কয়- মেয়েদের ছাইড়া দিয়া দুর্যোধনরে বাইন্ধা নিয়া চলো যুধিষ্ঠিরের কাছে...
ছাল-বাকলা পইরা বইসা আছে যুধিষ্ঠির আর তার সামনে রাজকীয় পোশাক পরা দুর্যোধনরে বাইন্ধা নিয়া আসছে চিত্রসেন। বাড়ির যে মাইয়াদের সে নিয়া আসছিল দ্রৌপদীর দুর্দশা দেখানোর লাইগা; তারা এখন দ্রৌপদীর উঠানে দুর্যোধনরে দেখতাছে যুধিষ্ঠিরের সামনে হাঁটু মুইড়া বইসা থাকতে....
দুর্যোধন মাথা তোলে না। যুধিষ্ঠির চিত্রসেনরে কয় হাতের বাধন খুইলা দিতে। দুর্যোধন উইঠা খাড়ায়। যুধিষ্ঠির তার দিকে তাকাইয়া কয়- যাও বাড়ি যাও।

সব জায়গায় বাহাদুরি দেখাইতে যাইও না....
শত্রুর দয়ায় প্রাণ নিয়া বাইচা থাইকা কী লাভ? দুর্যোধন সবাইরে হস্তিনাপুর ফিরা যাইবার আদেশ দিয়া নিজে সিদ্ধান্ত নেয় আত্মহত্যার। ভাইয়েরা তার পায়ে ধইরা কান্দাকাটি করে। মামা শকুনি হাতে ধইরা বোঝায় কিন্তু দুর্যোধন এই জীবন রাখব না আর। সব দেইখা কর্ণ আইসা খাড়ায় দুর্যোধনের সামনে- হইছেটা কী শুনি? যুদ্ধে সেনাপতিররা শত্রুর হাতে ধরা খায় এইটা কি নতুন কিছু? বন্দী হইবার পর সৈন্য আর প্রজারা আবার সেনাপতিরে শত্রুর হাত থাইকা ছাড়াইয়া আনে; সেইটাওতো নতুন কিছু না। পাণ্ডবগোরে তুমি শত্রু মনে করতাছ কেন? তারা এখন তোমার রাজ্যে বসবাস করা প্রজা।

তাগোর দায়িত্ব হইল রাজা দুর্যোধনরে শত্রুর হাত থাইকা ছাড়াইয়া আনা। তারা যা করছে তা অনুগত প্রজার দায়িত্বের বেশি কিছু করে নাই। তুমি তাগোরে ধন্যবাদ দিছ তাতেই তাদের জীবন ধন্য হইবার কথা। এইবার লও বাড়ি যাই...
কিন্তু এই যুক্তি দিয়া কি দুর্যোধন নিজেরে সান্ত্বনা দিতে পারে? সে কয়- কর্ণ তোমরা যাও; গিয়া রাজ্য শাসন করো। আমি বরং মরি...
কর্ণ এইবার দুর্যোধনরে একটা ঝাঁকি দেয়- বেকুবি কইরো না কইলাম।

মান অপমান ওইগুলা ব্রাহ্মণের বিষয়। ক্ষত্রিয়ের কাজ শত্রু নিধন। নিজে মইরা গেলে কোনোদিনও শত্রুজয় হইবার সম্ভাবনা নাই বরং বাইচা থাকলেই কিছু না কিছু চান্স বাইর করা যায়। ...চলো গিয়া সেই বন্দোবস্ত করি....
হস্তিনাপুর ফিরা আইসাই দুর্যোধন পড়ে ভীষ্মের সামনে- কইছিলাম না যাইও না? লাফাইতে লাফাইতে তো গেলা; সেইখানে কী হইছে তার সংবাদ রাখি না মনে করো? তোমার ধোপানির পোলা কর্ণ তো পয়লা ধাক্কাতেই পলাইছে তোমারে থুইয়া। শেষ পর্যন্ত তো পাণ্ডবগো দয়াতেই বাইচা রাজবাড়ি ফিরলা? কই? নিজের শানশওকত ঠিকমতো দেখাইতে পারছিলা তো পাঞ্চালীরে?
দুর্যোধন ভীষ্মের কথার কোনো উত্তর না দিয়া হাঁটে।

বাড়িতে গিয়া ঝিমায়। বাঁচামরার প্রশ্নে না হয় মানসম্মান তুচ্ছ কিন্তু বাইচা থাকলে তো সম্মান লাগে। ভীষ্ম খোঁচাইব; প্রজারা হাসব এইটা তো হইতে পারে না। এমন একটা কিছু করতে হইব যাতে সবাই এই প্রসঙ্গটা ভুইলা যায়...
রাজা হিসাবে বড়োসড়ো কিছু করা মানে হয় বড়োসড়ো যুদ্ধের জয় না হয় বড়ো একখান যজ্ঞ করা। বড়ো যুদ্ধ যেহেতু আপাতত সুযোগ নাই তাই যজ্ঞই করব দুর্যোধন।

যজ্ঞের মইধ্যে সবচে বড়ো রাজসূয় যজ্ঞ। কিন্তু সেইখানে একটা সমস্যা আছে। বংশে রাজসূয় যজ্ঞ করছে আপনা কাকাতো ভাই যুধিষ্ঠির। আর রাজা হিসাবে এখনো জীবিত আছে নিজের বাপ ধৃতরাষ্ট্র; যার আবার রাজ্যে অভিষেক হয় নাই কোনোদিন। সে মূলত এখনো ভাই পাণ্ডর রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত রাজা।

বংশে রাজসূয় যজ্ঞ করা ব্যক্তি জীবিত থাকতে যেমন দ্বিতীয় কেউ তা করতে পারে না তেমনি নিজের বাপ ভারপ্রাপ্তেরও রাজসূয় করার সুযোগ নাই। তাই দুর্যোধনের লাইগা একমাত্র বিকল্প হইল রাজসূয় যজ্ঞ থাইকা কিছুটা কম মর্যাদার বৈষ্ণব যজ্ঞ; করদ রাজাদের কাছ থিকা কর তুইলা সেই টাকায় সোনার লাঙল বানাইয়া মাটি চইষা উদ্বোধন হয় এই যজ্ঞের....
কিন্তু যজ্ঞের ঝকমকানি ছাল-বাকলা পরা পাণ্ডবদের তো দেখাইতে হয়। ...দুর্যোধন পাণ্ডবদের নিমন্ত্রণ পাঠায় যজ্ঞে যোগদানের। যুধিষ্ঠির প্রত্যাখ্যান করে বিনয়ের সাথে- এখন হস্তিনাপুর গেলে তো বনবাসের শর্ত লঙ্ঘন হয় তাই আমরা যাইতে অপারগ। তয় দুর্যোধনের লাইগা আমার আশীর্বাদ থাকল।

তারে কইও আমাগো তেরো বচ্ছর পূর্ণ হইলে হস্তিনাপুরে আবার দেখা হইব আমাদের। আর ভীম কয়- হ। তেরো বছর পূর্ণ হইলে আমরা হস্তিনাপুর গিয়া দুর্যোধনরে আগুনে ফালাইয়া যে যজ্ঞ করুম; সেইখানে তার লগে দেখা হইব আমাদের...
যজ্ঞ শেষে কেউ কয় যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ থাইকা তোমারটা ভালৈছে; কেউ কয় খারাপ। কর্ণ কয়- দুঃখ কইরো না দুর্যোধন। পাণ্ডবরা নিপাতে গেলে রাজসূয় যজ্ঞ কররা তুমি।

তবে তোমার এই যজ্ঞ যেমনই হোক না কেন; এই যজ্ঞের পুণ্যের লগে তুমি কর্ণের একটা একটা প্রতিজ্ঞা যোগ করো আজ- যতদিন অর্জুন বাইচা থাকব ততদিন এই কর্ণ পা ধুইব না; মদ-মাংস খাবে না আর আমার কাছে কেউ কিছু চাইলে কোনো অবস্থাতেই তারে না বলব না আমি....
যজ্ঞের কোনো সংবাদেই কান তোলো না যুধিষ্ঠির। সে খালি ভাবতে থাকে কর্ণের প্রতিজ্ঞা- যতদিন অর্জুন জীবিত থাকব ততদিন কেউ তার কাছে কিছু চাইলে কোনো অবস্থাতেই তারে না বলবে না সে... তার মানে অর্জুনরে হত্যা না করার বর চাইলেও কর্ণ তা দিব... যুধিষ্ঠির ভাবতে থাকে কর্ণের কাছে কী চাওয়া যায়...
এমন সময় দ্বৈপায়নের কথায় পাণ্ডবরা জায়গা বদলাইয়া ফিরা আসে কাম্যকবনে। কারণ বনের এক জায়গায় বেশিদিন বসবাস করলে বনের যেমন ক্ষতি হয় তেমনি নিজেরও শেকড় গজায়। ওইদিকে দুর্যোধন কোনোমতেই ভুলতে পারে নাই কোনো অপমান। পাণ্ডবরা তার যজ্ঞের নিমন্ত্রণেও সাড়া দেয় নাই।

এরি মধ্যে একদিন মুনি দুর্বাসার দেখা পায় দুর্যোধন। একটু খবিস কিসিমের এই মুনি। বদরাগি আর কথায় কথায় মাইনসেরে অভিশাপ দেয়া তার কাম। তেলবাজ মুনি দুর্বাসারে খুশি করা খুব কঠিন। সেই যুগে একবার মাত্র তারে খুশি করতে পারছিল কুন্তী আর এই যুগে তারে তেল মারতে মারতে খুশি কইরা ফালায় দুর্যোধন।

মুনি তার সেবায় খুশি হইলে সে কয়- আমার উপরে যদি আপনি খুশি হইয়া থাকেন তয় আমার একটা অনুরোধ রাখেন। আপনিতো জানেন যে আমার বড়োভাই যুধিষ্ঠির খুব ভালো মানুষ। সে এখন বনে আছে। আমারে সে কইয়া দিছে যে আপনারে পাইলে যেন কই আপনি আপনের শিষ্যদের নিয়া তার বনবাসের বাড়িতে একদিন নিমন্ত্রণ খাইতে যান...
পঙ্গপালের মতো একপাল শিষ্য নিয়া সত্যি সত্যি একদিন যুধিষ্ঠিরের কাম্যকবনে গিয়া হাজির হয় দুর্বাসা মুনি- খাইতে আইলাম তোমাদের ঘরে...
দুর্যোধন দুর্বাসারে যুধিষ্ঠিরের ঘরে খাইতে পাঠায় নাই। পাঠাইছে যুধিষ্ঠিরের বাড়িতে খাইতে না পাইয়া দুর্বাসা কী অভিশাপ দেয় তা দেখার লাইগা।

কিন্তু কৃষ্ণ যে সেইদিন সেইখানে উপস্থিত সেইডা তো আর জানে না কেউ। মুনি আইসা খাইতে চাইলে যুধিষ্ঠির কয়- ঠিকাছে; যান নদী থাইকা স্নান কইরা আসেন। দ্রৌপদী কপাল থাবড়ায়-এখন কেমনে কী করি। অত মানুষের খাওন পাকাইতে তো বহুত সময় লাগব। কিন্তু স্নান শেষ কইরা আইসা যদি দুর্বাসা খাওন না পায় তো ছারখার কইরা দিব সব...
কৃষ্ণ দ্রৌপদীরে থামায়- খাড়াও দেখতাছি আমি...
কৃষ্ণ এক লোকেরে দিয়া দুর্বাসার কাছে সংবাদ পাঠায়- কও গিয়া বাসুদেবের পোলা কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের বাড়ির সব খাবার খাইয়া ফালাইছে আজ...
কৃষ্ণের নাম শুইনা দাড়িলোম সব খাড়া হয়ে উঠে দুর্বাসার।

গোসলটোসল বাদ দিয়া সে শুরু করে দৌড়। শিষ্যরা জিগায়- গুরু কই যান? দৌড়াইতে দৌড়াইতে মুনি কয়- পলাও। যাদব জাউরা কৃষ্ণের লগে মুনিগিরি ফলান ঠিক না। পলাও...
কাম্যকবনেই আরেক ঘটনা ঘটে অন্যদিন। ...পাণ্ডবরা গেছে শিকারে।

বাড়িতে দ্রৌপদী আর পুরোহিত ধৌম্য। এই সময় ধৃতরাষ্ট্রের মাইয়া দুঃশলার জামাই সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ আরেকটা বিবাহের আশায় যাইতেছিল শাল্বরাজ্যে। পথে কাম্যকবনে দ্রৌপদীরে দেইখা তার মাথা আউলা- এই বনে এমন সুন্দরী নারী কেমনে কী? এর সামনে তো অন্য মেয়েরা বান্দরের সুমান...
জয়দ্রথের চ্যালা কোটিকাস্য সংবাদ নিয়া আইসা বিস্তারিত জানাইলে জয়দ্রথ কয়- শাল্বরাজ্যে গিয়া কাম নাই। এরেই বিবাহ করব আমি... জয়দ্রথ নিজে আউগাইয়া গিয়া প্রস্তাব তোলে দ্রৌপদীর কাছে- ফকির পাণ্ডবগো লগে থাইকা কী করবা তুমি? তার থাইকা আমারে বিবাহ কইরা তুমি হও সিন্ধুর রাণী...
দ্রৌপদী ধাক্কা মাইরা জয়দ্রথরে মাটিতে ফালাইয়া দিলেও জয়দ্রথ তারে বাইন্ধা নিজের রথে তুইলা ফালায়। রথ চলা শুরু করলে দ্রৌপদী চিক্কুর দিয়া ডাকে ধৌম্যরে আর চলন্ত রথের পিছনে দৌড়াইতে দৌড়াইতে ভীমের নাম ধইরা চিল্লায় ধৌম্য পুরোহিত- ভীম।

কই গেলিরে ভীম...
ধৌম্যের চিক্কুর আর ঘোড়ার দাগ দেইখা পাণ্ডবেরা পৌঁছাইয়া যায় জয়দ্রথের কাছে। মাইরের শুরুতেই ভীমের হাতে চ্যাপ্টা হয় কোটিকাস্য। দ্রৌপদীরে ছাইড়া জয়দ্রথ পলায়। যুধিষ্ঠির আশ্রমে ফিরা আসে দ্রৌপদী- ধৌম্য আর নকুল সহদেবরে নিয়া। ভীম আর অর্জুন ধাওয়া দেয় জয়দ্রথের পিছে।

যুধিষ্ঠির অর্জুনরে কইয়া যায়- ওরে জানে মাইর না। ও আমাগো বইনের জামাই...
ভীম তার চুলের মুঠি ধইরা আছড়ায়। অর্জুন কয় যুধিষ্ঠির কইছেন তারে জানে না মারতে। ভীম কয়- এ হালা দ্রৌপদীরে অসম্মান করছে এর বাচার কোনো অধিকার নাই। কিন্তু অর্জুন ভীমেরে সামলায়।

ভীম টাইনা জয়দ্রথের মাথার চুল ছিড়া ফালাইয়া ধইরা নিয়া আসে দ্রৌপদীর কাছে । যুধিষ্ঠির কয়- যথেষ্ট শিক্ষা হইছে তার। এইবার জননী গান্ধারী আর বইন দুঃশলার কথা ভাইবা এরে ছাইড়া দেও। ভীম কয়- তোমার কথায় ছাড়া যাইবা না তারে। পাঞ্চালী যদি ছাড়তে কয় তবেই শুধু ছড়া পাইব সে...
যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকাইয়া দ্রৌপদী হাসে- যে আমারে জুয়ার দানে তুলতে পারে তার কাছে আমার অসম্মান আর কী এমন বিষয়।

...দেও। তোমাগো বোনাইরে ছাইড়াই দেও...
অজ্ঞাতবাসে যাইবার আগে আগে জয়দ্রথরে ধরা-মারর চেয়ে কর্ণের নিবীর্যকরণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ যুধিষ্ঠিরের কাছে। কর্ণের কাছে অর্জুনের প্রাণভিক্ষা চাওয়া হবে চূড়ান্ত অসম্মানের বিষয়। তাই কর্ণের প্রতিজ্ঞার ফাঁক দিয়া কর্ণরেই নিবীর্য করার বিষয়ে লোমশ মুনি পরামর্শ দিছেন এবং নিজেই দায়িত্ব নিছেন নিছেন কর্ণরে নিবীর্য করার। সেই সংবাদটা এইমাত্র আইসা পৌঁছাইল যুধিষ্ঠিরের কানে।

আইজ এক ব্রাহ্মণ কর্ণের কাছে গিয়া চাইয়া বসছে তার অক্ষয় বর্ম; যে বর্ম ভেদ করার মতো কোনো অস্ত্র আইজও দুনিয়ায় কেউ আবিষ্কার করে নাই। এই বর্ম নিয়া যুদ্ধে নামলে কর্ণ অমর। কিন্তু নিজের প্রতিজ্ঞার ফান্দে পইড়া আইজ সেই বর্মটাই ব্রাহ্মণরে দান কইরা দিতে হইছে কর্ণের...
যুধিষ্ঠির স্বস্তি পায়- যুদ্ধের মাঠে কর্ণ তবে এখন এক মরণশীল জীব... ২০১৩. ১০.২৮ সোমবার
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী।

পর্ব ৫ [ঘটোৎকচ ৩] মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। [পর্ব ৪: ঘটোৎকচ ২] মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩।

দ্রৌপদী। [পর্ব ৩: ঘটোৎকচ] মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ২ মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী।

৩। দ্রৌপদী। পর্ব ১ মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ৩] মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী।

২। কুন্তী [পর্ব ২] মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ১] মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ১।

সত্যবতী

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।