আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ১]

মাহবুব লীলেন বাচ্চা পয়দার ক্ষেমতাই যার নাই সেই ব্যাডায় আবার করছে দুইখান বিবাহ। রাজরানি হইবার লোভে নামর্দ স্বামীরে মাইনা নিলেও আঁটকুড়া বেডার ঘরে সতিনের সংসার কেমনে মানা যায়? কিন্তু সতিন হজম না কইরাও উপায় নাই কুন্তীর। পাণ্ডুরে দ্বিতীয় বিবাহ করাইছেন ভীষ্মদেব নিজে। নিজে তিনি বিয়াশাদি না করলেও শান্তনু বংশে গত তিন প্রজন্মের বিবাহকর্তা তিনি। তার অনুমতির উপরই নির্ভর করছিল তার নিজের বাপের দ্বিতীয় বিবাহ।

এর পরে তো ছোট ভাই কিংবা বড়ো ভাতিজার বিবাহের সিদ্ধান্তে কাউরে জিগানোরও দরকার মনে করেন নাই তিনি। পাত্রী সামনে আইনা ভাই-ভাতিজারে জানাইয়া দিছেন- আইজ তোর বিয়া... কিন্তু ঝামেলা বাধাইল তার ছোট ভাতিজায়। কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ একদিন স্বয়ংবর সভায় গিয়া কুন্তীরে নিয়া আইসা খাড়াইল তার সামনে- আমি বিয়া কইরা ফালাইছি জ্যাঠা... বাইরে ভাতিজাবধূরে আশীর্বাদ করলেও তিন জেনারেশন ধইরা তার ঘটকালির অধিকার নষ্ট করায় মনে মনে ভীষ্ম ভালোই খেপলেন। কিন্তু তার খেপাটা যে অত বেশি তা অনুমান করতে পারে নাই কুন্তী। হঠাৎ একদিন তিনি মাদ্রীরে আইনা খাড়া করলেন পাণ্ডুর সামনে- তোর বৌটা আঁটকুড়া।

তাই তোর লাইগা দ্বিতীয় বিবাহের আয়োজন করছি আমি... এক পোলার মা কুন্তীরে আঁটকুড়া কয় নির্বংশ বেটায়... কথাখান মনে মনে কইলেও বাইরে কুন্তী স্বাভাবিক থাকে। কুন্তীর বহুদিন আগে থেকে সংসার কইরাও নিঃসন্তান ভাসুরবধূ গান্ধারীরে তিনি কিছু বলেন না কেন; এই প্রশ্নও সে ভীষ্মরে করে না। রাজ্যের সমস্ত সৈনিক যার অধীন; সেই ভীষ্মরে খেপাইয়া সৈনিকবিহীন রাজা পাণ্ডুর জীবনটা আরো কঠিন কইরা ফালানি কোনো বুদ্ধিমানের কাম না। তাই সতিনই সই। কিন্তু পাণ্ডুরে দিয়া কিছু হইব কি হইব না মাদ্রী সেইটা বুঝবার আগেই যেন কুন্তীর পোলাপান হস্তিনাপুরের মাঠে দৌড়াইতে পারে সেইটা নিশ্চিত করতে হইব তার... কিন্তু কোনোকিছু ফাইনাল করার আগে সত্যবতীরে একটু বাজাইয়া নেওয়া দরকার।

তাই কুন্তী গিয়া বুড়িরে খোঁচায়- আমারে আঁটকুড়া বইলা নাতিরে তো আরেকখান বিয়া করাইলেন দাদি। কই? আপনের নতুন নাতবৌয়ের শইলেও তো গর্ভের কোনো লক্ষ্মণ নাই... পাটনি সত্যবতী বুদ্ধিমান আর নির্বোধের পার্থক্য বোঝেন দিন আর রাইতের মতো। বড়ো নাতিবৌ গান্ধারী বহুত আদব কায়দা জানে; ধর্মকর্ম করে; সত্য কথা বলে; স্বামী কিংবা গুরুজনে ভক্তির অভাব নাই তার। কিন্তু খালি ধর্ম আর সত্য কইয়া সংসার চলে না। সব যোগ্যতাই ছিল ভীষ্মের; শুধু জানা ছিল না সময়ে সময়ে সত্যরে কেমনে নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে হয় কিংবা দরকার মতো সত্য বানাইয়া নিতে হয়।

এই কারণেই সারা জীবন সত্যবাদী থাইকা সে রাজা বানায় কিন্তু নিজে রাজা হইতে পারে না কোনোদিন... কিন্তু যাদব বংশের মাইয়া কুন্তীর তো এই সমস্যা থাকার কথা না... দাদি সত্যবতী সরাসরি কুন্তীর চোখে তাকান- নাতির আমার সমস্যা আছে আমি জানি। কিন্তু আমি তার ঘরে তোমাদের পোলাপান দেখতে চাই... কথাটা বুঝতে পারছ তুমি? কুন্তীর না বোঝার কারণ নাই। কিন্তু বুড়িরে আরেকটু নাড়ানো দরকার- দাদিজান। আপনি যা কইলেন তাই সত্য। কিন্তু ভীষ্মদেবেরে কথাখান কে বুঝাইব কন? অবস্থা দেইখা তো মনে হয় বছর না ঘুরতেই তিনি আরো দুই চাইরখান সতিন আইনা আমার ঘাড়ে তুলবেন... সত্যবতী এইবার কুন্তীরে নিশ্চিন্ত করেন- এই বিষয়ে ভীষ্ম আর কিছু করব না সেইটা আমি তোমারে কইয়া দিতে পারি।

কিন্তু আমার কথাবার্তা খুব সোজা। নাতি আমার অক্ষম হইলেও তার ঘরে আমি পুতাদের মুখ দেখতে চাই। শাস্ত্রে বহুত বিকল্প আছে; খালি সমাজের চোখে একটু ধুলা দিতে হয়; আমার মনে হয় সেই বুদ্ধি তোমার ভালোমতেই আছে.. সবকিছু জাইনাও কুন্তীরে সতিনের ভাত খাওয়াইছে বুড়ি। বুড়ির কইলজায় একটা খোঁচা মারতে না পারলে কুন্তীর জান ঠান্ডা হইব না। কুন্তী এইবার বেক্কলের মতো চেহারা নিয়া জিগায়- দাদিজান।

ছোট পোলার বিধবাগো গর্ভে সন্তান জন্ম দিবার লাইগা আপনে কুমারিকালের বড়ো পোলা দ্বৈপায়নরে পাঠাইছিলেন ছোটভাইয়ের বৌদের ঘরে। সেই সিস্টেমে যারা জন্ম নিছে তারা শেষ পর্যন্ত আপনার বংশেরই পোলাপান হইছে। এখন কি আপনি তিনারেই আবার পাঠাইতে চান নিজের পোলার বৌদের বিছানায়? সত্যবতী খিটখিট কইরা উঠেন কুন্তীর কথায়- বেশরমের মতো কথা কবা না কলাম। দ্বৈপায়ন তোমার স্বামীর সাক্ষাত পিতা। তোমার নিজেরও পিতার সমান।

আর কোনো বিকল্প দেখো না তুমি? তুমি ভালো কইরাই জানো যে এই বাড়িতে দ্বৈপায়ন খালি ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডুরে জন্ম দেয় নাই। তোমার দেবর বিদুরও দ্বৈপায়নের ছেলে। দাসীর গর্ভে জন্মাইছে বইলা রাজবাড়িতে সে একটু তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে আছে। হ রাজবাড়ি। বোঝোই তো।

পাটনি মায়ের পোলা দ্বৈপায়নের ঘরে জন্ম নিয়া দুইজন হয় ক্ষত্রিয় রাজপুত্তুর আর একজনে নমশূদ্র অচ্ছ্যুত। এইটাই সিস্টেম শান্তনু বংশের। তা যাই হোক; কিন্তু পাণ্ডুর শইলে যেমন আছে দ্বৈপায়নের রক্ত; বিদুরের শইলেও তাই। আমার কাছে তোমার স্বামী ভাসুর দেবর তিনজনই আমার পোলার ঘরের নাতি। বিদুর বুদ্ধিমান পোলা।

শান্তনু রাজ্যের নিয়ম যেমন সে জানে ধর্মটর্মের নিয়মকানুনও তার ভালোমতো জানা। কথাটা বুঝতে পারছ তুমি? প্রকাশ্যে লজ্জা দেখাইলেও কুন্তী মনে মনে হাসে- তুমি কি মনে করো বুড়ি তোমার বুদ্ধির লাইগা আমি বইসা ছিলাম? আমি বিদুরের শরণাপন্ন হইছি কি না সেইটা তোমার ছানিপড়া চোখে ধরা পড়ার কথা না। বিয়ার আগে পোলা জন্ম দিয়া সেই পোলারে লুকাইতে পারো নাই বলে এক বুইড়ারে বিয়া করতে হইছিল তোমার। কিন্তু এক পোলা জন্ম দিবার পরেও কুমারী সাইজা স্বয়ংবরা পর্যন্ত করেছি আমি... আমার ঘরে পাণ্ড বংশের পোলাপান হইলে যদি কারো চোখ টাটানি হয় তবে তুমি তা সামলাইবা কি না তা আমার জানার দরকার ছিল; আমি তা জাইনা গেলাম। আর তুমি যেখানে আছ সেইখানে ভীষ্মদেবরে যে ভয়ের কিছু নাই সেইটা সক্কলেই জানে... বুড়া শান্তনুর জোয়ান পোলার সমবয়েসি তরুণী বিমাতা সত্যবতী।

কে জানে... তাগো মধ্যে অন্য কিছু আছিল কি না। কুন্তীর মাঝে মাঝে মনে হয় বুড়িরে গিয়া জিগায়- ও দাদি। দাদারে তো মজাইছিলা রূপরস দিয়া। কিন্তু সতিনের জোয়ান পোলারে ব্রহ্মচারী কইরাও সারাজীবন ঘরে বাইন্ধা রাখছিলা কোন মন্ত্র দিয়া কওতো শুনি? গঙ্গার নন্দন ভীষ্ম। নিজে সংসারী না হইলেও সংসার তিনি বোঝেন সকলের থেকে বেশি।

এক কান দুই কান কইরা পাণ্ডুর অক্ষমতা এখন অনেকেই জানে। যৌনরোগে আক্রান্ত পাণ্ডরাজা যদি হস্তিনাপুরেই মারা যায় তবে বড়োই কলঙ্ক হবে বংশের মুখে। ভীষ্ম তাই বিধান দিছেন পশু শিকারের নামে পাণ্ড বনবাসে যাইব দুই বৌ নিয়া। সেইখানে গিয়া সে শিকারের সাথে ধম্মকম্ম করব আর মুনিঋষি দেবতার দয়ায় চেষ্টা করব সন্তান পাবার... কুন্তী জানে জীবন্ত পাণ্ডু আর হস্তিনাপুরে ফিরা আসতে পারব না কোনোদিন। ভীষ্ম তারে নির্বাসনে মৃত্যুর বিধানই দিছেন।

পাণ্ড মরার পর যদি কোলে পোলাপান নিয়া আসতে পারে তবে পাণ্ডর বৌরা ফিরতে পারব হস্তিনাপুরে। না হইলে তাদেরও এইটা শেষ যাত্রা... ভীষ্মের বিধানে এখন আন্ধা বড়োভাই ধৃতরাষ্ট্রই থাকবেন ভারপ্রাপ্ত রাজা। এর অর্থ পাণ্ডু বোঝে। ভারপ্রাপ্ত নয়; ভীষ্ম তার সিংহাসনটা বড়ো ভাইরে দান কইরা দিলেন। কিন্তু ভীষ্মের কথা অমান্য করার সাহস তার নাই।

শান্তনু বংশের সমস্ত সৈনিক আর সামন্তরা ভীষ্মের কথা মানে। আন্ধা হইবার কারণে বড়োভাই হইয়াও যে রাজ্য ধৃতরাষ্ট্র হারাইছেন; এখন সুযোগে সেই রাজ্য পাইয়া ধৃতরাষ্ট্রও চান পাণ্ড দূর হয়ে যাক। যতদিন পর্যন্ত না পাণ্ডুর পোলাপান রাজা হইবার যোগ্য হয় ততদিন পর্যন্ত ধৃতরাষ্ট্র অনির্দিষ্টকালের লাইগা হস্তিনাপুরের রাজা... মাদ্রী পাণ্ড আর কুন্তীর পিছে পিছে চলে...বনে ঢুকেই কুন্তী পাণ্ডুরে ডর দেখায়- পুত্রহীনের স্বর্গে যাবার নিয়ম নাই এইটাতো আপনি জানেন মহারাজ? পাণ্ড কয়- হ তা তো জানি বৌ কিন্তু কেমনে কী করি? কুন্তী এইবার তারে শাস্ত্রের কাহিনী শোনায়। বৌয়ের গর্ভে অন্য কেউ সন্তান দিলেও সেইটা তার পোলা বলেই সকলে জানে। এই যেমন; আপনে তো মূলত পাটনিপুত্র দ্বৈপায়নের পোলা।

কিন্তু রাজার বৌয়ের গর্ভে জন্মাইছেন বইলা রাজপুত্র হইছেন। আপনারে কিন্তু কেউ পাটনিপুত্র কয় না। ...তো আপনেরে আমি একখান ঘটনা কই মহারাজ; আমি কিন্তুক কুমারী আছিলাম না বিবাহের সময়। এর আগেই আমার একটা পোলা আছিল। সেই পোলা কিন্তু কোনো মাইনসের পোলা না।

দেবতা সূর্যের সন্তান। ...তো কেমনে সেই পোলা পাইলাম সেই কাহিনী কই। পোলা পাওনের আগে আমি আছিলাম মুনি দুর্বাসার সেবিকা। মুনি দুর্বাসারে সেবা কইরা কেউ খুশি করতে না পারলেও আমি কিন্তু পারছিলাম। সেই খুশিতে তিনি আমারে একটা মন্ত্র দিয়া যান।

মন্ত্রটার জোরে নিজের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের লাইগা আমি যে কোনো দেবতারে ডাকতে পারি। তো মন্ত্রের ক্ষমতা পরীক্ষার লাইগা আমি একদিন হঠাৎ সূর্যরে ডাইকা বসলাম। তারপর দেখি আমার ডাক শুইনা সত্যি সত্যি সূর্য চইলা আসলেন আর আমারেও একটা পোলা দিয়া গেলেন। ....পরে অবশ্য তারে আমি গাঙে ভাসাইয়া দিছিলাম রাজকন্যার এমন পোলা থাকা উচিত না বইলা। ...তো সেই মন্ত্র কিন্তু এখনও আমার আছে।

আমি কিন্তু দেবতাগোরে ডাইকা আইনা আপনেরে পোলাপান দিতে পারি মহারাজ... দুর্বাসা থাইকা দ্বৈপায়ন কোনো অংশে ছোট ঋষি নন। মন্ত্র দিয়া যদি দেবতারে ডাইকা মানুষের গর্ভে সন্তান পয়দা করা যাইত তবে নিজে গিয়া দ্বৈপায়ন উঠতেন না ছোটভাইয়ের বৌদের বিছানায়। কুমারী সেবিকা কুন্তীরে দুর্বাসা মন্ত্র দিছে না পোলা দিছে সেইটা পাণ্ড ঠিকই বোঝে। ...কিন্তু রাজি না হইয়াই বা তার কী উপায়? পোলাপান না থাকলে স্বর্গ কি নরক হয় সেইটার থেকে বড়ো কথা হলো সমাজে বিবাহিত আঁটকুড়ার কোনোই জায়গা নাই... পাণ্ডরে সিস্টেম কইরা কুন্তী তার কোলে একটা পোলা তুইলা দেয়- দেখেন দেখেন রাজা পাণ্ডু। দুর্বাসার দেয়া মন্ত্রের ক্ষমতায় ধর্মের ঔরসে এ সন্তান জন্মাইছে আমার গর্ভে।

এই পোলা কিন্তু আপনার প্রথম সন্তান। আপনের পরে এই পোলায়ই হইব হস্তিনাপুরের রাজা... এর নাম রাখছি যুধিষ্ঠির... এরপরে একটা। তারপর আরেকটা। দেবতার নাম করে কুন্তী তিন তিনটা পোলা তুইলা দেয় পাণ্ডুর কোলে। পাণ্ডু খুবই খুশি।

এখন আর তারে নিঃসন্তান কইতে পারব না কেউ। কিন্তু মাদ্রী খেইপা উঠে কুন্তীর উপর- আমারে বেক্কল পাইছ তুমি? দেবতারে ডাক দিলা আর তারা আইসা তোমারে পোল দিয়া গেলো। ...সাদা সাদা আর্য দেবতারা আইসা তোমারে দিয়া গেলো ভীম আর অর্জুনের মতো কালা কালা পোলা? এইসব ভগিচগি অন্যেরে বুঝাইলেও আমারে বুঝাইতে আসবা না কইলাম। কুড়াইন্যা পোলাপানও পাণ্ডরাজা মাইনা নিবো। কিন্তু আমারে অত নাদান ভাইব না তুমি।

বনবাসে আইসা পোলা জন্মানোর যে স্বাভাবিক সময়কাল তা পূরণ হইবার আগেই প্রথম পোলা হইছে তোমার। তুমি যদি মনে করো যে হস্তিনাপুরে বিদুরের লগে তোমার ঢলাঢলি আমার চোখে পড়ে নাই তবে তুমি ভুলের মধ্যে আছ। তুমি যে পয়লা পোলার বীজ হস্তিনাপুর বিদুরের ঘর থাইকাই লগে নিয়া আসছিলা সেইটা পোলার চেহারাতেই প্রমাণ। আর তোমার দ্বিতীয় পোলা ভীমের চেহারা এইখানকার যে কোনো পাহাড়ি মানুষের চেহারার লগে খাপে খাপে মিল; সেইটা কি অস্বীকার করবা তুমি? আর এইখানকার নিষাদ পোলাপানের লগে তোমার তিন নম্বর পোলা অর্জুনরে ছাইড়া দিলে তো তুমিই তারে তাগোর থিকা আলাদা করতে পারবা না। ...আমারে ওইসব মন্ত্রফন্ত্র বুঝাইও না।

আমি কিন্তু সবাইরে কইয়া দিমু তুমি কেমনে কী করছ... কুন্তী হাসে- বেক্কল নারী। বুদ্ধি থকলে কি ভাই তোরে নামর্দের কাছে বিক্রি কইরা দেয়? তুই বুদ্ধিমান হইলে তো ভাইয়ে তোর লাইগা স্বয়ংবরা করত...। মাদ্রীও খেঁকিয়ে উঠে- ভাইয়ে বিক্রি করুক আর দান করুক। এখন আমি পাণ্ডুর রানি। চোখের সামনে তুমি ভংচং কইয়া পোলা বিয়াইবা আর আমি আঁটকুড়া হইয়া বইসা থাকুম? - তোরে পোলা বিয়াইতে নিষেধ করছে কেডায়? সবকিছুই যখন বুঝস তখন যা; দুইচারটা পোলাপান তুইও পয়দা কর... মাদ্রী এইবার একটু দমে যায়- বাচ্চা পয়দা করার সিস্টেমতো জানি।

কিন্তু তুমি যেমন দেবতা টেবতার নাম দিয়া সেইগুলারে জায়েজ কইরা ফালাইতে পারো; সেইটাতে আমি জানি না... কুন্তী হিসাব করে; এখন মাদ্রীর পোলাপান হইলে তারা সকলেই হইব কুন্তীর তিন পোলার বয়সে ছোট। সিংহাসন দাবি করার দিকে তারা থাকব সকলের পিছনে। তাছাড়া তার তিন পোলার আরো দুয়েকটা ভাই থাকলে হাতের শক্তি বাড়ে। হউক। মাদ্রীরও তাইলে পোলাপান হউক।

তাতে তার মুখ যেমন বন্ধ হবে তেমনি নিজের ছিদ্র ঢাকার লাইগা সে কুন্তীর ছিদ্রও ঢাইকা রাখব আজীবন.... মারামারি না কইরা শত্রুরে কৃতজ্ঞ বানাইতে পারলে বেশি কামে দেয়। কুন্তী আস্তে আগে গিয়া মাদ্রীরে ধরে- তুই গর্ভধারণের সিস্টেম কর। মন্ত্র দিয়া তোর গর্ভ জায়েজ করার দায়িত্ব আমার। তুই খালি গিয়া পাণ্ডরাজারে কবি যে- আমিও পোলার মা হইতে চাই। দিদিরে কও তার দেবতা ডাকার মন্ত্র আমারে একটু ধার দিতে।

এইটা হইলেই হইব। তাতে সকলেই জানব যে একই সিস্টেমে দেবতাগোরে ডাইকা পাণ্ডরাজার বংশরক্ষার লাইগা পোলাপান পয়দা করছি আমরা... মাদ্রী গিয়া পাণ্ডর কাছে কয় কুন্তীরে কইতে মন্ত্রখান তারে ধার দিতে। পাণ্ডও কয়। কুন্তীও মাইনা নেয় কিন্তু মাদ্রীর পোলাপানের সীমাসংখ্যা একটু বাইধা রাজা জরুরি বিবেচনা কইরা কয়- তারে আমি মন্ত্র দিমু। কিন্তু একবারের বেশি কইলাম দিমু না।

এতে আমার অসুবিধা আছে... কিন্তু একবারেই মাদ্রী জন্ম দেয় যমজ সন্তান। সে যাতে আবার পোলা জন্ম দিবার চেষ্টা না করতে পারে সেইজন্য কুন্তী গিয়া স্বামীরে বোঝায়- কইছিলাম না আপনের ছুডু বৌ একটা হারামজাদি? দেখছেন কী করছে সে? সে একবারে মন্ত্র দিয়া দুই দুইজন দেবতারে ডাইকা আইনা দুইটা পোলা জন্মাইছে। এইটা কিন্তু মন্ত্রের শর্তের পরিষ্কার লঙ্ঘন। আপনে আমারে আর অনুরোধ কইরেন না মাদ্রীরে মন্ত্র ধার দিবার... মাদ্রী আর মন্ত্রও পায় না; ছেলেও নিতে পারে না আর। তার থাকে দুইটাই ছেলে।

কুন্তীর তিন আর সব মিলে পাণ্ডরাজা পায় পাঁচখান পাণ্ডব... গান্ধারী জননী হইছে একশো পোলার। কুন্তী হাসে। গাঞ্জাগপ্পের আর জায়গা পায় না। বিয়ার অত বছর পার হইলেও যে একটা পোলার জন্ম দিতে পারল না; কুন্তী বনে আসার পর এক সাথে সে জন্ম দিয়া দিলো একশোটা পোলা আর একখান মাইয়া। পোলা মাইয়া জন্মানো যেন নদীতে জাল ফেইলা ছোট মাছ ধরা।

জাল ফেললাম আর তুইলা গুইনা কইলাম একশো একখান হইছে। রাজ্যের সেনাবাহিনী ভীষ্মের হাতে; তাই ধৃতরাষ্ট্র ধান্দা কইরা একশো পোলার গপ্প বানাইছে। সকল সৈনিক ভীষ্মের কথা শুনলেও বড়ো হইয়া এই একশোটা পোলা চলব ধৃতরাষ্ট্রের ইচ্ছায়। কী একখান গল্প বানাইছে তারা; গান্ধারী নাকি কুমড়া প্রসব করছে। তারপর সেই কুমড়ারে কাইটা টুকরা কইরা ঘিয়ে ভিজাইয়া থুইছেন শ্বশুর দ্বৈপায়ন।

সেই ঘিয়ে ভিজানো কুমড়ার টুকরা থাইকা একশো একটা পোলামাইয়ার মা হইছে গান্ধারী...। কিন্তু কাহিনীটা না মাইনাও কুন্তীর উপায় নাই। কারণ কাহিনীর সাথে গান্ধারী শ্বশুর দ্বৈপায়নের নামখানও জড়াইয়া নিছে। দ্বৈপায়নের অতই কেরামতি; তিনি কুমড়া কাইট্টা ঘিয়ে ভিজাইয়া থুইলে সেইখান থাইকা মানুষ পয়দা হয়। তার যদি এতই ক্ষমতা তবে ছোটভাইয়ের বৌগুলার বিছানায় না গিয়া ঘিয়ের মধ্যে কুমড়া ভিজাইয়াই তো তিনি ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ড আর বিদুরের জন্ম দিতে পারতেন?... কিন্তু উপায় নাই; দ্বৈপায়ন নিজেও এই কাহিনীর বিরোধিতা করেন নাই।

মুনিঋষিদের নামের লগে এইরকম কিছু অলৌকিক ক্ষমতার কাহিনী থাকতে হয়। ঋষিরা বহুত কষ্ট কইরা এইসব কাহিনী বানায়। দ্বৈপায়ন যদি এইরকম একটা ফাও কাহিনী পাইয়া যান তো ছাড়বেন কেন? এইটা একটা সুবিধাও। ঋষিরা নিজের নামে ফাও কাহিনী চালান বইলাই অন্যের ফাও কাহিনীগুলাও তারা মাইনা নেন। এই যেমন কুন্তীর দেবতা কাহিনী।

এই কাহিনীটাও তো দ্বৈপায়ন মাইনা লইছেন; স্বীকৃতিও দিছেন... থাউক। নিজের কাহিনীর খাতিরে গান্ধারীর চাল কুমড়া কাহিনীটাও কুন্তীরে মাইনা নিতে হইব... যদিও কুন্তীর সন্দেহ হয়; বোধহয় দ্বৈপায়নই নিজে একই বয়সের এই একশো একটা পোলাপান আইনা গান্ধারীরে দিছেন... হইতেও পারে; ধৃতরাষ্ট্র তার বড়োপোলা। তার লাইগা মায়া থাকতেই পারে তার। কিন্তু ভীষ্মদেব কি মাইনা নিছেন গান্ধারীর একশো পোলার কাহিনী? ভিতর থাইকা না মানলেও বাইরে না মাইনা তার উপায় নাই। যেহেতু দ্বৈপায়ন এই কাহিনীর সাথে সরাসরি যুক্ত আছেন...... গান্ধারীর এখন একশোটা পোলা।

তাই নিজেদের পোলাদের আরেকটু শক্ত পোক্ত না কইরা হস্তিনাপুর যাওয়া ঠিক না। নিজের পোলাদের সুবিধার জন্যই পাঁচ ভাইরে এক কইরা বড়ো করা দরকার। পাঁচ ভাই এক থাকলে হিসাব মতোই বড়োভাই হিসাবে কুন্তীর ছেলেরা মাদ্রীর ছেলেদের সেবাযত্ন পাইব। তাই কুন্তী একাই পাঁচটা পোলার দেখাশোনা করে আর মাদ্রী সেবা করে পাণ্ডুরাজার। এর মধ্যে একদিন পাণ্ডুরাজা যায় মইরা।

মরা স্বামীর লাশ সামনে রাইখা কুন্তী আগুন হইয়া উঠে মাদ্রীর দিকে- হারামজাদি। নিজের গতর ঠান্ডা করার লোভে স্বামীরে মাইরা ফালাইলি তুই? এমন অভিযোগ মাদ্রী কল্পনাও করে নাই। বনের ভিতরে স্বামীরে নিয়া ঘোরাঘুরির সময় তার প্রতি স্বামীর হঠাৎ খায়েশ জাগে। না না কইরাও আর শেষ পর্যন্ত সে না করতে পারে না। কিন্তু স্বামী তার দুব্বল হার্টের মানুষ।

উত্তেজনায় শরীর টানটান হইয়া উঠলে ধুম কইরা তার হৃৎপিণ্ডখান বন্ধ হইয়া যায়। মাদ্রী অতটা বোঝে নাই। কিন্তু কামোত্তেজনার সময় যে পাণ্ডরাজা মরছে সেইটা তো আর অস্বীকার করতে পারে না। সে মুখ নত কইরা রাখে। কিন্তু কুন্তী আগে বাড়ে আরো- বেশরম বেহায়া নারী।

তেরো বচ্ছর বয়স তোর নিজের দুইটা পোলার। পাণ্ডুরাজার বড়োপোলাটা ষোলো বচ্ছরে পা দিছে এইবার। তাগোরে কী বলবি তুই তাদের বাপের মৃত্যুর কারণ? তুই কি তাদের বলতে পারবি যে তোর লগে যৌনখেলা খেলাইতে নিয়া তাগোর বাপেরে খাইছস তুই?... কোন মুখে তুই এখন হস্তিনাপুর যাবি? নগদ পয়সা দিয়া কেনা ভীষ্মের দাসী তুই। এখন হস্তিনাপুরে গেলেই সন্তান দুইটারে কাইড়া নিয়া তোরে আবার কারো কাছে বিক্রি করবেন না ভীষ্ম; তার কি নিশ্চয়তা? আর তোর অপরাধে আমারেও মানতে হবে নির্বাসনের বিধান। কেননা অসুস্থ রাজা পাণ্ডুরে দেইখা রাখার ভার আমার উপরেই দিছিলেন গঙ্গার নন্দন আর পাটনি সত্যবতী.... থাক তুই... তুই থাক তোর কামবাসনা নিয়া।

এখন স্বামীও নাই। এদিক সেদিক যেদিক ইচ্ছা গিয়া তুই তোর কাম বাসনা কর। নিজের পেটের পোলাগোর সামনে যৌনখেলায় পিতার মৃত্যুর বর্ণনা দিবার থাইকা আমার মইরা যাওনই ভালা। পোলাগের সামনে তাগোর অসুস্থ পিতার লগে যৌনকর্মের কাহিনী বলার লাইগা বাইচা থাক তুই। আমি বরং আত্মঘাতী হয়ে সহযাত্রী হই নিহত স্বামীর।

কেননা পৃথার কাছে অসম্মানে বাইচা থাকনের চেয়ে মৃত্যুই ভালো; বিশেষ করে যে স্বামীরে শতশত পাত্রের সামনে মালা দিয়া বরণ করছি আমি। তোর তো ওইসব কিছু না। সম্মান তোর কোনো কালেই ছিল না; বাকি জীবনও তুই কাটায়ে দিতে পারবি দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা কিংবা দাসীগিরি করে। নিজের পোলাদের ভবিষ্যৎ নিয়া আমার চিন্তা নাই। কারণ বংশের বাত্তি পঞ্চ পাণ্ডবরে বুকে তুইলা রাখবেন ভীষ্ম আর সত্যবতী।

... সংবাদটা শুইনা তাই স্বামীর লগে সহমরণে যাইবার লাইগা আমি সাথে কইরা নিয়া আসছি বিষ... বিষপাত্র তোলে কিন্তু মুখে দেয়া না কুন্তী। আড়চোখে দেখে মাদ্রী কী করে। মাদ্রী ভাইঙ্গা পড়ে। কুন্তী অপেক্ষা করে। আঘাতখান জায়গামতোই লাগছে মাদ্রীর।

মাদ্রী দৌড়াইয়া আইসা কুন্তীর বিষের পাত্র কাইড়া নেয়- দিদি গো। জীবনে আমার সম্মান আছিল না সত্য। কিন্তু নিজের পোলাগো সামনে এই কাহিনী আমারে কইতে কইও না গো দিদি। দোষ আমারই। যিনি এই দোষ থাইকা আমারে খণ্ডাইতে পারতেন তিনি এখন নিথর।

আমি আর নিজের পোলাগো সামনে যাইতে চাই না। তুমি যা হয় একটা কিছু তাদের বুঝাইয়া কইও আর নিজের পোলাগো লগে আমার দুইটা পোলারেও একটু জায়গা দিও দিদি... বিষ খেয়ে মাদ্রী পাণ্ডুর সহগামী হয় আর প্রায় সতের বছর পর পাণ্ডু আর মাদ্রীর লাশ নিয়ে হস্তিনাপুরে পা দেয় কুন্তী। সাথে তার পাঁচ পাঁচটি তরুণ পাণ্ডব। যুধিষ্ঠির ষোলো- ভীম পনেরো- অর্জুন চৌদ্দ- নকুল সহদেব তেরো। কুন্তী জানে এখন রাজা পাণ্ডুর সৎকার আর শোকেই ব্যস্ত থাকবে সবাই।

এই শোকসময়েই পিতামহী সত্যবতীকে ম্যানেজ করে প্রাসাদে জায়গা করে নিতে হবে। পাঁচ নাতির দায়িত্ব সঁপে দিতে হবে কুরুবুড়া ভীষ্মের হাতে। আর বিদুরের লগে আলাপ করে বুঝে নিতে হবে রাজ্যের বাতাস.... সৎকারের শেষ দিনই দ্বৈপায়ন আইসা সত্যবতীর হাতে ধরেন- চলো মা। এইবার তুমি আমার আশ্রমে চলো। বহুত করছ তুমি এই বংশের লাইগা।

এইবার তাগোর ভবিষ্যৎ তাগোরে ব্যবস্থা করতে দেও। আর অশান্তির দরকার নাই তোমার... দ্বৈপায়ন বহুত বুদ্ধিমান মানুষ। ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ড পর্যন্ত পুরা বংশটাই ছিল সত্যবতীর। সেই বংশ এইখানে শেষ। দ্বৈপায়ন তো জানেন তার দুই পুত্রবধূর পোলাপান একটাও তার নিজের পোলাগো পয়দা না।

এদের মইধ্যে মারামারি অনিবার্য। সত্যবতীর এক নাতি মইরা গেছে; আরেকটা বুড়া। এই বংশ বৃদ্ধির আর কোনো পথ নাই। হস্তিনাপুরে এখন শুরু হইব কুন্তীর না হয় গান্ধারীর বংশ বিস্তার। তাই এই অশান্তি থাইকা তিনি মায়েরে সরাইয়া নিতে চান... সত্যবতীও রাজি।

সাথে তার দুই পুত্রবধূ অম্বিকা আর অম্বালিকারেও নিলেন। তারপর যে কানীন পুত্রকে রেখে রাজবধূ হয়েছিলেন তিনি। সেই কানীন পুত্রের হাত ধরেই শান্তনুর পরিবার ছেড়ে বনবাসী হলেন সত্যবতী। পেছনে পড়ে রইল নিজের বংশ বিস্তার করতে গিয়া যার বংশবিস্তার তিনি বন্ধ কইরা দিছিলেন; সংসারে আটকা পড়া নিঃসঙ্গ সেই ব্রহ্মচারী গঙ্গার নন্দন আর দুই নাতিবৌ গান্ধারী-কুন্তীর সংসার.... ২০১২.১১.১০-১৭ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।