আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৮

উত্তরার লাগে ছোটো ভাই অভিমন্যুর বিবাহে দ্রৌপদীর পাঁচ পোলা প্রতিবিন্ধ্য- সুতসোম- শ্র“তকর্মা- শতানীক আর শ্রুতসেনও আইসা হাজির হইছে বিরাটের দেশে। কিন্তু শৈশব থেকে তেরো বচ্ছর দূরে বড়ো হইয়া জোয়ান পোলারা যেমন না পারে মায়েরে মায়ের মতো ভাবতে তেমনি দ্রৌপদীও পারে না ফিরাইয়া আনতে তেরো বচ্ছর আগে হারাইয়া ফেলা মাতৃত্বের রূপ। তাই অভিমন্যুর বিবাহেও দ্রৌপদী নেহাত পাণ্ডববধূরূপে রূপের ঝলকানি দেওয়া সাজগোজ করে...
উত্তরা অভিমন্যুর বিবাহ উসিলায় মৎস্যদেশের উপপ্লব্য নগর পরিণত হইছে কুন্তী আর দ্রৌপদীর পিতৃবংশের সমাবেশস্থলে। নিজের দুই পোলা বলরাম আর কৃষ্ণরে নিয়া হাজির হইছেন স্বয়ং কুন্তীভ্রাতা বসুদেব; যাদব বংশীয় আরো অসংখ্য যোদ্ধা আর গোত্রপ্রধানের সাথে আছে ‌প্রদ্যুম্ন-শাল্ব আর সাত্যকিও। দুই পোলা ধৃষ্টদুম্ম আর শিখণ্ডীর সাথে বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়া আসছেন দ্রৌপদীপিতা পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ...
বিবাহের পরদিনই বসে পাণ্ডবগো বনবাসোত্তর প্রথম রাজনৈতিক সভা।

দ্বারকা-পাঞ্চাল গোত্রের সাথে এই সভায় যোগ দেয় পাণ্ডবদের নতুন সম্বন্ধী মৎস্যদেশরে রাজপরিবার আর সকলের সামনে সভায় প্রসঙ্গটা উত্থাপন করে কৃষ্ণ...
সংক্ষেপে কাহিনী বয়ান শেষে কৃষ্ণ সকলের দিকে তাকায়- যুধিষ্ঠির এইবার তার ন্যায্য পাওনা চান; আপোশে যদি তা না পাওয়া যায় তবে যুদ্ধেও পিছপা হবেন না তিনি। এখন আমাদের দায়িত্ব হইল দ্বিতীয় পন্থার লাইগা যুধিষ্ঠিরের হাত শক্তিশালী করা...। তয় যুদ্ধ ঘোষণার আগে দুর্যোধনের মনোভাব পরিষ্কার কইরা জানা প্রয়োজন। তাই আমার প্রস্তাব হইল; একজন চালাকচতুর দূত পাঠানো হোক দুর্যোধন কী করতে চায় না চায় তা জানতে আর পাশাপাশি চলতে থাকুক নিজেগো শক্তির সমন্বয়...
কৃষ্ণ তার কাহিনী বয়ানে যুধিষ্ঠিরের যথেষ্ট প্রশংসা আর দুর্যোধনের পুরাটাই বদনাম করেন। এই জিনিসটা পছন্দ করতে পারে না বলরাম- দূত পাঠানের প্রস্তাব ভালো।

তবে সেইটা যেন যুদ্ধ বাঁধানোর দূতিয়ালি না হইয়া সত্যি সত্যি শান্তির লাইগাই দূতিয়ালি হয় সেইটাও খেয়াল রাখতে হইব। কারণ আমার মতে দুর্যোধন কোনো অন্যায়ও যেমন করে নাই তেমনি পাণ্ডবগো পৈতৃক সম্পত্তিও সে দখলও করে নাই। পাশাখেলার শর্তমতেই পাণ্ডবরাজ্যের ন্যায্য অধিকারী হইছে সে। বেকুবি আর অন্যায় যদি কেউ কইরা থাকে তবে তা মূলত করছে যুধিষ্ঠির। কারণ লাফাইতে লাফাইতে সে নিজের বুদ্ধিতেই শকুনির পাশা খেইলা হারাইছে বাপের রাজ্যপাট...
বলরামের কথায় ক্ষেইপা উঠে সাত্যকি- তুমি যেমন চাষা।

তোমার কথাবার্তাও সেইরকম চাষামার্কা ক্ষ্যাত; দুর্যোধন কোনো অন্যায় করে নাই... ঢংয়ের কথা কও? কথা যদি কইতেই হয় তয় এইখানে আমরা দুর্যোধনরে সাপোর্ট করতে আসছি না যুধিষ্ঠিররে সাহায্য করতে আসছি সেইটা বুইঝা কথা কইলে সবার লাইগাই ভালো। কৌরবরা যতই বলুক না কেন অজ্ঞাতবাসের তিন দিন থাকতেই পাণ্ডবগো তারা খুইজা বাইর কইরা ফালাইছে; কিন্তু এইখানে আমাদের সকলের সিদ্ধান্ত হইল কথাটা আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা সকলেই মনে করি পাণ্ডবরা পাশাখেলার সবগুলা শর্তই অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। তাই এখন আমাদের দায়িত্ব হইল পাণ্ডবগো তাদের ন্যায্য মাটি ফিরা পাইতে সাহায্য করা। দুর্যোধন যদি ভালোয় ভালোয় ফিরাইয়া দেয় তয় ভালো।

আর যদি না দেয় তয় আমরা সকলেই যুধিষ্ঠিরের পক্ষে যুদ্ধ করব। এইটাই সারকথা...
দ্রুপদ সাত্যকিরে সমর্থন কইরা কথা আগে বাড়ায়- দুর্যোধন এমনি এমনি দিব না। ধৃতরাষ্ট্র পোলার কথায় উঠেন বসেন; সুতরাং তিনিও ভিন্ন কিছু বলবেন না। ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপ কুরুরাজের পোষ্য; দুর্যোধনের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যাওয়ার ক্ষমতা তাদের নাই। আর কর্ণ-শকুনি-দুঃশাসন তো সর্বদাই দুর্যোধনের পক্ষের মানুষ।

...সুতরাং বলরামের কথা আমিও সমর্থন করতে পারলাম না। আমি বরং মনে করি দুর্যোধনের কাছে গিয়া বেশি মিঠা কথা কইলে সে আমাদের দুর্বল ভাববে। তাই আমার মত হইল দেরি না কইরা আরো সৈন্য সংগ্রহের লাইগা এখনই বিভিন্নদিকে সুযোগ সন্ধান শুরু করা ভালো। আমি যদ্দুর জানি দুর্যোধন অলরেডি সৈন্য সংগ্রহ শুরু কইরা দিছে। তাই যত আগে আমরা মিত্রদের পক্ষে টানতে পারব তত লাভ।

তয় এইসবের লগে দূতিয়ালিও চলুক। সেইক্ষেত্রে দ্যূত হিসাবে আমি আমার পুরোহিতরে হস্তিনাপুর পাঠাইতে পারি; কৃষ্ণ তারে বুঝায়ে দিবেন তিনি কী কইবেন না কইবেন কুরুরাজের কাছে...
বলরাম বেকুবটা যেখানেই থাকে সেখানেই প্রসঙ্গ না বুইঝা কথা কইতে গিয়া সব মাটি কইরা দেয়। আর সেইটা কাটাইতে গিয়া সাত্যকি আবার পুরাটারেই গান্ধা কইরা ফালায়। এই বলরাম আর সাত্যকির ঠোকাঠুকির লাইগা একবার ভীমের পোলা কী নাকান-চুবানটাই না দিলো কৃষ্ণরে। তাই এইবার আগে থাইকাই কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিররে কইয়া দিছে এই আলোচনায় যেন ভীমের পোলা ঘটোৎকচ না থাকে।

কৃষ্ণের কথায় যুধিষ্ঠিরও তারে বিবাহে নিমন্ত্রণ করে নাই। কিন্তু নিজের সাক্ষাত বড়ো ভাই বলরাম; সারা বংশের মানুষ যেখানে আসতাছে সেইখানে ভাগিনার বিবাহে তো আর তারে আসতে নিষেধ করা যায় না...
আলোচনাটা আর চালানও সম্ভব না। সংক্ষেপে সভা শেষ করার লাইগা কৃষ্ণ পয়লা বলরামরে সাপোর্ট কইরা ঠান্ডা করে- ভাইজানের কথাটা ফালান দিবার মতো না। কুরু-পাণ্ডব দুই বংশের লগেই আমাদের সমান সম্বন্ধ। দুর্যোধন আমার পোলার শ্বশুর আর আমি পাণ্ডবগো মামাতো ভাই।

অন্যদিকে ভীম আর দুর্যোধন দুইজনই বলরামের সাক্ষাত শিষ্য। তাই আমরা দুইপক্ষেরই যেমন মঙ্গল চাই তেমনি শান্তিও চাই। তয় মূল কথা হইল এইখানে আমরা উত্তরা-অভিমন্যুর বিবাহে দাওয়াত খাইতে আসছি; যুদ্ধের আলোচনা করতে আসি নাই। তাই আমি কই কি; দ্রুপদরাজ যে প্রস্তাব দিছেন সেইটাই সবচে ভালো প্রস্তাব। ...আপনি আপনের পুরোহিতরেই হস্তিনাপুর পাঠান।

আপনে মুরুব্বি মানুষ; কী কইতে হইব না হইব তা আপনিই তিনারে বুঝাইয়া দেওয়া সব থিকা ভালো। আর এরপরে কী করতে হবে না হবে তা থাউক পাণ্ডবগো সিদ্ধান্তের উপর। ...বিবাহের খানাপিনা আর আদর আপ্যায়নের লাইগা সকলের পক্ষ থিকা আমি মৎস্যদেশের রাজা বিরাট আর তার পরিবাররে ধন্যবাদ জানাই। সুখী জীবন কামনা করি উত্তরা আর অভিমন্যুর। ...অনুমতি দিলে আমরা এখন সকলে যার যার ঘরে ফিরা যামু।

তারপর পাণ্ডবগো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাওয়ার পর স্বতন্ত্রভাবে সিদ্ধান্ত নিমু কে কার পক্ষে যুদ্ধ করব আর কার পক্ষে না...
দ্বারকাবাসীরা চলে যায়। দ্রুপদের পুরোহিত রওয়ানা দেন হস্তিনাপুর। যুধিষ্ঠির-বিরাট আর দ্রুপদ নিতে থাকেন যুদ্ধের প্রস্তুতি। সকল সংবাদ ঠিকঠাক মতো গিয়া পৌঁছায় দুর্যোধনের কানে এবং দ্রুততালে সে চালায়ে যায় তার মিত্র আর সৈন্যের সন্ধান...
যুদ্ধে সহায়তার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব নিয়া একইদিনে একইসাথে কৃষ্ণের ঘরে হাজির হয় দুর্যোধন আর অর্জুন। দুইজনেই কৃষ্ণের আত্মীয়।

কাউরেই যেমন ফিরান সম্ভব না তেমনি উচিতও না। তাই কৃষ্ণ তার সামরিক ক্ষমতারে দুইভাগে ভাগ করেন; একভাগে থাকে তার দুর্ধর্ষ নারায়ণী গোপ সৈন্য আর অন্যভাগে থাকেন নিরস্ত্র কৃষ্ণ নিজে। কৃষ্ণ পক্ষ নিবেন কিন্তু যুদ্ধ করবেন না কোনো পক্ষেই। আর অর্জুন যেহেতু বয়সে দুর্যোধন থাইকা ছুটু তাই কৃষ্ণ প্রথমে অর্জুনরেই সুযোগ দেন দুইভাগ থাইকা যে কোনো একটা পছন্দ কইরা নিতে...
- কৃষ্ণ বিন্দুমাত্র দ্বিধা না কইরা নিরস্ত্র কৃষ্ণরেই বাইছা নেয় অর্জুন আর কৃষ্ণের গোপ সৈন্য পাইয়া খুশি হইয়া বলরামের কাছে যায় দুর্যোধন। সিধাসাধা এই মানুষটার কাছে কুরুপাণ্ডব যুদ্ধ মানে তার দুই সাক্ষাত গদার শিষ্য ভীম আর দুর্যোধনের লড়াই।

সে দুর্যোধনরে কয়- বহুত চেষ্টা করলাম যুদ্ধ থামাইতে। কিন্তু দেখলাম কৃষ্ণ এর মধ্যেই পক্ষ ঠিক কইরা ফালাইছে। কিন্তু আমি যেহেতু কাউরে ফালাইয়া কাউরে টানতে পারুম না। তাই আমার সিদ্ধান্ত হইল আমি কারো পক্ষেই যামু না...। যুদ্ধ করব না আমি...
দুর্যোধন দ্বারকা থিকা আরো কিছু কমবেশি প্রতিশ্রুতি নিয়া বাড়ি যায় আর অর্জুন কৃষ্ণরে কয়- যুদ্ধে আপনে আমার সারথি হবেন...
যুধিষ্ঠিরের আমন্ত্রণে নকুল সহদেবের মামা মদ্ররাজ শল্যে আসতাছিলেন ভাগিনার কাছে।

কিন্তু আসার পথে দুর্যোধন তারে পটাইয়া নিজের পক্ষে নিয়া যায়। তিনি পক্ষ পরিবর্তনের সংবাদটা ভাগিনারে জানাইতে আসলে যুধিষ্ঠির কয়- অসুবিধা নাই মামা আপনে দুর্যোধনের পক্ষেই যুদ্ধ করেন। কারণ আমি জানি মামা; শত্রুপক্ষে যুদ্ধ করলেও আপনে আমাগোরে মায়া কইরা মারবেন যাতে না মরি। সেইটা নিয়া আমি ভাবি না। তয় আপনে যেহেতু মামা কৃষ্ণের সমান যোদ্ধা তাই দুর্যোধন যেন আপনের সম্মান রক্ষা করে সেইটা একটু দেইখেন...
এমন তেলানিতে শল্য চক চক কইরা উঠে- তুমি সর্বদাই সত্য কথা কও; আর আমি যে কৃষ্ণের সমান এই কথাটাও তুমি ছাড়া কেউ স্বীকার করতে নারাজ।

...তয় সম্মান রক্ষার কথাটা একটু বুঝাইয়া কওতো ভাগিনা...
যুধিষ্ঠির কয়- নিশ্চয়ই শুনছেন মামা; কৃষ্ণ কিন্তু যুদ্ধে যোগ দিলেও যুদ্ধ করব না। সে হইব পাণ্ডবপক্ষের সবচে বড়ো যোদ্ধা অর্জুনের সারথি। এখন আপনে যদি অস্ত্র লইয়া সৈনিকের লগে দৌড়াদৌড়ি করেন তাইলে তো কৃষ্ণের লগে আর আপনের সমানে-সমান মর্যাদাটা রক্ষা হইল না। তাই আমি কই কি; আপনে যদি কুরুপক্ষের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা কর্ণের সারথি হইতে পারেন তাইলে কৃষ্ণের লগে আপনের সমান মর্যাদা রক্ষায় আর কোনো সমস্যা হয় না...
শল্য কয়- বুদ্ধি খারাপ দেও নাই ভাগিনা। কিন্তু তাই বইলা ছোটোলোকের পোলার রথ চালাইতে হইব মোর? যুধিষ্ঠির কয়- সেইটা করলে আপনে ভাগিনাদের সবচে বড়ো উপকারটাও করতে পারবেন মামা... শল্য কয়- কেমনে? যুধিষ্ঠির কয়- কর্ণের রথ চালাইতে চালাইতে আপনে মনের সাধ মিটাইয়া জাতপাত তুইলা সারাক্ষণ তারে গালাগালি করবেন।

তাতে মাথাগরম কর্ণ আউলা হইয়া উল্টাপাল্টা অস্ত্র চালাইব আর এক ফাঁকে আপনের ভাগিনা অর্জুন তারে পাইড়া ফেলব ক্ষ্যাতে...
শল্য হিসাব কইরা দেখে মন্দ না। কৃষ্ণের সমান মর্যাদাও পাওয়া যাবে আর ভাগিনাদের উপকারও করা যাবে সব থিকা বেশি- আমি রাজি ভাগিনা...
মোট সাতটা বাহিনী জোগাড় হইছে পাণ্ডবদের। তার মধ্যে বড়ো চাইরটাই আত্মীয় বাহিনী: দ্রুপদের পাঞ্চালসেনা বিরাটের মৎস্যসেনা- ঘটোৎকচের একচক্রাসেনা আর সাত্যকির যাদবসেনা। এর বাইরে আছে ধৃষ্টকেতুর চেদিসেনা- জয়ৎসেনের মগধসেনা আর খুচরা কিছু সৈনিক নিয়া পাণ্ডবগো নিজস্ব একটা বাহিনী...
অন্যদিকে ধৃতরাষ্ট্রপুত্র বিন্দু আর অনুবিন্দুর অবন্তি বাহিনী; মেয়েজামাই জয়দ্রথের সিন্ধু বাহিনী আর নিজস্ব তিনটা বাহিনী নিয়ে দুর্যোধনের পারিবারিক বাহিনীর সংখ্যা পাঁচ। এর বাইরে আছে ভগদত্তের চীনা আর কিরাতসেনা; কৃতবর্মার অন্ধক ও যাদবসেনা; শল্যের মদ্রসেনা; যবন আর শক সেনা নিয়া সুদক্ষিণের কম্বোজ বাহিনী; নীলের নেতৃত্বে দক্ষিণাত্যের মহিষ্মন্তিসেনা আর সোমদত্তের পুত্র ভূরিশ্রবার নিজস্ব একটা বাহিনী।

মোট এগারোটা বাহিনী প্রস্তুত দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করার লাইগা...
দুইপক্ষে সেনাসংগ্রহের মাঝে একদিন সন্ধির প্রস্তাব নিয়া দ্রুপদের পুরোহিত আইসা হাজির হন রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। পয়লা মিঠা কথায় বনবাসে পাণ্ডবগো দুর্দশার কথা কইয়া রাজা ধৃতরাষ্ট্রের মন গলানোর চেষ্টা করেন। তারপর পাণ্ডবগো লগে শকুনি-দুর্যোধনের দুষ্কর্ম আর অন্যায়ের কিছু ইঙ্গিত দিয়া তিনি সভাজনের কাছে অনুরোধ করেন যেন তারা পাণ্ডবগো ন্যায্য পাওনার লাইগা রাজা ধৃতরাষ্ট্ররে সুপারিশ করেন। তারপরে তিনি এইটাও স্মরণ করাইয়া দেন যে পাণ্ডবরা মোটেই বিবাদ চায় না কিন্তুক কুরুদের সৈন্যসংখ্যা যত বেশিই হোক না ক্যান যুদ্ধ শুরু হইলে পাণ্ডবগো সামনে টিকতে পারব না তারা। কারণ ভীম অর্জুনের অস্ত্রের লগে কৃষ্ণের বুদ্ধিও যোগ হইছে পাণ্ডব শিবিরে এখন....
ভীষ্ম কন- কথা ঠিকাছে; পাণ্ডবগো অধিকারও ঠিকাছে আবার আপনার প্রস্তাবও ঠিকাছে।

কিন্তু মনে লয় আপনে আমাগের ডর দেখাইতে আসছেন। কথা কইবেন কন; কিন্তু ভয়টয় কিছু দেখাইয়েন না কলাম...
কর্ণ ক্ষেইপা উঠে পুরোহিতের দিকে- ব্রাহ্মণ হইয়া অন্যায় আব্দার আপনে ক্যামনে করেন? পাণ্ডবরা যদি প্রতিজ্ঞা পালন করত তবে আপনে না কইলেও দুর্যোধন সসম্মানে তাগোর রাজ্য ফিরাইয়া দিত। কিন্তু তারা তো অজ্ঞাতবাসের এক বচ্ছর পুরা হইবার তিনদিন আগেই ধরা পড়ছে। এখন তারা যদি রাজ্য ফিরা পাইতে চায় তবে গিয়া কন যেন শর্ত মতে আরো বারো বচ্ছর বনবাস আর এক বচ্ছর অজ্ঞাতবাস শেষ কইরা যেন আসে...
হস্তিনাপুরের রাজনীতিতে কর্ণরে কোনোদিনও সহ্য করতে পারেন না ভীষ্ম। তিনি এইবার পুরোহিতরে ছাইড়া কর্ণরে ধরেন- অত লাফাইও না তুমি।

মৎস্যদেশে অর্জুন কী প্যাদানিটা দিছিল মনে আছে তো? এই ব্রাহ্মণের কথা না শুনলে যুদ্ধক্ষেত্রে কিন্তু মাটি খাইতে হইব সবার...
ধৃতরাষ্ট্র দুইজনরে থামাইয়া দ্রুপদের দ্যূতরে কন- যা কইছেন তা আমি শুনছি আর বিবেচনাও করতাছি। এখন চিন্তাভাবনা কইরা উত্তর দিবার লাইগা আমারে কিছু সময় দেন। ...আমি আমার বক্তব্য দিয়া পাণ্ডবগো কাছে অতি শিগগির সঞ্জয়রে পাঠামু কইয়েন...
ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়রে ডাইকা কন- আমি কিন্তু পাণ্ডবগো কোনো দোষ দেখি না। কুরুদেশে দুর্যোধন আর কর্ণ ছাড়া অন্য কেউ তাগোর দোষ দেখে কি না তাও আমার জানা নাই। কিন্তু কী আর করব বলো... নিজের পোলারে তো ফালাইতে পারি না...।

যাই হউক; আমিও মনে করি ভীম অর্জুন আর কৃষ্ণ যেইখানে একসাথে আছে সেইখানে যুদ্ধের আগেই যুধিষ্ঠিররে তার রাজ্য ফিরাইয়া দেওন ভালো। অজ্ঞাতবাসের তিনদিন বাকি না বচ্ছর পুরা হইছে তা এখন ভাবনা অবান্তর। আমার চরদের কাছে বাসুদেবের পোলা কৃষ্ণের যে কাহিনী শুনছি তাতে রাত্তিরে আমার ঘুম হয় না সঞ্জয়। তার উপ্রে শুনতাছি অর্জুন আর কৃষ্ণ সর্বদা একই রথে থাকব... বিষয়টা তুমি বুঝতে পারতাছ সঞ্জয়? ...তুমি যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়া কও- তোমার জ্যাঠা মোটেও যুদ্ধ চান না। তারপর নিজের বুদ্ধি থাইকা এমন কিছু কইবা যাতে যুধিষ্ঠির খুশি হয়।

তয় আমাগো লগে কারা কারা আছে তাও একটু শুনাইয়া দিও; যাতে আমাগোরে অতটা ফেলনা না মনে কইরা বসে। অবশ্য খেয়াল রাইখ যেন তারা ক্ষেইপা না যায়...
সঞ্জয় যুধিষ্ঠিররে যথেষ্ট তেলাইয়া কয়- রাজা ধৃতরাষ্ট্র তার ভাতিজাগো মঙ্গলকামনার সাথে সাথে সকলের লাইগা শান্তি চান। তাছাড়া পঞ্চ পাণ্ডবের লগে যেইখানে কৃষ্ণ ধৃষ্টদুম্ন চেতিকানরা আছে সেইখানে যুদ্ধ কইরা খামাখা বংশক্ষয় করার মতো বোকা তিনি নন; কারণ কুরুপাণ্ডব দুইবংশেরই অভিভাবক তিনি। তাই আমি কই তোমরাও শান্তির পথে ভাবো। কারণ বুইঝা দেখো; যুদ্ধ চাইলে কিন্তু তোমাগোরে যুদ্ধ করতে হইব ভীষ্ম-দ্রোণ-অশ্বত্থামা-কৃপ-শল্য-কর্ণ আর দুর্যোধনের লগে।

সেইটাও কিন্তু খুব সোজা কাম না তা নিশ্চয়ই তুমি ভালো কইরা জানো যুধিষ্ঠির...
সঞ্জয় এইবার কৃষ্ণ আর দ্রুপদের দিকে ফিরে- আপনেরা মুরুব্বি মানুষ। আপনাগোরেই কই; ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্র চান যে আপনেরাই দুই বংশে শান্তির ব্যবস্থা করেন...
যুধিষ্ঠির কয়- যুদ্ধ ছাড়াই যদি যুদ্ধের জিনিস পাওয়া যায় তো কোন আক্কেলে আমি যুদ্ধ করতে যামু? কিন্তু জ্যাঠা ধৃতরাষ্ট্রের নিজের বুদ্ধি ভালো হইলেও চলার সময় তো তিনি তার পোলা দুর্যোধনের বুদ্ধি নিয়া চলেন; যে আবার লাফায় দুঃশাসন কর্ণ আর শকুনির কথায়। কথা হইল; বহুদিন তারা পুরা রাজ্য ভোগ দখল করছেন। এইবার আমারে আমার ইন্দ্রপ্রস্থ ফিরাইয়া দিলে আমিও আগে যা হইছে তা ভুইলা গিয়া যুদ্ধটুদ্ধর কথা চিন্তাও করুম না আর....
সঞ্জয় কয়- এমন কথা কইও না যুধিষ্ঠির। আমার মতে তারা যদি রাজ্যের ভাগ নাও দেয়; তবু তোমার শান্তির পথে যাওয়াই উত্তম।

শান্তি বহুত বড়ো জিনিস। তুমি যদি কৃষ্ণের গ্রামে গিয়া ভিক্ষা কইরাও খাও তবুও বহুত শান্তিতে থাকবা; যা তুমি যুদ্ধ কইরা রাজ্য পাইলেও পাইবা না কোনোদিন। জীবন আর কয়দিন বলো? আমি কই কি তুমি তাগোরে যা দিছ তা তো দিয়াই দিছ; এইবার বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটানোর ব্যবস্থাই দেখো...
যুধিষ্ঠির এইবার সঞ্জয়রে ঠেইলা দেয় কৃষ্ণের দিকে- আমরা দুইজনেই দুইজনের বক্তব্য কইলাম। কৃষ্ণ নিরপেক্ষ মানুষ; আমি তার কাছেই তুইলা দিলাম বাকি বিচারের ভার....
কৃষ্ণ আবার বল ঠেলে যুধিষ্ঠিরের দিকে- বুঝলা সঞ্জয়। যুদ্ধ না কইরা যদি উপায় থাকে তবে যুধিষ্ঠির নিজের ভাই ভীমরে হাতে পায়ে বাইন্ধা আটকাইয়া যুদ্ধ থামানোর পক্ষে।

তয় কথা হইল কি; কৌরবরা তো ডাকাইত। আর তুমি তো জানোই যে ডাকাইত মারা পুণ্যের কাম। আর ধরো গিয়া ভীষ্ম দ্রোণ ধৃতরাষ্ট্র কৃপ এরা মুরুব্বি হইলেও তারাও ডাকাইতের ঠাঙ্গিদার। কারণ দ্রৌপদীর লগে যা করা ্হইছে তা তো তাগোর সামনেই হইছে। এইসব বুইড়ারা তো সেই কলঙ্ক না থামাইয়া দুর্যোধনের বলতে গেলে ইন্ধনই দিছেন।

আমার মনে হইতাছে সঞ্জয় পাশাখেলার পরে কুরুসভায় পাঞ্চালীর লাঞ্ছনার ঘটনাটা তুমি নিজে ভুইলা গিয়া আমাদেরও ভুইলা যাইতে কইতাছ। ...তা যা হউক; পাণ্ডবগো ক্ষতি না কইরা যদি শান্তি স্থাপন করা যায় তয় আমি সেইটার পক্ষে কাজ করতে রাজি। কিন্তু আমার কথা কি তোমার কৌরবরা মানবে? মনে তো হয় না। তাই আজকের আলোচনার সারকথা হিসাবে তুমি রাজা ধৃতরাষ্ট্ররে কইবা যে- পাণ্ডবদের যুদ্ধ করার যথেষ্ট ক্ষমতা থাকলেও তারা মূলত শান্তিকামী। তারা তাদের ন্যায্য পাওনাটা চায়; আপনি সেই ব্যবস্থাটা করেন... - হ হ।

জ্যাঠারে আমার প্রণাম দিয়া কইও আমরা পাঁচ ভাইরে যদি পাঁচটা গ্রাম দেয়া হয় তবে আর কিছুই চাওয়ার নাই আমাদের...
ধুম কইরা যুধিষ্ঠিরের এই প্রস্তাবে বেকুব হইয়া বইসা থাকে কৃষ্ণসহ সবাই আর সঞ্জয় হস্তিনাপুর ফিরা গেলে তারে জাপটাইয়া ধরেন ধৃতরাষ্ট্র- কী সংবাদ কও? সঞ্জয় কয়- মহারাজ অবস্থা খারাপ। এর বেশি কিছু এখন কইতে পারব না। আমারে এক রাইত ঘুমাইতে অনুমতি দেন মহারাজ। কাইল সকালে সকলের সামনে বিস্তারিত কমুনে সব...
ভোরবেলা প্রধানমন্ত্রী বিদুররে ডাকেন ধৃতরাষ্ট্র- পাণ্ডবগো শিবিরে গিয়া ডর খাইছে সঞ্জয়। তার ডর দেইখা সারা রাইত ডরে আমারও ঘুম হয় নাই বিদুর...
বিদুর কয়- আপনি তো মহারাজ একান্তে আমার সব কথাই বোঝেন কিন্তু পোলার সামনে গেলে তো আবার নিজের বুঝ পাল্টাইয়া ফেলেন।

তা আমি আর কী কমু কন? যুধিষ্ঠির তো আপনেরে মান্যই করত; এখনো করে। আপনি খালি তার বাপের অংশটা তারে দিয়া দেন; আমি নিশ্চিত কইতে পারি যে সে আপনেরে আবার মাথায় তুইলা রাখব...
ধৃতরাষ্ট্র স্বীকার যান- কথা সত্য বিদুর। দুর্যোধন সামনে না থাকলে কোনোদিনও তোমার মতের লগে কোনো অমত হয় না আমার। কিন্তু পোলাটা সামনে আসলে যে কী হয় আমার... কপাল বিদুর। সবই কপাল...
পরদিন সকালে রাজসভায় সঞ্জয় বিস্তারিত কইয়া উপসংহার টানে- যুদ্ধ লাগলে পাণ্ডবরা আমাদের নির্বংশ কইরা ফালাইব মহারাজ...
সঞ্জয়রে সমর্থন করেন ভীষ্ম- আমিও তাই বলি দুর্যোধন।

কৃষ্ণ আর অর্জুন যেইখানে একসাথে আছে সেইখানে যুদ্ধে আমাদের পরাজয় ছাড়া কিছুই দেখি না আমি। যদিও তুমি দুঃশাসন শকুনি আর ছোটলোক কর্ণ ছাড়া কারো কথা কানে তোলো না; তবুও তোমারে কই; যুদ্ধের চিন্তা বাদ দিয়া তুমি পাণ্ডবগো সম্পত্তি ফিরাইয়া দেও...
ভীষ্ম চান্স পাইলেই কর্ণরে ধুইতে যান। কর্ণও ভীষ্মের কথা ধরে আর বহু কষ্টে দুইজনরে থামাইয়া দ্রোণ ধৃতরাষ্ট্ররে পরিষ্কার জানায়ে দেন ভীষ্মের মতই তার মত। কিন্তু সেইদিকে নজর না দিয়া ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়রে জিগান- আইচ্ছা আমাগো এগারোটা বাহিনী জোগাড় হইছে শুইনা কী কইল যুধিষ্ঠির?
সঞ্জয় কিছু কয় না। ধৃতরাষ্ট্র আবার প্রশ্ন করেন- আইচ্ছা তার লগে আর কারা কারা আছে সেই সম্পর্কে তুমি কিছু কওতো সঞ্জয়
সঞ্জয় কয়- বহু লোক মহারাজ।

দুই পোলা নিয়া রাজা দ্রুপদ- কেকয়রাজের পাঁচ পোলা- সাত্যকি- কাশীরাজ- দ্রৌপদীর পাঁচ পোলা- সুভদ্রার পোলা অভিমন্যু; শিশুপালের পোলা ধৃষ্টকেতু- জরাসন্ধের পোলা সহদেব আর জয়ৎসেন। তবে সব থাইকা বড়ো কথা হইল; কৃষ্ণ সর্বক্ষণ আছেন যুধিষ্ঠিরের লগে...
সঞ্জয়রে থামাইয়া ধৃতরাষ্ট্র কন- এদের কাউরে নিয়া আমার কোনো ডর নাই। আমার খালি ডরাই কুন্তীর মাইজা পোলা ভীমেরে। যুধিষ্ঠিরের কাছে মাপ চাইলে সে মাপ কইরা দিব। কৃষ্ণ-অর্জুনের কাছে আত্মসমর্পণ করলে তারাও আর অস্ত্র উচাইব না।

কিন্তু বদমেজাজি ভীমটার ভিতরে এক ফোটা দয়ামায়া যেমন নাই তেমনি জীবনে কোনোদিন প্রতিশোধের কথাও ভোলো না সে। অন্য কে কী করবে না করবে জানি না; কিন্তু আমার সব সময়ই ভয় হয় আমার সবগুলা পোলাই হয়তো মারা পড়ব এই নির্দয় ভীমের গদায়...। আমরা যুদ্ধ করতে পারি। ভীষ্ম-কৃপ-দ্রোণ আছেন আমাদের। কিন্তু এরা আমাদের পক্ষে যুদ্ধ করলেও এই তিনজনের কেউই পাণ্ডবগো উপর অস্ত্র উঠাইবেন না সেইটাও আমি জানি দুর্যোধন।

আর অস্ত্র উঠাইলেই বা কী? বানপ্রস্থে যাওয়ার বয়সী মানুষের কাছে তুমি আর কতটাই বা যুদ্ধ আশা করতে পারো?... তোমার পক্ষে যদি সততার সাথে কেউ যুদ্ধ করে তবে সে একমাত্র কর্ণ। ...কর্ণের ক্ষমতা নিয়া আমার কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু এই পোলাটা যেমন অতিশয় দয়ালু তেমনি অস্থির আর মাথাগরম। তার গুরু পরশুরাম ঠিকই কইছেন; চূড়ান্ত মুহূর্তে অতিরিক্ত উত্তেজনায় কর্ণের ভুল করার সম্ভাবনা অতিশয় প্রবল....। ভাবনা কইরা দেখো দুর্যোধন একই রথে যখন আইসা হাজির হইব কৃষ্ণের বুদ্ধি আর অর্জুনের অস্ত্র তখন তোমার একলা এক যোদ্ধা অস্থিরচিত্ত কর্ণের ভুল করা ছাড়া আর কীইবা আশা করতে পারো তুমি? তাই মুরব্বিগো লগে আমিও একমত।

যুদ্ধে যাওয়া মোটেও ঠিক হইব না আমাদের। আমি সন্ধির প্রস্তাবই পাঠামু যুধিষ্ঠিরের কাছে...
দুর্যোধন হাসে- অতটা ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নাই মহারাজ। পাণ্ডবরা বনে যাবার শুরুতে যখন কৃষ্ণ আর পাঞ্চালরা আইসা আমাগের হুমকি ধামকি দিতাছিল তখন একবার আমি ভাবছিলাম- থাউক। এইসব ঝামেলায় গিয়া খামাখা আব্বা আর প্রজাগো কষ্ট না বাড়াই। তার চেয়ে ভালো; পাণ্ডবগো ডাইকা তাগো রাজ্য দিয়া সন্ধি করি।

কিন্তু তখন দাদা ভীষ্ম আর গুরু দ্রোণ আমারে তা করতে নিষেধ কইরা কইছিলেন যে যুদ্ধ কইরা যাদব পাঞ্চালরা কুলাইতে পারব না আমাদের সাথে। কিন্তু এখন বুঝতাছি বয়সের কারণে তারা ডর খাইছেন। তাতে আমার কোনো অসুবিধা নাই। কারণ এখন আমাদের অবস্থা আগের থিকা শতগুণে ভালো। আর অন্যদিকে তেরো বচ্ছর বনে জঙ্গলে থাইকা পাণ্ডবগো অবস্থা এখন আগের থিকা বহুত খারাপ।

তার অকাট্য প্রমাণ তো সঞ্জয়ের মুখে নিজের কানেই শুনলেন। যুদ্ধ ডরাইয়া যুধিষ্ঠির এখন রাজ্যের বদলে পাঁচখান গ্রাম ভিক্ষা চাইতাছে পাঁচ ভাইয়ের লাইগা। ... আর আরেকটা কথা আব্বা। ভীম সম্পর্কে আপনার দুর্ভাবনা এক্কেবারে খামাখা। ভীম আর আমি তো একইসাথে বলরামের কাছে গদা শিখছি।

উস্তাদের ভাষ্যমতেই গদার যুদ্ধে আমি ভীম থাইকা বহুগুণ বেশি ক্ষমতাশীল। সে যদি আমার সামনেও আসে তবু তার বেশিক্ষণ টিকার কোনো সম্ভাবনা নাই। ...আর সৈনিকের সংখ্যার দিক থাইকা আমরা পাণ্ডবগো থাইকা এখন দেড়গুণেরও বেশি সেইটাতো সকলেই জানে...
ধৃতরাষ্ট্র দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন- যুদ্ধের হিসাব তোমার হিসাবের মতো সোজা হইলে তো হইতই বাপ। তুমি সবকিছু হিসাব কইরা তুলনা করছ; কিন্তু যাদব বংশীয় কৃষ্ণের বুদ্ধির হিসাবটা বাদ দিয়া নিজের হিসাবে বড়ো বেশি ফাঁক রাইখা দিছ দুর্যোধন। ...আইচ্ছা সঞ্জয়; কওতো যুদ্ধের লাইগা যুধিষ্ঠিররে সবচে বেশি নাড়া দিতাছে কেঠায়? - ধৃষ্টদুম্ন।

দ্রৌপদীর ভাই ধৃষ্টদুম্ন্য আর তার লগে আছে তার ভাই শিখণ্ডী...
ধৃতরাষ্ট্র আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন- শুনছি দ্রুপদের এই দুই পোলা আরো বেশি নিষ্ঠুর। অস্ত্র চালাইতে গেলে জাতপাত-ব্রাহ্মণেরও ধার ধারে না তারা...
যুধিষ্ঠিরের কথায় উপপ্লব্য নগরে বইসা ঝিমায় কৃষ্ণ। যুদ্ধের লাইগা সকলরে জড়ো কইরা শেষে সঞ্জয়রে কী কথা কইয়া পাঠাইল যুধিষ্ঠির? সে এখন মাত্র পাঁচটা গ্রাম চায় দুর্যোধনের কাছে? কিন্তু বেকুব হইবার তখনো অনেক বাকি কৃষ্ণের। যে ভীম ধৃতরাষ্ট্রের পোলাদের মারবার লাইগা সারাক্ষণ যুদ্ধমন্ত্র জপে; বনবাস আর লাঞ্ছনার রাগে একলা একলা কথা কয়-হাসে; রাগে হাঁটুর ভিতর মুখ লুকাইয়া কান্দে; সেই ভীমও গলা নামাইয়া কয়- যুদ্ধ না কইরা যা পাওয়া যায় তাই ভালো কৃষ্ণ। তুমি সেই ব্যবস্থাই করো...
অর্জুন মূলত যুধিষ্ঠিরের ছায়া।

যুধিষ্ঠিরের বাড়া কোনো সিদ্ধান্ত থাকে না তার। নকুলও রিপিট করে যুধিষ্ঠিরের কথা...
কৃষ্ণ অবাক হইয়া তাকায় উনষাট বছর বয়সের যুধিষ্ঠির- আটান্ন বছরের ভীম আর সাতান্ন বছর বয়স অর্জুনের দিকে। আইজ প্রথম কৃষ্ণের মনে হয় বয়স যেমন পাণ্ডবগোরে জাপটাইয়া ধরছে তেমনি বনবাসের কষ্টে সত্যিই এরা এখন একদল ভাইঙ্গাপড়া মানুষ। এরা সৈন্য সমাবেশ করছে শুধু দুর্যোধনরে ভয় দেখাইতে; যুদ্ধ করতে না...
কৃষ্ণ আমতা আমতা করে যুধিষ্ঠিরের সামনে- ঠিকাছে; তোমাদের প্রস্তাব নিয়া তবে আমি হস্তিনাপুর যাব। কিন্তু যুদ্ধ আটকাইতে পারব কি না তার নিশ্চয়তা দিতে পারব না আমি... - আমি যুদ্ধই চাই।

যুদ্ধ যাতে হয় সেই ব্যবস্থাই তুমি করবা হস্তিনাপুর গিয়া...
গলাটা সহদেবের। যেখানে ভীম পর্যন্ত ভচকাইয়া গেছে সেখানে সহদেবরে কিছু জিগানোরই দরকার মনে করে নাই কৃষ্ণ। সহদেব কৃষ্ণের চোখে চোখ রাইখা কয়- কৌরবরা যদি শান্তিও চায় তবুও তুমি যুদ্ধ ঘটাবা এইটাই আমার কথা। যুধিষ্ঠির ভীম আর অর্জুন যদি যুদ্ধ না করতে চান তবে আমি একলা হইলেও যুদ্ধ করুম। কারণ রাজ্য পাওয়া না পাওয়ার থাইকা আমার কাছে পাঞ্চালীর লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নেওয়াটই বড়ো...
সাত্যকিও চিৎকার দিয়া উঠে- পাঁচ গ্রামের হিসাব বুঝি না আমরা।

আমরা যুদ্ধই চাই...
প্রবীণ সভাসদগণের পরামর্শ আর সঞ্জয়ের বর্ণনা বিবেচনা কইরা কুরুসভায় রাজা ধৃতরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন- শোনো দুর্যোধন। যুদ্ধের চিন্তা বাদ দিয়া তুমি পাণ্ডবগো তাদের সম্পত্তি ফিরাইয়া দিবার আয়োজন করো। বাকি যে অর্ধেক রাজ্য থাকব তাতে কোনোকিছুতেই কোনো অভাব হইব না তোমার। যুদ্ধে ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপের যেমন মত নাই; আমারও নাই....
- একটা সুঁই পরিমাণ মাটিও পাণ্ডবগো দিমু না আমি.... রাজার সিদ্ধান্তের উপরে দুর্যোধনও তার পরিষ্কার সিদ্ধান্ত জানায়ে দেয়- আর কেউ যদি যুদ্ধ নাও করে তবু আমি দুঃশাসন আর কর্ণই যুদ্ধ করব পাণ্ডবগো লগে...
কর্ণ দুর্যোধনরে সমর্থন করে আর দুর্যোধনরে কিছু কইতে না পাইরা ভীষ্ম শুরু করেন কর্ণরে গালাগাল- তুমি আর কতা কইও না। তুমি কৃষ্ণরে চিনো? কৃষ্ণে চক্রের ক্ষমতা জানা আছে তোমার? কৃষ্ণের চক্রের কাছে তোমার জারিজুরি মুহূর্তও টিকব না সেইটা জানো? তুমি আসোলে কোনো যোদ্ধাই না।

তুমি একটা ফালতু ভণ্ড। তোমার সকল জারিজুরি খালি মুখে। তুমি পরশুরামের কাছে নিজের মিথ্যা পরিচয় দিয়া যেইভাবে তার শিষ্য হইছিলা; এখনও তুমি সেইরকম মিথ্যা বড়াইই করতাছ। ...তোমার আসোল পরিচয় পাইয়া পরশুরাম যেমন তোমারে আশ্রম থাইকা ধাক্কা দিয়া বাইর কইরা দিছিলেন; একদিন দেখবা দুর্যোধনও তোমার আসোল পরিচয় পাইয়া তোমারে থাবড়ায়ে বাইর করবে হস্তিনাপুর থাইকা...। কারণ অর্জুন আর কৃষ্ণরে যদি কেউ জয় করবার পারে তবে সেইটা তুমি না।

পারলে সেইটা একমাত্র আমার পক্ষেই সম্ভব। অথচ আমিই... - ঠিকাছে দেখি তবে জয় করেন...
কর্ণ হাতের ধনুক ফিককা ফালায় দুর্যোধনের সামনে- তোমার দাদায় যখন আমারে অতটাই ছোট আর নিজেরে অতটা বড়ো মনে করেন তবে দেখি তোমার দাদায় কেমনে কৃষ্ণ-অর্জুনরে জয় করেন। আমি এই অস্ত্র ছাড়লাম। তোমার দাদা ভীষ্ম না মরা পর্যন্ত আমি আর অস্ত্র ধরুম না কইয়া দিলাম। এইটা আমার প্রতিজ্ঞা দুর্যোধন।

তোমার দাদায় মরার পর আমার যোগ্যতা দেখবা তুমি...
- রাধাপুত্র কর্ণ। তোমার স্বভাবে অনেক গড়মিল থাকলেও যতদূর জানি একবার প্রতিজ্ঞা করলে তুমি সেইটা রাখো। মনে রাইখ আমি না মরা পর্যন্ত আর কোনো অস্ত্র ধরবানা না তুমি....
ভীষ্মের কথার কোনো উত্তর না দিয়া গটগট কইরা কর্ণ বাইর হইয়া গেলে ধৃতরাষ্ট্র হাসেন- কইছিলাম না দুর্যোধন। কর্ণ পোলাটার মাথা গরম হইলে বুদ্ধিশুদ্ধিও লোপ পায়? দেখলাতো সে তোমার লাইগা যুদ্ধ করতে আইসা জ্যাঠার উপর রাগ কইরা তোমরারেই সে একলা ফালাইয়া গেলো যুদ্ধের সামনে...
ভীষ্মও হাসেন- যাউক। এক পাগলরে তো যুদ্ধ থাইকা আটকাইতে পারলাম।

অন্তত আমি যদ্দিন বাইচা আছি ততদিন আর যুদ্ধ করব না কর্ণ। ...তা তুমি এখন কী সিদ্ধান্ত নিবা দুর্যোধন?
- যুদ্ধ। যেকোনো অবস্থায় যুদ্ধই আমার সিদ্ধান্ত পিতামহ। আর আপনি যখন কইছেন যে কৃষ্ণ অর্জুনরে আপনি পরাজিত করতে পারেন; তাই আমার সিদ্ধান্ত হইল আপনেই হইবেন আমার যুদ্ধের সেনাপতি...
পাণ্ডবগো দূত হইয়া হস্তিনাপুর যাইবার আগে কৃষ্ণ গিয়া খাড়ায় দ্রৌপদীর সামনে। অনেকক্ষণ চুপ থাইকা অতি ধীরে মুখ খোলে পাঞ্চালী- পাণ্ডদের সন্ধির প্রস্তাব নিয়া হস্তিনাপুর যাও কৃষ্ণ।

আমার আপত্তি নাই। কিন্তু যখন তুমি দুর্যোধনের কাছে সন্ধির প্রস্তাব করবা তখন তোমার সখীর এই খোলা চুলের কথা স্মরণ রাইখ; যা একদিন হাত দিয়া টানছিল দুঃশাসন। আর সখীর কাছে করা তোমার নিজের প্রতিজ্ঞার কথাটাও যেন তোমার মনে থাকে। এর বেশি আমার আর বলার কিছু নাই। কিন্তু পাণ্ডবগো মতো তুমিও যদি মনে করো যে পুরানা দিনের সেইসব কথার কোনোটাই আর মনে করতে চাও না তুমি।

তবে জাইনা যাও; দ্রৌপদীর বৃদ্ধ বাপ- দুই ভাই আর অভিমন্যুর লগে এখন নিজের পাঁচটা জোয়ান পোলাও আছে দ্রৌপদীর। তোমরা না থাকলেও কেউ না কেউ তো থাকবে যে দ্রৌপদীর লাইগা আগুন জ্বালাবে হস্তিনাপুর...
কৃষ্ণ মুখ খোলে- তুমি নিশ্চিত থাকো পাঞ্চালী। পাণ্ডবরা কৌরবদের ক্ষমা কইরা দিলেও তাদের নরকে যাওয়া ঠেকাইতে পারব না কেউ....
২০১৩.১১.১৯ মঙ্গলবার
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী।

পর্ব ৭ মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ৬ মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩।

দ্রৌপদী। পর্ব ৫ [ঘটোৎকচ ৩] মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। [পর্ব ৪: ঘটোৎকচ ২] মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী।

৩। দ্রৌপদী। [পর্ব ৩: ঘটোৎকচ] মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী।

পর্ব ২ মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ৩। দ্রৌপদী। পর্ব ১ মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২।

কুন্তী [পর্ব ৩] মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ২] মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ১] মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী।

১। সত্যবতী

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।