আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হেমন্তের কবিগণ, নবান্ন ও ঢেঁকি কথন



আজ অনলাইন বাংলা খবরের কাগজের প্রথম পাতার শীর্ষে চোখ মেলাতেই দেখলাম ১লা অগ্রহায়ণ। মুহুর্তে ভেসে উঠলো স্মৃতির পটে উঠানে ছেলেবেলাকার প্রভাতের শিশির সিক্ত শিউলি ফুল কুড়ানো একান্নবর্তী পরিবারের ভাই-বোনেরা মিলে। আহা! আফসোস। আফসোস। ।

ভীষণভাবে মিস করি সেই স্বর্ণালী দিনগুলো। আসলে আমরা তো আজকাল আমাদের প্রিয় ঋতুগুলোকে এই সব স্মৃতিজাগানিয়া বিভিন্ন লেখাতেই খুঁজে পাই, তাছাড়া খবরের কাগজ না দেখলে বুঝতেও পারিনা আমরা নাগরিক মানুষেরা কখন আসে কোন ঋতু। প্রকৃতি, ঋতু, পরিবেশ ব্যক্তি জীবনে যেমন নির্মল আনন্দের সৃষ্টি করে তেমনি সমষ্টি, জাতি ও দেশে দেশে আনন্দ উৎসবের বিকাশ ঘটায়। বিশ্ব প্রকৃতি থেকে শুরু করে বাংলার ষড়ঋতুকে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদিকে ব্যক্তি বিশেষের মনের গহনে অনির্বচনীয় আনন্দের সৃষ্টি করেছেন অন্যদিকে সকলের সাথে সে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার পথ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের ঋতু-বৈচিত্র্য নিয়ে কবির বিপুল সৃষ্টি আমাদের মধ্যে জাগায় শিহরণ।

আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠি আমরা। ঋতু পরিবর্তনের নানা ধারা নিয়ে কবির গাঁথা মালা থেকে একটি ফুলের সৌরভ আমরা নিতে পারি। হেমন্ত কবির চোখে দীপালিকার আলো, হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে, হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে। ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো ‘দীপালিকায় জ্বালাও আলো, জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে। ’ হেমন্তের আগমনের আগে আসে বর্ষা আর শরৎ।

হিম থেকে এসেছে হেমন্ত। তাই হেমন্তকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস। হেমন্তের শিশির ঝরা নিশিতে ফোটে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি আর কামিনী। হেমন্তেই দীঘির জলে, বিলে, ঝিলে ফোটে কত না রঙের পদ্ম। এ দিকে খেত-খামারে রাশি রাশি ভারা ভারা সোনার ধান উঠতে থাকে।

ঘরে চলে নবান্ন উৎসব। আর তারই সাথে মনে গাঁথা কবি সুফিয়া কামালের ছড়া-কবিতা “হেমন্ত”, সবুজ পাতার খামের ভেতর হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে কোন্ পাথারের ওপার থেকে আনল ডেকে হেমন্তকে? আনল ডেকে মটরশুঁটি, খেসারি আর কলাই ফুলে আনল ডেকে কুয়াশাকে সাঁঝ সকালে নদীর কূলে। সকাল বেলায় শিশির ভেজা ঘাসের ওপর চলতে গিয়ে হাল্কা মধুর শীতের ছোঁয়ায় শরীর ওঠে শিরশিরিয়ে। আরও এল সাথে সাথে নুতন গাছের খেজুর রসে লোভ দেখিয়ে মিষ্টি পিঠা মিষ্টি রোদে খেতে বসে। হেমন্ত তার শিশির ভেজা আঁচল তলে শিউলি বোঁটায় চুপে চুপে রং মাখাল আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়।

বাংলাদেশের পাড়াগাঁর গা থেকে যেমন তিনি পান ‘রূপশালী ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ’ তেমনই হেমন্তের কার্তিক, অগ্রহায়ন আর জীবনানন্দ দাশ যেন একই সুত্রে গাঁথা। উজ্জ্বল রোদে সোনার ঝিলিক খেলে নুয়ে পড়া পুষ্ট ধানের শীষে। সে দৃশ্যে খুশির আভা ফোটে কৃষকের চোখে-মুখে। কাস্তের টানে মুঠি মুঠি কাটে ধানগাছ। এই বাংলায় হেমন্ত মানে নবান্নের উৎসব।

আর নতুন ধানের গন্ধ। গ্রীষ্মের দাবদাহে রুদ্ররূপ, বর্ষায় বিরহিনী, শরতে স্নিগ্ধময়ী শারদলক্ষ্মী আর হেমন্তে কুয়াশার অবগুণ্ঠনে ঢাকা হৈমন্তিকা বয়ে নিয়ে আসে এক শুভবার্তা। ধান কাটা হয়ে গেছে কবে যেন — ক্ষেত মাঠে পড়ে আছে খড় পাতা কুটো ভাঙা ডিম — সাপের খোলস নীড় শীত। এই সব উৎরায়ে ঐ খানে মাঠের ভিতর ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ — কেমন নিবিড়। ঐ খানে একজন শুয়ে আছে — দিনরাত দেখা হত কত কত দিন হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কত অপরাধ; শান্তি তবু: গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ।

কালহীন কালের প্রতীক হিসেবে তিনি নিয়েছেন প্রান্তরকে প্রধানত হেমন্তের প্রান্তরকে। কার্তিকের মৃদু কুয়াশা মাখা জ্যোৎস্না ভরা মাঠ তার এই দূরাস্তীর্ণ কল্পনাকে চঞ্চল করে তুলেছে সবচেয়ে বেশি। যখন ‘হেমন্ত ফুরায়ে গেছে, পৃথিবীর ভাঁড়ারের থেকে’, তখন অপেক্ষাতুর হৃদয় ভেবেছে, ‘হে নাবিক, হে নাবিক, জীবন অপরিমেয় বাকী। ’ কার্তিকের জ্যোৎস্নায় কয়েকটি মাঠে চরা ঘোড়া কবির মনকে আশ্চর্যভাবে সঞ্চারিত করেছে সময়হীন সময়ের প্রান্তরে: মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকে জ্যোৎস্নার প্রান্তরে, প্রস্তর যুগের সব ঘোড়া যেন এখনও ঘাসের লোভে চরে পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর পরে। এই সব ঘোড়াদের নিওলিথ স্তব্ধতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে জীবনানন্দের মানসিক মুক্তি।

রবীন্দ্রনাথকে যদি বর্ষা আর নদীর কবি বলা যায়, তাহলে জীবনানন্দ হেমন্ত আর প্রান্তবেরর কবি। মৃদু ধূমল জ্যোৎস্না­ দিকচিহ্নহীন মাঠ এক অপূর্ব জাগর স্বপ্ন সৃষ্টি করে তার মনে­ এক বিচিত্র সুর রিয়্যালিজমের মধ্যে তার কল্পনাকে মগ্ন করে। এই কল্পনার অনুষঙ্গী ‘বাঁশপাতা-মরা ঘাস-আকাশের তারা। ’ ‘কার্তিক কি অঘ্রাণের রাত্রির দুপুরে’ ‘হলুদ পাতার ভিড়ে বসে’ ‘মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে’ প্রহর জাগে পাখি। এই হেমন্ত জ্যোৎস্নাতেই বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা শঙ্খমালার আবির্ভাব।

ছবি: নবান্ন, এস এম সুলতান, অন্তর্জাল থেকে জীবনানন্দের কবিতায় এসেছে ধান টাকা হয়ে গেছে। হ্যাঁ, ধান এভাবেই টাকা হয়ে যায় হেমন্তে। আর টাকা আসা মানেই উৎসব। এজন্য এসময় সারা দেশের বিভিন্নস্থানে মেলা হয়, যাত্রা হয়। বাউল গানের আসর বসে।

এগুলোরই সম্মিলিত নাম নবান্ন। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী, অসাম্প্রদায়িক ও মাটির সঙ্গে চির বন্ধনযুক্ত নবান্ন উৎসবের মাস। প্রবাদে আছে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। এক সময় ঢেঁকির সুরেলা শব্দ ফুটিয়ে তুলত নবান্ন উৎসব। বুদ্ধির ঢেঁকি, আমড়া কাঠের ঢেঁকি, ঢেঁকির মতো মেয়ে - এরকম বহু বাগধারা এখন শুধু পুঁথিতেই বন্দী।

নতুন ধানের চাল তৈরির ধুম পড়ে যেত গ্রামবাংলায়। গ্রামে মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণী ও বৌ-ঝিরা নিজস্ব ঢেঁকিতে ধান ভাঙিয়ে চাল করত। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পালাক্রমে চলত ধান ভাঙার কাজ। গরিব পরিবারের মহিলারা বড় গৃহস্থের বাড়িতে ঢেঁকিতে ধান ভেঙে চাল করে দিয়ে বিনিময়ে পারিশ্রমিক হিসেবে পেত চাল অথবা টাকা। গরিব মহিলারা পাঁচ থেকে ছয়জনের দল তৈরি করে ধান ভাঙত পালাক্রমে।

২-৩ জন ঢেঁকিতে পাড় দিত আর একজন ঘরের মধ্যে ধান চাল ওলট-পালট করে দিত। চলত পান খাওয়ার আড্ডা আর হাসি-আনন্দ। আবার অনেক সময় সুরে সুরে গীত। ঢেঁকি নিয়ে কত গানই না রয়েছে। ও ধান কোটেরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া...।

ছবি: অন্তর্জাল থেকে এখন সেই শব্দ আসবে কোথা থেকে? এখন নবান্ন আসে নীরবে। কৃষকের বাড়ি ঢেঁকি নেই, বধূর কণ্ঠে নেই ধানভানা গান। তামাম বাংলাদেশ তন্নতন্ন করে খুঁজে এখন ঢেঁকিঘর মেলানো ভার। এই প্রজন্মের কাছে ঢেঁকি অচেনা এক অন্যরকম বস্তু, অচেনা এক আদিম যন্ত্র। ধান ভাঙাতে যেমন ইঞ্জিন মোটরচালিত যান্ত্রিক কল, তেমনই সব কিছুতেই প্রযুক্তির ছোঁয়া।

পাল্টে গেছে জীবনযাত্রা যেমন, তেমনই খ্রিস্টপূর্বের ধান ভানা ঢেঁকি হারিয়ে গেছে। প্রায় ৪০ হাজার বছরের পুরনো সেই উৎসবের নাম মাটির সঙ্গে চির বন্ধনযুক্ত নবান্ন উৎসব। 'নবান্ন' শব্দটির আভিধানিক অর্থ 'নতুন অন্ন'। 'দুধ, গুড়, নারকেল, কলা প্রভৃতির সঙ্গে নতুন আতপ চাল খাবার উৎসব' বিশেষ। উৎসবেরও একটি আভিধানিক ব্যাখ্যা রয়েছে।

তা হলো হৈমন্তিক ধান কাটার পর অগ্রহায়ণ মাসে অনুষ্ঠিত একটি উৎসব। সেই অনাদিকাল থেকে কৃষি সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম বাংলায় পালিত হয়ে আসছে এ উৎসব।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।