আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টেম্পলার এবং ফ্রীম্যাসন by হারুন ইয়াহিয়া (২য় কিস্তি)

যে কেউ সৎপথে চলে, তারা নিজের মঙ্গলের জন্যেই সৎ পথে চলে। আর যে পথভ্রষ্ট হয়, তারা নিজের অমঙ্গলের জন্যেই পথ ভ্রষ্ট হয়। কেউ অপরের বোঝা বহন করবে না। কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না। সুরাঃ বনী ইসরাইল আয়াতঃ ১৫

১ম কিস্তি ধর্মযোদ্ধা টেম্পলারদের মানসিকতা টেম্পলারদের প্রকৃত পরিচয়, উদ্দেশ্য এবং তারা কিভাবে আসলো সে সম্বন্ধে জানতে হলে আমাদেরকে ধর্মযুদ্ধকালীন ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাতে হবে।

টেম্পলারদের সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা নাইটরা ধর্মযুদ্ধরত নাইটদের একটা দল যারা পবিত্র ভূমি রক্ষার অজুহাতে ফিলিস্তিনে ভ্রমণ করে এবং ঘাঁটি গেড়ে বসে। যখন প্রথম ধর্মযুদ্ধ শুরু হয় তখন ইউরোপ কেবলমাত্র অন্ধকারযুগ থেকে উত্থিত হচ্ছে। একদিকে ছিল ক্ষুধা, দারিদ্রতা, অজ্ঞতা এবং ছোট ছোট রাজ্য ও সামন্তন্ত্রের মধ্যে কতৃত্ত নিয়ে বিরোধ অন্যদিকে উত্তর থেকে আসা একটানা বর্বরোচিত আক্রমণ ইউরোপকে বাসের অযোগ্য মহাদেশে পরিণীত করে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও সংঘসমূহ যা তখন তৈরি হতে লাগলো তা মানুষের প্রয়োজন মিটানো এবং ইউরোপে শক্ত কত্তৃত্ত স্থাপনে যথেষ্ট ছিল না। এই বিশৃঙ্খলার মাঝে ক্যাথলিক চার্চ তার ধর্মগুরু এবং কর্মচারীদের সহায়তার মাধ্যমে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানে পরিণীত হোলো যা সাধারণ মানুষের উপর ব্যাপক খবরদারি করা শুরু করল।

চার্চের সদস্যরা তাদের উৎকৃষ্ট শিক্ষার মাধ্যমে উচ্চ পর্যায়ের জ্ঞান ও উপলব্ধি অর্জন করেছিল যা তাদেরকে অজ্ঞ জনসাধারণ এবং অধিকাংশ অশিক্ষিত অভিজাত শ্রেণীর উপর প্রভাব বিস্তার করতে সাহায্য করেছিল। তারা মাঝেমাঝেই তাদের আসল লক্ষ্য ভুলে যেয়ে পার্থিব ক্ষমতার প্রতি লোভাতুর হত এবং তাদের এই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে যেয়ে ইউরোপের অনেক রাজা এবং অভিজাতদেরকে চার্চের ক্ষমতাবলে অধিনস্ত করে নিয়েছিল। ভ্যাটিকানের ক্ষমতার শীর্ষে থাকাকালীন পোপ দ্বিতীয় আরবান যুদ্ধ ঘোষণা করে। পবিত্র ভূমি যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে ছিল তা দখল করতে হবে। আপাত দৃষ্টিতে পোপ দ্বিতীয় আরবানের উদ্দেশ্য ছিল খুব মহৎ ছিল খ্রিস্টানদের চোখে যে পবিত্র ভুমির নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে খ্রিস্টানদের কাছে।

কিন্তু প্রথম ধর্মযুদ্ধ শুরু করা পোপ দ্বিতীয় আরবানের উদ্দেশ্য এই একটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। আগেই বলা হয়েছে পোপরা যে ভূমি নিয়ন্ত্রণ করত সবাইকে সংগ্রাম এবং অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে দিনানিপাত করতে হত। প্রাচ্য থেকে আগত ব্যবসায়ীরা যেসব কাহিনী প্রচার করত তার বেশিরভাগ জুড়ে থাকত মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানরা কি বিপুল বিত্ত-বৈভবের অধিকারী, এমন বিলাসদ্রব্য ও ফলমূল যা ইউরোপে কেউ কখনও দেখেনি। এই সমস্ত বিষয় ধর্মযুদ্ধের প্রভাবক হিসেবে দেখা দিল। তখন পোপরা দখলদারিত্ত ও উপনিবেশের সংমিশ্রণের এক পরিকল্পনা করল যার ফলে তারা প্রাচ্যের সম্পদ কুক্ষিগত করতে পারে এবং সাথে সাথে আরও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে।

ফলশ্রুতিতে তারা ইউরোপে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দিয়ে সার্বিক ক্ষমতা দখল করতে চাইলো তা করতে যেয়ে তারা খ্রিস্টানদের ১০০০ বছরের শান্তি, নম্রতা ও অহিংসের সংস্কৃতি দূরে সরিয়ে দিলো। যুদ্ধের জন্য লোকবল সংগ্রহ করতে যেয়ে অ্যান্টি খ্রিস্টান কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করা গেলো যার ফলে ক্রুসেডারদের সহিংস, নির্দয় এবং অজ্ঞ আচরনের ব্যাপারে কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। পোপরা তাদের সৈন্য সংখ্যা বাড়ানোর জন্য তাদের হাতে থাকা সম্ভাব্য সকল উপায় অবলম্বন করল এমনকি চিহ্নিত দাগী আসামীদেরকেও সৈন্যদলে যোগ দেওয়ানো হল এই আশ্বাসে যে ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে তাদের সকল অন্যায় ক্ষমা করে দেওয়া হবে। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগেরই নিজেদের খ্রিস্টান ধর্মের মৌলিক মতবাদসমূহ সম্বন্ধে কোনও জ্ঞান ছিল না আর ইসলাম সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা বলাইবাহুল্য। সুতরাং বলা যায়, ধর্ম বা আদর্শের খাতিরে নয় ধর্মযুদ্ধের প্রধান নিয়ামক ছিল প্রাচ্যের ধনসম্পদ কুক্ষিগত করা।

রাজারা এবং স্থানীয় অভিজাত সম্প্রদায় যারা প্রায় সবসময় একে অন্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকত তারাও তাদের সম্পদ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ধর্মযুদ্ধে স্ব স্ব সৈন্য নিয়ে একসাথে বেরিয়ে পড়ল। এই শ্রেণী যাদের নিজেদের মধ্যে অন্তরকলহের কারণে কোনও একতা ছিলনা তারা নিজেদের উদ্যোগে এই যুদ্ধে যাচ্ছিল। এই সামন্ত জমিদারদের দলে অবধারিতভাবে তাদের দাসেরা ছিল যারা তাদের মুক্তির বিনিময়ে এই যুদ্ধযাত্রায় অংশ নিয়েছিল। এই ধর্মযোদ্ধাদের মধ্যে যারা চার্চের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। এই বিষয়ে একটি উৎসের বর্ণনা উল্লেখযোগ্যঃ “ ফরাসী নাইটদের আরও জায়গার প্রয়োজন।

ইটালীয় ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্য মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ব্যবসার সম্প্রসারণ...... এই যুদ্ধের একটা বড় অংশ সাধারণ গরিব জনগোষ্ঠী যারা তাদের জীবনের কষাঘাত থেকে বাঁচবার উদ্দেশ্যে এই অভিযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিল”। ঐসব ধর্মযোদ্ধাদের দেখে এক সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর পরিবর্তে একটি অসংগঠিত, বিশৃঙ্খল এবং অনিয়ন্ত্রিত লোকসমাগম মনে হচ্ছিল। এরকম একটা বাহিনীর কাছ থেকে যেটা আশা করা যায় তারা তা’ই করেছিল, প্রথম ক্রুসেডেই তারা ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত ধ্বংসযজ্ঞ সংগঠিত করে। জেরুজালেম দখল করার পরপরই তারা জনগোষ্ঠীর প্রায় সিংহভাগ হত্যা করে ফেলে যার বেশিরভাগই ছিল মুসলিম এবং ইহুদী। ইতিহাসের বর্ণনা থেকে জানা যায় এই হত্যাযজ্ঞে প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ নিহত হয়।

সত্য কথা বলতে এই নাইট টেম্পলারদের স্থপতিরা চার্চের প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল না। এই ধর্মযোদ্ধাদের বেশিরভাগই অজ্ঞ ও ইতরপ্রকৃতির, যারা এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল কোন মহৎ উদ্দেশ্যে নয় বরং রোমাঞ্চ, ধনসম্পদ, সম্মান এবং খ্যাতি অর্জনের জন্য। যাইহোক এই ফ্রেঞ্চ অভিজাতরা তাদের সংগঠন সৃষ্টির অল্প সময়ের মধ্যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্যে প্রকাশ করে যা মোটেও খ্রিস্টানসুলভ ছিলনা বরং তাতে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন অসৎ লক্ষ্যের আভাস পাওয়া যায়। এই সৈন্যসকল যাদের উদ্দেশ্য এবং লোভ ছিল নিজেদের ভয়াবহ দারিদ্র দূর করা; তারা খুব শীঘ্রয় মধ্যযুগের ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ এবং ভয়ঙ্কর শক্তিতে পরিনিত হয়।  


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।