আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টেম্পলার এবং ফ্রীম্যাসন by হারুন ইয়াহিয়া (৫ম কিস্তি)

যে কেউ সৎপথে চলে, তারা নিজের মঙ্গলের জন্যেই সৎ পথে চলে। আর যে পথভ্রষ্ট হয়, তারা নিজের অমঙ্গলের জন্যেই পথ ভ্রষ্ট হয়। কেউ অপরের বোঝা বহন করবে না। কোন রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না। সুরাঃ বনী ইসরাইল আয়াতঃ ১৫

১ম কিস্তি ২য় কিস্তি ৩য় কিস্তি ৪র্থ কিস্তি ১১২৭ সালে সেন্ট বারনার্ডের সাথে দুজন টেম্পলারের সাক্ষাৎ মোড় ঘোরানো ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এই সাক্ষাতের সময় টেম্পলারগণ পোপ এবং ভ্যাটিকানের অন্যান্যদেরকে তাদের সংঘের সাধারণ নিয়মাদির বিষয়ে সম্যক ধারণা দেয় যদিও তাতে বেশীরভাগই সন্তুষ্ট ছিল না। এমতাবস্থায় সেন্ট বারনার্ড টেম্পলারদের পক্ষালম্বন করেন এবং বুঝানোর চেষ্টা করেন যে চার্চের বর্তমান নিয়মাদি কিঞ্চিৎ পরিবর্তন পরিবর্ধন করলে তা খ্রিষ্টান মতবাদের সাথে আরও অধিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এর পরপরই সেন্ট বারনার্ড নিজ সিস্টারসিয়ান সংঘের (Cistercian Order) নিয়ম কানুনের উপর ভিত্তি করে একটি বই রচনা করে যার নাম “The New Templars’ Rule” এবং ঘোষণা করে যে টেম্পলারদের নৈতিক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব তার। এভাবেই শুধুমাত্র পোপের কাছে জবাবদিহিতার করতে হবে এই সুযোগের মাধ্যমে তারা তাদের পথের সব বাধা থেকে মুক্তি লাভ করে। এছাড়াও একমাত্র পোপ ছাড়া অন্য কারো তাদেরকে কোন প্রকার শাস্তিবিধান এবং কোন কাজের ফরমায়েশ করার অধিকার ছিল না।

সেন্ট বারনার্ড বিশ্বাস করত যে এই ধরণের সুযোগ সুবিধা প্রদান এবং সেগুলোর প্রয়োগ চার্চকে আরও শক্তিশালী করবে কিন্তু এটা সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলো যে তার এই কাজ এক ভয়াবহ আগামীর সুচনা করবে। চার্চের পূর্ণ সহযোগিতা খ্রিষ্টান মতবাদ মহান আল্লাহ্‌ প্রেরিত ধর্ম যাতে আল্লাহ্‌র বানী উপস্থিত আছে যদিও তা কালক্রমে বিকৃত হয়ে গেছে। খ্রিষ্টধর্মের নিউ টেস্টামেন্টে শান্তিপ্রিয়তার কথা বারবার বলা হয়েছে কিন্তু খ্রিষ্টধর্মের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে সময়ে সময়ে তারা ধর্মের নামে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। এর অন্যতম এক কারণ ছিল চার্চের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ, যা চার্চকে অগণিত রাজনৈতিক খেলায় টেনে এনেছে। ফলশ্রুতিতে চার্চ তার মূল উদ্দেশ্য থেকে অনেক দূরে সরে যায়।

এই সময়ে চার্চ ইউরোপের মুকুটধারীদের উপর প্রভাব বিস্তারকেই তাদের অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করে এবং এভাবে এক দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনের সুচনা করে। এ সব কিছুর সুচনা হয় পোপ সপ্তম গ্রেগরীর (Gregory VII) হাত ধরে, যে এই ঘোষণা দেয় যে চার্চকে রক্ষার প্রয়োজনে সশস্ত্র শক্তি প্রয়োগ করা বৈধ। চার্চই সকল ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করবে এই বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পোপ গ্রেগরী কথিত গ্রেগরীয়ান আন্দোলন শুরু করে এবং তৎকালীন প্রভাবশালী শাসকদের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তার গ্রহন করা নীতিগুলো ব্যাপকভাবে গৃহীত এবং পালিত হয়। যদিও এই প্রক্রিয়া ভ্যাটিকানের ক্ষমতা বৃদ্ধির নিয়ামক হিসেবে কাজ করছিল কিন্তু তার ফলে অনেক শাসক এবং সাধারণ মানুষ চার্চের বিরোধীতে পরিণিত হয়।

পোপ আরবান ২য় (Urban II) পরবর্তীতে গ্রেগরীর শক্তি প্রয়োগের রাজনৈতিক দর্শনকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং তার তত্ত্বের সাথে একমতপোষণ করে যা সংক্ষেপে বলা যায় “ ধর্মের জন্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে সহিংসতা বৈধ” যা অতি অবশ্যই খ্রিষ্টানধর্মের মূলনীতি বিরুদ্ধ। এভাবেই প্রথম ক্রুসেডের কথিত ধর্মীয় বৈধতা দেয়া হয়। সেন্ট বারনার্ড তার জীবদ্দশায় এই নীতিগুলোর প্রতি জোরালো সমর্থন দেয়, যদিও তা খ্রিষ্টানধর্মের নীতিবিরোধী ছিল। সেন্ট বারনার্ড এই ভুলকে চূড়ান্তরুপ দেয় এই কথা বলে যে, “যখন খ্রিষ্টের কোন নাইট কোন মানুষকে তার অপকর্মের জন্য হত্যা করে, বস্তুত তা মানুষ হত্যা না বরং সেটা হোলো শয়তানকে নির্বাসিত করা। ” প্রথম ক্রুসেডের পর নাইটদের সর্বপ্রথম সংঘ the Hospitallers order প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে চার্চ তৎপর হয়ে উঠে।

শুরুর দিকে এই সংঘ পবিত্রভুমিতে আসা তীর্থযাত্রীদের সহযোগিতা এবং অসুস্থদের সেবা দেওয়ার দায়িত্ব হাতে নেয়। এরপরও চার্চের ভিতর কিছু ক্ষমতালোভী গোষ্ঠী এতে সন্তুষ্ট ছিল না, তাদের চাহিদা ছিল আরও বেশী। চার্চের অধীনে যে সকল সৈন্যদল ছিল তাদের মূলত নাইটরা নিয়ন্ত্রণ করত ফলে সমসাময়িক ইউরোপিয়ান শাসকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতো। এভাবেই তারা চার্চের কতৃত্ত নিজেদের কুক্ষিগত ধনসম্পদ রক্ষার্থে ব্যবহার করত। এটা করতে গিয়ে তারা অস্ত্রের বলে খৃষ্টধর্ম প্রচার করত।

এছাড়াও এইসব কাজের ফলে পবিত্র ভুমির উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ সুসংহত ছিল এবং সম্রাজ্যবাদ ছড়াতে সুবিধা হচ্ছিল। নেতৃত্বস্থানীয় যাজকদের একটি দল তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এক শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলার জন্য এই ভুলধারণাগুলো লালন করছিল। এই সময়ে দৃশ্যপটে টেম্পলারদের আগমন ঘটে এবং তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পুরন করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। এসব থেকে একটি বিষয় বোঝা যায় বারনার্ডের সাথে নাইটদের সাক্ষাৎ তাদের সুদূরপ্রসারী কৌশলের একটি অংশ ছিল। তারা জানত একমাত্র বারনার্ডের পক্ষেই তাদেরকে সকল সুযোগ দেওয়া সম্ভব ছিল, তাই এই লক্ষ্যে তারা তাকে পারস্পারিক সাহায্যের প্রস্তাব দেয়।

সেন্ট বারনার্ডেরও চার্চের স্বার্থ সমুন্নত রাখার জন্য কিছু লক্ষ্য এবং পরিকল্পনা ছিল। অভিজাত সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক এবং সূক্ষ্ম রাজনৈতিক জ্ঞানের কারণে সেন্ট বারনার্ড তার যুবা বয়স থেকেই গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিল। সে তার এই প্রভাব চতুরতার সাথে ব্যবহার করে তার সবচেয়ে অনুগতকে পোপ পদে নির্বাচিত করেছিল। বারনার্ড এই বিষয়ে সম্যক অবগত ছিল যে একজন যাজকে জন্য সৈন্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করা কতটা কঠিন। আসলে এটা করা তাদের জন্য দরকারও নেই।

তার মতে যেসকল সৈন্য পবিত্রভূমিতে দায়িত্ব পালন করেছে তাদেরকে চার্চের মতবাদে দীক্ষিত করা তুলনামূলকভাবে সহজ এবং একটা ভালো পরিকল্পনা। তারপরও এতে সে একটা সমস্যা দেখছিল যে, এদের মত নির্দয়, বর্বর, অজ্ঞ যুদ্ধপ্রিয় মানুষদেরকে কিভাবে অনুগত নাইটে রূপান্তর করা যায়। এরপরও সে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে কিছু কৌশল (যেমন বিভিন্ন ধরণের ছাড় ও সাহায্যের মোড়কে ঘুষ) প্রয়োগ করে এই সকল অশিক্ষিত লোকগুলোকে বশ এবং নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, যা পরবর্তীতে এক ভয়াবহ ভুল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল। শুরু থেকেই টেম্পলাররা বারনার্ডের পরিকল্পনামাফিক কাজ করছিল এবং টেম্পলাররাও তার উপর নির্ভর করে তাদের পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছিল। বারনার্ড প্রথমত টেম্পলার এবং তারপর তাদের নাইটদের মাধ্যমে চার্চের জন্য এক সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে।

বারনার্ড যখন এই পরিকল্পনা করছিল তখন টেম্পলাররা যারা ধর্মীয় নৈতিকতা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল তারা বারনার্ডের কল্যাণে সকল ধরণের সুবিধা পাওয়ার তোড়জোড় করছিল। তাদের এই পারস্পরিক সম্পর্কের ফলস্বরূপ সংঘের সদস্যরা আপাত ধার্মিকভাব দেখাত এবং চার্চ তাদেরকে সব সুযোগ সুবিধা দিত। এছাড়াও টেম্পলারদের অসৎ উদ্দেশ্য সামনে চলে আসায় ১৩০৭ সালে যখন তাদেরকে শাস্তিস্বরূপ নির্বাসিত করার পরিকল্পনা করা হল তখন চার্চের এক বিশেষ গোষ্ঠীর অব্যাহত প্ররোচনায় তাদেরকে খালাস দেওয়া হয় এবং নির্বাসন থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।