আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেকুব

হরতালে জীবনযাত্রার তাল সামলানো দায়। সকাল সকাল দোকানে গিয়ে মাথা গরম। ডিমের দাম লাফ দিয়ে আকাশে উঠেছে। তরল দুধ নেই। গাড়ি আসেনি।

এই সেদিনও মহল্লার মুরগির দোকানে ব্রয়লারের কেজি ছিল ১২০ টাকা। এক দিনেই তা মইয়ের ডগায় পৌঁছে ১৫০ টাকা বলে হূষ্টচিত্তে হাত নাড়ছে।

কঠিন চিজ’ জব্বারের মাংসের দোকানে হাড়সর্বস্ব কয়খান মাংসের চাপ ঝুলছে। পারলে ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ওই ভিড়ে গা লাগাতে ইচ্ছা করে না।

ছেলেমেয়ের কথা ভেবে যেতে বাধ্য হই। ওরা তো বোঝে শুধু একটাই—দাও! কোত্থেকে দেবে, তা জানি না।

মাংসের দোকানে গিয়ে খদ্দেরের ভিড় ঠেলে জায়গা করে নিয়ে শুকনা গলায় বলি, আমাকে দুই কেজি দিয়ো, জব্বার মিয়া।
চাপাতি দিয়ে চপাচপ মাংস কাটছে জব্বার। আমার দিকে পলকের তরে তাকিয়ে ঠকাস করে চওড়া একটা হাড়ে চাপাতি চালাল সে।

হেঁকে বলল, ‘আগে যারা আইছে, হেগোর দেওনের পর থাকলে পাইবেন। তয় কেজিতে কইলাম ২০ টেকা কইরা বেশি দেওন লাগব। ’

মহল্লার এক পরিচিত মুখ আমার দিকে ফিরে তেতো হাসি ঝরাল। বলল, ‘দেখছেন ভাই, হরতাল কেমুন পৌষ মাস আইনা দিছে হ্যারে!’
জব্বার অমনি ফস করে দেশলাইয়ের কাঠির মতো জ্বলে ওঠে, ‘পৌষ মাসের কী আছে? হরতালে টেরাক আহন বন্ধ। গরুর সাপ্লাই নাই।

এর মইদ্যেও যে মাংস দিবার পারতাছি, শুকরিয়া করেন। ’
জব্বারের কথা শেষ হতে না হতে তার খ্যাড়খ্যাড়ে গলা ছাপিয়ে কুঁদে উঠল একটা হেঁড়ে গলা। সেদিকে তাকাতেই দেখি মহল্লার মালদার মহাজন আফসারউল্লাহ। তিন-তিনটা বাড়ি তাঁর। সবার মাথা ছাড়িয়ে উঁচু হয়ে আছে তাঁর মাথা।

সঙ্গে গোমস্তাও আছে একজন।
আফসারউল্লাহ বলেন, ‘একটু সুযোগ পাইলেই তোগোর ধান্দাবাজি বেজায় বাইড়া যায় রে, জব্বইরা! এইগুলা যে ফ্রিজে রাখা মইষের মাংস, হেইডা কি আমরা বুঝি না মনে করছস? পেটের দায়ে আমরা আইছি বইলা খুব ভাব লইতাছস, না?’
জব্বার হাসার চেষ্টা করে বলে, ‘বেয়াদ্দবি নিয়েন না, মুরুব্বি। আমি তো জোর কইরা কাউরে মাংস গছাইতাছি না। যার পোষাইব নিব, যার পোষাইব না, নিব না। ’
এবার রীতিমতো ফেটে পড়েন আফসারউল্লাহ।

আঙুল নাচিয়ে বলতে থাকেন, ‘কী! এত্ত বড় বেয়াদ্দবি! আমগোর মহল্লায় দোকান দিয়া আমগোর লগে বাহাদুরি। যা, কেউ তোর মাংস লমু না। দেখি তুই এইখানে মাংস বেচস কেমনে?’
এই বলে আফসারউল্লাহ ভিড় করা খদ্দেরদের দিকে ফেরেন। গলার রগ ফুলিয়ে ভাষণ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলতে থাকেন, ‘ভাই সব, দোষ কিন্তু আমাগোরই। আমাগোর মইদ্যে একতা নাই বইলা এই সব বদমাইশ লোকজন একহাত লইয়া যাইতাছে।

মাফ না চাইলে আর দাম না কমাইলে কেউ আর ওর দোকান থিকা মাংস কিনবেন না। চলেন, দেখি ওর দোকানের মাংস না খাইয়া আমরা থাকতে পারি কি না। ’
কথা শেষে করে আফসারউল্লাহ তাঁর লম্বা দুটো হাত এমনভাবে নাড়তে লাগলেন, যেন একপাল ভেড়া তাড়ানোর চেষ্টা করছেন তিনি। তাঁর হাতের এ ঝাপটায় অসামান্য প্রভাব। নিমেষে ফাঁকা হয়ে গেল দোকান।


গোবেচারার কাছে একতাই বল। মনে মনে ভাবি, দেশে আফসারউল্লাহর মতো মানুষের নেতা হওয়া দরকার। তিনি কি বেশি টাকায় পাঁচ-দশ কেজি মাংস নিতে পারতেন না? নিশ্চয়ই পারতেন। আর ক্রেতা হিসেবে জব্বার তাঁকে দামও দিত। কিন্তু তিনি তা না করে মহল্লাবাসীর স্বার্থ রক্ষা করে গেলেন।

দেশের রাজনীতিতে এমন মানুষেরই আসা দরকার। শুনেছি, একসময় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন আফসারউল্লাহ। দুবার ওয়ার্ড কমিশনার পদে লড়েছেন। টক্কর দিতে পারেননি। নিজের ওপরই করুণা হয়।

আমরা আসলে নেতা চিনি না। ভুল লোককে ভোট দিই। আফসারউল্লাহর মতো মানুষকে নেতৃত্বে রাখলে কি আর দেশের এই দশা হয়?

আমার মনেও একটা জেদ চেপে গেল। মনে মনে পণ করলাম, যা বেটারা, বেশি টাকা দিয়ে মাছ-মাংস-মুরগি কিছুই কিনব না। মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে আমাদের এভাবেই শুরু করতে হবে।

তাদের বিরুদ্ধে শক্ত করে তুলতে হবে অসহযোগ আন্দোলনের ভিত।

খালি হাতে বাসায় ফিরতেই গিন্নি শুকনা গলায় বলে, ‘কী হলো, বাজার কই?’

আমি মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের সবক ঝাড়ি। গিন্নি ঝাঁজিয়ে উঠে বলে, ‘ওসব আন্দোলন দিয়ে কেবল আগুন জ্বলে আর নিরীহ মানুষ পোড়ে। পেট ভরে না। চারদিকে দেখেও কি আক্কেল হচ্ছে না?’

এদিকে ছেলেমেয়েরাও চরম হতাশ।

হরতালে স্কুল বন্ধ। এখন তোফা খাবার না হলে আর ছুটির মজা কিসের!

কলহের লাল-সংকেত দেখে কুঁকড়ে যাই। কোনো রকমে ম্যানেজ করার জন্য বলি, ‘ফ্রিজে যা আছে, তা-ই দিয়ে আপাতত চালিয়ে দাও, বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময় বাজার নিয়ে আসব। ’

গিন্নি ফেটে পড়ে বলে, ‘বাহাত্তরে পৌঁছার আগেই দেখি ভীমরতি ধরেছে তোমাকে! বেরোবার সময় তোমাকে ফ্রিজ খুলে দেখালাম না—মাছ-মাংস কিছুই নেই। ’

ঝড় আছড়ে পড়ার আগেই দ্রুত বেরিয়ে পড়ি।

কিছু দূর যাওয়ার পর দেখি, আফসারউল্লাহ বেশ হেলেদুলে আসছেন। পেছনে ভারী ব্যাগ হাতে তাঁর গোমস্তা। আমাকে দেখে গাল ভরে হাসলেন তিনি। সগর্বে বললেন, ‘জব্বইরার নাটবল্টু সব টাইট হইয়া গেছে! এদের সাথে এমন না করলে হয় না। বেটা মাফ তো চাইছেই, কেজিতে আগের দামের চেয়ে ২০ টাকা কইরা কম নিছে।

আমি থ বনে বেকুবের মতো জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা কয় কেজি কিনলেন, মুরুব্বি?’

জবাব এল, ‘বেশি আর কিনতে পারলাম কই? মাত্র ১০ কেজি!’

 

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।