আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দিতে পারো একশ ফানুশ এনে



মস্তিষ্কের সমস্ত স্নায়ু টান টান হয়ে আছে, টান ছেড়ে দিলেই ঘুমিয়ে পড়বো। কিন্তু টান ছেড়ে দিতে পারছি না। আস্তে আস্তে সমস্ত নিউরন শিথিল হয়ে আসছে, শরীর নিস্তেজ হয়ে বিছানায় মিইয়ে যাচ্ছে আর তার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাথার ভেতরে কণ্ঠস্বরের পরিমান! ফিসসিস থেকে ক্রমে কোলাহল করে কণ্ঠস্বর গুলো বলে যাচ্ছে, একবার ঘুমিয়ে পড়লে আর উঠতে পারবে না! কুয়াশা বাড়ছে । সূর্যের আবছা আলোতে যেন কুয়াশাগুলো আরও ঘন হচ্ছে। মোড়ের দোকান থেকে ভাপাপিঠার ধোঁয়া-ঘ্রাণ ভেসে আসছে ।

ভাপাপিঠার ধোঁয়ায় প্রবল নিবিড় হচ্ছে অন্তর্গত যুদ্ধের পরিমান, আমি টান ছেড়ে দিচ্ছি, ভিতরে খুব ভিতরে কে জানি ধরে রাখছে! কে সে?! **** **** **** ঠিক যেন যুদ্ধক্ষেত্রে সাই করে তরবারি চালাল এমন করে গায়ের উপর থেকে কাঁথা ছুঁড়ে ফেলল বিনু! চোখে সূর্যের ঝিলিক লাগছে! দিনের আলো চোখে লাগলে ও ঘুমাতে পারে না! এত সকালে কে যেন তার ঘরের পর্দা টেনে দিয়ে গেছে! এত ভোরে উঠা তার স্বভাব নয়, তাই ঘুম ভেঙেই ঘরে এত আলো দেখে গেল মেজাজ খারাপ হয়ে! কোঁচকানো ভ্রু নিয়ে জানলার পর্দা টেনে দিতে গিয়েই দেখলও মোড়ের দোকানে ভাপা পিঠা তৈরি হচ্ছে। কুয়াশার মত ধোঁয়া উঠছে গরম গরম পিঠা থেকে! তার হঠাত করে বিছানায় পা দুলিয়ে দুলিয়ে ভাপা পিঠা খেতে ইচ্ছা হল! সস্তা ভাপা পিঠা খাওয়ার আনন্দ বড় সস্তায় পাওয়া যায়! **** **** **** এ শহরে দামী আনন্দ মানেই আলো ঝলমলে সন্ধ্যা!!মঞ্চের সামনে চেয়ারে বসে পুতুল নাচ দেখছিল রিনু। আজকে হথাত বিনুর কথা খুব মনে পড়ছে। কতদিন বিনুটার সাথে দেখা হয় না! রিনু আর বিনু দুই বোন। বিনু মাএর সাথে থাকে বিনু বাবার সাথে ।

বাবা আর মায়ের মাঝের সম্পর্কের অদৃশ্য সূতা ছিঁড়ে গেছে অনেকদিন। কিন্তু বোনদের মাঝখানে সুতা তো ছিঁড়ে যায়নি । বাবা মা যতই দূরে গেছেন কাছে আসার প্রবল টান যেন তাদের নেশার মত চেপে ধরেছে। মাঝখানে নির্মমতার মত এসে গেছে দুরত্ব। দুজন দুশহরে বসে পরপ্সপরকে ভাবা , টেলিফোন , অবেলার চোখের জল সবকিছুই তাই আলোঝলমলে সন্ধ্যাগুলোতে বড্ড বেদনা জাগিয়ে যায়! আচ্ছা, বিনু এখন কার সাথে ভাপা পিঠা বানায়?! মা এর সাথে নিশ্চয়ই?! একবার গ্রামের পিঠা বানানোর চাল গুড়ি করতে গিয়ে শখ করে ঢেঁকিতে চড়ে রিনু বিনুর হাতে ঢেঁকি ফেলে দিয়েছিল!! কি যে রক্ত! রিনুর হঠাত একবারে অনেককথা মনে চলে আসে! কেমন জানি ভাপা পিঠা খেতে ইচ্ছা করছে! এ শহরে এখন কোথায় ভাপাপিঠা পাওয়া যাবে?! একজন নিশ্চয়ই এ খবর জানে! রিনু ঝটপট ফোন বের করে সেই একজনের নাম্বারে ডায়াল করা শুরু করে! **** **** **** মঞ্চের পিছনে নিবিষ্ট মনে সুতো টেনে যাচ্ছেন মজিদ মিয়া।

মজিদ মিয়া ১০ বছর যাবত এ লাইনে আছেন, শহরে শহরে পুতুল নাচ দেখিয়ে বেড়ান । কোনদিন এমন হয়নি, আজকের সন্ধ্যাটাই কেমন জানি বিষণ্ণ করা, অন্যরকম! পুতুল নাচে আজ ছিল গ্রামের পিঠা পুলি উৎসবের গাঁথা! নিজে পুতুল খেলাতে খেলাতে হঠাত করে মনে পড়েছে গ্রামের কথা । গ্রামে বউ, দুইটা ছেলেমেয়ে রেখে কতদিন যাবত ভবঘুরে আছেন! পেটের তাগিদে আজ এ শহর তো কাল ও শহর! এই শীতে কি বউ ছেলেমেয়েদের পিঠা বানিয়ে খাওয়াতে পারছে? নতুন চালের ভাপা পিঠা?! তিনি এখনও টাকা পাঠাতে পারেননি, তিনি টাকা নিয়ে গ্রামে যাবেন, তার পর সবাই মিলে ভাপা পিঠা খাবেন ভাবতে ভাবতে আনন্দে তার চোখে পানি চলে আসে! **** **** **** ইমতিয়াজ সাহেব অগোচরে হাটতে হাঁটতে কখন রোকেয়া হলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন খেয়াল করেন নি। এখন আরও বেখায়ালে অপেক্ষা করে চলেছেন যেন কেউ একজন হল থেকে বের হয়ে আসবে, তার হাতে একটা টিফিন বাক্স তুলে দিয়ে বলবে ভাপা পিঠা! শীতের নতুন পিঠা খেলে প্রেম বাড়ে! অথচ তিনি জানেন এখন আর কেউ আসবে না, এসব আজ থেকে অনেক আগেকার কথা, প্রায় ৩০ বছর! তারপর কত কিছু ঘটে গেছে! পারমিতা, রোকেয়া হলের সেই মেয়েটির সাথে তার বিয়ে হয়েছিল। তাদের দুটো ফুটফূটে মেয়ে আছে, রিনু আর বিনু! কিন্তু সেই ভাপাপিঠা বানিয়ে দেয়া মেয়ে এবং কাক ডাকা ভোরে রোকেয়া হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিই আর একসাথে নেই! আসলে ভালোবাসা ব্যাপারটা নতুন চালের ভাপা পিঠার মত, প্রতি শীতে শীতে নতুন করে নতুন চাল দিয়ে বানাতে হয়!নাইলে কখন জানি উদ্বায়ী হয়ে যায় বুক থেকে! শুধু একফোঁটা করে জল পড়ে থাকে চোখের দু কোণায় যেন এটুক প্রমান করতেই যে ভালোবাসা সত্যিই ছিল!! আচ্ছা, আজকে হঠাৎ করে ময়মনসিংহ হাজির হয়ে নতুন চালের ভাপা পিঠা খেতে চাইলে পারমিতা কি ফিরিয়ে দেবে? বিনুকেও কতদিন চোখের দেখা দেখা হয় না।

ময়মনসিংহে ওদের ঠিকানাটা যেন কি? ইমতিয়াজ সাহেব মনে করার চেষ্টা করছেন । কিছুতেই মনে পড়ছে না! **** **** **** রিনু হঠাত করে ফোন দিয়ে বলেছিল ঢাকা শহরে ভাপা পিঠা কোথায় পাওয়া যায় খুঁজে বের করতে। পিঠা উৎসবে এই ২৩ নং স্টলটার সামনেই ওর দাঁড়ানোর কথা! কখন থেকে বসে আছি কোন খোঁজ খবর নেই! ফোন ও ধরছে না! এদিকে আমার হাত পুড়ে গেছে! ও আসতে থাকুক আমি পিঠা কিনে নিয়ে বসব ভেবে ভাপা পিঠা কিনতে গেছি অসাবধানে হাত চলে গেছে পিঠার পাত্রের উপর! ভাপা পিঠার পাত্র থেকে বের হতে থাকা বাষ্পের এক ছ্যাকায় হাতের অবস্থা দফারফা! খুব জ্বলছে! কিছুক্ষণ পর রিনু কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে এসে হাজির হল। আমি কি হয়েছে জিজ্ঞেস করাতে বলল, কাল ভোর থেকে বাবার খোঁজ নেই! রাতে বাসায় ফিরেনি,আজও সারাদিন সবজায়গায় খুঁজাখুঁজি করে কোথাও পাচ্ছি না। না বলে কোথাও তো যায় না! আলাভোলা একটা মানুষ, কোথায় যেতে পারে বলতো? বলতে বলতে আবার কেঁদে ফেলল , চোখের নোনতা জল ভাপা পিঠার বাষ্পের মত বের হয়ে আমার হাতে পড়তে লাগল ।

আমি বললাম, ময়মনসিংহ ফোন দিয়েছিলি? -বিনু চিটাগাং , ও বলল কিছু জানে না। মার ফোনে পাচ্ছি না । আর বাবা ময়মনসিংহ কেন যাবেন? এত দিনে কখনো যাননি ছাড়াছাড়ির পর । রিনু কাদছিল। আমি খেয়াল করলাম ওর চোখের জল আমার হাতের পোড়া জায়গায় পড়ে কেমন আরাম পাচ্ছি!! জ্বলুনিটা অনেক কমেছে! কারো কারো চোখের জলে হিলিং পাউয়ার আছে! **** **** **** বিধাতা নিবিষ্ট মনে পুতুলের সুতো ধরে টানছেন।

রিনু, বিনু, মজিদ মিয়া, ইমতিয়াজ সাহেব, পারমিতা কত গুলো সুতো!! নাহিদ নামে একটা ছোট্ট ছেলে সদ্য ঘুড়ি উড়ানো শিখেছে, নাটাই হাতে ঘুড়ি উড়াচ্ছে, বিধাতা নাহিদের সুতো টানছেন, নাহিদের ঘুড়ির সুতোও টানছেন । হঠাত করে...... হঠাত করে নাহিদের ঘুড়ির সূতা ছিঁড়ে গেল!! নাহিদ ঘুড়ির পিছনে ছুটছে......তো......ছুটছে...... । । **** **** **** আমি আর রিনু ময়মনসিংহের বাসে উঠে পড়েছি! ওর মা ফোন ধরেছেন, ইমতিয়াজ সাহেব ময়মনসিংহে আছেন! রিনু আর আমি পাশাপাশি বসে আছি! রিনুর জানালার বাইরে চোখ, আমার রিনুর দিকে!!একশো ষোলটি জোছনার পর ভিজছি না পড়া বৃষ্টিতে; নোনা জলে......... হঠাত করে একটা ছুটে যাওয়া ঘুড়ির পিছনে ছুটতে ছুটতে ছোট্ট একটা ছেলে আচমকা আমাদের বাসের সামনে এসে পড়ল! একটা শুভ্র ভাপা পিঠাতে তাজা টকটকে রক্ত মেশালেন বিধাতা নামের একজন পুতুল খেলোয়াড়! সূর্য উঠলো, শুরু হতে লাগলো আরেকটা সকাল আর লক্ষ কোটি জীবন একটা মৃত্যুকে পেছনে ফেলে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.