আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শ্যামল আমার অনিমেষ



১. ক্লাসে একটা নতুন ছেলে এসেছে। ঢ্যালা ঢ্যালা চোখ আর মাথা ভর্তি চুল। কি যেন একটা ম্যাজিক দেখিয়ে নিজের চারপাশে ছেলে-মেয়েদের একটা ভিড় জমিয়ে ফেলেছে। আশ্চর্য! নতুন এসেই নিজের চারপাশে এমন ভিড় করে ফেলল- ব্যাপারটা আমার মোটেই পছন্দ হলনা। কাহিনী কি জানার জন্য মুখ লুখিয়ে উকি দিলাম।

দেখলাম ছেলেটা তার ডান হাত মুঠ করে কিছুক্ষণ উঁচু করে ধরে রাখল। নামিয়ে এনে হাতের মুঠ খুলতেই দেখলাম ওর হাত ভেজা। সবাই এটা দেখে হাতেতালি দিল। আমি ক্লাসের সেকেন্ড বয়, সবসময় আমিই হাতেতালি পেয়ে এসেছি, তাই আমার সামনে আজ অন্য একজন’কে হাতেতালি পেতে দেখে মনটা আমার বিষিয়ে উঠল। আমি ওকে চ্যালেঞ্জ করে বললাম, উহ, এটা আমিও পারি!! ঝাঁকড়া চুল ওয়ালা ছেলেটা আমার দিকে চেয়ে বলল, সত্যি পারবি? দেখাতো! আমি বেশ কায়দা করে ঠিক ওর মতো হাত মুঠ করে রাখলাম।

কিন্তু হাত খুলে আমি বেশ অবাক হলাম, আমার হাত খটখটে শুকনা, পানির ছিটাফোঁটাও নেই। নতুন আসা ছেলেটি প্রথম দিনেই আমাকে হারিয়ে দিল। ঢ্যালা ঢ্যালা চোখের এই ছেলেটির নাম শ্যামল। ২। ক্লাসে আরও একটি নতুন ছেলে এসেছে।

ধবধবে ফরসা, আর হাত পায়ে বড়দের মতো পশম। এত বেশি ফরসা যে ভাল মতো লক্ষ্য করলে হয়তো ভেতরকার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখা যাবে। এই ছেলেটি কিছুটা অহংকারি। নইলে এসেই কেন ক্লাসের ফার্স্ট বয়, সেকেন্ড বয়ের সাথে খাতির করার চেষ্টা করবেনা? ছেলেটির নাম গোপেশ গুহ। খুবই অদ্ভুত নাম।

আমরা সম্ভব সব উপায়েই ওর নাম বিকৃত করে ওকে ক্ষেপাতে লাগলাম। ও তেমন গা’ করত না, তাতে আমাদের উৎসাহে তেমন ভাটা পরেনি। ৩। পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে আমরা এক একজন এক একদিকে ছড়িয়ে পরলাম। ততদিনে আমাদের বন্ধুত্বও বেশ ছড়িয়ে পড়েছে।

শ্যামল আমাকে শিখিয়েছে কি করে ও শুকনো হাত সবার সামনে পানি ছাড়াই ভিজিয়ে ফেলে। গোপেষ’কে এখন আর ‘...পেষ’ বলে ক্ষেপাই না। ও আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে কাগজের প্লেন বানাতে হয়, কিভাবে একটানে হাতি আঁকতে হয়। আমরা তখন আমাদের হয়ে গিয়েছিলাম। ৪।

প্রায় চার বছর পর শ্যামল’কে আমি প্রথম দেখি শ্মশান ঘাটে। ওর বাবা মারা গিয়েছেন। আমি দূর হতে দাড়িয়ে শুধু শ্যামল’কে কাঁদতে দেখেছি, কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে দাড়াতে পারিনি। তারও অনেক আগেই একদিন ঘুম থেকে উঠে শুনি গোপেশ’রা কোথায় যেন চলে গেছে। ৫।

আইয়ুব বাচ্চু’র ‘অনিমেষ’ গানটা যতবার শুনি ততবার আমার শ্যামলের কথা মনে পরে, গোপেষের কথা মনে পরে। কত খুঁজেছি ওদের, কেউ ওদের কথা বলতে পারেনি। কেউ বলে শ্যামল ইন্ডিয়া চলে গেছে, কেউ বলে মামার বাড়ি চলে গেছে। গোপেষের বাবার ছিল বদলির চাকরি। ওরা কোথায় বদলি হয়ে গেছে কে জানে! কতদিন আউয়াল আর আমি ভেবেছি ঢাকার গ্রামীণ ব্যাংকের হেড অফিসে গিয়ে খোঁজ নেব, নেয়া হয়না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটিন মাফিক জীবনে আমরা বাধা। ওরা দুইজন হয়তো আমাদের জীবন থেকে হারিয়েই গেছে। ৬। “ আশিস, আমি শ্যামল!!” “ আশিস, আমি সত্যি শ্যামল!” “তুই আমাকে চিনতে পারছিস না? আরে আমি শ্যামল, ইন্ডিয়া থেকে বলছি,তুই কথা বলছিস না কেন?” আমি জানিনা, আমি সত্যি জানিনা, ওই সময় আমি কেন কথা বলতে পারিনি। প্রায় দশ বছর পরে যেই বন্ধু ফোন করে সে আবার কেমন বন্ধু? এরকম বন্ধুর সাথে মিনিট পাঁচেক কথা না বললে আমার কিচ্ছু কষ্ট হবেনা।

৭। শ্যামল’কে আমি আবারও খুজে পাবো- এ আশা আমি ছেড়েই দিয়েছিলাম। এখন ওর সাথে আমার প্রায় প্রত্যেক দিনই কথা হয়। আমরা গোপেষ’কে খুজি। জানিনা পাবো কিনা, হয়তো পাবো, হয়তো পাবো না।

গোপেষ, যদি কোনদিন তোর সাথে আমার দেখা হয়, তাহলে তোকে আমি আচ্ছা করে একটা চড় দিব, তুই না বলে কোথায় হারিয়ে গেলি? এতটা স্বার্থপর হওয়া তোর উচিত হয়নি। স্বার্থপর মানুষদের আমি একদমই সহ্য করতে পারিনা। তোর উপর আমি অনেক রেগে আছি। তবুও তুই ভাল থাকিস, সুস্থ থাকিস। আমার সব অনিমেশ’দের জন্য অনেক বেশি শুভকামনা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.