আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্ব

বাংলা আমার দেশ

বাংলাদেশ সংকটে যুদ্ধ আসন্ন মনে হওয়ায় ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ১৯৭১ সালের এপ্রিলে চটজলদি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েন পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর হামলা চালানোর জন্য সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশকে চাপ দিতে থাকেন। পূর্ব পাকিস্তানে তড়িঘড়ি সামরিক অভিযান চালানোর ব্যাপারে জনসংঘের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। মানেকশ দৃঢ়তার সঙ্গে রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করেন এবং জানিয়ে দেন যে, যুদ্ধের জন্য তাদের বর্ষাকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তিনি চীনের সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, শীতকালে হিমালয়ের গিরিপথগুলো বরফে আচ্ছাদিত হওয়া নাগাদ আমাদেরকে ধৈর্য ধরতে হবে নয়তো চীন সামরিক হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবে। এ যুক্তি দেয়ায় কয়েকজন উ্বর্ধতন রাজনৈতিক নেতা মানেকশকে বরখাস্ত করে অবিলম্বে যুদ্ধ শুরু করতে চেয়েছিলেন।

এক পর্যায়ে জেনারেল মানেকশ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদের ইচ্ছামতো দ্রুত যুদ্ধ শুরু করতে চাইলে দেশের সম্মান খোয়া যেতে পারে এবং সৈন্য, কামান ও সাজসরঞ্জাম মৌসুমি বৃষ্টিতে আটকা পড়বে। তাতে যুদ্ধে বিপর্যয় ঘটবে। তিনি তার বক্তব্য শেষ করে পদত্যাগ করার প্রস্তাব দেন। ইন্দিরা মানেকশর পদত্যাগের প্রস্তাব নাকচ করে দেন এবং তার পরামর্শ গ্রহণ করেন। বয়রা যু্দ্ধ ২১ নভেম্বর ভারত সীমান্তের কাছে যশোর শহর থেকে ২০ মাইল পশ্চিমে বয়রায় প্রথম ভারতীয় ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।

ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনী ৬ মাইল অভ্যন্তরে ঢুকে চৌগাছা দখল করে নেয়। তবে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধে তাদের অগ্রযাত্রা থেমে যায়। কয়েকটি ভারতীয় ট্যাংক জলাভূমিতে আটকা পড়ে। এ যুদ্ধে উভয়পক্ষ একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রথম বিমান বাহিনীর সহায়তা কামনা করে। তাদের মধ্যে ট্যাংক যুদ্ধও হয় এখানেই প্রথম।

পিটি-৭৬ ট্যাংক সজ্জিত ভারতের ৪৫তম ক্যাভালরি গরীবপুর দখলে এগিয়ে এলে উভয়পক্ষের তুমুল লড়াই শুরু হয়ে যায়। ভারতীয় হামলা মোকাবিলায় পাকিস্তানের ১০৭তম পদাতিক ব্রিগেডের সহায়তায় এম-২৪ শ্যাফি ট্যাংক সজ্জিত তৃতীয় সাঁজোয়া স্কোয়াড্রন এগিয়ে আসে। সংখ্যায় বেশি হওয়ায় পাকিস্তানিরা ভারতীয় হামলা গুঁড়িয়ে দিতে পারতো। কিন্তু পাঞ্জাব রেজিমেন্ট বাংকারে অবস্থান গ্রহণ করে এবং ভারতীয় ভূখণ্ডে পাল্টা হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে। ভারতীয়রা পদাতিক বাহিনী ও রিকয়েললেস রাইফেলকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে রেখে ট্যাংকগুলোকে সামনে পাঠায়।

পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা ধরে ভারতীয় ট্যাংক থেকে পাকিস্তানি অবস্থানে গোলাবর্ষণ করা হয়। কিন্তু ঘন কুয়াশা থাকায় পাকিস্তানিরা ভারতীয় ট্যাংকের অবস্থান শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। পিছু না হটে পাকিস্তানি ট্যাংক ও পদাতিক বাহিনী ভারতীয় অবস্থানের দিকে ধেয়ে যায়। ভারতীয়রা এ হামলা ব্যর্থ করে দেয়। পাকিস্তানি পক্ষে ব্যাপক হতাহত হয়।

দু্পুরের মধ্যে তাদের ১১টি ট্যাংক অকেজো এবং ৩টি সচল অবস্থায় ধরা পড়ে। অন্যদিকে ভারতের ধ্বংস হয় ৬টি ট্যাংক। পাকিস্তানের ১০৭তম ব্রিগেড মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতীয় সৈন্য নিহত হয় ৪০ জন। ২২ নভেম্বর পাকিস্তানি কমান্ডার বিমান বাহিনীর সহায়তা চান।

ভারতীয় রাডারে তিনটি পাকিস্তানি স্যাবর জেটের উড্ডয়ন ধরা পড়লে চারটি ভারতীয় ন্যাট কলকাতার দমদম বিমান ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করে। ভারতীয় বিমান তেড়ে আসার আভাস পেয়ে স্যাবরগুলো নিজেদের ভূখন্ডে ফিরে আসে। দ্বিতীয়বার ভারতীয় রাডারে ধরা না পড়ায় স্যাবারগুলো অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসার সুযোগ পান। বিকেলে ভারতীয় স্থলবাহিনীর উপর তৃতীয় দফা বিমান হামলা হয়। জঙ্গিবিমানগুলো রাডারে ধরা পড়ার তিন মিনিটের মধ্যে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রায় এন্ড্রু মাসির নেতৃত্বে চারটি ন্যাট উড়ে আসে।

অন্য তিনটি ভারতীয় বিমানের পাইলট ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এমএ গণপতি, ফ্লাইং অফিসার কেবি বাগচি ও ফ্লাইং অফিসার ডন লাজারাস। ন্যাটগুলো দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে হামলায় অংশ নেয়। ভারতীয় ন্যাটের গুলিতে দু’টি স্যাবর ঘায়েল হয়। উইং কমোডর চৌধুরীর বিমান থেকে ধোঁয়া বের হতে থাকলেও তিনি তেজগাঁও বিমান ঘাঁটিতে ফিরে আসতে সক্ষম হন। ভারতের নওগাঁর কাছে একটি গ্রামে দু’টি পাকিস্তানি স্যাবর ভূপাতিত হয়।

জ্বলন্ত বিমান থেকে প্যারাশূট দিয়ে নামতে গিয়ে পাকিস্তানি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পারভেজ মেহেদী কোরেশী ও ফ্লাইং অফিসার খলিল আহমদ ভারতীয় সৈন্যদের হাতে বন্দি হন। ভারত পূর্ব পাকিস্তান ভূখন্ডে লড়াই হওয়ার সত্যতা অস্বীকার করে দাবি করে যে, পাকিস্তানি জেটবিমান ভারতীয় আকাশসীমা লংঘন করেছিল এবং ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তানি বিমানগুলোকে গুলি করে নামিয়েছে। বয়রার আকাশ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী চার ভারতীয় বৈমানিক রায় মাসি, এমএ গণপতি ও ডন লাজারাস ‘বীর চক্র’ এবং কেবি বাগচি ‘বায়ু সেনা’ খেতাবে ভূষিত হন। লাজারাস ভারতীয় বাহিনীতে পদোন্নতি পেয়ে হন ফ্লাইট কমান্ডার। ভারতের হাতে বন্দি পাইলট পারভেজ মেহেদী কোরেশী ১৯৯৬ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনী প্রধান হিসাবে নিযুক্তি পেলে প্রথমে অনেকেই বিশ্বাস করতে চায়নি।

একটি দুর্বল বিশ্বাস নিয়ে ফ্লাইট কমান্ডার লাজারাস তাকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন যে, ১৯৭১ সালে আকাশ যুদ্ধে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। হয়তো সে স্মৃতি এতদিনে তিনি ভুলে গেছেন। ফ্লাইট কমান্ডার লাজারাস উত্তর পাওয়ার আশা করতে পারেননি। একদিন বিস্মিত হয়ে তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল পারভেজ মেহেদী কোরেশীর স্বাক্ষর দেয়া একটি চিঠি পান।

চিঠিতে কোরেশী ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রশংসা করেন। সেই সঙ্গে লাজারাসের অফুরন্ত মঙ্গল কামনা করেন। লাজারাস এ চিঠি অত্যন্ত যত্ম করে নিজের কাছে রেখে দেন। পাকিস্তানের প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা অঘোষিত যুদ্ধ শুরু হওয়ায় ২৩ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সমগ্র পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং জনগণকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন। জন্মলগ্ন থেকে প্রতিরক্ষার দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত থাকায় পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নীতিতে বলা হয়েছিল, ÔThe defense of East lies on the West.’ ‘পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নির্ভর করছে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর।

’ এ প্রতিরক্ষা নীতির আওতায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব রণাঙ্গনের উপর ভারতীয় হামলার চাপ কমাতে এবং পশ্চিম রণাঙ্গনে যতটুকু সম্ভব ততটুকু ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করার অভিপ্রায়ে যুদ্ধের পথ বেছে নেন। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৫ টায় ভারতে হামলা চালানোর চূড়ান্ত নির্দেশ দেয়া হয়। ১০ মিনিটের মধ্যে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রথম বহর আকাশে উড্ডয়ন করে এবং লক্ষ্যবস্তুর দিকে ধেয়ে যেতে থাকে। সরকারি চ্যানেলে ঘোষণা করা হয় যে, পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানি রেঞ্জারদের চৌকিতে বিমান বাহিনীর সহায়তায় ভারতীয় সৈন্যদের হামলার জবাবে এ বিমান হামলা চালানো হয়। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৫টা ৪০ মিনিটে পাকিস্তান বিমান বাহিনী পশ্চিম ভারতের ৮টি বিমান ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করে।

সীমান্ত থেকে ৩ শো মাইল অভ্যন্তরে আগ্রায়ও বোমাবর্ষণ করা হয়। পাকিস্তানের এ অপারেশনের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন চেঙ্গিস খান। ’ ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইলের ‘অপারেশন ফোকাস’-এর আদলে ভারতে এ হামলা চালানো হয়। তবে ‘৭৩ সালে ৬ দিনব্যাপী আরব-ইসরাইল যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ জঙ্গিবিমান নিয়ে ইসরাইল আরব দেশগুলোর বিমান ঘাঁটিতে যেভাবে হামলা চালিয়েছিল, সেই তুলনায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর তৎপরতা ছিল খুবই হতাশাব্যঞ্জক। ভারতে বোমাবর্ষণে পিএএফ ৫০টির বেশি জঙ্গিবিমান ব্যবহার করতে পারেনি।

পাকিস্তানি বিমান হামলায় ভারতীয় ঘাঁটিগুলোর রানওয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য অকেজো ছিল। তবে ভারতীয়রা পশ্চিম রণাঙ্গনে এ ধরনের হামলা চালানোর সত্যতা অস্বীকার করে। ভারতীয় বিমান প্রতিরক্ষা রাডার পাকিস্তানি বিমান শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। বিমানগুলোর গর্জন শুনে ভারতীয়রা পাকিস্তানি বিমান হামলা আঁচ করতে সক্ষম হয়। দিল্লিতে পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতির উপর সাংবাদিকদের নিয়মিত ব্রিফিং দেয়া হতো।

এ সময় দিল্লিতে সাইরেন বেজে উঠলে সাংবাদিকরা বুঝতে পারেন যে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ভারতের অগ্রবর্তী বিমানঘাঁটি ও রাডার স্থাপনায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর আকস্মিক হামলার মধ্য দিয়ে একাত্তর সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সূচনা হয়। ৩ ডিসেম্বর রাতে তিন দফা ভারতীয় লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো হয়। যেসব বিমান ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করা হয় সেগুলো ছিল অমৃতসর, আম্বালা, আগ্রা, অবন্তিপুর, বিকানার, হালবারা, যোধপুর, জয়সালমার, পাঠানকোট, শ্রীনগর, উত্তরলাই ও ফরিদকোট। ভারতীয় হামলার পরিকল্পনার কথা জানাতে পেরে পাকিস্তান বিমান বাহিনী আগেভাগে হামলা চালায়।

ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ যুদ্ধ শুরু করার তারিখ নির্ধারণ করেছিলেন ৪ ডিসেম্বর। এ তারিখ সেনা কমান্ডারদের জানিয়ে দেয়া হয়। পাকিস্তান নৌবাহিনী প্রধান ভাইস এডমিরাল মোজাফফর হাসানের কাছে যুদ্ধ শুরু করার ভারতীয় সংকেত ধরে পড়ে। ৪ লাকি সংখ্যা হিসাবে বিবেচিত হওয়ায় ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বরকে ডি-ডে হিসাবে বেছে নেয়া হয়। ডে-ডে’র বিষয়ে সমঝোতা হওয়ায় জেনারেল মানেকশ ভারতীয় বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল পি সি লাল, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল সরদারী এম নন্দ ও সেনা কমান্ডারদের তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন।

কিন্তু ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বিমানের গর্জন শুনে ভারতীয় সেনা কমান্ডারদের অনেকেরই ধারণা করেছিলেন যে, ডি-ডে’র সময় ও তারিখ এগিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানি হামলার জবাব দানের সিদ্ধান্ত নেন। সৈন্যদের লুটপাট ও ধর্ষণে লিপ্ত না হওয়ার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দেন। সৈন্যদের উদ্দেশ্যে রেডিও ঘোষণায় তিনি বলেন,‘When you see a Begum, keep your hands in your pockets and think of Sam. ‘কোনো মহিলাকে দেখতে পেলে হাত পকেটে গুজে রাখবে এবং স্যামের কথা স্মরণ রাখবে।

’ ৩০ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান ও চীফ অব জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল গুল হাসান খানের মধ্যে এক বৈঠকে ঘোষণা ছাড়া ভারতে বিমান হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ভারতে বিমান হামলা চালানোর পেছনে পাকিস্তানের কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল: (১) ভারতীয় সৈন্যদের পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশে বাধা দান। অসংখ্য নদীনালা ও খাল বিল থাকায় বাংলাদেশের গভীর অভ্যন্তরে সৈন্য চলাচল করা সহজতর ছিল না। সৈন্য, ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানের পক্ষে বিশাল বিশাল নদী পাড়ি দেয়া ছিল অত্যন্ত কঠিন। (২) অপ্রত্যাশিতভাবে অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালিয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীকে তাক লাগিয়ে দেয়া।

(৩) পশ্চিম রণাঙ্গনের আকাশে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় ভারতের এসব বিমান ঘাঁটিগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া। (৪) ভারতের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে বিমান শক্তিতে ভারতের সংখ্যাধিক্যের বিপরীতে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। ভারতীয় বিমান বাহিনীর কন্ট্রোল সেন্টারগুলোতে কাজের পালা পরিবর্তনকালে আকস্মিক হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশনের অভিজ্ঞতার আলোকে রাতের অন্ধকারে ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে প্রথমে দু’টি তরঙ্গে এবং পরে রাতব্যাপী আরো কয়েক দফা আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিমান হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় ভূগর্ভস্থ বাংকারে (পেন) ভারতীয়রা তাদের বিমান লুকিয়ে রাখবে বলে আন্দাজ করা হয়েছিল।

জ্বালানি ট্যাংকার, গোলাবারুদের মজুদ ও কমান্ড সেন্টারের মতো আচ্ছাদিত লক্ষ্যবস্তুগুলোতে নির্ভুল বোমাবর্ষণের জটিলতাও বিবেচনায় নেয়া হয়েছিল। ইয়াহিয়া খানের অফিসে কর্মরত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্টরা আগেই জানতে পেরেছিল যে, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারতে হামলা চালাবে। পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত বাঙালিরা স্বপক্ষত্যাগ করায় ভারতে হামলার পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায় বলে কেউ কেউ অনুমান করেছেন। এছাড়া ভারতীয় বিমানঘাঁটিগুলোর রানওয়ে অকেজো করে দেয়ার মতো গোলার ঘাটতিও ছিল। গোয়েন্দা তথ্য পেয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনী এ ধরনের একটি হামলা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত ছিল।

ভারতীয় বিমান বাহিনীতে রেড এলার্ট জারি করা হয় এবং পহেলা ও ২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় অগ্রবর্তী বিমানঘাঁটিগুলো থেকে জঙ্গিবিমান প্রত্যাহার করা হয়। ভারতীয়রা গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী ধারণা করেছিল যে, পহেলা ডিসেম্বর পাকিস্তানি বিমান হামলা হবে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদানীন্তন প্রধান রামেশ্বর নাথ কাউয়ের পীড়াপীড়িতে ৩ ডিসেম্বরও বিমান বাহিনীকে সতর্কাবস্থায় রাখা হয়। সেদিন ভারতীয় বিমান বাহিনী সতর্ক থাকায় পাকিস্তান বাহিনী তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার পাল্টা পদক্ষেপ যুদ্ধ শুরু হওয়ার মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা সফরে ছিলেন।

কংগ্রেসের কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগদানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আমন্ত্রণে তিনি এ মহানগরী সফরে ছিলেন। কলকাতায় প্রয়োজনীয় কাজকর্ম শেষে ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় তিনি একটি বিশেষ বিমানে রাজধানী নয়াদিল্লির উদ্দেশে রওনা হন। তাকে বহনকারী বিমানটি লক্ষ্ণৌর অদূরে পূর্ব আকাশে থাকা অবস্থায় দিল্লি থেকে পাঠানো একটি জরুরি বার্তার জবাব দেয়ার জন্য পাইলট প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা ডি পি ধরকে ককপিটে আসার জন্য অনুরোধ করেন। ডিপি ধর ৩/৪ মিনিট ককপিটে অবস্থান করেন এবং ফিরে এসে ইন্দিরাকে নয়াদিল্লি থেকে প্রেরিত বার্তা অবহিত করেন। ইন্দিরার সঙ্গে কথা শেষ করে তিনি পেছনে তার নিজের আসনে ফিরে আসেন এবং সামনের আসনে উপবিষ্টদের লক্ষ্য করে বলেন,‘The fool has done exactly what one had expected’ ‘সবাই যা প্রত্যাশা করছিল এই বোকা লোকটি (ইয়াহিয়া খান) ঠিক সে কাজটি করেছেন।

’ মিসেস গান্ধীর বিমান নয়াদিল্লীর পরিবর্তে লক্ষ্ণৌতে অবতরণ করে। ১০টায় বিমানটি পুনরায় আকাশে উড্ডয়ন করে। ১০টা ৫৫ মিনিটে ইন্দিরা গান্ধীকে বহনকারী বিমানটি দিল্লির পালাম বিমান বন্দরে অবতরণ করে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম ইন্দিরাকে বিমান বন্দরে অভ্যর্থনা জানান। মিসেস গান্ধী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং সরাসরি অপারেশন রুমে প্রবেশ করেন।

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ ইন্দিরা গান্ধীকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করার জন্য সেখানে ছুটে আসেন। তিনি পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধ শুরু করার জন্য তার অনুমতি প্রার্থনা করেন। তাকে তৎক্ষণাৎ অনুমতি দেয়া হয়। ইন্দিরা গান্ধী অপারেশন রুমে একটি টেবিলের উপর স্কচ হুইস্কির একটি বোতল এবং কয়েকটি গ্লাস দেখতে পান। মদের বোতল দেখতে পেয়ে তিনি ভ্রু কুঞ্চিত করেন এবং বিষয়টি তদন্ত করার জন্য মানেকশকে নির্দেশ দেন।

মানেকশ তাকে জানান যে, এ ব্রান্ডের নাম ‘ব্লাক ডগ’। এ মদ খেয়ে ইয়াহিয়া খান যুদ্ধ শুরু করেছেন এবং তিনি তাকে প্রচুর পরিমাণে এ মদ পান করাবেন এবং তাকে যুদ্ধে পরাজিত করবেন। মানেকশ তাকে বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ করেন। সাউথ ব্লকের পশ্চিম অংশে মন্ত্রিসভার একটি জরুরি বৈঠকে সভাপতিত্ব করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা সেখানে এগিয়ে যান। একইদিন রাতে জাতির উদ্দেশে রেডিও ভাষণে তিনি তার দেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিমান হামলাকে যুদ্ধ ঘোষণা হিসাবে আখ্যায়িত করেন।

রাতে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকে মিসেস গান্ধী যুদ্ধের কয়েকটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন। (১) বাংলাদেশকে দ্রুত মুক্ত করা (২) আজাদ কাশ্মীরের দক্ষিণাংশ ভারতের সঙ্গে একীভূত করা এবং (৩) পাকিস্তানের সামরিক শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়া যাতে ভবিষ্যতে দেশটি আর কখনো ভারতের প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিতে না পারে। যুদ্ধের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে প্রধানমন্ত্রী গান্ধী পশ্চিম পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য শিয়ালকোটের মধ্য দিয়ে রাওয়ালপিন্ডি পর্যন্ত এগিয়ে যেতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানদের নির্দেশ দেন। সিআইএ তৎক্ষণাৎ ভারতের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো ওয়াশিংটনকে অবহিত করে। ভারতীয় মন্ত্রিসভার অভ্যন্তরে সিআইএ’র সোর্স ছিল।

এ সোর্সই সিআইএ’র কাছে ভারতীয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ফাঁস করে দেয়। ভারতের পাল্টা বিমান হামলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার নির্দেশে ৩ ডিসেম্বর রাতে ভারতীয় বিমান বাহিনী প্রাথমিক জবাব দেয় এবং পরদিন ভোরে ব্যাপক প্রতিশোধমূলক বোমাবর্ষণ করে। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তান বিমান বাহিনীর স্থাপনাগুলোতে হামলা অব্যাহত রাখে। পরদিন ভোরে দু’টি দেশ তাদের মধ্যে ‘যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করার’ সত্যতা স্বীকার করে। তবে কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি।

তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ৩ ডিসেম্বর উভয় দেশের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ বেধে গেলে ভারতীয় বিমান বাহিনী পশ্চিম রণাঙ্গনে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোতে বোমাবর্ষণ এবং স্থলবাহিনীকে ছত্রছায়া প্রদান করলেও আকাশে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে পারেনি। পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তানের মাত্র এক স্কোয়াড্রন বিমান গোটা সেক্টরের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডকে পূর্ব পাকিস্তানের আকাশে আধিপত্য কায়েমের নির্দেশ দেয়া হয়। তারা সাফল্যের সঙ্গে তাদের উপর আরোপিত দায়িত্ব পালন করে।

৩ ডিসেম্বর রাতে ভারতের ক্যানবেরা বোমারু বিমানগুলো তেজগাঁও বিমান বন্দরে উপর্যুপরি আঘাত হানে। পাকিস্তানের ১৪তম স্কোয়াড্রনে স্যাবর জেট ছাড়া আর কোনো বিমান ছিল না। এসব বিমানের নৈশকালীন লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করার সামর্থ্য না থাকায় ভারতীয় বিমানগুলোকে পাকিস্তানি বিমানবিধ্বংসী কামান ছাড়া আর কোনো বাধার মুখোমুখি হতে হয়নি। ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৭ নম্বর, ১৪ নম্বর, ১৭ নম্বর ও ৩৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের হান্টার, ২২১ নম্বর স্কোয়াড্রনের এসইউ-৭ এবং ২৮ নম্বর স্কোয়াড্রনের মিগ-২১-কে তেজগাঁয়ে বোমাবর্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়। ১৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের হান্টার পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম দিনের বেলায় আক্রমণ চালায়।

২৮ নম্বর স্কোয়াড্রনের চারটি মিগ-২১ এসব বিমানকে ছত্রছায়া দেয়। একটি স্যাবর বোমাবর্ষণের আগে হান্টারকে ধাওয়া করার চেষ্টা করে। এসময় হান্টারের গুলিতে পাকিস্তানি স্যাবর জেট ভূপাতিত হয়। ভারতের ১৪ নম্বর স্কোয়াড্রন কুর্মিটোলায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ঘাঁটিতে আঘাত হানে। হ্যাঙ্গার ও বিমান স্থাপনা লক্ষ্য করে ভারতীয় বিমানগুলো রকেট নিক্ষেপ করে।

বিকেলের মধ্যে ভারতীয় হান্টার নারায়ণগঞ্জে জ্বালানি ডিপোতে আঘাত হানে। ৪ ডিসেম্বর ভোরে ১৪ নম্বর স্কোয়াড্রনের হান্টারগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে বোমাবর্ষণ করে। একইদিন বিকেলে তেজগাঁয়ে ২৮ নম্বর স্কোয়াড্রনের মিগের বোমাবর্ষণে একটি টুইন অটার বিধ্বস্ত হয়। ভারতীয় জঙ্গিবিমানকে ধাওয়া করতে ঢাকায় ডগফাইটে তিনটি স্যাবর জেট খোয়া যায়। দু’টি খোয়া যায় কুর্মিটোলায় হান্টারের আঘাতে।

উইং কমান্ডার এসএম আহমেদ চারটি ভারতীয় হান্টারকে ধাওয়া করতে একটি স্যাবর জেট নিয়ে আকাশে উড্ডয়ন করেন। হান্টারের সঙ্গে আরো কয়েকটি মিগ ও এসইউ-৭ যোগ দেয়। হান্টারের গুলিতে এফ-৮৬ স্যাবর ভূপাতিত হলে এসএম আহমেদ কুর্মিটোলার ৫ মাইল অদূরে অবতরণ করেন। রশিদী একটি বিমান নিয়ে কয়েকটি ভারতীয় বিমানের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হন। তার একটুখানি দূরে স্কোয়াড্রন লীডার আফজাল ও ফ্লাইট লে. সাঈদ দু’টি এফ-৮৬ নিয়ে ৩টি হান্টারের সঙ্গে ডগফাইটে লিপ্ত হন।

আফজাল ও সাঈদের বিরুদ্ধে আরেকটি হান্টার এগিয়ে আসে। এ হান্টারের গুলিতে আফজাল ভূপাতিত হন। কয়েক মিনিট পর আফজাল একটি মিগ-২১ ভূপাতিত করেন। ফ্লাইট লে. সাঈদ নিরাপদে অবতরণে সক্ষম হন। উদ্ধারকারী দল এসএম আহমদ ও সাঈদকে খুঁজে না পাওয়ায় যুদ্ধের সময় তাদের ‘নিখোঁজ’ হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়।

পরে খবর পাওয়া যায় যে, স্থানীয় জনতার হাতে এ দু’জন পাইলট নিহত হয়েছেন। ৪ ডিসেম্বর বিকেলে নারায়ণগঞ্জে ভারতের ১৪ নম্বর স্কোয়াড্রনের হান্টারের সঙ্গে লড়াইয়ে একটি স্যাবর জেট ভূপাতিত হলে ফ্লাইট অফিসার সাজিদ নূর প্যারাশূটের সাহায্যে জিনজিরায় অবতরণ করেন। পরে তাকে উদ্ধার করা হয়। এসব মিশনে ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের ৬ টি হান্টার ও একটি এসইউ-৭ বিধ্বস্ত হয়। লালমনিরহাটে গোলাবারুদ বোঝাই একটি ট্রেনে বোমাবর্ষণ করতে গিয়ে ফ্লাইট লে. এ আর ডি কোস্টা নিহত এবং দু’টি হান্টার ঘায়েল হয়।

বিমানবিধ্বংসী কামানের গোলাবর্ষণে এ দু’টি ভারতীয় বিমান ঘায়েল হয় এবং ভারতীয় ভূখণ্ডে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত একটি বিমানের পাইলট স্কোয়াড্রন লীডার এস কে গুপ্ত নিরাপদে বাগডোগরায় অবতরণ করেন। একইদিন বিমানবিধ্বংসী কামানের গোলায় ১৪ নম্বর স্কোয়াড্রন আরো দু’টি হান্টার হারায়। তবে দু’জন পাইলট স্কোয়াড্রন লীডার কে ডি মেহরা ও ফ্লাইট লে. কে সি ত্রিমেনহিয়ার নিরাপদে বিমান থেকে বেরিয়ে আসেন। ত্রিমেনহিয়ারকে যুদ্ধবন্দি করা হয়।

তবে কে ডি মেহরা আটক হওয়া থেকে রক্ষা পান এবং ভারতীয় ভূখণ্ডে ফিরে যান। ৩৭ নম্বর স্কোয়াড্রনকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়। এ স্কোয়াড্রনের দু’জন পাইলট নিহত হন। তারা হলেন স্কোয়াড্রন লীডার এস বি সামন্ত ও ফ্লাইট অফিসার এস জি খোন্দে। ২২১ নম্বর স্কোয়াড্রনের একটি এসইউ-৭ গুলিতে ভূপাতিত হলে পাইলট স্কোয়াড্রন লীডার ভি ভুটানিকে যুদ্ধবন্দি করা হয়।

৪ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান বাহিনীর ক্যানবেরা বিমানগুলো চট্টগ্রাম বিমান বন্দর, জ্বালানি ট্যাংকার ও তেল শোধনাগারে হামলা চালায়। সেদিন পাকিস্তান বিমান বাহিনী মোট ২৪ বার উড্ডয়ন করে এবং ভারতীয় বিমানকে লক্ষ্য করে ৩০ হাজার রাউন্ড গোলা নিক্ষেপ করে। অন্যদিকে ভূমি থেকে আকাশে ভারতীয় বিমান লক্ষ্য করে ৭০ হাজার রাউন্ড গোলাবর্ষণ করা হয়। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ইতিহাসে একদিনে আর কখনো এত গোলাবর্ষণ করা হয়নি। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে, তারা ভারতীয় বিমান বাহিনীর ১০ থেকে ১২টি বিমান ধ্বংস করে এবং যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনায় গোলাগুলি সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

যুদ্ধের শেষদিন নাগাদ পাকিস্তান বিমান বাহিনী কার্যক্ষম ছিল। ৪ ও ৫ ডিসেম্বর ঢাকাবাসী অতি নিচুতে বিমানের রোমাঞ্চকর ডগফাইট প্রত্যক্ষ করে। ভারতীয় বিমান বাহিনী বিমান ঘাঁটিতে মোতায়েন পাকিস্তানি বিমানে হামলা চালানোর প্রতি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে। তবে চরম মূল্য দিয়েও তারা পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাকিস্তান বিমান বাহিনীর উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধনে ব্যর্থ হয়। ভারতীয় বিমান বাহিনী স্থলবাহিনীকে ছত্রছায়া প্রদানে ব্যস্ত হয়ে পড়লে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর উপর চাপ হ্রাস পায়।

এ ফাঁকে পাক বিমান বাহিনী কুমিল্লা ও আরো কয়েকটি জায়গায় স্থল অভিযানে সহায়তা দানে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়। দু’দিনে স্যাবর জেট মোট ২০ দফা উড্ডয়ন করে এবং ৫ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান বাহিনীর মোকাবিলায় এক হাজার দুই শো রাউন্ড গোলাবর্ষণ করে। ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা নাগাদ ভারতীয় বিমান বাহিনী কৌশল পরিবর্তনের কথা উপলদ্ধি করে। পাক বিমানবিধ্বংসী রেজিমেন্ট ৫ ও ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা নাগাদ ভারতীয় বিমান হামলা থেকে নিজেদের বিমানঘাঁটি রক্ষা করতে সফল হয়। ৬ ডিসেম্বর ২৮ নম্বর স্কোয়াড্রনের চারটি মিগ-২১ গৌহাটি থেকে উড়ে এসে তেজগাঁও বিমান বন্দরের রানওয়েতে এক হাজার পাউন্ড ওজনের কয়েকটি বোমা নিক্ষেপ করে।

বোমাবর্ষণ করায় বিমান বন্দর অপারেশনের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ভারতীয় বিমান হামলার সময় তেজগাঁও বিমান বন্দরে পাকিস্তানি বিমান বাহিনী বাধা দেয়ার সময় পায়নি। স্থলবাহিনীকে সহায়তা দিয়ে একটি পাকিস্তানি জেট বিমান অবতরণ করা মাত্র ভারতীয় বিমান হামলা শুরু হয়। ১০ মিটার গভীর ও ২০ মিটার প্রশস্ত দু’টি গর্ত হয়। একটি গর্ত থেকে আরেকটি গর্তের দূরত্ব ছিল এক হাজার ২ শো মিটার।

তবে কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটি ৭ ডিসেম্বর সকাল নাগাদ কার্যক্ষম ছিল। সেদিন সকালে ভারতের ২৮ নম্বর স্কোয়াড্রনের মিগ-২১ আবার কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে আঘাত হানে। ৬ ডিসেম্বর ভারতের ৭ নম্বর স্কোয়াড্রনকে পশ্চিম রণাঙ্গনে সেনাবাহিনীকে সহায়তাদানে পূর্ব রণাঙ্গন থেকে প্রত্যাহার করা হয়। ১৪ ও ২৮ নম্বর স্কোয়াড্রনের মিগ-২১ এবং হান্টারগুলো বিরতি না দিয়ে আঘাত হানতে থাকায় কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটির রানওয়েতে বড় বড় গর্ত হয়। ৭ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান হামলায় পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তান বিমান বাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

ভারতীয় বিমান বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত পরিত্যক্ত কুমিল্লা, লালমনিরহাট ও শমসেরনগর বিমানবন্দরে আঘাত হানে। যশোর বিমানঘাঁটিতে মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়। মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এ বিমান বন্দর রক্ষা পায়। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ রানওয়েগুলো মেরামতে উপর্যুপরি প্রচেষ্টা চালায়। বেসামরিক শ্রমিকদের সহায়তায় বিমান বাহিনী ও সেনাবাহিনীর প্রকৌশলীগণ ৬ ও ৭ ডিসেম্বর বিরামহীনভাবে কাজ করে।

তেজগাঁও বিমান বন্দরকে পুরোপুরি কার্যক্ষম করে তুলতে ৮ ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু মেরামত কাজ শেষ হতে না হতেই ৭ ডিসেম্বর বিকেল ৪ টা ৫০ মিনিটে আবার ভারতীয় বিমান হামলা হয়। তখন হিসাব করা হয় যে, রানওয়ে মেরামতের জন্য আরো ৩৬ ঘন্টার প্রয়োজন। ভারতীয় বিমান বাহিনী তেজগাঁও বিমান বন্দর পুনরায় মেরামতের মতো সুযোগ না দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। প্রতিপক্ষের বিমান হামলা অব্যাহত থাকায় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সেকেন্ড ক্যাপিটালের রাজপথকে রানওয়ে হিসাবে ব্যবহার করার চিন্তা করতে থাকে।

তবে টেকনিক্যাল সমস্যা থাকায় এ সম্ভাবনা বাতিল করে দেয়ায় পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তান বিমান বাহিনী চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। রানওয়ে মেরামতের জন্য নিরবচ্ছিন্ন ৩৬ ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন অনুভূত হওয়ায় এবং ভারতীয় বিমান হামলা প্রতিরোধে বিমানবিধ্বংসী ইউনিটগুলোর অক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে উঠায় ৮ ও ৯ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পাইলটদের বার্মার মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয়। ৮ ডিসেম্বর চাঁদপুরে মোতায়েন পাকিস্তানের ৩৯তম এডহক ডিভিশন নদীপথে পিছু হটার অনুরোধ জানায়। এসব সৈন্য ঢাকা প্রত্যাহারে কয়েকটি লঞ্চের সমন্বয়ে একটি বহর গঠন করা হয়। একটি গানবোটের প্রহরায় ১০ ডিসেম্বর ভোরে এ বহর যাত্রা করে।

ভারতীয় বিমান বাহিনী বহরটি শনাক্ত করতে সক্ষম হয় এবং বোমাবর্ষণ করে। বোমাবর্ষণে নিমজ্জ্বিত কিংবা আটকা পড়ায় লঞ্চগুলো ঢাকা পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। নৈশকালে নৌযান দিয়ে তল্লাশি চালিয়ে এবং হেলিকপ্টারে করে তাদের উদ্ধার করা হয়। ১১ ডিসেম্বর ৪৪ নম্বর স্কোয়াড্রনের তিনটি এএন-১২এস জয়দেবপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে বোমাবর্ষণ করে। ১৪ ডিসেম্বর সকালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা পূর্ব পাকিস্তান প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের বার্তা ধরে ফেলে।

এ বার্তা ধরা পড়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে ঢাকায় হামলা চালানো হয়। নগরীর পর্যটন গাইডের মানচিত্র সঙ্গে নিয়ে ২৮ নম্বর স্কোয়াড্রনের চারটি মিগ-২১ আকাশে উড্ডয়ন করে। বৈঠক শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে বিমানের কানফাটা গর্জন ধ্বনিত হয়। মিগ থেকে গভর্নর হাউস লক্ষ্য করে প্রথমে ৫৭ মিলিমিটার রকেট নিক্ষেপ করা হয়। বোমাবর্র্ষণ করে গভর্নর হাউসের মূল হলরুমের ছাদ ফুটো করে ফেলা হয়।

ভবনটি একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়। ভারতীয় বিমান হামলায় আতংকিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এম এ মালিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে প্রেরিত এক বার্তায় পদত্যাগের ঘোষণা দেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে ঢাকায় রেডক্রস সেন্টারে আশ্রয় নেন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসাবে এমএ মালিক জেনারেল টিক্কা খানের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘাঁটিগুলোতে সৈন্য ও গোলাবারুদ বহনে রাতের অন্ধকারে পাকিস্তান বিমান বাহিনী হেলিকপ্টার ব্যবহার অব্যাহত রাখে। পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের আত্মসমর্পণের প্রাক্কালে লে. কর্নেল লিয়াকত বুখারীর নেতৃত্বে আর্মি এভিয়েশন স্কোয়াড্রন ৩৯তম এডহক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রহিম খানের মতো বাছাইকৃত অফিসারদের নিয়ে বার্মার মধ্য দিয়ে পালিয়ে যায়।

তেজগাঁও বিমান বন্দর লক্ষ্য করে নিক্ষিপ্ত ৭৫০ পাউন্ড ওজনের তিনটি বোমা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে রহমত-ই-আলম ইসলামী মিশন নামে একটি এতিমখানায় পতিত হলে ৩ শো শিশু নিহত হয়। এ এতিমখানায় ৪ শো শিশু ঘুমন্ত ছিল। একইভাবে নারায়ণগঞ্জে একটি পাটকলের কাছে বস্তিতে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে দু’টি বোমা পতিত হলে ২৭৫ জন লোক নিহত হয়। রহমত-ই-আলম ইসলামী মিশনে বোমাবর্ষণ করেছিল পিস্টল ইঞ্জিন চালিত একটি জঙ্গিবিমান। স্থানীয় ও বিদেশী পর্যবেক্ষকরা দাবি করছিলেন যে, বিমানটি পাকিস্তানি।

পরে জানা যায় যে, পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে পিস্টন ইঞ্জিন চালিত কোনো বিমান ছিল না। বিমানটি ছিল মিত্রবাহিনীর। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে, ৪ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের ২২ থেকে ২৪ টি বিমান খোয়া যায়। ৭ টি বিমান বিধ্বস্ত হয় পাকিস্তানি বিমানের সঙ্গে সংঘর্ষে এবং বাদবাকিগুলো বিমানবিধ্বংসী কামানের গোলায়। তবে ভারতীয় বিমান বাহিনীর হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানে ১৯ টি বিমান খোয়া যাবার সত্যতা স্বীকার করা হয়।

আইএএফ’র দেয়া তথ্য অনুযায়ী তাদের তিনটি বিমান প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিমান যুদ্ধে, দুর্ঘটনাক্রমে ৬ টি এবং অবশিষ্টগুলো বিমানবিধ্বংসী কামানের গোলায় বিধ্বস্ত হয়। ভারতীয় বিমানের গুলিতে ৫টি স্যাবর জেট ভূপাতিত হয়। ঢাকা মুক্ত হওয়ার পর মিত্রবাহিনী তেজগাঁও বিমানবন্দরে ১৩টি বিমানের কাঠামো উদ্ধার করে। দু’টি টি-৩৩ ট্রেইনার ছিল ব্যবহারের অনুপযোগী। ৮টি স্যাবর জেট সচল করা হয়।

১৯৭২ সালে ৫ টি স্যাবর জেট বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাকিস্তানি হাইকমান্ড বিমানগুলো উড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ জারি করেছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে পিএএফ’র প্রধান এয়ার কমোডর ইনাম এ নির্দেশ পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করে বলেন, বিমানগুলোর প্রজ্জ্বলিত হওয়ার দৃশ্য ঢাকার প্রতিরক্ষায় মোতায়েন সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে দেবে। তার যুক্তি মেনে নেয়া হলে ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সদস্যরা গোলাবারুদের মজুদ ধ্বংস করে এবং বিমানগুলোর ইলেক্ট্রিক ও হাইড্রোলিক সিস্টেম অকেজো করে দেয়। পাকিস্তান বিমান বাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে ভারতীয় বিমান বাহিনী বিনা বাধায় মোট ৪ হাজার বার পাকিস্তানি অবস্থানে হানা দেয়।

পাকিস্তানি বিমান হামলা ব্যর্থ হওয়ার কারণ পাকিস্তান ‘প্রিঅ্যাম্পটিভ’ বা হুঁশিয়ারি ছাড়া বিমান হামলা চালালেও তাদের হামলা চরমভাবে ব্যর্থ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.