১।
আমার জন্ম খুব সাধারণ পরিবারে। কঠোর ইসলামিক ধ্যানধারণা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সম্পর্কে তীব্র সচেতনতা এর কোনটাই আমার পরিবারে ছিল না। স্বাধীনতার ইতিহাসের প্রথম হাতেখড়ি হয় বাবার কাছ থেকে আর বাকিটা বই পড়ে কিংবা সিনেমা দেখে। তবে বিএনপি আর আওয়ামী লীগ দুই সরকারের সময়েই স্কুলে পড়ার কারণে স্কুলের বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের দুই রকম ইতিহাস পড়ার দুর্ভাগ্য হয়েছে।
এটা দু:খজনক একটা ব্যাপার তবে বড় একটা অংশ বাদ দেয়া ছাড়া বিএনপির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ভয়ংকর কোন ম্যানিপুলেশন ছিল না। যেমন, রাজাকার নামটা বাদ ছিলো, বলা হতো এদেশীয় দোসর তবে রাজাকাররা দেশ রক্ষার চেষ্টা করছিল এমন কিছু দেখেছি বলে মনে পড়ে না। অন্তত দশ এগারো বছরের কিশোর হিসেবে ওই বইগুলো থেকে এতটুকু বুঝতাম যে মুক্তিযুদ্ধ আসলে বিশাল একটা ব্যাপার।
আওয়ামী লীগ আসার পর স্কুলের পাঠ্যবইয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, জিয়াউর রহমানের ২৬ এর বদলে ২৭ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা, জামাত ই ইসলামীর বিরোধিতা এই ব্যাপারগুলো যোগ করা হলেও সেগুলো নতুন কিছু ছিল না। আমার ধারণা ছিল এগুলো তো পরিবার থেকেই জানার কথা, বাবা-মা কিছু না বললে মুক্তিযুদ্ধের ওপর বই আছে, তাও না পড়লে গল্পের বইতেই তো ইতিহাসের এই ব্যাপারগুলো পাওয়া যায়।
এর বাইরেও যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অন্য একটা ভাসর্ন থাকতে পারে সে ব্যাপারে আমার কোন ধারণাই ছিলো না।
এই অন্য ভাসর্নের সাথে পরিচিত হই আরেকটু বড় হওয়ার পর। আমাদের গ্রামের এক আত্মীয় একাত্তরকে বলতেন গন্ডগোলের বছর। প্রথম শুনে বুঝতে পারিনি গন্ডগোলের বছর মানে কোনটা। পরে অন্যরা বললো উনি একাত্তরকে গন্ডগোলের বছর বলেন।
কারণ? ওনার বাবা শান্তি কমিটির মেম্বার ছিল (সম্ভবত রাজাকার শব্দটার একটা ইউফেমিজ্ম হিসেবে শান্তি কমিটির মেম্বার বলা হতো। নিজের একজন আত্মীয়কে রাজাকার বলাটা আসলেই খুব কষ্টকর)। এই ব্যাপারটা শোনার পর আমার খুবই খারাপ লাগছিলো। একটা মানুষের কাছে তার বাবা পৃথিবীর সমান বিশাল। যেকোন সন্তানের কাছে বাবা পারে না এমন কোন কাজ নেই।
বাবা আমাদের গর্বের স্থান, আমার ভরসা, শ্রদ্ধা, আদর্শ সবকিছু। হঠাৎ একদিন কেউ যদি আবিষ্কার করে তিনি বাবা হিসেবে যাকে চিনে আসছেন তিনি আসলে একজন খুনী এবং ধষর্ণকারী, আমার মনে হয়না কোন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সেই মুহূর্তে মানসিক সুস্থতা ধরে রাখা সম্ভব। মানসিক সুস্থতা ধরে রাখার জন্য এর বিরুদ্ধে একমাত্র ডিফেন্স মেকানিজম হতে পারে পুরো ব্যাপারটা অস্বীকার করা। যেমন, সাইকো সিনেমার নরম্যান বেট্স এর কথাই ধরা যাক। মা এবং তার প্রেমিককে হত্যা করার পর এই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হত্যার পুরো বিষয়টা তার স্মৃতি থেকে মুছে ফেলে।
আমার ওই আত্মীয়’র বাবার ব্যাপারটা জানার পর থেকে তাকে এড়িয়ে চলতাম। আর কথা হলেও কখনও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তুলতাম না। আমার মনে হতো কি দরকার লজ্জা দিয়ে। এমনিতেই হয়তো উনি ব্যাপারটা নিয়ে অপরাধবোধ ভোগেন, সেখানে আমি খোচাখুচি করলে কষ্ট হয়তো আরো বেশী পাবেন। উনি বলতেন আরে মুক্তিযুদ্ধে তো ৩০ হাজার মানুষ মরছে, শেখ মুজিব ভুল কইরা ৩০ লাখ বলছে।
তারপর বলতেন, রাজাকাররা আসলে চেষ্টা করতো সাধারণ মানুষগো পাকবাহিনীর কাছ থিকা রক্ষা করতে, ওরা মানুষ মারতো এইটা ভুল কথা। আমি চুপ করে শুনতাম, ওনার বাবা কি করেছেন সেটা মোটামুটি পরিবারের সবাই জানতো। আমার মনে হতো উনি এসব বলে ভালো থাকার চেষ্টা করছেন, পারিবারিক মন্ডলের বাইরে কখনো এসব শুনি নি বলে আমার ধারণা ছিল এসব ওনার একান্ত নিজস্ব মনগড়া ইতিহাস। মানসিক সুস্থতা ধরে রাখার সামান্য প্রচেষ্টা।
২।
আমার আত্মীয় সেই রাজাকারপুত্রের কাছে শোনা ইতিহাসের এই ভার্সনটা আমি আবার শুনতে পাই ২০০৬ এ, যখন আমি সামহোয়ারইনব্লগ পড়া শুরু করি। এই ভিন্ন ভার্সনের আইডিয়াটা দেয়া হতো খুব সুক্ষভাবে। ইনসেপশন সিনেমাটার কথাই ধরি। ওখানে ডমিনিক কবকে এ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয় রবার্ট ফিশার এর অবচেতন মনে এমন একটা আইডিয়া ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য যাতে ফিশার তার বাবার মৃত্যুর পর বিজনেস এম্পায়ারটা ভাগ করে ফেলে। সামহোয়ারের পোস্টগুলোতেও এমন একটা হিডেন এজেন্ডা থাকতো।
যেমন, মার্চ কিংবা ডিসেম্বর মাসের আগে পরে দু’একজন হঠাৎ করে পোস্ট দিতো- মুক্তিযুদ্ধে কি আসলেই ৩০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছেন? এ ধরনের পোস্ট যারা দিতো ওদের অন্য পোস্টগুলো সাধারণত থাকতো ডিরেক্ট কপি পেস্ট। উদাহরণ হিসেবে এই ব্লগটা দেখতে পারেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধে যে আসলেই ৩০ লক্ষ মানুষ মারা যায়নি এটা নিয়ে আসতো আরেকটা পোস্ট। সেই পোস্টের সোর্স হিসেবে অবধারিতভাবে আনা হতো শমির্লা বসুর লেখা একটা বই আর ফিরোজ মাহবুব কামালের ব্লগ। মজার ব্যাপার ছিলো এই রিপিটিটিভ পোস্ট করার ব্যাপারটা প্রতি বছরই হতো নতুন নতুন নিকে।
ওই কয়েক বছর যারা ব্লগ অনুসরণ করেন নি আপনারা ধারণা করতে পারবেন না ব্যাপারটা কতটা ওয়েল অর্গানাইজ্ড ছিল। এই পোস্ট আর এটা দেখতে পারেন। এই লিংকে এধরনের অসংখ্য পোস্টের তালিকা পাবেন। পড়ে থাকলে দেখবেন বেশীরভাগ পোস্টের মূল বক্তব্য একই। ৩০ লক্ষ মানুষ মারা যায়নি, গোলাম আযম ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ, রাজাকাররা কি আসলেই খারাপ, মুক্তিযোদ্ধারা কি আসলেই ভালো, বুদ্ধিজীবীদের আসলে ইন্ডিয়ানরাই হত্যা করেছে, এ ধরনের ব্যাপার নিয়ে পোস্টের পর পোস্ট আসতো।
শুধু তাই না ওই সময়টাতে উইকিপিডিয়াতে কিছু সময় দেয়ায় বুঝতে পারি উইকিতে রাজাকার, জামাত ই ইসলাম, গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী এই ধরনের পেজগুলোতে খুব সুক্ষভাবে ১৯৭১ এ তাদের ভূমিকাগুলো বাদ দেয়া হচ্ছে।
যোসেফ গোয়েবল্স একবার ব্রিটিশদের সম্পর্কে বলেছিলেন যে, ওরা যখন মিথ্যা বলে তখন অনেক বড় মিথ্যা বলে এবং সেটা থেকে নড়চড় করে না, যতটা হাস্যকরই লাগুক না কেন। ব্লগের প্রচারণাটাও এই মতবাদের উপর ভিত্তি করে তৈরী ছিল। প্রথমবার যখন বলবে, “রাজাকাররা কোন মানুষ খুন করে নাই” আপনি বলবেন শালা ছাগু। দ্বিতীয়বার যখন বলবে “রাজাকাররা কোন মানুষ খুন করে নাই”, আপনি বলবেন, ছাগু আবার আসছোস।
তৃতীয়বার যখন বলবে, “রাজাকাররা কোন মানুষ খুন করে নাই” আপনি এবার দেখেও না দেখার ভান করবেন। কারণ ব্লগিং করার জন্য আপনাকে কেউ টাকা দেয় না। দেশ বাঁচানো কিংবা সমাজ রক্ষা করাও আপনার ব্লগিং এর উদ্দেশ্য না। এই কারণে একটা রাজাকার ছাগু কি করলো তাতে আপনার কিছু যায় আসে না। কিন্তু এখানে সমস্যা হলো আপনি যার পোস্ট দেখে কোন প্রতিবাদ না করেই চলে যাচ্ছেন, সে ওই পোস্ট্ লেখার জন্য টাকা পাচ্ছে।
ব্লগিং এ টাকা পয়সার এই ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য ছিল না আমার জন্য। তবে এটা যে কতটা সত্যি আর ভয়ংকর সেটা দেখতে পাই উইকিপিডিয়াতে।
উইকিপিডিয়ায় এমন কিছু একাউন্ট (অনেকসময় নির্দিষ্ট কিছু আইপি) ছিল যেগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, রাজাকার, আল-বদর, গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, দেলোয়ার হোসেন সাঈদীসহ অন্যান্য রাজাকার, ছাত্রশিবির, জামাত ই ইসলামী, বুদ্ধিজীবী হত্যা এই পেজগুলো ছাড়া আর কোন পেজে কোন এডিট করতো না। তাদের একমাত্র ফোকাস ছিল একাত্তরে জামাতের নৃশংস ভূমিকার অংশগুলো এসব পেজ থেকে খুব সুক্ষভাবে বাদ দেয়া। যেমন আপনি যদি গত পরশুর উইকিতে কাদের মোল্লার পেজটা দেখেন তাহলে খেয়াল করবেন কাদের মোল্লা ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিপ্লোমা এবং মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে (?) এমন একটা তথ্য দেয়া ছিল, এবং এই তথ্যের উৎস হচ্ছে www.freejamatleaders.com (???) ।
অর্থাৎ তারা নিজেরাই নানারকম পেজ তৈরী করে সেটাকে উইকির রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করছে (আজকে দেখলাম কাদের মোল্লার ওই পেজ ইতিমধ্যে ঠিক করা হয়েছে)। উইকির এডিটর, এ্যাডমিন সবাই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। এই জামাতী পেইড এডিটরদের প্রতি নজর রাখাটা এই অল্পকিছু স্বেচ্ছাসেবকদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এই কারণে উইকিতে মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট অসংখ্য পেজ থেকে জামাত ই ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের ভূমিকা সুকৌশলে বাদ দেয়া হচ্ছে। উইকির অল্প কিছু স্বেচ্ছাসেবকদের বিপরীতে রয়েছে জামাত আর শিবিরের লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে তৈরী করা আইটি টিম, যাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে ইন্টারনেটে সুচতুরভাবে জামাতের পক্ষে প্রপাগান্ডা চালানো।
আপনি যেকোন ব্লগে যান, ফেসবুকে যান আপনি একজন জামাত-এ্যাপোলজিস্ট খুজে পাবেন। সে আপনাকে রেফারেন্স দেবে শর্মিলা বসুর বই, ফিরোজ মাহবুব কামালের ব্লগ, কিংবা দৈনিক নয়াদিগন্ত থেকে।
সামহোয়ারইনব্লগে প্রো-জামাতী সবাই পেইড ব্লগার ছিল না। আরেক গ্রুপ ব্লগার ছিল যাদের ওই পেইড ব্লগারগ্রুপ খুব মান্য করে চলতো। এরা ফুল ঘাস লতাপাতা নিয়েই বেশীরভাগ সময় পোস্ট দিতো।
তবে অতি অতি সুক্ষভাবে তাদের পোস্টে কিছু হিন্ট দেয়া হতো। উদাহরণ হিসেবে দেখানো যায় এই পোস্ট এর প্রথম প্যারাটা :
যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়। আপনি কি বাংলাদেশকে চিনেন? উত্তর সাধারণ কিন্তু যদি একটি বিশেষ দলকে প্রশ্ন করা যায়ঃ সম্ভাবনাময় একটি দেশ কিন্তু তালেবান, র্ধমান্ধ, মৌলবাদী তথা জামাত শিবিরের ওরফে রাজাকারদের (কোন প্রমান এবং যুক্তি ছাড়া) নিধন করা ছাড়া কোন উন্নতি হবেনা। তাদের কে আমি তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা প্রেমিক বলি।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।