আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কমপক্ষে এবার তো না বলি...

একটি গল্প দিয়ে শুরু করি...
বছর পনের আগের কথা। তখনও অনেক ছোট আমি, ক্লাস সেভেন কি এইট এ পড়ি। সেই সময়ে প্রতিদিন গভীর আগ্রহে সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতাম, কখন আব্বা অফিস শেষে বাসায় ফিরবে। প্রতি রাতে খাবার পরে আব্বা আমাদের তিন ভাই বোন কে নিয়ে গোল হয়ে বসতেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতেন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ,কখনো বা নিছক রুপকথা,গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে নানান রকম দুষ্টুমি ও করতেন, আবার মাঝে মাঝে নিজ থেকেই যুদ্ধের দিনগুলোর গল্প বলতে থাকতেন...সেই সময় আমার ছোট ভাই আবিরের বয়স হবে বছর তিনেক/চারেক।
আব্বার গল্প শুনে তেমন কিছু ওর বুঝার কথা না, তবুও যেন খুব বুঝতে পারছে সব কিছু এমন ভাব নিয়ে চোখ বড় বড় করে সব গল্প শুনত আর মাঝে মাঝে বিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে থাকতো... আমরা তখন খুব মজা পেতাম ওর মাথা নাড়া দেখে।

ওর ভাব দেখে মনে হত ও যেন গল্প গুলো নিজের মত করে অনুভব করছে।
একদিনের ঘটনা থেকে বুঝতে পারলাম আবির শুধু যে মাথা নাড়ে তা নয়, ও অনেক কিছু ওর মতন করে বুঝতেও পারে। আবির সাধারনত মুখ ফুটে ওর পছন্দের কথা কখনো তেমন বলতনা, অন্য বাচ্চাদের মত কিছু চাইতো না বা কিছু নেবার জন্য জেদ করতো না। এমন সময়ে একদিন পাশের বাসার এক ওর বয়সি বাচ্চার হাতে একটি বল দেখে আমাকে এসে প্রথম বলল বলটা ওর ভালো লেগেছে... কিন্তু একবারও বলল না যে বলটা সে নিতে চাই... তো আমি ভাবলাম পণ্ডিত সাহেব যখন মুখ ফুটে বলেছে বলটা ওর পছন্দ, তখন ওকে তো বলটা দিতেই হবে। একদিন স্কুল শেষে ওকে নিয়ে দোকানে গেলাম।

বল হাতে পেয়ে দেখি আমার ভাইটার মুখ খুশিতে ঝলমল করছে, যখন দাম দিতে যাবো, হঠাৎ ও দোকানদারকে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করে বসে, বলটা পাকিস্তানের কিনা। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম ওর প্রশ্ন শুনে।
কেবল ভাবছিলাম জানতে চাইব কেন সে এমন প্রশ্ন করল তার আগেই দোকানদার সাহেব মনের আনন্দে বলে উঠে-”নাও বাবু নাও, এটা পাকিস্তানের বল, খুব ভালো বল”। শোনা মাত্র আমার ভাই বল ফেরত দেয়, সে পাকিস্তানের কোন জিনিষ নেবেনা, সত্যি সত্যি সে কোনভাবেই বলটা নেইনি আর, যদিও আসলে বলটা ছিল চীনের। পরে দেখি গায়ে লেখা, মেড ইন চায়না ,অনেক বলেছিলাম ওকে...বিশ্বাস করতে পারেনি।

বিশ্বাস একবার উঠে গেলে মনে হয় আর ফেরত আসেনা। সেদিন আমি খুব অবাক হয়েছিলাম ওর কাণ্ডে, খুশিও। আব্বার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর গল্প শুনে শুনেই আবির নিজের মত করে বুঝে নিয়েছিল পাকিস্তানের কোন জিনিষ আমরা ব্যবহার করতে পারিনা।
সেই বলের ঘটনার পর থেকে ওকে নিয়ে হয়েছিলো মহা মুশকিল, নিজে তো তখনও পড়তে পারেনা তাই যেখানে যায়, যা খায়, বা যা কিছু কিনে সব জায়গায় একই প্রশ্ন করে, এটা কি পাকিস্তানের তৈরি? আর আমাদের বুদ্ধিমান দোকানদার ভাইদের কল্যাণে আবির বেচারার আর তেমন কিছুই নেওয়া হয়না বা খাওয়া হয়না। সে সময় বাজারে আসল পাকিস্তানের তৈরি সেজান জুস, সব বাচ্চারা সেজান জুস খাই, টি ভি তে ধুমায়ে অ্যাড দেয় আর আমার ভাই খালি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে... বুঝতে পারি ওর খেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ইচ্ছেটাকে কখনই পাত্তা দেইনি সে...আজ পর্যন্ত না।


আমাদের পরিবারের কেউ কখনও পাকিস্তানের তৈরি কোন পণ্য কিনেনি, কিনেনা আর জানি কিনবেও না। আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও যুদ্ধকালীন সময়ে নানাভাবে উনাদের সাহায্য করেছেন। ছোট থেকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের এত গল্প শুনে মানুষ হয়েছি আমরা মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে ধারন করতে শিখেছি। কিন্তু আবিরের ব্যাপারটা ছিল আলাদা। ওর বয়স তখন এত কম ছিল যে সেই বয়সে কোন কারনে এত খানি সংযম দেখানো আসলেই খুব কঠিন ব্যাপার।


আবিরের গল্প দিয়ে শুরু করলাম কারন আমার সবসময় মনে হয় মানুষ তার প্রাথমিক এবং প্রধান শিক্ষা আসলে পরিবার থেকে পায়। যখন আবেগ অনেক বেশী ছিল আর যুক্তি কম কাজ করত তখন আমার কেবলি মনে হত যে দেশে ত্রিশ লক্ষ মানুষ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, তিন লক্ষ মা বোন ধর্ষিত হয়েছেন, আরও লাখ লাখ মানুষ যুদ্ধে আহত হয়েছেন, ঘরহারা হয়েছেন, সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন, ঠিকমত খবর নিলে হয়ত দেখা যাবে যুদ্ধে প্রায় প্রতিটা পরিবারই কোন না কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ছিল, সেই দেশের মানুষ যুদ্ধের পরে কিভাবে এত সহজে অতীত ভুলে গেল,যুদ্ধের দিনগুলোর বিভীষিকা ভুলে যেতে পারল, কিভাবে ধীরে ধীরে ইতিহাস বিকৃত হতে দিল, ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করল!!!
তখন এই সহজ হিসেবটা মাথায় ঢুকত না, এখন ঢুকে। হয়ত আমার হিসেব ভুল হতে পারে তবুও মনে হয় যুদ্ধের সময়েই পাকিস্থানিরা খুব সুক্ষভাবে এই প্রক্রিয়া শুরু করে গেছিল ১৪ই ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্যে দিয়ে... এর পরে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, বঙ্গবন্ধুর সাধারন ক্ষমা ঘোষণা , ৭৫ সালে সপরিবারে উনাকে হত্যা করা, ৭৬ সালে রাজাকারদের পুনর্বাসন, ৭৭ এ মন্বন্তর , সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা, এই সব ডামাডোলে মানুষ হয়ত ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে সরে গেছে আর তার সাথে হয়ত যোগ হয়েছিল সাধারন মানুষের ধর্মীয় ভয়(একান্তই নিজস্ব ধারনা)।
যেখানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ই রাজাকারদের পুনর্বাসনের প্রতিষ্ঠাতা সেখানে যে বাংলাদেশের ইতিহাস খুব সহজেই বিকৃত করার চেষ্টা করা হবে বারবার এটা সহজেই অনুমেয়। তবু কিন্তু ইতিহাস চাপা পড়েনি।

কিছু রাজনৈতিক দলের শত চেষ্টা, কিছু ভেকধারী সুশীলের স্লো পইজনিং সত্ত্বেও কিছু মানুষ কখনোই ইতিহাস ভুলে নি, ভুলতে দেয়নি, হৃদয়ে ধারন করে রেখেছে।
আমার এই বোকাশোকা মাথায় কখনোই ঢুকেনি কিভাবে বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেটে পাকিস্তান সাপোর্ট করে, কিভাবে পাকিস্তানের ক্রিকেটারেরা বাংলাদেশের মাটিতে এসে সাপোর্টারদের দেখে অনুভব করে যে তারা পাকিস্তানেই আছে। কিভাবে পাকিস্তানি ড্রেস কেনার জন্য হামলিয়ে পড়ে, কিভাবে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে মেহেরজানের মত সিনেমা হয়, কিভাবে কিছু মানুষ পাকিদের তার ভাই বলে বুকে জড়ানোর জন্য অস্থির হয়, আমি আসলেই কোনদিন বুঝিনি।
এই বিষয়গুলো নিয়ে কারো সাথে কথা বলতে গেলে শুনতে হয়েছে খেলার সাথে যেন রাজনীতি না মেশায়। মুক্তিযুদ্ধ সে তো আমাদের অস্তিত্ব, খেলার জন্য আমরা আমাদের অস্তিত্ব কেই মিথ্যে করব, করেছি, করছি... কেন ???কিভাবে??
আজ যদি বাংলাদেশের জাতীয় কোন হিরো (ক্রিকেট, ফুটবল, সিনেমা, লেখক যে কোনভাবেই হতে পারে) কোনভাবে আমার পরিবারের কারো কোন ক্ষতি করে জ্ঞানত বা অজ্ঞানত তখন কি আমরা খেলার সাথে পরিবার মিশাবেন না বলে সেই হিরোর জয়গান গাইতে পারব।

আমি জানি পারবনা, এমনকি দুর্ঘটনাবশত কোন অন্যায় করে থাকলেও আমাদের ভিতর থেকেই আসবেনা। তাহলে কেন পাকিস্তানের গুনগান আমরা সারাক্ষণ গাইতে থাকি???
এর আগে অনেকবার ভারতীয় সকল পণ্য বর্জন নিয়ে অনেকে অনেক লিখেছে, অনেক মিটিং , মানববন্ধন, অনেক আন্দোলন ও হয়েছে। (সেখানে আমার সমর্থন ও রয়েছে। ভারতীয় জিনিষে বাজার ছেয়ে যাক এটা কোনভাবেই কাম্য নয়। ) কিন্তু তার আগে কেন আমরা পাকিস্থানের সাথে কূটনৈতিক বা ব্যাবশায়িক কোন সম্পর্ক ছিন্ন করিনি(যেখানে তারা আনুষ্ঠানিক ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি) আমি জানিনা।


কেন আমরা সবাই বুঝিনা এটা আমাদের দেশ, নিজেদের দেশ... আমাদের বাংলাদেশ। এই দেশের জল হাওয়াতে আমরা বড় হয়েছি, এদেশের টাকায় আমরা পড়াশুনা করেছি, যে কোন বিপদে আপদে যে দেশ কে আমরা পাশে পাব, কাছে পাব সেটা বাংলাদেশ। যে ভাষায় আমরা সবচেয়ে সুন্দর ভাবে সহজ ভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারব সেটা বাংলা ভাষা। যে দেশ কখনও আমাদের ফিরাবে না, পরম মমতায় বুকে টেনে নিবে সবসময় সেই দেশ শুধুমাত্র আমাদের বাংলাদেশ।
আর সেই দেশ কে যেই দেশ ১৯৭১ সালে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, যারা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল, যারা আমাদের ত্রিশ লক্ষ স্বজন নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল, যারা আজও সেই হত্যাকাণ্ডের জন্য আনুষ্ঠানিক ভাবে ক্ষমা চায়নি, যারা এখনও আমাদের অভ্যন্তরীণ বাপারে নাক গলাতে চেষ্টা করে, দেশদ্রোহী রাজাকারদের সহায়তা করে কিভাবে আমরা সেই দেশের গুণগান গাইতে পারি? আমাদের বিবেকে বাধেনা আমাদের স্বজনদের হত্যাকারীর সাথে হাত মিলাতে, তাদের জয়গান গাইতে?? কিভাবে আমরা সেই দেশের সাথে কোন সম্পর্ক রাখি, কিভাবে আমরা জেনে শুনে সেই দেশের সালওয়ার কামিজ, কুর্তা সহ আরও অন্যান্য জিনিষ কিনতে পারি, পণ্য ব্যবহার করতে পারি???
আমরা ৭১ দেখিনি, আমাদের ইতিহাস সঠিকটুকু জানার কথা ছিল বাংলাদেশের সূচনা লগ্ন থেকেই, হয়ত অনেকেই জানিনি বা জানতে চাইনি এতদিন ...কিন্তু আমরা ২০১৩ দেখেছি... রাজাকারদের বিচার প্রক্রিয়া দেখেছি, দেখছি, তাদের ধৃষ্টতা দেখেছি, কাদের মোল্লার ভি দেখেছি, তার প্রতিবাদে শাহবাগে সকল শ্রেণীর সাধারন মানুষের প্রতিবাদ দেখেছি, গন জাগরন মঞ্চ দেখেছি, সবার দাবীতে স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে দেশদ্রোহী বেঈমান রাজাকার কাদের মোল্লার ফাঁসি দেখেছি।

আমরা যারা আগে কোন ইতিহাস জানিনি, জানতে চাইনি, ইতিহাস এড়িয়ে থেকেছি তারাও আজ ২০১৩ তে এসে জানছি। ইতিহাসের তলা থেকে আজ কসাই কাদের, দেইল্লা রাজাকার, বাচ্চু রাজাকার, মুজাহিদদের কীর্তি কলাপ উঠে এসেছে, যারা আগে জানত না, তারাও এখন জানে ৭১ সালে রাজাকারদের ভূমিকা, আর সাথে পাকি বাহিনির নৃশংসতা। এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে, এতদিনেও কি আমরা নিজের দেশ টাকে ভালবাসতে শিখবনা? পূর্ব পুরুষদের ঋণ শোধ করার চেষ্টা করবনা? নিজের দেশটাকে মন প্রান দিয়ে ভালবাসবনা?? এখন কি তবে আমরা সম্মিলিত ভাবে পাকিস্থানের সাথে সকল রকম সম্পর্ক বর্জন করতে পারিনা??? সকল রাজাকারের জন্য তাদের প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত করতে পারিনা??? জামাত শিবির কে দেশের স্বার্থে দেশ থেকে বিতারন করতে পারিনা???
আমার তিন বছরের ছোট্ট ভাই যদি সে সময় কিছু না বুঝেই পাকিস্থানকে বর্জন করতে পারে, আমরা তবে এত বড় হয়েও কেন পাকিস্তান আর দোসরদের বর্জন করতে পারবনা???

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.