আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিরিয়া : ডাইনি হিন্দার ভাবশিষ্যরা

মানব সভ্যতার উন্মেষ ঠিক প্রথম কোথায় হয়েছিল তা বলার উপায় নেই। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এগিয়ে। মিসর, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন প্রভৃতি দেশকে সভ্যতার সূতিকাগার বলে অভিহিত করা হয়। ইরাককে বলা হয় সভ্য দুনিয়ার প্রাচীন দেশ। পৃথিবীতে প্রথম রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল সম্ভবত ইরাকের ইউফ্রেতিস নদীর তীরে।

ফ্রান্সের লুবো মিউজিয়ামে সংরক্ষিত দলিল অনুসারে পৃথিবীর প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয় এ নদী তীরের দুটি নগর রাষ্ট্র ল্যাগাস ও উম্মার মধ্যে। নদীর পানি নিয়ে বিরোধে দুই জাতিই ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ইরাক পৃথিবীর ধর্মীয় ইতিহাসেও প্রাতঃস্মরণীয়। বিশ্বাসীদের আদি পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)। ইসলাম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের কাছে তিনি পরম শ্রদ্ধেয়।

বাইবেল ওল্ড টেস্টামেন্ট বা তাওরাত ও জবুর কিতাবে হজরত ইব্রাহিমকে আব্রাম বা আব্রাহাম নামে অভিহিত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে হজরত ইব্রাহিমের প্রসঙ্গ এসেছে ব্যাপকভাবে। এই নবী জন্ম নেন ইরাকের উর শহরে। ধর্মীয় উপখ্যান মতে, নবী হজরত ইউনূস (আ.)-কে গিলে খেয়েছিল এক বিশাল আকারের মাছ। আল্লাহর কৃপায় তিনি মাছের পেট থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন।

হাজার হাজার বছর ধরে সে মাছের কঙ্কাল রক্ষিত ছিল ইরাকের এক শহরে। মাত্র দুই যুগ আগের সমৃদ্ধ দেশ ইরাক এখন ধ্বংসস্তূপ। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়ার মানুষের কাছে মহাপুরুষ হজরত ইব্রাহিম বা আব্রাহাম পরম শ্রদ্ধেয়। কিন্তু তার দেশকে বোমা মেরে ধ্বংস করতে তাদের এতটুকু বাধেনি। ইরাকি নেতা সাদ্দাম রাসায়নিক অস্ত্র মজুত করেছেন এই কল্পিত অভিযোগ তুলে স্বাধীন দেশ ইরাকে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।

সৌদি আরব ও ইসরায়েলের প্রত্যক্ষ সহায়তায় তারা সমৃদ্ধ একটি দেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। মানব সভ্যতার সূতিকাগার মিসরের অস্তিত্বও আজ হুমকির সম্মুখীন। সে দেশের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেছে মার্কিন সেবাদাসের ভূমিকা পালনকারী সেনাবাহিনী। প্রেসিডেন্ট মুরসির হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে রাজপথে অবস্থানরত জনতার ওপর ট্যাঙ্ক ও কামানের গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছে কয়েক হাজার মানুষকে।

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষমতা রাখত তিনটি দেশ। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভাবা হতো যে ইরাককে সে দেশ এখন অস্তিত্ব হারানোর ঝুঁকিতে। মিসরের সেনাবাহিনীকে পশ্চিমা শক্তি বশ করেছে ডলার ছিটিয়ে। বাকি ছিল সিরিয়া। সে সিরিয়ার কফিনে পেরেক মারার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে যুক্তরাষ্ট্র।

সিরিয়ার আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ উসকে দিয়েছে। জঙ্গিবাদের বিরোধিতা নাকি আমেরিকার অলঙ্ঘনীয় নীতি। অথচ সিরিয়ার আসাদ সরকারকে স্তব্ধ করতে তারা তথাকথিত ইসলামপন্থিদের ওপর সওয়ার হয়েছে।

সিরিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের ক্ষোভের কারণটি স্পষ্ট। সিরিয়ার সমর্থনপুষ্ট লেবাননের হিজবুল্লাহ গ্রুপ ইসরায়েলকে যেভাবে নতজানু হতে বাধ্য করেছে, সে সাধ্য কোনো আরব দেশের হয়নি।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সিরিয়াকে অন্যতম শক্তিশালী বলে ভাবা হয়। ইরানের সঙ্গে তাদের মৈত্রীর সম্পর্ককে ইসরায়েল তাদের অস্তিত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখে। দুই. আনুমানিক হিসাবে পাঁচ হাজার বছর আগে সিরিয়ায় সভ্যতার বিকাশ ঘটে। ভূমধ্যসাগর তীরের এ দেশটি ইসলামী শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয় দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর আমলে। তার আমলে সিরিয়ার গভর্নর পদে নিয়োগ পান আমির মুয়াবিয়া (রা.)।

মুয়াবিয়া ছিলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্যতম সাহাবি।

ইসলামের ঘোর শত্রু আবু সুফিয়ান ছিলেন মুয়াবিয়া (রা.)-এর বাবা। তার মায়ের নাম হিন্দা। ইসলাম বিরোধিতায় হিন্দা আবু সুফিয়ানের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। ওহুদের যুদ্ধে শহীদ হন মহানবী (সা.)-এর প্রিয় চাচা আমির হামজা।

মহানবী (সা.) বিপদে-আপদে যাদের ওপর নির্ভর করতেন হামজা (রা.) ছিলেন তাদেরই একজন। তাকে হত্যা করে কুরাইশরা মহানবী (সা.)-কে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। এই মহাবীরকে হত্যা করে তারা ক্ষান্ত হয়নি, লাশের ওপরও জিঘাংসা চালানো হয়। আমির হামজার (রা.) নাক ও কান কেটে উল্লাস করে তারা। মুয়াবিয়ার মা হিন্দা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার যে নজির রাখে ইতিহাসে তার তুলনা পাওয়া ভার।

তরবারি দিয়ে হামজার বুক চিরে কলিজা বের করে আনে এই প্রতিহিংসাপরায়ণ রমণী। তারপর রূপকথার ডাইনির মতো পৈশাচিক উল্লাসে কলিজা চিবিয়ে খায় সে।

মহানবী (সা.)-এর বিরোধিতায় উমাইয়ারা যে কোনো কোরাইশ গোত্রের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও ইসলামের জয় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলে তারাও নতিস্বীকার করে। মুয়াবিয়াসহ উমাইয়ারা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেন। মহানবী (সা.) তাদের অতীতের সব অপরাধ ক্ষমা করে দেন।

হজরত ওসমান (রা.) নিহত হন বিদ্রোহীদের হাতে। তার মৃত্যুর পর খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হন মহানবী (সা.)-এর জামাতা হজরত আলী (রা.)। তিনি ছিলেন তার সময়ের অন্যতম সেরা বীর। আল্লাহর তরবারি বলে অভিহিত করা হতো তাকে। সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিদেরও একজন ছিলেন তিনি।

হজরত আলীর (রা.) খলিফা হওয়াকে মেনে নিতে পারেনি উমাইয়ারা। উমাইয়া দলপতি আমির মুয়াবিয়া (রা.) ছিলেন সে সময় সিরিয়ার গভর্নর। তিনি হজরত আলীর (রা.) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। হজরত আলী (রা.) মুয়াবিয়াকে সুপথে আনতে সম্ভাব্য সব চেষ্টাই চালান। ব্যর্থ হয়ে তিনি বিদ্রোহ দমনের পদক্ষেপ নেন।

সিফফিনের যুদ্ধে কোণঠাসা হয়ে পড়ে মুয়াবিয়া বাহিনী। হজরত আলীকে ঠেকাতে তারা বাঁকাপথ গ্রহণ করে। বর্শার মাথায় কোরআন বেঁধে যুদ্ধে নামেন মুয়াবিয়ার অনুসারীরা। খলিফা হজরত আলী (রা.) বিদ্রোহীদের এই ঘৃণ্য কৌশলে অাঁতকে ওঠেন। কোরআনের মর্যাদা রক্ষায় তিনি বিদ্রোহীদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপনে রাজি হন।

সিদ্ধান্ত হয় হজরত আলী (রা.)-এর পর মুয়াবিয়া খলিফা হবেন। তারপর খেলাফত যাবে আলী পুত্র হজরত হাসান ও হোসেন (রা.)-এর হাতে।

মুয়াবিয়া এ সন্ধির মর্যাদা রাখেননি। তিনি তার জীবদ্দশায় মদ্যপ পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী খলিফা মনোনীত করে যান। এই ইয়াজিদের শাসনামলে কারবালার প্রান্তরে নিহত হন মহানবী (সা.)-এর প্রিয় নাতি হজরত হোসেন (রা.)।

আহলে বায়াত বা নবী বংশের বেশ কিছু সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে ইয়াজিদের অনুসারীরা।

তিন. সিরিয়ার সঙ্গে মুয়াবিয়া বা উমাইয়াদের সম্পর্ক ইতিহাসের এক মহাসত্য। সিরিয়ার দামেস্ক নগরীকে উমাইয়া খেলাফতের রাজধানী করা হয় হিন্দাপুত্র মুয়াবিয়ার আমলে। মসজিদে জুমার খুতবায় মহানবীর প্রিয় কন্যা ফাতেমার (রা.) স্বামী ও ইসলামের চতুর্থ মহান খলিফা হজরত আলী (রা.)-কে অভিসম্পাত দেওয়ার বিধান জারি করেন তিনি। ৫৯ বছর ধরে চলে মহানবী (সা.)-এর বংশধরদের অভিসম্পাত দেওয়ার ঘৃণ্য বিধান।

ইসলামী খেলাফতের নামে উমাইয়ারা কার্যত রাজতন্ত্র প্রবর্তন করে। মহানবী (সা.)-এর সম্পত্তিও তারা বাজেয়াপ্ত করার ধৃষ্টতা দেখায়। দেখেশুনে মনে হচ্ছে উমাইয়া শাসন অবসানের পর ১৩শ' বছর কেটে গেলেও নিষ্ঠুর ও নির্দয়তার ঐতিহ্য থেকে সিরিয়া বেরিয়ে আসতে পারেনি। সিরিয়ার হাফিজ আল আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উড়িয়েছে সে দেশের তথাকথিত ইসলামপন্থি বিদ্রোহীরা। আল কায়দা সমর্থিত এ বিদ্রোহীদের পেছনে একদিকে রয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সমর্থন।

অন্যদিকে ইসরাইলের প্রচ্ছন্ন আশীর্বাদ। বিদ্রোহীদের পেছনে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে ধনাঢ্য দেশ সৌদি আরবের সমর্থনের বিষয়টিও ওপেন সিক্রেট। সিরিয়া সরকার বিদ্রোহীদের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করছে এই অজুহাতে আমেরিকা সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছিল। রাশিয়া ও চীন সিরিয়ার পক্ষ নেওয়ায় আমেরিকাকে রণেভঙ্গ দিতে হয়। পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে সিরিয়ার আসাদ সরকার এক গাত্রদাহের নাম।

আমেরিকা ও ইসরাইলের ঘোরতর শত্রু ইরানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত আসাদ সরকারকে উৎখাত করে ইরানকে একঘরে করতে চাচ্ছে পশ্চিমারা। এ কারণে তারা আল কায়দা সমর্থিত বিদ্রোহীদের মদদ দিতেও পিছপা হচ্ছে না।

সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে সে দেশে হস্তক্ষেপ কসরত চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো। কিন্তু লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ফাঁস করে দিয়েছে সিরিয়ার বিদ্রোহীরাই মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে চালু করা হয়েছে বহুসংখ্যক বন্দী শিবির।

যেখানে প্রতিপক্ষ গ্রুপের লোকজনকে আটক করে নির্মম নির্যাতন চালানো হচ্ছে। শত শত শিশুকেও বন্দী করা হয়েছে। তাদের ওপর চালানো হচ্ছে বিভৎস নির্যাতন। আট বছর বয়সী শিশুরাও তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। মাত্র কয়েক মিনিটের বিচার শেষে গুলি করে অথবা গলা কেটে মানুষ হত্যা সিরীয় বিদ্রোহীদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

বন্দীদের বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, নির্মমভাবে পেটানো, কোমরের সঙ্গে ঘাড় বেঁধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেলে রাখার মতো অপরাধও তারা করছে। কয়েক মাস আগে আল কায়দা সমর্থিত বিদ্রোহীরা তাদের হাতে আটক একজন সিরীয় সৈন্যের কলিজা বের করে চিবিয়ে খায়। সংবাদ মাধ্যমে কলিজা কেটে খাওয়ার ভিডিও প্রচারের পর সারা দুনিয়ায় হৈচৈ পড়ে যায়। সিরিয়ায় মার্কিন হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করতে বিদ্রোহীরা সে দেশে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের নাটক সাজায় বলেও ধারণা করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র আল কায়দাকে জঙ্গি সংগঠন বলে মনে করে জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াইকে তারা তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে।

কিন্তু আরব বিশ্বের অপছন্দনীয় সরকারগুলোকে উৎখাত করতে তারা আল কায়দা সমর্থিত বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গেও জোট বাঁধছে। নিজেদের ইসলামী যোদ্ধা বলে দাবি করলেও সিরিয়ার বিদ্রোহীরা কার্যত ইসরায়েল ও পশ্চিমা দেশগুলোর শিখণ্ডি হিসেবে কাজ করছে। সিরিয়ায় ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা নয়, ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষাই তাদের উদ্দেশ্য। যে কারণে ইসরায়েলও চায় সিরিয়ার বিদ্রোহীরা জয়ী হোক। প্রেসিডেন্ট আসাদের শাসনব্যবস্থা ধসে পড়ুক।

অশুভ ঐক্য হয়তো একেই বলে!

লেখক : সাংবাদিক।

ই-মেইল : sumonpalit@gmail.comy

 

 

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.