আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মহাকাব্যের স্রষ্টা মাইকেল মধুসূদন দত্ত

ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা বাঙালি কবি ও নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাকে মহাকবি হিসেবে অভিধা দেওয়া হয়। তিনি বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ব্রিটিশ ভারতের যশোর জেলার এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ পরিবারে ২৫ জানুয়ারি ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে তার জন্ম। মাত্র ১৩ বছর বয়সে পিতৃভূমি ছেড়ে মধুসূদন কলকাতায় চলে যান।

সেখানে তিনি হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাই অচিরেই কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ডি এল রিচার্ডসনের প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন। রিচার্ডসন তাকে কবিতা লিখতে উৎসাহিত করেছিলেন। ওই সময় হিন্দু কলেজের বিখ্যাত অধ্যাপক ডিরোজিওর স্বদেশানুরাগে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ইয়ং বেঙ্গল সমিতিতে নাম লেখান।

তার সহপাঠী ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, প্যারীচরণ সরকার প্রমুখ ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। ১৮ বছর বয়সেই মহাকবি হওয়ার ও বিলাতে যাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার মনে বদ্ধমূল হয়ে যায়। ১৮৪৩ সালে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে মধুসূদন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এরপর ওই বছরই ১৩ ফেব্রুয়ারি মিশন রোন্ডতে অবস্থিত ওল্ড মিশন চার্চ নামে এক অ্যাংলিক্যান চার্চে গিয়ে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাকে দীক্ষিত করেছিলেন পাদ্রী ডিলট্রি।

তিনিই তার মাইকেল নামকরণ করেন। রাজনারায়ণ দত্ত তার বিধর্মী পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। মধুসূদন শিবপুরের বিশপস কলেজ থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যান। তখন গ্রিক, লাতিন, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষা শিক্ষা করেন। বিশপস কলেজে পড়াশোনা শেষ করে তিনি ভাগ্য অন্বেষণে চলে যান মাদ্রাজ।

মাদ্রাজেও বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেননি তিনি। স্থানীয় খ্রিস্টান ও ইংরেজদের সহায়তায় তিনি একটি স্কুলে ইংরেজি শিক্ষকের চাকরি পান। অল্প বেতনে ব্যয় সংকুলান হতো না। তখন তিনি মাদ্রাজ 'ক্রনিকল' পত্রিকায় টিমোথি পেনপোয়েম ছদ্মনামে কবিতা লেখেন। 'হিন্দু ক্রনিকল' নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন তিনি।

নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যেই তিনি 'দ্য ক্যাপটিভ লেডি' নামে কাব্য রচনা করেন। রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক ইংরেজ যুবতীকে বিয়ে করেন। তাদের সাত বছরের দাম্পত্যজীবনে দুই পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়। রেবেকার সঙ্গে বিয়ে বিচ্ছেদের মধুসূদন এমিলিয়া অাঁরিয়েতা সোফিয়া নামে এক ফরাসি তরুণীকে বিয়ে করেন। ১৮৫৬ সালে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন।

এরপর তিনি আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করে কিছুকাল আইনচর্চা করেন। আইন ব্যবসায় তিনি তেমন সাফল্য লাভ করতে পারেননি। তা ছাড়া অমিতব্যয়ী স্বভাবের জন্য তিনি ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েন। পরে তিনি ফ্রান্সের ভার্সাই চলে যান। বিদেশবিভঁূইয়ে গিয়েও তার মন পড়েছিল যশোরের সাগরদাঁড়ি।

সাগরদাঁড়ির কপোতাক্ষ নদ নিয়ে তিনি কবিতাও লিখেছিলেন ভার্সাইয়ে বসে। মাইকেল মধুসূদন ১৮৫২ সালে তারাচরণ শিকদার, জেসি গুপ্ত ও রামনারায়ণ তর্করত্নের হাত ধরে বাংলায় শৌখিন রঙ্গমঞ্চে নাট্য মঞ্চায়ন শুরু হয়। ১৮৫৮ সালে পাইকপায়ার জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ও প্রতাপচন্দ্র সিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতার বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চে রামনারায়ণ তর্করত্নের 'রত্নাবলী' নাটক অভিনীত হয়। শিল্পগুণবিবর্জিত এই সাধারণ নাটকটির জন্য জমিদারদের বিপুল অর্থব্যয় ও উৎসাহ দেখে মধুসূদনের মন ব্যথিত হয়ে ওঠে। এরপর তিনি নিজেই নাট্য রচনায় ব্রতী হন।

রামনারায়ণ তর্করত্নের সংস্কৃত নাট্যশৈলীর প্রথা ভেঙে তিনি পাশ্চাত্য শৈলীর অনুসরণে প্রথম আধুনিক বাংলা নাটক রচনা করেন। ১৮৫৯ থেকে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত তিনি 'শর্মিষ্ঠা' [১৮৫৯], 'একেই কি বলে সভ্যতা' [১৮৬০], 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' [১৮৬০], 'পদ্মাবতী' [১৮৬০], 'কৃষ্ণকুমারী' [১৮৬১] নাটক রচনা করেন। এ ছাড়া মৃত্যুর পূর্বে 'মায়াকানন' [১৮৭৪] নামে একটি অসমাপ্ত নাটক লিখেছিলেন। তার 'শর্মিষ্ঠা' প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। 'পদ্মাবতী' নাটকেই তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন।

১৮৬০-এ তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দে লিখেছিলেন 'তিলোত্তমাসম্ভব' কাব্য। এরপর তিনি রচনা করেন বাংলা ভাষার প্রথম মহাকাব্য 'মেঘনাদ বধ'। তার অন্যান্য কাব্যের মধ্যে 'ব্রজাঙ্গনা', 'বীরাঙ্গনা' উল্লেখযোগ্য। তার 'চতুর্দশপদী কবিতা' [১৮৬৬] তুমুল আলোচিত কাব্যগ্রন্থ। মাইকেলের পৌরাণিক নাটক 'শর্মিষ্ঠা'য় আধুনিক পাশ্চাত্যশৈলীর অনুপুঙ্খ দৃষ্টিভঙ্গি উঠে এসেছে।

এ নাটকের আখ্যানবস্তু মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত রাজা যযাতি, শর্মিষ্ঠা ও দেবযানীর ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনী থেকে নেওয়া। পাশ্চাত্য নাট্যরীতি নির্ভর করলেও এ নাটকে সংস্কৃত নাট্যশৈলীর প্রভাব রয়েছে। এ নাটকের কাব্য ও অলঙ্কার-বহুল দীর্ঘ সংলাপ, ঘটনার বর্ণনাত্দক রীতি, প্রবেশক, নটী, বিদুষক প্রভৃতির ব্যবহার সংস্কৃতশৈলীর অনুরূপ। ১৮৬০ সালে লেখা মাইকেল রচনা করেন 'একেই কি বলে সভ্যতা' ও 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' নামে দুটি প্রহসন। এ প্রহসন দুটিও বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ রচনার দাবি রাখে।

প্রথম নাটকটির বিষয় ছিল ইংরেজি শিক্ষিত নব্য বাবু সম্প্রদায়ের উচ্ছৃঙ্খলতা। দ্বিতীয়টির বিষয় ছিল সনাতনপন্থি সমাজপতিদের নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন। এ নাটকে মাইকেলের পর্যবেক্ষণ শক্তি, সমাজ বাস্তবতাবোধ প্রবলভাবে ওঠে আসে। তার পৌরাণিক নাটক 'পদ্মাবতী' এর ভিত্তি পুরোপুরি ভারতীয় পুরাণ নয় বরং এখানে গ্রিক পুরাণের আবহ দেখা যায়। এখানে রতি ও ভগবতীর চেষ্টায় ইন্দ্রনীল উদ্ধার পান এবং বিচ্ছিন্না স্ত্রী পদ্মাবতীর সঙ্গে তার মিলন ঘটে।

মূল গ্রিক উপাখ্যানটি বিয়োগান্তক হলেও মাইকেল এ নাটকটিকে ইংরেজি ট্র্যাজিক-কমেডির ধাঁচে করেছেন মিলনান্তক। শেষ জীবনে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে বেঙ্গল থিয়েটারের কর্ণধার শরৎচন্দ্র ঘোষের অনুরোধে তিনি 'মায়াকানন' নাটক রচনায় হাত দেন। নাটকটি তিনি শেষ করতে পারেননি।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.