আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কৃষ্ণ (বিদেশী গল্প অবলম্বনে রচিত, ১৮+)



১)
মুশতাক আহমেদের উপন্যাসটা যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। আগামী ঈদে বের হওয়ার কথা এটার। মনস্তত্ত্ব নিয়ে গল্প-চটি গল্প-উপন্যাস লিখিয়ে হিসেবে মুশতাকের জনপ্রিয়তা আকাশসম। সেই মুশতাক আহমেদকে নাকি রাইটার্স ব্লকে ধরেছে! লেখা দিয়ে যার জীবন চলে, তাকে আর যাই হোক, এসব বড়লোকি অসুখে পেলে চলে না।
স্ত্রী দীপিকা এসে প্রস্তাব দিলেন বাইরে কোথাও গিয়ে লেখাটা শেষ করে আসার।

শহরের দালানকোঠার ভিড়ে মাথা অতোটা কাজ করে না সবসময়। মুশতাক দুইদিন ভাবলেন প্রস্তাবটা নিয়ে। তৃতীয়দিন বৌ-বাচ্চা নিয়ে রওনা দিলেন ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর গ্রামের বাড়ীতে। বন্ধুটি শহরের স্থায়ী বাসিন্দা। তবে গ্রামের বাড়ীতে রেখে এসেছেন দূর সম্পর্কের জ্যাঠাতো ভাইবোনকে।

তারাই পাহারা দিচ্ছে হিন্দু জমিদার বাড়ীটিকে।
দুনিয়ার লক্কর ঝক্কর পেরিয়ে যখন মুশতাক-দীপিকা পা রাখলেন প্রাসাদে, তখন বিদ্যুৎ বর্জিত ঘরগুলোয় হারিকেন আর মোম জ্বলছে টিমটিম। বন্ধুর ভাই হাত জোর করে নমস্কার জানিয়ে শুধালেন, “কোনো সমস্যা হয় নি তো খুঁজে পেতে?”
বিরক্তি চেপে মুশতাক বললেন, “তেমন কোনো অসুবিধা হয় নি... কিন্তু কাউকে যদি স্টেশনে পাঠাতেন, আরও আগে খুঁজে পেতাম। ”
“হে হে দাদা বুঝেনই তো! বাড়ীতে বিধবা বোনকে রেখে অতদূরের স্টেশনে যেতে মন সায় দিচ্ছিলো না। ”
“হুম!”

রাতে খানাপিনার সময়ও বিধবা বোনকে দেখা গেলো না কোথাও।

ভাই নিজেই সবকিছু বেড়ে দিলেন, পরিবেশন করলেন। দীপিকা কৌতূহল চেপে না রাখতে পেরে ঘুরিয়ে জানতে চাইলেন, “রান্না কি আপনি করেছেন? বেশ হয়েছে কিন্তু!”
গর্বিত হাসি দেখা গেলো ভাইয়ের মুখে, “না না বৌদি। রান্না করেছে রাধা। পাঁকশাকে ওর হাত খুব ভালো। ”
“হু, তা তো বুঝতেই পারছি।

কিন্তু সে কোথায়? আসার পর তো একবারও দেখলাম না। ”
“রাধা সন্ধ্যে বেলায়ই দোর লাগিয়ে দেয়। ঠাকুরের পূজা করে, তারপর ঘুমিয়ে পড়ে। ”
স্বামী-স্ত্রী চোখাচোখি করলেন। দুজনেই অবাক হয়েছেন বোঝা যায়।

বাসায় অতিথি আসার পরও কেউ সাক্ষাৎ না করে দোর লাগিয়ে দেয়, এই প্রথম শুনলেন।

নতুন জায়গায় এসে ঘুমে সমস্যা হওয়াটা মুশতাকের পুরনো অসুখ। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। ভোর হতে না হতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কয়টা বাজে হিসেব নেই।

হয়তো পাঁচটা। সাবধানে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন উনি। লেখার খাতিরেই গ্রাম্য পরিবেশ দেখতে চান একদম ভোরে, সকালে, মাঝ সকালে, দুপুরের কাঠফাটা রোদে, বিকেলে, পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদে, সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে, রাতের নির্জনতায়।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ বুলিয়ে খালি পায়ে মুশতাক নেমে পড়লেন উঠোনে। শিশির ভেজা ঠাণ্ডা মাটি কাঁপিয়ে দিলো শরীর।

অন্যরকম এক ভালো লাগা ভর করলো নিজের মধ্যে। যেন চলে গেছেন ছোট্টবেলার সেই গ্রামে, সেই দস্যিপনায়।
এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে মুশতাক চলে এলেন মূল বাড়ী থেকে খানিকটা দূরে। বাড়ীর বামদিক ধরে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ আবিষ্কার করলেন শান বাঁধানো ঘাট। আরেকটু এগিয়ে গেলেন ভালোভাবে দেখার জন্য।

কিন্তু ভীষণ চমকে উঠলেন এক নারীমূর্তি দেখে। মূর্তিটি ঠায় বসে আছে ঘাটের শেষ সিঁড়িতে। সাদা শাড়ী পরা মূর্তিটির লম্বা কালো চুল উস্কখুস্ক হয়ে ছড়িয়ে আছে ঘাড়ে। মুশতাক চোখ কচলে আবারো তাকালেন। মূর্তিটি কি একটু নড়লো? নিঃশ্বাস বন্ধ করে মুশতাক তাকিয়ে রইলেন।

হ্যাঁ, মূর্তিটি নড়েচড়ে উঠে দাঁড়ালো। এক পা এক পা করে নেমে পড়লো পুকুরের কালো পানিতে। মুশতাক চোখ ফেরাতে পারলেন না। মূর্তির জলকেলি শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে রইলেন এবং এক সময় আবিষ্কার করলেন, তিনি এতক্ষণ ধরে রাধার স্নান করার দৃশ্য দেখেছেন।

দুপুরে দীপিকার ডাকাডাকিতে মুশতাক দরজা খুললেন।

অনেকখানি লিখে ফেলেছেন উপন্যাসের। হাত চলা শুরু করেছে রকেটের গতিতে। এসময় স্ত্রীর আদুরে কণ্ঠও কর্কশ শোনালো।
“কী হয়েছে? চেঁচাচ্ছো কেনো?” মুশতাকের বিরক্তিতে অবাক হলেন দীপিকা। “কই চেঁচালাম? খেতে ডাকছি! সেই সকালবেলায় দরজা বন্ধ করেছো।

খিদেও লাগে না নাকি?”
ভাত, মাছ, সবজি, মাংস কিছুই বাদ নেই তালিকায়। রান্না কি রাধাই করেছে? প্রশ্নটা তোলার মতো সাহস পেলেন না মুশতাক। ভোরের ঘটনার পর থেকে রাধা সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন উনি। রাধা দেখে ফেলার আগেই উনি বাড়ীতে চলে এসেছিলেন কিন্তু তারপরও মনের মধ্যে ভেজা শাড়ী পরা রাধার অবয়ব যতবার ভেসে উঠছে, ততবার এক অপরাধবোধ কাজ করছে যেন।
“বললে না কেমন হয়েছে রান্না?” দীপিকার প্রশ্নে ধপ করে বাস্তবে ফিরলেন মুশতাক।


“তুমি রেঁধেছ নাকি? ভালোই লাগছে। ”
“হুম, আমিই রাঁধলাম। রাধাকে বললাম রান্নাঘরের সবকিছু দেখিয়ে দিতে। আজ থেকে আমিই আমাদেরটা রেঁধে নেবো। শুধু বাজারটা করে দেবে দাদা।


“হু। ”

সন্ধ্যায় ঘর থেকে বের হলেন মুশতাক। দুপুরের পর থেকে সারাদিন ঐ ছোট্ট ঘরে বসা। লিখতে লিখতে হাত ব্যথা, মাথা ব্যথা সব একসাথে জাঁকিয়ে বসেছে। হালকা ধূমপান না করলেই নয়।

তবে এবার আর বামদিকে গেলেন না। বাড়ীর ডানদিক ধরে হাঁটা শুরু করলেন। একটু পরেই চলে এলেন একটা সুপুরি বাগানের ভেতর। চারদিকে অসংখ্য ঝি ঝি পোকার ডাক। তার মধ্যে গ্রামে অন্ধকার হয়ে এলেই শীত শীত লাগে।

মুশতাক বেশীদূর যাওয়ার সাহস পেলেন না। পথ হারিয়ে ফেললে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। আশেপাশের দুই কিলোর মধ্যে কোনো বসতি নেই। তাই ফিরে এলেন শ্যাওলা পড়া প্রাসাদে।

বাড়ীর উঠোনে এসে দাঁড়াতেই দেখলেন রাধার ঘর হাট করে খোলা।

মেয়েটা একতলার একদম কিনারের ঘরটায় থাকে। আর মুশতাকদের জায়গা হয়েছে দোতলায়। আসার পর থেকে রাধার ঘর বন্ধই পেয়েছেন উনি। এই প্রথম খোলা দেখে মনে মনে কৌতূহল ঝাঁপিয়ে পড়লো। কিন্তু আরেকজনের ঘরে উঁকি দেওয়াটা ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতেই কেটে গেলো কয়েক মিনিট।

এই কয়েক মিনিটে মুশতাক নিজের ভেতরে অনুভব করলেন প্রথম চুমু খাওয়ার সেই ধড়ফড়ানি। তারপর সব ধরণের এথিকসকে গুলি করে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন রাধার দরজার দিকে।

২)
মুশতাকের উপন্যাসে যোগ হলো নতুন চরিত্র “রাধা”। কাহিনীকে জমিয়ে তুলতে যত বেশী চরিত্র বপন করা যায় ততোই লাভ। কিন্তু কিছুদূর লেখার পর এই চরিত্রকে মুশতাকের উড়ে এসে জুড়ে বসা কিছু বানাতে ইচ্ছে হলো না।

বরং মনে হলো, উপন্যাসে আলটপকা ঢুকিয়ে এই চরিত্রটিরই অপমান করা হচ্ছে।
ফলে দুপুরে খাওয়ার জন্য স্বামীকে ডাকতে এসে যখন দীপিকা মুশতাকের নতুন উপন্যাসের নাম “রাধা” দেখলেন, চমকে উঠলেন। যতদূর জানেন, মুশতাকের উপন্যাসের নাম ছিলো “পাপী মন” এবং তার সত্তর ভাগ শেষ হয়েছে। কিন্তু রাধা নামক উপন্যাসটির মাত্র কয়েক অধ্যায় লেখা হয়েছে আর পাশেই অবহেলায় পড়ে আছে পাপী মন।

“তুমি কি নতুন উপন্যাস লেখা শুরু করেছো নাকি?” বৌয়ের কণ্ঠে ঝাঁঝ টের পেলেন মুশতাক।


“হু। আগেরটা ঠিক জমছে না। শেষ করতে পারছি না। ”
“পারছ না মানে কী? ঐটা শেষ করার জন্যেই তো এখানে আসা। ”
“হ্যাঁ, কিন্তু লাভ হলো কই? সেই আটকেই তো আছি।

তারচে’ নতুন কাহিনী নিয়ে যদি আরেকটা শেষ করি, সেটাই লাভ। ”
দীপিকার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেলো।

আজকেও সন্ধ্যায় বের হলেন মুশতাক। সুপুরি বাগানে কয়েক চক্কর মেরে পায়ে পায়ে ফিরলেন বাড়ীর উঠোনে। কিন্তু আজ বন্ধ দেখাচ্ছে।

রাধার ঘর আজ বন্ধ দেখাচ্ছে। কেন? মুশতাকের শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠলো। তবে কি গতকালের উঁকি দেওয়ার ঘটনা রাধা টের পেয়ে গেছে? ছিঃ ছিঃ কী কেলেংকারী!
মুশতাক ঢোঁক গিলে চারপাশে তাকালেন। রাধার দরজায় উঁকি দেওয়ার জন্য তাঁর ব্যাকুলতা কেউ টের পাচ্ছে কিনা, দেখতে চাইলেন। অমূলক চিন্তা।

তবুও বারবার খুঁজে বেড়াতে লাগলেন কাউকে। সেই কেউটা যেন রাধা হয়, এই প্রার্থনাও করতে লাগলেন।

“এই! তিনদিন হয়ে গেলো এখানে। কবে ফিরবো শহরে?” দীপিকার আব্দারী সুর মুশতাকের কল্পনায় ছেদ টানলো।
“এতো তাড়া কিসের? ভাড়া তো দিতে হচ্ছে না।

আরও কয়েকদিন থাকি। নতুন উপন্যাসটা শেষ করি!”
“নতুন উপন্যাসের নায়িকা কি বিধবা রাধা নাকি?”
“বলতে পারো। ওকে কল্পনা করেই সাজিয়েছি চরিত্রটি। ”
“কল্পনা করে মানে? তুমি কি ওকে নিয়ে ফ্যান্টাসি করছো নাকি?”
হো হো করে হেসে ফেললেন মুশতাক। “ফ্যান্টাসি না করলে কাহিনী ডেভেলপ করবো কীভাবে?”

৩)
নিয়মিত ভোরে উঠা আজকাল অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে মুশতাকের।

প্রথম প্রথম রাধার চোখের আড়ালে থেকে স্নানের দৃশ্য দেখতেন উনি। কিন্তু এখন রাধার সামনে এসেই দাঁড়িয়ে থাকেন। রাধা ঐ পারে, উনি এই পারে। রাধা মুশতাককে দেখে মোটেও অবাক হয় না, কিছু বলেও না। ভারী অদ্ভুত মনে হয় মুশতাকের।

তিনি রাধার ভেজা শরীরে লেপটে থাকা শাড়ী কল্পনায় নিয়ে লিখতে বসেন উপন্যাস। বের করতে চেষ্টা করেন রাধা কী চায় তাঁর কাছে? কেনো সে মেনে নিচ্ছে মুশতাকের অবৈধ দৃষ্টি? কেনো রাধার পূজার ধরণে এতো নগ্নতা?

৪)
দীপিকা বুঝতে পারেন, ভয়ংকর কিছু ঘটছে এ বাড়ীতে। ঘটছে তার চোখের সামনেই। কিন্তু তিনি ব্যাপারটাকে পাত্তা দিতে চান নি বলে চোখে পড়ে নি।
ইদানীং মুশতাকের আচরণ খুব খাপছাড়া লাগছে।

ভয় লাগা শুরু করেছে রাধা মেয়েটাকেও। সারাদিন ঘর বন্ধ করে ও কী করে? জাদুটোনা নয় তো? নিজে বিধবা বলে অন্যের স্বামীসুখ সহ্য নাও হতে পারে। শুধু রান্নার সময়টায় বের হতে দেখেন ওকে। তাও শাকপাতা আর ভাত একসাথে সিদ্ধ করে খেয়ে ফেলে। এছাড়া ঘর থেকে বের হতে দেখাই যায় না তেমন।


অস্বস্তি নিয়ে একদিন বলেছিলেন, “আমরা যতদিন আছি, ততদিন অন্তত শাড়ীর সাথে ব্লাউজ পরতে পারেন!”
শুনে সে কী হাসি রাধার! “আমি তো আপনার স্বামীকে সবসময় এড়িয়েই চলি। ব্লাউজ পরার দরকার কী?”
খাঁটি সত্য কথা। এরপর কিছু বলতেও বাঁধে। দীপিকাও মনে খচখচানি নিয়ে চুপ করে গিয়েছিলেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, চুপ করে থাকাটা বোকামি ছিলো।

মুশতাককে আরো নজরে রাখার দরকার ছিলো।

৫)
রাতে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়ে গেলো মুশতাক-দীপিকার। মুশতাক কেনো এই বাড়ী ছেড়ে যেতে চাচ্ছেন না বা কেনো ওঁর উপন্যাস দেড় সপ্তাহেও শেষ হলো না, তার কারণ দর্শাতে গিয়ে দীপিকা রাধাকে টেনে আনলেন। রাধার যৌবনে মুশতাক আটকা পড়ে গেছেন বলে টিটকারিও মারলেন। কিন্তু মুশতাক কোনো প্রতিবাদ করলেন না।

স্ত্রীকে মিথ্যে বলার প্রয়োজন নেই। এখন রহস্যহীন দীপিকাকে অসহ্য লাগে তাঁর। বদলে উদ্ভিন্ন যৌবনা, রহস্যময়ী রাধা পূজনীয় বস্তু।

সকাল বেলায়ই দীপিকা বাচ্চাকে নিয়ে এক কাপড়ে বের হয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে অভিশাপ দিয়ে গেলেন মুশতাককে।

যে সাপিনীর জন্য দীপিকাকে অস্বীকার করলেন, সেই সাপিনীর দংশনেই মরবেন উনি।
আড়াল থেকে সবই দেখলেন বন্ধুর ভাই। দেখেও চুপ করে রইলেন। নিজের ছোটো বোনকে তিনিও খুব ভয় পান। যার পোষা প্রাণী একটা শঙ্খচূড় সাপ, তাকে ভয় না পাওয়াটা বোকামি।



৬)
দীপিকা যাওয়ার পর মুশতাক প্রতিদিনই খোলা দেখতে পান রাধার ঘর। প্রতি সন্ধ্যায়ই তিনি রাধার খোলা দরজা ধরে দেখতে থাকেন কৃষ্ণের পূজা।
ধূপ, ধূনা আর প্রদীপের আলোয় রাধার ছোট্ট ঘরটা অদ্ভুত এক মায়ায় পরিণত হয়। ছোট কৃষ্ণমূর্তিটা যেন রাধার মন্ত্রোচ্চারণে জীবন্ত হয়ে উঠে। আর মুশতাকের আরাধ্য মুহূর্তটা আসে তারপরই।

রাধা একে একে খুলতে থাকে আঁচল, খুলতে থাকে কোমরে জড়ানো শাড়ী। প্রতিদিনই অবাক বিস্ময়ে মুশতাক দেখতে থাকেন রাধার শরীর। কৃষ্ণকে কীভাবে রাধা উৎসর্গ করে তার যৌবন, কীভাবে কৃষ্ণের লীলাখেলার সাথী হয় সে, তা নেশাগ্রস্তের মতো দেখেন। আর এতেই পেয়ে যান পুলক। রাধার শীৎকারে অন্ধকার হয়ে আসে তাঁর জগত।

মুশতাক হয়ে যান কৃষ্ণ। কল্পনায় উপগত হন রাধার উপর। দরজায় দাঁড়িয়েই।

ঠিক এই সময়টায় কখনো বাড়ীতে থাকেন না দাদা। কে জানে, হয়তো বোনের পাগলামি সহ্য করতে না পেরেই!

৭)
দিনকে দিন উপন্যাস লেখা লাটে উঠে মুশতাকের।

সারাদিন উনি মগ্ন থাকেন রাধাতে। দুপুরে কোনোদিন রান্না করেন, কোনোদিন না খেয়েই সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়ে দেন। টের পান না ক্ষুধার অনুভূতি। বিধবা রাধা কেনো সব ফেলে শুধু কৃষ্ণকে নিয়ে আছে, এ রহস্যের কিনারা করতে না পেরে ছটফট করেন। অল্পবয়সে স্বামীহারা হয়ে স্বামীর জন্য বরাদ্দকৃত প্রেম কাউকে দিতে না পেরে কৃষ্ণকে বেছে নিয়েছে কিনা, ভেবে চলেন।

নাহলে কেনো রক্তমাংসের মুশতাককে ফেলে মাটির ঐ মূর্তি নিয়েই এতো আদিখ্যেতা ওর? নাকি নিজের নাম রাধা বলে কৃষ্ণকেই বানাতে হবে আরাধ্য পুরুষ?

এর মাঝে একদিন দীপিকার চিঠি এলো। সকল রাগ ভুলে বেচারা মুশতাককে অনুরোধ করেছে শহরে চলে আসতে, অভিশপ্ত রাধার কাছ থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু মুশতাক কুচি কুচি করে সে চিঠি ভাসিয়ে দিয়েছেন পুকুরের জলে। আর ঐ জলে স্নান করে রাধা কামনায় পাগল করেছে তাঁকে।

“দাদা, আজ আমি বাড়ী ফিরছি না।

পাশের গ্রামে যাবো। আসতে আসতে কাল সকাল। আপনি কি একা থাকতে পারবেন?”
বন্ধুর ভাইয়ের কথায় উদাসীন মুশতাক শুধু মাথা নাড়লেন। আদৌ তাঁর মাথায় কিছু ঢুকলো কিনা বোঝা গেলো না।

সেদিন সন্ধ্যায় রাধা প্রথমবারের মতো মুশতাকের ঘরে এলো।

মেয়েটার বেশভূষা কখনোই পরিপাটী নয়। আঁচল যেন খসে খসে পড়ে। চুল যেন কখনোই আঁচড়ানো নয়। কিন্তু রূপের ছটায় এগুলো কোনো অপরাধই মনে হয় না মুশতাকের কাছে। রাধা এসে এক বাটি নারকেল-মুড়ি দিয়ে বললো, “খেয়ে নিন।

আজ রাতে আপনাকে সাজাবো আমার কৃষ্ণ। পূজো দেবো মাঝরাত অব্দি। জাগার জন্য পেট ভরা দরকার। ”
মুশতাক শিহরিত হয়ে উঠলেন। আজ তিনি কৃষ্ণ আর রাধা হবে তাঁর রাধা? গোগ্রাসে মুড়ি খেয়ে উনি স্নান সেরে ফেললেন।

কৃষ্ণমূর্তির জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে পুলকিত হলেন বারবার।

৮)
পূর্ণিমার রাত।
হলুদ আলোয় ভেসে যাচ্ছে জমিদার বাড়ী। নারকেল গাছের দেয়াল ভেদ করে রাধার ঘরে ঢুকছে চাঁদের আলো। নারকেল পাতার নকশা কেটে বসে যাচ্ছে কৃষ্ণের বেদীতে।

মুশতাক বসে আছেন সেখানে। রাধা তাঁকে যত্ন করে বসিয়ে রেখে গেছে। দরজা দিয়ে শীতল হাওয়া ঢুকে রোম দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে শরীরের।
একটু পর রাধা এলো। ঘিয়া জমিন লাল পাড়ের গরদ শাড়ীতে রাধাকে চকমকি পাথরের মতো লাগছে।

আরও কিছু কি করেছে মেয়েটা? ঘোর লাগা অবস্থায়ও লেখকের পর্যবেক্ষণ দৃষ্টি জেগে উঠলো। খুঁজতে লাগলো ব্যতিক্রম কিছু। হ্যাঁ, আজ রাধা টিপ দিয়েছে। লাল টকটকে টিপটা যেন কালীর জিভ হয়ে ভেংচি কাটছে মুশতাককে।
না না, এ তো সিঁদুর! বিধবা হয়ে ও সিঁথিতেও সিঁদুর দিয়েছে? কী পরিকল্পনা রাধার? আজ কি ও প্রেমিকা নয় বরং বৌ হয়ে পূজো দেবে কৃষ্ণের?

আর বেশীক্ষণ নয়।

মুশতাক রাধার আরতি পাওয়ার মধ্যেও চরম পুলকের কথা চিন্তা করতে লাগলেন। আর কিছুক্ষণ পরই রাধা ভেঙ্গে ফেলবে কাপড়ের বাধা। কাপড় নামক এই বাহুল্যের কোন মানেই হয় না। ভাবতে থাকেন মুশতাক। শরীরের মতো সুন্দর জিনিস আসলে দেখার জন্যেই।

সিন্দুকে তালা মেরে রাখার মতো রেখে ঢেকে রাখার জিনিস নয় মোটেই।

এই তো!
এসে পড়েছে সেই মুহূর্ত। ধূপ ধূনার রহস্যময় জগতে হারিয়ে যেতে যেতেও নিজেকে প্রস্তুত করেছেন মুশতাক এই মুহূর্তটির জন্য। আজ আর দরজা ধরে নয়, আজ আর রাধার পাশ থেকে নয়, আজ একদম সামনে থেকে দেখবেন রাধাকে। সামনাসামনি মুশতাক উন্মোচিত করবেন রাধার রহস্য।


এই তো রাধা খুলতে শুরু করেছে আঁচল। মুশতাক বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইলেন আরাধ্য নারীদেহের দিকে। অনুভব করলেন রক্তের গরম হয়ে উঠা। হঠাৎ টের পেলেন রাধা জড়িয়ে ধরেছে তাঁকে। চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিচ্ছে কপাল, গাল, গলা।

মুশতাক বুঝে গেলেন, আজ রাধা স্বমেহন করবে না। আজ সে সত্যিকার অর্থেই কৃষ্ণকে বিলিয়ে দিতে চায় নিজের যৌবন। বোঝাতে চায় তার ভালোবাসা। পরিষ্কার হয়ে গেলো রাধার বৌ সাজার কারণ

অধিক উত্তেজনায় মুশতাক ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন রাধাকে। চড়ে বসলেন রাধার উপর।

রাধা খিলখিল করে হেসে দিলো। কৃষ্ণকে তো সে এভাবেই চেয়েছিলো! এতো কামুক আর ভালোবাসাময়। বৃদ্ধ স্বামী যা দিতে পারেনি, দেবতা মদন সেটা চুকিয়ে দেবেন এই আশায়ই না এতদিন ধরে অর্চনা করেছে মূর্তির! রাধার প্রার্থনা শুনে কোনো এক পুরুষের বেশে খালি প্রাসাদে আসবেন তিনি, নেশাগ্রস্ত হয়ে যাবেন রাধার যৌবনে, মিটিয়ে দেবেন রাধার পিপাসা। এইটুকুই তো চেয়েছে ও।
কিন্তু এ কী? রাধার যৌবনে হাত রাখতে না রাখতেই মুশতাক গুঙিয়ে উঠলেন।

গরম তরলে ভাসিয়ে দিলেন রাধার শরীর। হতভম্ব রাধার কয়েক মুহূর্ত লাগলো সামলে উঠতে। আর তারপরই তীব্র ঘৃণায় ও ছিটকে পড়লো পাশে। অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে রইলো পরাজিত এক সৈনিকের দিকে। অক্ষম এক ব্যক্তির দিকে।

কৃষ্ণ হওয়ার অযোগ্য এক পুরুষের দিকে।

“বেরিয়ে যান! বেরিয়ে যান এক্ষুণি। ” রাধার চিৎকারে ক্লান্ত মুশতাক ঘোলা চোখে চাইলেন। সাথে সাথে শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা এক স্রোত নেমে এলো উনার। রাধার হাতে ধরা শঙ্খচূড় সাপটি ফণা উঁচিয়ে প্রস্তুত, প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে চোখে।


“বেরিয়ে যান নতুবা আমার শঙ্খচূড়ের খাবার বানাবো ঐ অকর্মণ্যকে!” রাধার হিসহিসানিতে মুশতাক হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কাপুরুষের মতো টলতে টলতে দৌড় লাগালেন সুপুরি বাগানের দিকে।

ঐদিক দিয়েই চলে গেছে শহরে যাওয়ার রাস্তা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।