আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আড়িয়াল বিলের ইতিকথা

...বর্ষায় দিগন্ত বিস্তৃত আড়িয়াল বিলের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট গল্পের মত ভেসে থাকে ছোট ছোট গ্রাম। বর্ষার পলিমাখা জল শুকিয়ে গেলে বিলের নিচু জমিতে ধানের ক্ষেত সারা বছর রং বদলায়। এক সময় বিলের জলে হাত ডুবিয়ে ইচ্ছে করলে মুঠি মুঠি মাছ তুলে আনা যেত। নানা জাতের অসংখ্য মাছ, সাপ, কুমির, ঘড়িয়াল, কাছিম, শুশুক, ডলফিন, কাঁকড়া ব্যাঙ, জোঁক, পোঁকা-মাকড়, পাখি, শিয়াল, বাগডাসা, বেজি, শাপলা, কচুরীপানা, হিজল গাছ আর অগণিত জাতের পোকা-মাকড়ের এক মহা জীব-বৈচিত্রের রাজ্য ছিল এ বিলে। ‘কড়কড়া ভাত আর সরপড়া পুঁটি অথবা কই পাতরি’; খাইয়া মাছের ঝোল, শুইয়া রমণীর কোল--আনন্দে বলো হরি হরি বোল’; ‘মাগুর মাছের ঝোল--নব যুবতীর কোল--আর হরি হরি বোল’--এ রকম নানা কথা, নানা ছড়া এক সময় এ বিলের পাড়ায পাড়ায় প্রচলিত ছিল।

আজ ধীবর বা কৈবর্ত জাতের জেলেরা ভাল নেই; ভাল সেই আড়িয়াল বিলের মানুষ। আজ যেন, শুধুই অংকিত কোন বিলের ছায়া! আর যদি কথিত বিমান বন্দর গড়ে উঠে তাহলে এ বিল হবে হাস্যকর, অবিশ্বাস্য কোন রুপকথা! এক সময় ভাগ্যকুল, বালাশুরের কুন্ডুরা বিক্রমপুরের সবচেয়ে ধনী পরিবার ছিল। বাংলার নবাব খুশী হয়ে এদের অতি সন্মানীত ‘রায়’ উপাধী প্রদান করেন। সেই সময় কুমার প্রমথ নাথ রায় অবিভক্ত বঙ্গদেশের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন। ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক ১৯১৯-২০ সালের দিকে এ বংশের ধনকুবের কুমার প্রমথনাথের কাছ থেকে বিরাট অংকের ঋণ গ্রহণ করে।

অবিভক্ত বাংলার প্রতি জেলাতে, এমনকি বিহারের কোথাও কেথাও এই বংশের জমিদারী ছিল। এই বংশের যোগ্য সন্তান পঙ্কজ রায় এক কালে ক্রিকেটের জগতে এক নম্বর ব্যাটসম্যান ছিলেন। ভিনু মানকর ও পঙ্কজ রায় জুটি একবার একত্রে ৪১৩ রান তুলেছিলেন। ভাগ্যকুলের রায়েরা ছিলেন জাতে তিলি, টাইটেলে কুন্ডু--এদের বলা হত সৎশুদ্র। এক কালে এরা খুব গরিব ছিল।

প্রচলিত মিথ আছে--এদের এক পূর্ব পুরুষ নদী পথে চলতে হঠাৎ দেখেন, নদীর পাড় ভাঙ্গার সাথে সাথে বিশাল অট্রালিকা ভেঙ্গে পড়ছে, আর ভাঙ্গা দেওয়ালের সংগে সংগে জলে পড়ছে বিক্রমপুরের বিখ্যাত রাজা বল্লাল সেনের গুপ্তধনের ভান্ডার --অজস্র সোনার মোহর আর রৌপ্য মুদ্রা, তারপর...। কৃঞ্চজীবন কুন্ডু--রামচন্দ্র রায়--গঙ্গাপ্রসাদ--গুরু প্রসাদ, হরিপ্রসাদ, চৈতন্যপ্রসাদ ও প্রেমচাঁদ প্রসাদ--মধুরামোহন, প্যারীমোহন , কিশোরীমোহন, গোপীমোহন, বৈকুন্ঠমোহন, শ্রীনাথ, সীতানাথ, রাজা জানকীনাথ--কুমার প্রমথনাথ, রমেন্দ্রনাথ--যদুনাথ রায়, প্রিয়নাথ রায়: এই বংশ ধারার মধ্যে রামচন্দ্র প্রথম রায় উপাধী লাভ করেন; শ্রীনাথ ও জানকী নাথ ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ‘রাজা’ উপাধী লাভ করেন; শ্রীনাথের পুত্র প্রমথনাথ ‘কুমার’ উপাধী লাভ করেন। শুরুতে এদের বসতি ছিল বিক্রমপুরের নুরপুর গ্রাম, পদ্মার ভাঙ্গনে এরপর আওয়াল গ্রাম, হাতারপাড়া গ্রাম, সবশেষে ভাগেরকুল (ভাগ্যকুল) ও রাঢ়িখালের বালাশুর গ্রাম। ১৮৭৪-৭৯--এ সময়ে ভাগ্যকুলের প্রাসাদ পদ্মার করাল গ্রাসে হারাতে থাকলে, আড়িয়াল বিলের ধারে বালাশুর গ্রামে সীতানাথের দুই পুত্র যদুনাথ ও প্রিয়নাথ নতুন প্রাসাদ গড়ে তোলেন। জমিদারী, মহাজনি, জাহাজের ব্যবসা ইত্যাদি করেই তাদের এত সমৃদ্ধি।

বালাশুরের এই প্রাসাদ, রাজকর্মচারীদের বসতি আর জনপথের নিরব চিহ্ন দেখে রাঢ়িখালের কৃতি সন্তান ডঃ হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, বিলের ধারে প্যারীস শহর। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন্ বিজ্ঞানী আচার্য স্যার জগদ্বীশ চন্দ্র বসুর বাড়ী এ বিলের রাঢ়িখাল গ্রামে। তার বাড়ী এখন বসু ইন্সটিউট ও কলেজ। তাদের পাকা ঘরটি এতদিন যাদুঘর হিসাবে ছিল। যে কোন দিন ভেঙ্গে যেতে পারে এই কারণে যাদুঘরটি পূর্ব দিকে নব নির্মিত একতলা পাকা ঘরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এখানে তার বেতার তরঙ্গ, গাছের প্রাণ আছে ইত্যাদি গবেষণার ডকুমেন্ট, তার নানা সময়ের ছবি এবং তার পরিবারের ছবি প্রদর্শন করা হয়েছে। হাজার বছরের মনীষী--যার মেধা আর মননে মানুষ আর ধর্ম সত্যিকারভাবে প্রকাশ পায়। আমাদের দু’ শতাধিক সুহৃদের দলটির ভাগ্য অতি সুপ্রসন্ন বলতে হয় কারন, হুমাযুন আজাদের কবর দেখতে দেখতে আমরা যখন চোখ বন্ধ করে তার লেখায় ভাসছি তখনি চোখ খুলে দেখি তার অনুজ মন্জুর কবীর মাতিনকে। কথা হয় হুমায়ুন আজাদের নানা সময়ের নানা বিষয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে। চমৎকার তার কবরবেদী--যে বইটির জন্য তার অসময়ে চলে যাওয়া--সেই বই এর মত নকশার মাঝে চির শায়িত মুক্ত চিন্তার পথিকৃত।

...  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.