আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিটি আছে করপোরেশন নেই

'কবে যে সিটি করপোরেশনের শেষ সেবা-সুবিধা পেয়েছি, তা ভুলেই গেছি। ঢাকায় এখন সিটি আছে, করপোরেশন নেই। সব ধরনের নাগরিক সেবা লাপাত্তা। শুধু ট্যাঙ্ দেওয়ার ক্ষেত্রেই সিটি করপোরেশনের অস্তিত্ব দেখতে পাই, অন্য কোথাও নয়। '

সিটি করপোরেশনের সেবা-সুবিধা পাওয়া নিয়ে ক্ষোভের সঙ্গেই কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর শহীদবাগ এলাকার বাসিন্দা বদরুল আমিন রিপন।

নিজের বাড়ির সামনের ভাঙ্গাচুরা, খানা-খন্দকে পূর্ণ প্রধান রাস্তা দেখিয়ে তিনি জানান, বছরের পর বছর ধরে এভাবেই পড়ে আছে রাস্তাটি। সেখানে গত ৫/৭ বছরেও বিন্দুমাত্র সংস্কারের প্রলেপ পড়েনি। সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তার অস্তিত্ব হারিয়ে রীতিমতো সে াতবাহী খালে পরিণত হয়। যেখানে-সেখানে পড়ে আছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, চার পাশে দুর্গন্ধের ছড়াছড়ি। কোথায় করপোরেশনের লোক? কারও চেহারাও তো দেখা যায় না।

শুধু রাজারবাগ, শহীদবাগ এলাকাতেই নয়, সিটি করপোরেশনের কর্মকাণ্ডের বেহাল চিত্র রাজধানীর সর্বত্রই বিদ্যমান। ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করার পর থেকেই শুরু হয়েছে বিশৃঙ্খল ও অচলাবস্থা। বিভক্ত সিটি করপোরেশনে জনপ্রতিনিধি না থাকায় নাগরিক সেবা স্থবির হয়ে পড়ছে। মশক নিধন, রাস্তাঘাট সংস্কার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কোনো কাজেই গতি নেই। নাগরিক-সেবা নেই বললেই চলে।

বছরজুড়ে চলছে রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ির কাজ।

অন্তঃহীন দুর্ভোগ ভোগান্তিতে রাজধানীর বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। সমাধানহীন সমস্যাদির পাহাড় জমে জমে রীতিমতো নাগরিক দুর্যোগের সৃষ্টি হয়েছে, চলছে বিপর্যস্ত জীবনযাত্রা। ঘন ঘন লোডশেডিং, গ্যাস স্বল্পতায় টিমটিম করে জ্বলে চুলা, পানির জন্য চলছে কারবালার হাহাকার। ঘর থেকে বেরুলেই আরও শতেক জঞ্জাল-যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হয়।

দুঃসহ যানজটে রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকাই থাকে অবরুদ্ধ। রাস্তাঘাট-অলিগলি পচাগলা দুর্গন্ধময় পানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। জলাবদ্ধতা বহু মহল্লার স্থায়ী দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা, উৎকট দুর্গন্ধের ছড়াছড়ি। এত সমস্যা, এত ভোগান্তি মাথায় নিয়ে ঢাকায় মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে সে প্রশ্নে কারও ক্ষোভের কারণ থাকার কথা নয়।

রাজধানীর জীবনযাত্রায় 'বিশেষ মান' নিশ্চিত করা দূরের কথা, ঢাকায় বেঁচে থাকাটাই এখন রোজকার লড়াই। প্রধান প্রধান রাস্তার ওপরে যেন সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে রীতিমতো ময়লা-আবর্জনার হাটবাজার বসানো হয়েছে। একেকটি স্থানে ৭/৮টি করে কন্টেইনার টার্মিনাল বসিয়ে অলিগলি, বাসাবাড়ির ময়লা আবর্জনা তুলে এনে সেসব কন্টেইনার ডাস্টবিনে রাখা হচ্ছে। ব্যাপারটি অনেকটা ঘরের ময়লা রাস্তায় প্রদর্শনের মতো। কুড়িল-মালিবাগের প্রগতি সরণির বারিধারা ও মধ্যবাড্ডা এলাকায় এ ধরনের দুটি ময়লার বাজার আছে ঠিক রাস্তার মধ্যখানেই।

নাগরিক দুর্ভোগ পদে পদে : স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছ থেকে সহজেই নাগরিকত্বের সনদ, জন্মসনদ, ওয়ারিশ সনদসহ প্রয়োজনীয় সনদ সংগ্রহ করতে পারতেন নগরবাসী। ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় এসব সনদ পেতে যেতে হচ্ছে দূরের আঞ্চলিক কার্যালয়ে। ধরনা দিতে হয় দিনের পর দিন। লাগে বাড়তি টাকাও। সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে এ বিড়ম্বনার কথা শোনারও কেউ নেই।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) রয়েছে মোট ৩৬টি ওয়ার্ড। এসব দেখভালের জন্য আছে ৫টি আঞ্চলিক কার্যালয়। ডিএনসিসির সচিব আবু সালেহ শেখ বলেন, 'নাগরিকদের পরিপূর্ণ সেবা দেওয়ার জন্য আন্তরিকভাবেই কাজ করছেন কর্মকর্তারা। কিন্তু ৩৬ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সেবা পাঁচজন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা কতটা দিতে পারবেন, তা সহজেই বোঝা যায়। ' অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) রয়েছে ৫৮ ওয়ার্ড।

ওই এলাকার বাসিন্দারাও মাত্র ৫টি আঞ্চলিক অফিস থেকে সেবা পান। দক্ষিণ ঢাকার কামরাঙ্গীরচর, সুলতানগঞ্জসহ ডিসিসিতে নতুন সংযুক্ত এলাকাগুলোর বাসিন্দারা কোনোরকম নাগরিক সেবা পাচ্ছেন না। তবে এই বাসিন্দাদের ওপর ডিসিসির বাড়তি কর চাপানো হয়েছে ঠিকই। বেহাল রাস্তাঘাট : প্রধান প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলির রাস্তাঘাট পর্যন্ত ছোট-বড় খানাখন্দে ভরা। মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ নগরবাসী।

জন্ম, মৃত্যু, নাগরিক সনদ কোনোটাই পাওয়া যায় না টাকা ছাড়া। অনিয়ম-দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। জনদুর্ভোগ উঠেছে চরমে। কর্মকর্তা-কর্মচারী, মূল দায়িত্বে থাকা প্রশাসকেরও কোনো জবাবদিহিতা নেই, নেই দায়বদ্ধতা। সরেজমিন রাজধানীর সবুজবাগ, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা, গুলশান-বনানী, তেজগাঁও এলাকা ঘুরে অধিকাংশ ওয়ার্ডের বেহাল দশা দেখা গেছে।

সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি হয়েছে রাস্তাঘাটের। জনচলাচলের প্রতিটি রাস্তা ভেঙেচুরে একাকার, দু-চার ফুট অন্তর ছোট বড় খানা-খন্দক-বিপজ্জনক গর্ত। বেশিরভাগ এলাকায় গত ১০ বছরে রাস্তার সংস্কার না হওয়ায় পিচঢালাই উঠে চষা জমির আকৃতি ধারণ করেছে। রাস্তার স্থানে স্থানে ম্যানহোলের ঢাকনাগুলো ফাঁকা রয়েছে। ভাঙা রাস্তা, ময়লার স্তূপ, জলাবদ্ধতা, মশার উৎপাতসহ নানা সমস্যার বিষয়ে নগরবাসী অভিযোগ করলেও কোনো ফল মিলছে না।

গ্যাস সংকটে ত্রাহি ত্রাহি : রাজধানীর খিলগাঁও, গোড়ান, বাসাবো, পরীবাগ, শাহবাগ, মগবাজার, রামপুরা, উত্তরখান, দক্ষিণখান এলাকায় গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় বাসিন্দাদের রান্না করতে হয় গভীর রাতে। রাত ছাড়া গ্যাসের দেখা মেলে না। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় আছে বহুতল ভবনের বাসিন্দারা। যারা যত উঁচুতে থাকেন গ্যাস সমস্যা ভুগছেন তারা প্রত্যেকেই।

পরীবাগ এলাকা একটি বহুতল ভবনের ১২ তলার বাসিন্দা সায়েদুল হক। তিনি পেশায় টাইলস ব্যবসায়ী। তিনি জানান, গত দুই মাস ধরে বোতল গ্যাস দিয়ে রান্নার কাজ চালাচ্ছি। একে তো গ্যাস নেই। আর গ্যাস থাকলেও তার চাপ (গতি) কম থাকায় উপরের লাইনে গ্যাস পাওয়া যায় না।

বাসাবো পাটোয়ারী গলির বাসিন্দা ফাল্গুনী আক্তার এই প্রতিবেদককে জানান, গ্যাস নেই তাই গভীর রাত জেগে রান্নার কাজ সারতে হয়। রাত জেগে রান্না করি। দিনের বেলায় বিদ্যুৎ থাকায় গরমে ঘুমাতে পারি না। পুরনো ঢাকার রহমতগঞ্জ লেন, নারিন্দা, মুসুরিখোলা, জেলখানা রোড, তাঁতীবাজার, শাঁখারিবাজার, কাজী আলাউদ্দিন রোডে সারা দিনই গ্যাস সরবরাহ থাকে, কিন্তু চুলা জ্বলে টিমটিম করে। তিতাস সূত্র বলেছে, গত ৫/৬ দিন যাবৎ গ্যাস সংকট তেমন একটা ছিল না- নগরবাসীর তরফ থেকে ব্যাপক অভিযোগও আসেনি।

তবে নগরীর মিরপুর, পল্লবী, ক্যান্টনমেন্ট ও বনানীসহ যেসব এলাকায় পুরনো পাইপ লাইন রয়েছে সেসব মহল্লাতেই পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ যাচ্ছে না।

পানি নিয়ে নাকাল জীবন : ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, জলাশয় দখল, ওয়াসা কর্তৃপক্ষ নতুন পাম্প বসানোর জায়গা না পাওয়ায় বেশিরভাগ স্থানে পানির লাইনগুলো পুরনো হওয়ায়, পাইপ লাইনে ফাটল, এক পানির লাইনের সঙ্গে স্যুয়ারেজ লাইনের সংযোগ এক হওয়ায় ঢাকার মানুষ প্রতিদিনই পানি সংকটে ভুগছে। ব্যবহার করতে হচ্ছে দুর্গন্ধ পানি। মহাখালী ও আশপাশের মানুষ পানি সংকটের প্রতিবাদে জানিয়ে রাস্তায় আন্দোলন করে। এর আগে থেকে শহরের বেশিরভাগ মানুষই নিজ নিজ অবস্থান থেকে পানি সংকটের প্রতিবাদ করে আসছে।

ধানমন্ডির বাসিন্দা মাসুদ পারভেজ জানান, ড্রেনের পানি ওয়াসার লাইনে ঢুকিয়ে দেওয়ায় ওয়াসার লাইন দিয়ে দুর্গন্ধযুক্ত পানি বের হচ্ছে। এ পানি ফুটালেও দুর্গন্ধ দূর হয় না। সবুজবাগের মুগদাপাড়া, বাসাবো, আহমেদবাগ, মায়াকাননসহ আশপাশের মহল্লায় পানি সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। বাসিন্দারা বলেন, দিনে ও রাতে বড়জোর দুই দফায় এক ঘণ্টা করে পানি সরবরাহ পাওয়া গেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। পাইপ লাইনে ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত পানির সরবরাহ যাচ্ছে বাড়িঘরে।

বসবাস যখন মশার সঙ্গে : তীব্র গ্যাস ও পানি সংকটের সঙ্গে মশার উপদ্রব নগর জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। মশার উপদ্রব বাড়লেও মশা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না। মশা দমন, মশক প্রজননস্থল-যেমন ডোবা, নালা, বিল, ঝিল, নর্দমা ইত্যাদিতে নিয়মিত কীটনাশক ছিটানোর কথা থাকলেও সেসব বিষয় সিটি করপোরেশন শুধু বক্তৃতা, সেমিনার, লিফলেটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। মাঠ পর্যায়ে গত ৭/৮ মাসেও অনেক এলাকার মানুষ মশক নিধনের কোনো কার্যক্রম দেখতে পাননি। উত্তরা আজমপুরের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, 'মশার জন্য কেউই কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

আমাদের এই এলাকায় মশা এত বেশি যে মশার কয়েলেও কোনো কাজে আসে না। তা ছাড়া মশার কয়েলও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নকল-দুই নম্বর। মশা তাড়াতে জ্বালানো কয়েলের ওপরই মশাগুলোকে বসে থাকতে দেখা যায়। ' উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, 'মশার সঙ্গেই বসবাস আমাদের- মশার সঙ্গেই আছি। এলাকায় দেড়-দুই বছরেও মশার ওষুধ ছিটানোর নজির দেখতে পাচ্ছি না।

সন্ধ্যা হতে না হতেই ঝাঁক ঝাঁক মশা ৫/৬ তলা পর্যন্ত উঠে আসে-একযোগে আক্রমণ শুরু করে। '

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.