আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোটা সিস্টেম



বাংলাদেশে যে হারে মানুষ বাড়ছে, তাতে ফাঁকা জায়গার পরিমাণ ক্রমেই কমছে। খুব ছোটবেলায় আমাদের পাড়ায় মাঠের কোন অভাব ছিল না। ছোট বড় মিলিয়ে মোট মাঠের সংখ্যা ছিল ছয়টি। বিকেলে সেখানে ক্রিকেট/ফুটবল খেলা হতো। শীতের রাতে হতো ব্যাডমিন্টন।

তুলনামূলক বড় মাঠগুলোতে বসতো বিভিন্ন ক্রীড়া টুর্নামেন্ট।
শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে আসতে আসতেই পুরো পাড়ায় একটিও মাঠ অবশিষ্ট থাকলো না। আমরা ভাগ্যবান, বড় মাঠে খেলার যে কী আনন্দ, সেটা আমরা উপভোগ করতে পেরেছি!
ঢাকায় অনেক আগেই 'মাঠ' বিলুপ্ত ঘটেছে। সেখানে বাচ্চাকাচ্চারা অপেক্ষা করে কবে হরতাল দিবে, তাহলে রাস্তায় ক্রিকেট খেলা যাবে! আর নাহলে বড় বড় এপার্টমেন্টের ইনডোর গেমসরুমই ভরসা!
কাউকে কাউকে দেখেছি ছাদেও ক্রিকেট খেলতে। কিন্তু দুইমিনিট পরপর বল নিচে পড়ে গেলে খেলার মজা কতটুকু থাকে?
'প্রয়োজন কোন আইন মানেনা,' স্কুলে শেখা প্রবাদবাক্যটি আমরা বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে ক্রিকেট খেলার আইনই পাল্টে দিলাম।


ক্রিকেটে শুধু পীচের সাইজই হচ্ছে বাইশ গজ। বাউন্ডারীর হিসাব বাদ থাকুক। আমরা বাইশ গজেরও কম জায়গায় আস্ত ক্রিকেট খেলা নামিয়ে দিলাম। নিয়মও বিচিত্র, অফ এবং লেগ সাইডে বল ডিরেক্ট বাউন্ডারী ওয়ালে লাগলে দুই রান, গড়িয়ে গেলে এক। সোজা ডিরেক্ট লাগলে চার, গড়িয়ে লাগলে দুই।

পিছনে ওয়ালে আঁকা স্ট্যাম্প। ব্যাটের কোনায় লেগে যদি পেছনের ওয়ালে বল লাগে, তাহলে "কট বিহাইন্ড!" সবচেয়ে বিরক্তিকর ছিল বল যদি বাউন্ডারির বাইরে চলে যায়, তাহলে আউট! এবং যে ফেলেছে, তাকেই দেয়াল টপকে নিয়ে আসতে হতো।
বিরক্তির এখানেই শেষ না, আরেকটা নিয়ম ছিল যে যেহেতু পীচ ছোট, সেহেতু খুব জোরে বল করা যাবেনা, করলে নো বল। এর ফায়দাটাই ব্যাটসম্যানরা নিত। আউট হলেই বলতো, "বল জোরে ছিল! খুবই ফাস্ট হয়েছে বল! বিশ্বাস কর! আল্লাহর কসম!"
আরও কিছুক্ষণ ব্যাট করার জন্য সরাসরি আল্লাহকে ধরে টানাটানি!
বোলারও তখন আল্লাহর কসম খেয়ে বলতো, "আমি মোটেও জোরে বল করিনি।

এইটাই এই ওভারের সবচেয়ে স্লো বল ছিল!"
খুবই হাস্যকর কাজকারবার! ধরা যাক টেন্ডুলকার শোয়েব আখতারের বিখ্যাত ইয়র্কারে বোল্ড হলেন। অমনি তিনি দাঁড়িয়ে আম্পায়ারকে প্রিতিবাদ জানালেন, "হবে না, বল বেশি ফাস্ট ছিল! আল্লাহর কসম!"
ক্রিকেটের এই শর্ট ভার্সনকে আমরা ডাকতাম "শর্টজ্। "
শর্টজ্ ক্রিকেট খেলার কুফল আমরা হাতে নাতে পেলাম।
একদিন ঈশান এসে খুব গর্বের সাথে বলল তার এক বন্ধুর সাথে সে কথা বলে ফেলেছে। তাদের কলোনির মাঠে গিয়ে আমরা ফ্রেন্ডলী ম্যাচ খেলে আসবো।


খুবই ভাল প্রস্তাব! অনেকদিন বড় মাঠে খেলা হয়না, হাত নিশপিশ করছে! সানন্দে রাজি হলাম।
খেলার দিন দেখা গেল আমাদের শর্টজ্ ক্রিকেটের মহা মহা তারকারা একের পর এক ফ্লপ মারছেন। এখানেতো কমপ্লেইন করতে পারেনা, "বল বেশি জোরে ছিল!"
ছক্কা মারায় অনভ্যস্ত ব্যাটসম্যান রান তুলতে পারছে না। বোলাররা জোরে জোরে হাত ঘুরাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই বল ফাস্ট হচ্ছে না! ওরা আমাদের তুলোধুনো করে দিল!
শুধু মাত্র আমার এবং ইকবালেরই ছিল বড় মাঠে খেলার অভিজ্ঞতা। আমরা দুইজনেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এবং খানিকটা চৌর্য্য বৃত্তি করে ম্যাচ জিতিয়ে দিলাম।

চৌর্য্য বৃত্তির ঘটনা ব্যখ্যা করা যাক।
ষোল ওভারের খেলা ছিল। ওদের ছিল চার বোলার, তাই ওভার লিমিটেশন ছিল প্রতি বোলার চার ওভারের বেশি বল করতে পারবে না।
আমাদেরও চার বোলার। কিন্তু দুই বোলার তাদের প্রথম ওভারেই এমন মার খেলো যে তাদের দিয়ে আরও তিন চার ওভার করালেই ম্যাচ আর জেতা হতো না।


আমি এবং ইকবাল টানা বোলিং চালিয়ে গেলাম। ওরা ওভার লিমিট নিয়ে প্রশ্ন তুললে আমরা বললাম, "আমাদের আগে বলা হয়নি কোন লিমিটেশন আছে! এখন নতুন নিয়ম করলে কিভাবে হবে?"
ওরা ভদ্রলোক, ওরা ঝামেলা করেনি।
এই পুরো গল্প থেকে একটা বিষয় শেখা হল। বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে "কোটা ব্যবস্থা" থাকাটা ক্ষতি ছাড়া লাভ করেনা। কারও ভিতরকার সেরা পারফরম্যান্স বের করে আনতে প্রতিযোগীতার কোন বিকল্প নেই।

সেটা ক্রিকেট হোক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হোক, অথবা চলচ্চিত্র। শাহ জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন সিলেটিদের জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু করা উচিৎ না, তেমনি চলচ্চিত্রেও কোন কোটা ব্যবস্থা থাকা উচিৎ না।
শুনলাম বাংলাদেশ সরকার নাকি ভারতীয় সিনেমা আনার পরিকল্পনা করছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রবোদ্ধারা প্রতিবাদে হারেরেরে করে উঠেছেন। তাঁদের কথা, এতে নাকি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প একদম ধ্বংস হয়ে যাবে! তাঁরা বলছেন বাংলা চলচ্চিত্রের বাজেট কম।

একশো কোটি টাকা বাজেটের সিনেমা ফেলে কেউ এক কোটি টাকায় বানানো সিনেমা দেখতে যাবেনা।
যুক্তি সুন্দর! কিন্তু এখানে আমার একটা কথা ছিল। আমাদের দেশে সেই পাকিস্তান আমল থেকেই ভারতীয় চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ। তাহলে তাঁদের যুক্তি অনুযায়ী আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্প বিকশিত হবার কথা! কিন্তু সেটা কী ঠিক মতন হয়েছে? উল্টো আমরা পেয়েছি, "সিড়ির তলে বিড়ির দোকান" "খাইয়া ফালামু" "দে চুম্মা" জাতীয় সিনেমা। বলিউডের সিনেমার একদম কার্বন কপি সিনেমাগুলো, 'শিল্পের' সাথে যাদের দূর দূর পর্যন্ত কোন সম্পর্ক নেই।

খাবার না পেলে মানুষ ডাস্টবিন ঘেটেও খায়। আমাদেরও সেসব সিনেমা হজম করতে হয়েছে!
সিনেমা হলে মানুষকে ফেরাতে হলে আগে ভাল গল্প নিয়ে সিনেমা বানাতে হবে। তারপরে বাজেট নিয়ে ভাবনা। মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর "টেলিভিশন" ভাল, নাকি ঋত্বিক রোশনের "কৃষ?" ভাল রুচির মানুষ চোখ বন্ধ করে বলবেন, "টেলিভিশন!"
নায়কের বাবাকে নায়িকার বাবা শৈশবে মেরে ফেলেছে। নায়ক বড় হয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে।

অথবা কোটিপতি শিল্পপতির কন্যা নিজের "ডেডির" সব সম্পদের মায়া ত্যাগ করে ভালবেসে ফেলেছেন আদর্শবাদী ও বস্তিবাসী নেতা নায়ককে! এসব কাহিনী হলে দুইশো কোটি টাকা বাজেটের ছবি হলেও মানুষ পাত্তা দিবে না।
"চোরাবালি" যদি একই সাথে "ইয়ে যাওয়ানি হ্যায় দিওয়ানির" সাথে চলতো, মানুষ কী বুঝতে পারতো না কোন সিনেমা দেখা উচিৎ?
"ভাগ, মিলখা ভাগ!" কী আমাদের দেশের মানুষের বড় পর্দায় দেখার ইচ্ছে জাগেনি? তাদের কী সেই সৌভাগ্য থাকা উচিৎ ছিল না?
হুমায়ূন আহমেদ স্যার তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন, তিনি ভয় পাননা ভারতীয় চলচ্চিত্রকে। বরাবরের মতই তাঁর যুক্তিও ছিল সুন্দর। তাঁর সিনেমা যদি ভাল হয়, মানুষ এমনিতেই দেখতে যাবে। যদি ভাল না হয়, তাহলে যাবেনা।


এফডিসির কিছু মেধাহীন পরিচালক ভারতীয় সিনেমাকে ভয় পাবেন, এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর মতন পরিচালক কেন ভয় পাচ্ছেন? করণ জোহরের থেকে কী তিনি বেশি মেধাবী নন? তাঁর সামনে ডেভিড ধাওয়ান দাঁড়াবার যোগ্যতা রাখে?
কম্পিটিশনের প্রয়োজন আছে। উত্তম সুচিত্রার সাথে লড়তে হয়েছিল বলেই আমাদের দেশে রাজ্জাক কবরীর জন্ম হয়েছিল। আমরা যখন বুঝবো আমাদের লড়তে হবে রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা, সঞ্জয় লীলা ভানসালি, রাজকুমার হিরানীদের সাথে, তখন আমাদের দেশেও জন্ম নিবে একেকজন অভিষেক কাপুর, অনুরাগ কশ্যপের মতন ডিরেক্টরেরা। নাহলে আমাদের ভাগ্যে যুগের পর যুগ ধরে জুটতে থাকবে, "ঘাড় ত্যারা" " রিটার্ণ অফ সিড়ির তলে বিড়ির দোকান" "দে চুম্মা - ২" জাতীয় সিনেমা।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.