আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিঙ্গাপুরে

আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল

সেইবার সিঙ্গাপুরে যাওয়ার জন্য, সাশ্রয়ের কথা ভেবে টিকেট কেটেছিলাম এয়ারইন্ডিয়ার। তবে পরে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছি, আসলে সাশ্রয়ের কথা ভাবলে, যাত্রা-পরবর্তী মানসিক অবস্থা, সুস্থতার দিকটাও বিবেচনায় আনা উচিৎ। আর তারপর আবারও ভেবে দেখা দরকার- আদতেই সাশ্রয় হল কিনা। এয়ারইন্ডিয়ার বিমানবালাদের আচরণ দেখলে মনে হয়, তাদেরকে যেন জোড় করে কাজ করানো হচ্ছে; আর সেই জোরজবরদস্তিটি আর কেউ না, করছে যাত্রীরা। তাই ভীষণ ক্ষিপ্ত তারা যাত্রীদের উপর।

সেই থিমটিকে সফল করতেই যেন, তারা পথিমধ্যে খেতে দিয়েছিল শুকনো দুটো রুটি, সাথে ভাজির মত দেখতে কি যেন একটা পদ, টিনের ভেতর দীর্ঘ দিন ধরে পরে ছিল জাতীয় চেহারার দুটো বিস্কুট, পানি আর এইই! অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। তুলনাহীন! বাংলাদেশ বিমানের খাবারও এর চেয়ে কমপক্ষে হাজার গুণ ভাল। তবে শুনেছি এয়ার ইন্ডিয়ার সেই সার্ভিসটি নাকি বন্ধ হয়ে গেছে বাংলাদেশ থেকে।

যাহোক, সিঙ্গাপুর ভ্রমণ আমার জন্য প্রথম কোনও উন্নত-দেশ ভ্রমণ না হলেও, বিমানবন্দর চেঙ্গিতে নেমে যখন শহরে বেরিয়ে এসেছিলাম, আমি চমকে গিয়েছিলাম। একটি উন্নত দেশের রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার, যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদি সাধারণত যেমনটা হওয়া উচিৎ, সিঙ্গাপুরের এই সমস্ত ঠিক তেমনই- কিন্তু সেখানে স্বতন্ত্র যে বিষয়টি চোখে পড়ার মত, তা হল, প্রযুক্তির পাশাপাশি গাছপালার প্রতি তাদের গভীর অনুরাগ।

গোটা সিঙ্গাপুর শহরটিই যেন একটি বাগান; পরিকল্পিতভাবে রোপণ করা বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালায় ভরা। ফ্লাইওভার, ওভারব্রিজগুলোর নিচ, রাস্তার দুপাশ, ফুটপাথের কিনার বরাবর, নির্দিষ্ট করে রাখা খালি জায়গা, এছাড়া যেখানে তারা বিন্দু মাত্র সুযোগ পেয়েছে, নানা রকমের ফুলের- পাতাবাহার গাছপালা রোপণ করে তৈরি করেছে অপূর্ব সুন্দর সব বাগান। রাস্তার ডিভাইডারগুলোর মাঝখানে লাগানো গাছপালা, যত্নে করা পাতাবাহারের ঝোপগুলোর কারণে ইট-কাঠ-কংক্রিটের তৈরি ডিভাইডারগুলোর কঠিন শরীর বেশীরভাগ স্থানে সম্পূর্ণভাবে ঢাকা পড়ে গেছে। কোনও কোনও জায়গায় লতাগাছের ঝোপগুলোকে নিয়ন্ত্রণের ভেতর রেখেও এত উঁচু করে বেড়ে উঠার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে যে সেগুলোর কারণে কোথাও কোথাও এক পাশের রাস্তা থেকে অপর পাশের লাগোয়া রাস্তাটা পর্যন্ত আড়াল হয়ে গেছে। স্পষ্টতই শহরের সৌন্দর্য বর্ধনে নিয়োজিত কর্মকর্তারা সিঙ্গাপুরকে একটি বাগানের শহর থেকে, বাগানের ভেতর গড়ে উঠা একটি শহরে রূপান্তর করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে।



শহরের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত বিষয়ে আইনগত দিক থেকে সিঙ্গাপুরের চেয়ে কঠোর দেশ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে এজন্য সবাই যে খুব খুশি তা নয়! সবাই কি আর নিয়মকানুন-জোরজবরদস্তি ভালবাসে? পাবলিক টয়লেটগুলো ব্যবহারের পর ফ্ল্যাশ না করা, রাস্তায় থুথু, ময়লা-আবর্জনা ফেলা, যত্রতত্র সিগারেট খাওয়া জাতীয় অকর্মগুলো রুখতে মোটা অংকের আর্থিক (ক্ষেত্র-বিশেষে শারীরিক শাস্তির) জরিমানার খড়গ ঝুলিয়ে রেখেছে তাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সিঙ্গাপুরে তন্নতন্ন করে খুঁজলেও এক প্যাকেট চুইঙ্গাম খুঁজে পাওয়া যাবে না; কারণ তা ড্রাগের মতই, সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

আমার সেই সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে আমি ঘুরতে গিয়েছিলাম সিঙ্গাপুরের একটি ছোট্ট দ্বীপ সেন্তুসায়। অদ্ভুত সুন্দর সেন্তুসার সমুদ্র সৈকত! কোথাও ঝরঝরে বালুর বেলাভূমি, কোথাও পাথর দিয়ে বাঁধানো পাড় যেখানে চুপচাপ বসে, নোনা হাওয়া খেতে খেতে দেখা যায় ধু ধু জলরাশির দিগন্তে স্থির হয়ে ভেসে থাকা জাহাজ, ভারী নারকেল গাছের সাড়ির পটভূমিতে বিচ-ভলিবল খেলায় মত্ত নারীপুরুষ, তাদের ঘিরে দৌড়ে বেড়ানো শিশুদের, চোখে পড়ে মৃদুমন্দ ঢেউয়ের, নীলাভ বর্ণের স্বচ্ছ পানিতে সাঁতারুদের অক্লান্ত সাঁতার।

সমুদ্র তীরে গাছের দীর্ঘ সব ছায়ায় শান্ত, নিয়মিত ছেঁটে সমান করে রাখা সুন্দর ঘাসের মাঠগুলোতে অনেকে চাদর বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে প্রশান্তির সময় কাটায়। পার্কটিকে ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য সেন্তুসার ভেতর খোলা বাসের ব্যবস্থা আছে। সেটি ঘণ্টা বাজিয়ে বাজিয়ে পুরো এলাকাটাকে চক্কর কাটে আর পর্যটকরা নির্ধারিত স্থান থেকে তাতে চড়ে বসে পুরো পার্কটিকে ঘুরে দেখতে পারে। সন্ধ্যার পর সেখানকার একটি উন্মুক্ত মঞ্চে ‘সং অব দ্যা সি’ নামক একটি নাটক দেখানো হয় যেটা মূলত লেজার রশ্মি, আগুন আর পানির বিস্ময়কর সব কারসাজিতে পরিপূর্ণ। পানির ফোয়ারার উপর আলো ফেলে তারা সৃষ্টি করে অদ্ভুত সব অবাস্তব, রূপকথার চরিত্র।

হয়ত পাহাড়কে দিয়ে কথা বলায়, কীটপতঙ্গের মত প্রাণীকে দিয়ে গান গাওয়ায়! আলো ফেলে রং বদল করে করে পানির ফোয়ারাকে বাদ্যের তালে তালে নাচিয়ে বিভিন্ন মহনীয় তরঙ্গ, জল-আকৃতি সৃষ্টির মাধ্যমে অদ্ভুত সব সুন্দর দৃশ্যের জন্ম দেয়! জীবন্ত মানুষের অংশগ্রহণও আছে। শুনেছি বছরের পর বছর জুড়ে নাকি সেই একই নাটকই চলে ঐ মঞ্চে। হয়ত কারণ একবার যে সেই নাটক এবং আলো, আগুন ও পানির মনোমুগ্ধকর কারসাজি দেখেছে, সে নিশ্চয়ই তা বার বার দেখতে চাইবে।

সিঙ্গাপুরে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের জন্য একটি চমৎকার জায়গা হচ্ছে সিরাঙ্গুন, যা 'লিটেল ইন্ডিয়া' নামেও পরিচিত। এলাকাটি রাতদিন টুরিস্টদের আনাগোনায় মুখর হয়ে থাকে।

এখানেই আছে এশিয়ার সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় সুপার মার্কেট ‘মুস্তফা’। জনপ্রিয় হওয়ার মতই প্রকাণ্ড এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ শপিং সেন্টারটি। সিরাঙ্গুনের জনাকীর্ণ, প্রাণবন্ত রাস্তাগুলোর মোড়ে মোড়ে আছে নানান দেশের খাবারের রেস্তোরাঁ। তবে ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁর সংখ্যাই সেখানে সবচেয়ে বেশি। সন্ধ্যায় রেস্তোরাগুলোতে এত মানুষ ভিড় করে যে মাঝে মাঝে দীর্ঘ লাইন পড়ে যায় প্রবেশদ্বারের সামনে।

আর খাবার! আহা! অপূর্ব! সিঙ্গাপুরের অন্যান্য এলাকার তুলনায় খাওয়াদাওয়া, বসবাসের খরচ তুলনামূলক কম বলে অনেক বাংলাদেশী অভিবাসী এই এলাকাটিতে বসবাস করে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন রবিবারে এখানকার ছোট ছোট মাঠ কিংবা রাস্তার পাশের ফুটপাথগুলো বাংলাদেশীদের ব্যাপক সমাগমে গম গম করে। তারা মাঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে ভাগ হয়ে বসে গল্প করে, এলোমেলো হাঁটাচলা করে; কেউবা রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে কেনাকাটা করে ঘুরে ঘুরে। সস্তায় কেনাকাটা করার জন্যও সিরাঙ্গুনের জুড়ি নেই। এমন কি আক্ষরিক অর্থেই, ‘চিপেস্ট শপ অব সিঙ্গাপুর’- এই নামেও কিছু দোকান আমি দেখেছি সেখানে! তবে বাংলাদেশী শ্রমিকদের শীর্ণকায়, ক্লান্ত-ক্লিষ্ট মুখগুলো দেখলে খুব মন খারাপ লাগে! তারা কেমন সঙ্কুচিত ভঙ্গীতে চলাফেরা করে; বিদেশের সুন্দর পোশাকআশাক, গতিশীল জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করে বাংলাদেশ থেকে কিনে নিয়ে যাওয়া সস্তার কাপড় পরিধান করে কোনোরকমে থেকে, খেয়ে অবিশ্বাস্য অনাড়ম্বর জীবন যাপন করে।

আর মাস শেষে আয়ের বেশীরভাগটা তারা পাঠিয়ে দেয় দেশে। গ্রামীনফোনের সেই যে কমার্শিয়ালটা, যেখানে ছেলে ফোনে তার ব্যাকুল মাকে আশ্বস্ত করে এই বলে যে, সে গাড়িতে চড়ে কাজে যায়, কিন্তু দৃশ্যে দেখা যায় একটি হেলমেট পরে ট্রাকের পেছনে বসে সে চলেছে। সিঙ্গাপুরেও এই দৃশ্য চোখে পড়ে।

মাত্র পাঁচদিন পর যখন বাংলাদেশে ফিরে এলাম, পাঁচ দিনের সন্ন্যাসী- আমার দেশটাকে দেখতে বড় ধুসর, মলিন, অগোছালো, রুক্ষ মনে হল; তবে মুক্তও মনে হল অনেক! মনে হল যেন পাঁচ দিন পর বুক ভরে শ্বাস নিলাম! ধরতে পারলাম না, অনুভূতিটা এমন কেন? কি চাই তাহলে? নিজের দেশকেই চাই কিন্তু উন্নত, আধুনিক, আরও সভ্য অবস্থায় চাই?


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।