আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অভ্র ও একজন মেহদী!

মনে আছে একটা সময় ছিল কম্পিউটারে বাংলা লেখাকে মনে হতো এভারেস্ট জয়ের সমান। বিজয় ইনস্টল করা ছিল, বাংলা কী-বোর্ড দুইটা প্রিন্ট করা রাখা ছিল। বাংলা প্রিন্ট করা কী-বোর্ডও পাওয়া যেত। কখনো দরকার হলে অনেক কষ্টে দেখে দেখে বানান করে করে বাংলায় লিখতাম। খুব জরুরি আর বড় কিছু হলে নীলক্ষেত থেকে কম্পোজ করিয়ে প্রিন্ট করিয়ে আনতাম।


আস্তে আস্তে সময় বদলালো, অনলাইনে বাংলা ব্লগ এলো। ফেসবুক এলো। মানুষের লেখা মুগ্ধ হয়ে পড়ি আর ভাবি এরা কীভাবে বাংলায় লেখে? প্রাচীন আমলের সেই বাংলা ব্লগাররও কীবোর্ড মুখস্থ করেই লিখতেন- বিজয় নাহলে অন্য কিছু দিয়ে। তাদেরকে মনে হতো "ওয়াও! কী মারাত্মক সব লোকজন"!! বাংলা লেখার ভয়ে ইংরেজি বা বাংলিশ বা বাংরেজি ভাষায় ফেসবুকে/ইমেইলে/মেসেঞ্জারে বা অন্য কোথাও লেখা হতো। আস্তে আস্তে অভ্র নামক ফোনেটিক বাংলা লেখার সফটওয়ারের কথা শুনি।

কিন্তু নিশ্চয়ই খুব জটিল কিছু হবে এই ভয়ে অভ্র ব্যবহার থেকে বিরত থাকি। এরপর খুব সম্ভব ২০০৭/০৮ সালের একদিন প্রিয় ছোটভাই তানভীর খান আমাকে ইয়াহু মেসেঞ্জারে গুঁতা দিয়ে বললো, দাদা, অভ্র শিখে নেন। কথা বলতে বলতে দশ মিনিটের মাথায় দেখলাম আমি শুদ্ধভাবে বাংলায় লিখতে পারছি... !!!! হতবাক হয়ে গেলাম!!
তানভীরকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করি নাই আজও, কিন্তু সেদিন আনন্দে কী বিশাল লাফ দিয়েছিলাম মনে পড়ে! অনেকটা নিরক্ষর থেকে লিখতে-পড়তে পাড়ার আনন্দের মত... অন্ধত্ব থেকে প্রথম আলো বা রঙ দেখার অনুভূতির মতো... খুশিতে-আনন্দে সব জায়গায় বাংলায় লেখা শুরু করলাম!
ছোট বেলা থেকেই বাংলায় হালকা-পাতলা লেখালিখির দিকে ঝোঁক ছিল। কোবিতা (মাঝে মাঝে কবিতাও ), ছড়া, নাটক, চিন্তাভাবনা, চিঠি, প্রেমপত্র, প্রবন্ধ, গল্প ইত্যাদি ইত্যাদি ডায়েরীর পাতায় নাহলে চিপায়-চাপায় লিখতাম। স্কুলের বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বরও বরাদ্দ ছিল সবসময়।

কলেজেও অনেকবার বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম ক্লাসে। একসময় স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে কবি হবো! সাহিত্যিক হবো! লম্বা চুল আর পাঞ্জাবি পড়ার কারণে বুয়েটে পড়ার সময় অনেকের ধারনা ছিল আমি হয়তো বাংলা বিভাগের ছাত্র! এক বন্ধুর কবিতার বই ছাপাতে গিয়ে প্রোপোজাল পেলাম কবিতার বই বের করার... অথচ আমি কবিতার "ক" এর সামনের শুঁড়টাও জানিনা!!
যাকগে, আমার কবি হওয়া হয় নি, কবি-গল্পকার-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক-ব্লগার-শব্দশিল্পী কিছু হবার মতই প্রতিভা বা ক্ষমতা নেই, ছিলও না কোনদিন। সব বাঙালিই ভেতরে ভেতরে কবি (মাঝে মাঝে কেউ কেউ কোবি!!)। অসাধারণ সব লেখকের লেখা পড়তেই সচলায়তনে আসা। এর মাঝে অগ্রজ হিমু ভাই (হাঁটুপানির জলদস্যু), খুব প্রিয় অনুজ ইশতিয়াক রউফ আর প্রিয় বন্ধু-সহযোদ্ধা ডক্টর ফারুক হাসানের উৎসাহে সচলে পা দিই।

ইচ্ছে-স্বাধীন মত ফেসবুকে-ব্লগে-ওয়ার্ডে লিখে যাই... এবং প্রতিটি সেকেন্ডে অভ্রকে ধন্যবাদ দিই!!
মেহদী হাসান নামক ময়মনসিংহ মেডিক্যালের এক ছাত্র কী অসাধারণ কাজ করেছে সেটা এখন প্রতিটি সেকেন্ডে টের পাই। অনলাইনে বাংলাভাষাকে জীবন দান করার কৃতিত্ব এই মেহদী আর তার অভ্র দলের! দূর থেকে একসময় মেহদীকে মনে হতো কী বিশাল মানুষ!! কত অসাধারণ!! সেলিব্রিটি!! আস্তে আস্তে মেহদীর সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হয়, এবং কিছুদিনের মধ্যে আমার দেখা এই পৃথিবীতে সবচেয়ে উদারমনা-সাহসী-নিরহংকারী-নিবেদিতপ্রাণ-দেশপ্রেমিক-ভালমানুষের লিস্টে সে ঢুকে পড়ে! কাছে এসে আরও বুঝতে পারি, যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও কত বিশাল হৃদয়-কতটা হিমালয়ছোঁয়া অসাধারণত্ব এই ছেলেটার মাঝে আছে!
মেহদী যা করেছে বাংলাভাষা যতদিন টিকে থাকবে ততদিন তার কথা স্মরণ করতে হবে, অভ্রকে কৃতজ্ঞতা দিয়ে যেতে হবে। আমাদের মতো লাখে লাখে মানুষ অভ্র দিয়ে আজ বাংলায় লিখে যাচ্ছে- বিনামূল্যে-সহজে-বিনা পরিশ্রমে!! মাঝে মাঝে ভাবি, আমি যদি মেহদি হতাম, মাটির দশফুট উপর দিয়ে হাঁটতাম... অহংকারে! আর মেহদী? মাত্রাতিরিক্ত বিনয়ী-সজ্জন অসম্ভব সুন্দর মনে অধিকারী এই মানুষটি পারলে মাটির তলা দিয়ে হাঁটে!
একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে একুশে পদক দেয়া হয় বাংলাভাষায় অবদানের জন্য। অনলাইনে এর আগেও অনেক বার অনেক উৎসাহী গ্রুপ-উৎসাহী মানুষজন কিংবা কোন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কেউ কেউ মেহদীর জন্য একুশে পদকের দাবী জানিয়েছিল। কিন্তু মেহদী বরাবরই এই দাবী থেকে দূরে ছিল এবং এর ধরনের কোন পুরস্কার বা দাবীর সাথে কখনোই একমত বা আগ্রহ প্রকাশ করেনি! (ঐযে বললাম মাত্রাতিরিক্ত বিনয়ী!) কোনটির সাথেই তার কোন সম্পৃক্ততা নেই।


কিন্তু আমি আজ নতশিরে আবার বলি, মেহদীর কাছে-মেহদীর অভ্রর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। চিরকালের জন্য ঋণী! বাংলাভাষার জন্য কে কী করেছে সেই বিচারে যাবো না, কিংবা বাংলা ভাষায় কী অবদান রাখলে মানুষ একুশে পদক পায় তাও আমি জানিনা, কিন্তু বাংলাভাষার ইতিহাসে অভ্র এবং মেহদী অমর হয়ে থাকবে।
It is an honor to know you, Mehdi! Salute!

সোর্স: http://www.sachalayatan.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.