আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন মৃত মানুষের কাহিনী!

আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে একে দেব পদচিহ্ন/ আমি স্রষ্টা-সূদন, শোকতাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন সত্যি বলতে কি, এতটা রক্ত আমি আশা করিনি। আমি ভেবেছিলাম আমার মানসিকতার মত রক্তের পরিমাণটাও হবে নিরতিশয় ক্ষুদ্র। যখন ভাঙ্গা কাচের টুকরোটা দিয়ে ধমনীটা কেটে ফেললাম, তখন এত কিছু খেয়াল করিনি। তখন আমার সমগ্র সত্ত্বা জুড়ে ছিল এক তীব্র প্রশান্তি। কোন মানবিক অনুভূতি এতটা তীব্র হতে পারে বলে আমার জানা ছিল না।

সকল সুখ থেকে মুক্ত পাবার সুখ; সকল বেদনা থেকে মুক্তি পাবার বেদনা; সকল প্রশান্তি থেকে মুক্তি পাবার প্রশান্তি; সকল যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার যন্ত্রণা। এখন পর্যন্ত ঘরের কেউ বুঝতে পারেনি। সম্ভবত, কাচ ভাঙ্গার শব্দটা শুনতে পায়নি। যেহেতু, শুনতে পায়নি সুতরাং, উদ্বিগ্ন হবার কোন কারণ নেই। আব্বুর সাথে রাগ করে এভাবে আমি আগেও বহুবার দরজা বন্ধ করে দিয়েছি।

এটা দুশ্চিন্তা করার মত কোন বিষয় না। হয়তো, দু’এক ঘণ্টা পরে আম্মু আসবে আমার রাগ ভাঙ্গাতে। ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে সাধাসাধি করবে খাবার জন্য। শেষ পর্যন্ত যখন আমি কিছুতেই খেতে রাজি হব না, তখন আম্মুও খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেবে। অগত্যা, খেতে হবে।

ঘটনাগুলো ঘটার কথা ছিল এভাবেই। কিন্তু, সামান্য একটু স্খলন। ঘটনাগুলো আর কখনও এভাবে ঘটবে না। হয়তো, আজকেও আম্মু ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে দরজায় ধাক্কাধাক্কি করবে। যখন কিছুতেই দরজা খোলা হবে না, তখন দরজা ভাঙ্গা হবে।

তারপর? তারপর আম্মু যখন আমার রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখবে তখন তার অনুভূতি কেমন হবে? আমি যখন না খেয়ে থেকেছি, তখন আম্মুও খায়নি। এখন যখন আমি আমার ধমনীর রক্তকে স্ব-পথচ্যুত করেছি, আম্মুও কি তাই করবে? নাহ! আম্মু তা করবে না। করতে পারবে না। তাকে তার আরও দু’টি সন্তানের জন্য বেঁচে থাকতে হবে। মানুষের জীবনের সবথেকে শ্বাপদসংকুল অংশ হচ্ছে তার কৈশোর।

সেটাকে যে সফলভাবে অতিক্রম করতে পেরেছে, সে সফল। জীবন তারই জন্য। যে পারেনি, সে ব্যর্থ। তার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। আমি একজন ব্যর্থ মানুষ।

আমি অনধিকার চর্চা করতে চাইনি। আমি করিনি। নীরবে জীবনের পাট চুকিয়ে দিয়েছি। এক টুকরো ভাঙ্গা কাঁচে ছোঁয়ায় এত বড় মুক্তি লুকিয়ে আছে কে জানত? আত্মহত্যাটা যে প্রথম চেষ্টাতেই করে ফেলেছি, তাও না। কখনও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম, কখনও বা সাহস হয় নি।

কখনও দশ তলা বিল্ডিংয়ের কিনারায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি। ভেবেছিলাম খানিকটা পা হড়কে গেলেই... হয়নি। কখনও একগাদা ঘুমের ওষুধ ধরে বসে থেকেছি। খাবার মত সাহস হয় নি। কখনও ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়ার কথা মাথায় এসেছে।

পরে মনে হয়েছে ওটা মেয়েলী ব্যাপার। আমার মৃত্যুর মাঝেও পুরুষত্ব থাকবে। আমি একটু একটু করে রক্তের ধারাটাকে বয়ে যেতে দেখব। আমার মাঝে কোন অস্থিরতা থাকবে না। বাঁচার কোন আকুতি থাকবে না।

অবশেষে আমি তা করতে পেরেছি। দরজার ওপাশে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেছে। আমি আর পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারছি না। আমি চাইছি মহাবিশ্বের নিকষ নীরবতা। আমাতে এসে ভর করছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জট।

অসহ্য! মাথা থেকে দুর করতে চাইছি কিন্তু, পারছি না। আমার অবস্থাটা এখন শ্রোডিঞ্জারের বিড়ালের মত। দরজার ওপাশে অবজারভার হিসেবে আম্মু দাঁড়ানো আছে। এখন আমি একই সাথে জীবিত এবং মৃত। যখন আম্মু দরজা খুলবে তখন আমার তরঙ্গ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাবে।

একটা বহন করবে আমার জীবিত অংশ অন্যটা আমার মৃত অংশ। আমি দ্বিতীয় অংশে পড়েছি। এখন আমার অপেক্ষা অবজার্ভেশনের জন্য। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অবজারভার আমাকে না দেখলেও আমি কিন্তু, আমার অবজারভারকে ঠিকই দেখছি। বুঝতে পারছি না বিষয়টা।

আমার মৃতদেহ দরজার এপাশে। কিন্তু, দরজার ওপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সব আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এতক্ষণ খেয়াল করিনি, আমি আমার মৃতদেহটাকেও দেখতে পাচ্ছি। যে দু’টো রংকে আমি সবথেকে ঘৃণা করি তা হচ্ছে, বেগুনী আর লাল- বর্ণালির একেবারে দু'পাশের অংশ। তাই ডান হাতটা দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। অন্য দিকে চোখ ফেরাতে চাইছি কিন্তু, পারছি না। কারণ, আমি আমার চোখ দিয়ে দেখছি না। বিষয়টা এখনও আমার কাছে অস্বাভাবিক। হয়তো মৃতের জগতে এটাই স্বাভাবিক।

মৃতরা সবাই আমার মত পেছনে কি হচ্ছে না হচ্ছে সবকিছু দেখতে পায়। ভুল বললাম। আমার এখন সামনে পেছনে বলতে কিছু নেই। দরজার এপাশ বা ওপাশ বলতে কিছু নেই। দরজার ওপাশে থাকা আম্মুর আতঙ্কিত মুখকেও আমি দরজার এপাশে বলতে পারি।

আমি এক স্থানে আবদ্ধ থেকেও বলতে পারি, দরজার নিচ দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া আমার রক্তপ্রবাহ দেখে আম্মু পাগলের মত দৌড়ে গিয়ে আব্বুকে বলল, ‘রবিনের দরজাটা যেভাবে পার খোল। ’ আম্মু হিস্টিরিয়াগ্রস্থ রোগীর মত কাঁপতে লাগল। আব্বু দৌড়ে এসে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে। ছোট ভাই ঘরের এক কোণায় দাড়িয়ে রইল। তার চোখে কোন এক অজানা আশঙ্কা।

সে জানে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে। কিন্তু, জানে না কি ঘটেছে। আব্বু-আম্মুর বিছানা থেকে ছোট বোনটা সমানে কেঁদে চলেছে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পারছে না। এমন সময় কাঁদতে হয় না।

একটু পরেই দরজা ভেঙ্গে গেল। আব্বু ভেতরে ঢুকে খানিকক্ষণ হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর, সাথে সাথে বাইরে গিয়ে আম্মুকে জাপটে ধরল যেন আম্মু ভেতরে ঢুকতে না পারে। আমি নিজেই আমার মৃতদেহটাকে সহ্য করতে পারছি না। এতগুলো রক্ত দেখে বীভৎস একটা অনুভূতি হচ্ছে।

আম্মু কি করে সহ্য করবে? কিন্তু, আব্বু শেষ পর্যন্ত আর আম্মুকে ধরে রাখতে পারল না। আম্মু পাগলের মত আমার ওপর আছড়ে পড়ল। কেউ খেয়াল করল না কিন্তু, আমি বুঝতে পারলাম আম্মু জ্ঞান হারিয়েছে। অপরাধীর সুরে বললাম, ‘আমি দুঃখিত আম্মু। কিন্তু, বিশ্বাস কর আমার আর করার মত কিছুই ছিল না।

আমি একজন পরাজিত মানুষ। একজন পরাজিত মানুষের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। আমারও ছিল না। আমি সত্যিই দুঃখিত। ’ সে কথা কেউ শুনতে পেল না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.