আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মধ্যযুগের মুসলিম সভ্যতার কালজয়ী নিদর্শন: ক্যালিগ্রাফি বা লিপিকলা

"" যে দুর্বিনীত, সে ভালো কথা বলতে পারে না" কনফুসিয়াস ।

খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইসলাম ধর্মের অভ্যুদয়ের পর আরব উপদ্বীপের সীমানা পেরিয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে প্রায় তিন মহাদেশ জুড়ে। মধ্য এশিয়া থেকে উত্তর আফ্রিকা হয়ে পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয় সুবিশাল মুসলিম সাম্রাজ্য। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যে তখন দুনিয়াজুড়ে মুসলমানদের জয়জয়কার। মধ্যযুগে কয়েক শতাব্দী ধরে ক্যালিগ্রাফি মুসলিম শিল্পকলার অন্যতম প্রধান শাখা হিসেবে গড়ে উঠেছিল।

বিশ্বব্যাপী শিল্পকলার ইতিহাসে মধ্যযুগের ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি আজো এক অনন্য স্থান দখল করে রেখেছে।
ইংরেজি ‘calligraphy’ কথাটি এসেছে গ্রীক শব্দ ‘kalligraphia’ থেকে, যা ‘kallos’ (সৌন্দর্য) ও ‘graphein’ (লেখা)-এর সমন্বয়ে গঠিত। সুতরাং একে বাংলায় নান্দনিক হস্তলিখন পদ্ধতি বা সংক্ষেপে লিপিকলা বলা যেতে পারে। মানবেতিহাসে লিখিত ভাষার জন্মের সমান্তরালেই লিপিকলার জন্ম হয়েছিল। প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক্সের নান্দনিক শিলালিপি আজও সে সাক্ষ্য দেয়।

আর ইসলামী লিপিকলার জন্ম ও প্রসার ঘটেছিল ইসলাম ধর্মের জন্ম ও প্রচারের পাশাপাশি। বস্তুত আরবি ভাষায় লিখিত মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কুরআনের অনুলিপি তৈরি ও প্রচারের প্রয়োজনেই ইসলামী লিপিকলা বিকশিত হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে এর ব্যবহার কেবল ধর্মপ্রচারের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং মুসলিম স্থাপত্য, সিরামিক, কাঁচ ও মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প, বয়নশিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমে এই লিপিকলা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।


আরবি বর্ণমালা ব্যবহৃত হওয়ার কারণে সাধারণভাবে এই লিপিকলাকে আরবি লিপিকলা (Arabic calligraphy) বলা হয়। তবে মধ্যযুগে চীন থেকে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত মুসলিম সাম্রাজ্যে আরবি ছাড়াও ফারসি, উর্দু, তুর্কি, উজবেক, কাজাখসহ বিভিন্ন ভাষা লেখার ক্ষেত্রে আরবি বর্ণমালা ব্যবহৃত হত বলে এটিকে ইসলামী লিপিকলা বলাই বেশি যুক্তিসঙ্গত।

ইসলামের প্রথম যুগে কুরআন লিপিবদ্ধ করার কাজে কুফীয় (Kufic) ধাঁচের আরবি হস্তলিপির উদ্ভব ঘটে। এই লিখনপদ্ধতিতে আরবি হরফের আকৃতি জ্যামিতিক, জমকালো ও আলংকারিক ধাঁচের হওয়ায় মধ্যযুগের মুসলিম স্থাপত্যকলায়ও এর বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী পর্যন্ত কুফীয় হস্তলিপির প্রাধান্য বজায় ছিল। বর্তমানে ইরান ও ইরাকের পতাকা এই হস্তলিপি ধারণ করছে।
বিভিন্ন শাসনামলে মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত হয়েছে দামেস্ক, বাগদাদ, ইস্ফাহান, ইস্তাম্বুলসহ বিভিন্ন শহরে।

বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় সাম্রাজ্যের শাসকগণের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতার ফলে এসব শহর পরিণত হয়েছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের একেকটি প্রাণকেন্দ্রে। ইসলামী লিপিকলার বিকাশ ও বিবর্তনও ঘটেছে তাই বিভিন্ন শাসনামল ও রাজধানীকে কেন্দ্র করে। উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসনামলে কুরআন লিখন ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে আরবি বর্ণমালার ব্যবহারের প্রয়োজনে নাস্‌খ, তালিক, নাস্তালিক, মুহাক্কাক, রিকাহ্‌, দিওয়ানি, ইত্যাদি বিভিন্ন ধাঁচের হস্তলিপির উদ্ভব হয়। সর্বশেষ উসমানীয় শাসনামলে ইসলামী লিপিকলার চরম উন্নতি ঘটে। বিভিন্ন ধাঁচের আরবি হস্তলিপির সাথে অ্যারাবেস্ক (arabesque) নামক জ্যামিতিক নকশা ব্যবহার করে নকশাবিদরা নান্দনিক লিপিকলা সৃষ্টি করতেন।

মধ্যযুগের নামকরা মুসলমান ক্যালিগ্রাফারদের মধ্যে ইবনে মুকলাহ্‌, ইবনে আল বাওয়াব, ইয়াকুত আল মুস্তাসিমি, মীর আলী তাবরিজি, শেখ হামদুল্লাহ্‌ ও হাফিজ উসমান অন্যতম।
ইসলামী লিপিকলার চর্চায় মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন জিনিস ব্যবহৃত হয়েছে। মুসলিম সাম্রাজ্যে কাগজের ব্যবহার শুরু হওয়ার আগে কুরআন লিপিবদ্ধ করার কাজে প্রথমদিকে প্যাপিরাস ও পার্চমেন্ট ব্যবহৃত হত। উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়ায় প্রাপ্ত সোনা ও রূপার কালি দিয়ে নীল রঙের পার্চমেন্টে কুফীয় হস্তলিপিতে লেখা খ্রিস্টীয় নবম-দশম শতাব্দীর ফাতেমীয় আমলের বিশ্ববিখ্যাত ‘নীল কুরআন’ (The Blue Qur’an)-এর একটি পৃষ্ঠার ছবি নিচে দেওয়া হল।



পরবর্তীতে কুরআন লেখার কাজে কাগজের ব্যবহার শুরু হলে তা ইসলামী লিপিকলার ক্ষেত্রেও বিপ্লব ঘটায়।

ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মাদ (সা)-এর হাদিস ও তাঁর প্রতি প্রশংসাবাণী লেখার কাজেও লিপিকলা ব্যবহৃত হত। বিশেষ করে উসমানিয়া শাসনামলে রাসুলের হাদিস ও প্রশংসাবাণীর নান্দনিক প্রকাশের ব্যাপক চর্চা হয়েছিল। নিচে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে উসমানীয় শাসনামলে লিখিত কুরআনের একটি পাতা এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে উসমানীয় শাসনামলে রচিত একটি রাসুলের প্রশংসাবাণীর ছবি দেওয়া হল।





ইসলামী লিপিকলার আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যবহার ছিল ধাতব মুদ্রা তৈরিতে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে মুসলমান খলিফাগণ সোনা ও রূপার মুদ্রায় মানুষ কিংবা প্রাণীর ছবির বদলে লিপির ব্যবহার চালু করেন।

সে যুগের বিভিন্ন মুসলিম সাম্রাজ্যের মুদ্রায় সাধারণত কুরআনের বাণী ও অন্যান্য ধর্মীয় কথা উৎকীর্ণ থাকত। নিচে তিনটি ভিন্ন মুসলিম সাম্রাজ্যের তিনটি ধাতব মুদ্রার ছবি দেওয়া হল। প্রথমটি উমাইয়া খলিফা হিশামের ৭২৯-৭৩০ খ্রিস্টাব্দের রূপার দিরহাম, দ্বিতীয়টি মোগল সম্রাট শাহজাহানের ১৬২৮-১৬২৯ খ্রিস্টাব্দের সোনার মোহর এবং তৃতীয়টি উসমানীয় খলিফা ৩য় আহমেদের ১৭২৫-১৭২৬ খ্রিস্টাব্দের সোনার জার-ই-মাহবুব নামক মুদ্রা। সময়ের সাথে মুদ্রাগুলোর মান ও লিপিকলার উৎকর্ষের দৃষ্টান্ত লক্ষ্যণীয়।


মধ্যযুগের মুসলমানরা নানা রকমের ব্যবহার্য জিনিসপত্রেও লিপিকলার নান্দনিক প্রয়োগ ঘটিয়েছিল।

নিচে দেখানো যথাক্রমে ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত উসমানীয় আমলের তলোয়ার, পঞ্চদশ শতাব্দীতে পারস্যে নির্মিত লোহার শিরস্ত্রাণ, দ্বাদশ শতাব্দীতে পারস্যে নির্মিত ব্রোঞ্জের দর্পণ, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মিশর অথবা সিরিয়ায় নির্মিত সোনা ও রূপার প্রলেপ দেওয়া পিতলের গামলা, চতুর্দশ শতাব্দীতে স্পেনের গ্রানাডায় তৈরি রেশম কাপড় এবং ষোড়শ শতাব্দীতে পারস্যে নির্মিত অলংকার এর সাক্ষ্য বহন করছে।













তবে ইসলামী লিপিকলার সবচেয়ে সুন্দর প্রয়োগ ঘটেছিল মুসলমানদের নির্মিত বিভিন্ন ধরণের স্থাপত্যে। বিশেষ করে মসজিদ, সমাধিসৌধ ও প্রাসাদের অলংকরণে ক্যালিগ্রাফির অসাধারণ ব্যবহার মুসলিম স্থাপত্যকলাকে একটি অনন্য ও অতুলনীয় শিল্পমাত্রা দিয়েছিল। ইসলাম ধর্মে মানুষ কিংবা অন্যান্য প্রাণীর ছবি আঁকা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই লিপিকলানির্ভর অলংকরণশৈলীর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। যেখানে খ্রিস্টানরা তাদের গির্জা সাজাত মাতা মেরী, যিশু খিস্ট বা সন্তদের ছবি কিংবা মূর্তি দিয়ে, সেখানে মুসলমানরা মসজিদের ভেতরে বাইরে অলংকরণ করত অ্যারাবেস্ক মোটিফ, লতাপাতার নকশা ও আরবি বর্ণমালাভিত্তিক অনিন্দ্যসুন্দর শিল্পকলার সাহায্যে।

নান্দনিক লিপিকলা ব্যবহার করে মসজিদের দরজা, দেয়াল, ছাদ, গম্বুজ, ইত্যাদিতে কুরআনের বাণী উৎকীর্ণ করা হত। সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত ইরানের ইস্ফাহান শহরের শেখ লুতফুল্লাহ্‌ মসজিদের অনন্যসাধারণ লিপিকলা আজও সবাইকে অভিভূত করে।





মধ্যযুগে মিনার, মাদ্রাসা, সমাধিসৌধ, ইত্যাদির অলংকরণেও ইসলামী লিপিকলার নান্দনিক প্রয়োগ ঘটেছিল। দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত দিল্লীর কুতুব মিনার ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে নির্মিত উজবেকিস্তানের সমরকন্দে অবস্থিত তৈমুর লংয়ের গোর-ই-আমির সমাধিসৌধ আজও মধ্যযুগে ইসলামী লিপিকলার চরম উৎকর্ষতার দৃষ্টান্ত বহন করছে।




একইভাবে মুসলমান শাসকগণ তাঁদের প্রাসাদ অলংকরণেও ইসলামী লিপিকলা ব্যবহার করেছেন।

চতুর্দশ শতাব্দীতে নির্মিত স্পেনের গ্রানাডায় অবস্থিত সুবিখ্যাত আল-হামরা প্রাসাদের অনুপম স্থাপত্যকলা ও ক্যালিগ্রাফির কোন তুলনাই হয়না। নিচে আল-হামরা প্রাসাদ এবং এর স্থাপত্যকলা ও লিপিকলার কয়েকটি ছবি দেওয়া হল।








মধ্যযুগের গৌরবময় মুসলিম সাম্রাজ্যগুলো আর নেই। তবে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সভ্যতার বহু কালজয়ী নিদর্শন আজও রয়ে গেছে। ইসলামী লিপিকলা বা ক্যালিগ্রাফি এর অন্যতম।



তথ্যসূত্র:
১। উইকিপিডিয়া: ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি।
২। ক্যালিগ্রাফি কালাম।
৩।

ডিসকোভার ইসলামিক আর্ট।
৪। ক্যালিগ্রাফি ইন ইসলামিক আর্ট ও অন্যান্য।

৫। আমার লেখা ব্লগ
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.