আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইতিহাসের বিকৃতি ঠেকাতে হবে

মার্চকে আমরা বলি স্বাধীনতার মাস। যেমন ডিসেম্বরকে বলি বিজয়ের মাস এবং ফেব্রুয়ারিকে বলি ভাষার মাস। এ তিনটি মাসই বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশের জন্য অনুপ্রেরণা সৃষ্টির অফুরন্ত ভাণ্ডার। এই ভাণ্ডার কোনো দিন খালি হওয়ার নয়। যতদিন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বহমান রবে, ততদিন স্রোতস্বিনী নদীর স্বচ্ছ পানির মতো বাঙালির হৃদয়ে জাগ্রত হবে নতুন নতুন অনুপ্রেরণার শত-সহস্র ধারা-উপধারা।

সেই স্বচ্ছ ও পবিত্র জলধারার অবগাহনে ইতিহাস বিকৃতকারী পেঁচার ডাকের অশুভ প্রভাব থেকে নিজেদের কলুষমুক্ত রাখবে বাঙালির অনাগত প্রজন্ম। তবে নিবন্ধের স্পেস সীমাবদ্ধতার কারণে আজ শুধু মার্চ মাসের কয়েকটি গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা প্রসঙ্গে আলোচনা করব। মার্চ মাসের প্রতিটি ঘটনাই একেকটি মাইলফলক। তার সঠিক মূল্যায়ন জাতিকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগাবে অনন্তকাল ধরে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মার্চ মাসের ঘটনাপ্রবাহকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিকৃত এবং নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে তা আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে।

কারা তা করেছে এবং কেন করেছে সেটি আমরা জানি। এই ইতিহাস বিকৃতকারী শক্তি এখন দেশের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অনেক শক্তিশালী, তাই নতুন প্রজন্মকে পেঁচার ডাকের কুপ্রভাব থেকে মুক্ত রাখার জন্য বলা কথাকে আবার বলতে হবে, অনবরত বলতে হবে। মার্চ মাস এলেই তার সঠিক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের শৌর্য-বীর্য এবং গৌরবগাথা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে।

কয়েক দিন আগে একটি প্রাইভেট টেলিভিশনে 'বিজয় দেখিনি' শিরোনামের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। ওই অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রী ছিল।

এসব ছাত্রছাত্রীর উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর কারণেই আজকের শিরোনামে উলি্লখিত বিষয়বস্তুর ওপর লিখতে আগ্রহী হয়েছি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের উত্থাপিত প্রশ্নগুলো বহুল আলোচিত হলেও পুনরায় সেগুলো উত্থাপিত হওয়ায় আমি অবাক হইনি। কারণ এখনো এ দেশের রাজনৈতিক বিভাজনটি এমন যে, এক পক্ষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, অন্য পক্ষ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। এমন কথা বিশ্বে শুধু বাংলাদেশেই শোনা যায়। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে তারা এখনো অনবরত মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথাকে বিকৃত করছে, ইচ্ছাকৃতভাবে সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত এবং জেনেশুনে সত্যকে গোপন করছে।

এটি যারা করছে তাদের চিনতে এখন আর খুব একটা অসুবিধা হয় না। তাদের জন্য এখনো একাত্তরের পরাজিত দেশ পাকিস্তানের মায়াকান্নার আর শেষ নেই। আরেকটি বড় দল, যারা একাধিকবার ক্ষমতায় ছিল, তারা এই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল কাহিনীর প্রশ্নে বরের ঘরের মাসি আর কনের ঘরের পিসির মতো আচরণ করে। টেলিভিশনের সেদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের প্রথম প্রশ্ন ছিল স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে। যদিও তাদের সঙ্গে আলোচনায় বুঝতে পারি তারা স্বাধীনতার ঘোষক আর পাঠকের পার্থক্য অনুধাবন করতে পারে।

সাড়ে সাত কোটি মানুষের একটি ভূখণ্ড, যেটি আবার বৃহত্তর একটি দেশের অংশ, যাদের ওপর রয়েছে প্রবল পরাক্রমশালী পরাশক্তির প্রত্যক্ষ সমর্থন, সেই বৃহত্তর দেশ থেকে একাংশকে ছিন্ন করে নাম বদলে বাংলাদেশ নামকরণ-পূর্বক স্বাধীনতা ঘোষণা যে কেউ ইচ্ছা করলেই যখন-তখন করতে পারে না। এরকম কেউ করলে তাকে পাগল মনে করে সেদিকে কেউ কর্ণপাত করে না। স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য প্রয়োজন ছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষের কর্তৃত্ব এবং ম্যান্ডেট। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য নির্ধারিত ১৬৭টি জাতীয় পরিষদের আসনের মধ্যে ১৬৫টি আসন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে প্রদান করে সেই কর্তৃত্ব ও ম্যান্ডেট বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিল। যার ফলে আমরা দেখেছি একাত্তরের মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলনের সময় সাড়ে সাত কোটি বাঙালি বঙ্গবন্ধুর সব আদেশ-নির্দেশ সুশৃঙ্খলভাবে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।

সামান্যতম ব্যত্যয় কোথাও ঘটেনি। সারা দেশের মানুষ, আবাল-বৃদ্ধ, ছাত্র-জনতার মধ্যে সেই কী ভয়ানক উত্তেজনা, সেগুলো মনে হলে এখনো লোম খাড়া হয়ে যায়। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সভা ইয়াহিয়া খান মার্চ মাসের ১ তারিখে স্থগিত করার পর মুহূর্ত থেকে মনে হয়েছে সমগ্র বাঙালি জাতি যেন এখনই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত। সে রকম ভয়ানক উত্তেজনা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সবাই শান্ত থেকেছে। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে মানুষ প্রহর গুনেছে বঙ্গবন্ধু কি বলেন।

একাত্তরের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের সভা স্থগিত করলে বঙ্গবন্ধু হোটেল পূর্বাণীতে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'ষড়যন্ত্র যদি আরও চলে তাহলে বাংলাদেশ নিজ প্রশ্নের মীমাংসা করে নিবে। ' পরক্ষণেই ঢাকার রাজপথে লাখো মানুষের মুখে আওয়াজ ওঠে, 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর' (দৈনিক ইত্তেফাক-২ মার্চ-'৭১)। তারপর ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। এই ইশতেহারে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে উল্লেখ করা হয়, 'সাড়ে চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার সাড়ে সাত কোটি মানুষের আবাসিক ভূমির নাম হবে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির জাতির পিতা এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড-পৃ. ৬৬৬-৬৭)।

তারপর এলো ৭ মার্চ, সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এ রকম একটি চরম মুহূর্তে, যেখানে সামান্য একটু 'স্লিপ অব টাং' ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ পরিণতি। সেখানে প্রায় ১৯ মিনিটের উপস্থিত বক্তৃতা, যার প্রতিটি শব্দ ও বাক্য ছিল ব্যাপক অর্থপূর্ণ ও গুরুত্ববাহী। বঙ্গবন্ধু বললেন, 'আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

' উপরোক্ত সামান্য যতটুকু যা বললাম তার পরেও কি স্বাধীনতা ঘোষণার খুব বেশি কিছু আর বাকি থাকে। তারপরও বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা সরাসরি দিয়ে যান ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বিডিআরের ওয়ারলেস সেটের মাধ্যমে। এ ঘোষণার বহু দালিলিক এবং পরিস্থিতির পারিপাশ্বর্িকতার অনেক প্রমাণ আছে। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চের 'দ্য টাইমস' ও 'দ্য গার্ডিয়ান' পত্রিকা, ৫ এপ্রিলের বিশ্বখ্যাত সাপ্তাহিক নিউজ উইকের প্রচ্ছদ কাহিনী, পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সিদ্দিক সালিকের লিখিত 'উইটনেস টু সারেন্ডার' গ্রন্থের ৭৫ নম্বর পৃষ্ঠা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র-১৫শ খণ্ড পৃষ্ঠা-১৯০-৯১, এসব দলিলের ওপর যে কেউ একটু চোখ বুলালে দেখতে পাবেন বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার আগ মুহূর্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সরাসরি ঘোষণা দেন। একাত্তর সালের আগস্ট মাসে কারাগারে বিচারের জন্য যে অভিযোগপত্র তৈরি করা হয়েছিল সেখানে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান ভাঙার অভিযোগে অভিযুক্ত করে বিচার শুরু করেছিল।

শেষ কথা হলো, কেউ কি একাত্তর সালের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো পত্র-পত্রিকা দেখাতে পারবেন যেখানে লেখা আছে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। কেউ কি দেখাতে পারবেন জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকতে তিনি নিজে কোথাও বলেছেন, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। দ্বিতীয় বিভ্রান্তি ছড়ানো হয় এই বলে যে, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে আরও কম ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো। এই কু-যুক্তিটি যারা তোলেন তারা হয় হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তা করেন, আর নয়তো বিশ্বের একই রকম ইতিহাস সম্পর্কে তারা কিছু জানেন না এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা সম্পর্কেও তাদের ধারণা নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধ আর বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র বিদ্রোহ_ এ দুয়ের পার্থক্য তারা বোঝেন না।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার সঙ্গে আইনগত কাঠামো আদেশ বা এলএফও (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার) ২৫ ও ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছিলেন, 'পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট যদি সংবিধান বিল অনুমোদন না করেন তাহলে জাতীয় পরিষদ বাতিল বলে গণ্য হবে এবং প্রেসিডেন্টের আদেশই হবে চূড়ান্ত এবং তা কোনো আদালতে উত্থাপন করা যাবে না। ' এসব শর্ত দেখে তখনই বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন, বাঙালির হাতে কখনো পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দেওয়া হবে না এবং বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ব্যতিরেকে আর কোনো পথ খোলা নেই। তাই তিনি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নিলেন এবং স্থির করলেন যুদ্ধ যখন করতেই হবে তখন সে যুদ্ধটা পাকিস্তানই শুরু করুক। তারপর স্বাধীনতা ঘোষণা করলে বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও মানুষ বাংলাদেশের পক্ষে থাকবে। আর স্বল্প সময়ে স্বাধীনতা পেতে হলে ভারতের যে প্রত্যক্ষ সমর্থন দরকার তা প্রদান করতেও ভারতের জন্য সুবিধা হবে।

৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের গোলা নিক্ষেপ করে এবং আকাশ থেকে বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টারের গুলিবর্ষণে সেদিন বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের সব শীর্ষ নেতা এবং জড়ো হওয়া ১০ লাখ মানুষের কমপক্ষে পাঁচ লাখ মানুষ নিহত হতেন। ওই সময় বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সেনা কমান্ডার টিক্কা খানকে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, 'আমি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ চাই না, মাটি চাই'। সারা বিশ্ব ওই একতরফা ঘোষণাকে বলত হঠকারী সিদ্ধান্ত। তখন নাইজেরিয়ার বায়াফ্রার ভাগ্যবরণ করতে হতো বাংলাদেশের মানুষকে। নাইজেরিয়ার দক্ষিণাঞ্চল বায়াফ্রার।

'জাতিগত ইগবো সম্প্রদায়' নাইজেরিয়ার বৃহত্তর অংশ থেকে স্বাধীন হওয়ার জন্য কোনো রকম গণম্যান্ডেট ব্যতিরেকে এবং আক্রান্ত হওয়ার আগেই বায়াফ্রার গণআন্দোলনের নেতা 'ওডুমেগিইউ ওজুকু' একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ১৯৬০ সালের ৩০ মে। সঙ্গত কারণেই বিশ্বের কাছে তা আখ্যায়িত হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ হিসেবে। শেষমেশ স্বাধীনতা তো বায়াফ্রার মানুষ পেলই না, উল্টো আড়াই বছরের মাথায় নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনীর কাছে সম্পূর্ণ পরাস্ত হয় এবং ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের ওপর যারা কালিমা লেপন করতে চান তারা ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার হওয়া নিয়েও বিভ্রান্তি ছড়ান। তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আত্দসমর্পণ আর স্বেচ্ছায় গ্রেফতারবরণের পার্থক্যটি আড়াল করে রাখেন।

স্বেচ্ছায় গ্রেফতারবরণকারী নিজের জীবনের বিনিময়ে জনগণ এবং জাতীয় স্বার্থকে সবকিছুর ঊধের্্ব স্থান দেন এবং নিজের দাবির প্রতি অদম্য অটল থাকেন। আত্দসমর্পণকারীর ক্ষেত্রে দেখা যায় এর উল্টোটি। তাকে সবকিছু করতে হয় যার কাছে আত্দসমর্পণ করেন তার ইচ্ছা অনুযায়ী। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দী ছিলেন। এই নয় মাস তিনি বিশ্বের সবকিছু থেকেই বিচ্ছিন্ন ছিলেন।

সংবাদপত্র বা রেডিও-টেলিভিশন কোনো কিছুই তাকে দেওয়া হতো না। তিনি পাকিস্তানিদের কাছে আত্দসমর্পণ করেননি বলেই তাকে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে ফাঁসির দণ্ডাদেশের রায় দিয়েছিল ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১। এতে বোঝা যায়, পাকিস্তানিদের আদেশ-নির্দেশ বা অনুরোধ বঙ্গবন্ধু প্রত্যাখ্যান করেছিলেন নিজের জীবনের বিনিময়ে। এখানে লক্ষণীয়_ ফাঁসির দণ্ডাদেশটি ঘোষণা করা হয় একেবারে যুদ্ধের শেষপ্রান্তে। কারণ পাকিস্তানিরা আশা করেছিল শেষ মুহূর্তেও যদি মুজিবকে দিয়ে একটা আপসরফা স্বাক্ষর করা যায়, তাহলে পাকিস্তান রক্ষা পাবে।

২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতারবরণ এবং আত্দগোপন দুটি বিষয়েরই ভালোমন্দ তিনি নিজেই বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। রাজনৈতিক জীবনের দুরূহ ও কঠিন ঘাত-প্রতিঘাতের অভিজ্ঞতার দূরদৃষ্টি দ্বারা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, গ্রেফতারের সময় যদি তাকে গুলি করে হত্যা করা হয় বা পরবর্তী সময়ে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেওয়া হয়, তাহলেও মুক্তিযুদ্ধ চলবে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। বরং তাতে স্বাধীনতা প্রাপ্তি আরও ত্বরান্বিত হবে। অন্যদিকে আত্দগোপনের চেষ্টা করলে সত্তরের নির্বাচনের পর থেকে তাকে অনুসরণকারী পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের গুলিতে তিনি নিহত হবেন। সারা বিশ্বে প্রচার হবে পাকিস্তানের একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা উচ্ছৃঙ্খল জনতা বা সন্ত্রাসী কর্তৃক নিহত হয়েছেন।

তিনি চিহ্নিত হতেন পলায়নগামী একজন নেতা হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন হয়ে পড়ত সুদূরপরাহত। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও যেন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সে দিন ২৫ মার্চ রাতে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে তিনি ছিলেন ধীর, স্থির ও লক্ষ্যে অটুট। এ জন্যই তিনি মহান নেতা, জাতির পিতা, বাঙালি জাতির কাছে চিরদিন অমর ও অক্ষয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে তার সঙ্গে কেবল তিনিই তুলনীয়। বাংলাদেশের এগিয়ে চলার পথকে গতিময় করতে হলে বঙ্গবন্ধুর এই অমর কীর্তিকে অনুপ্রেরণার উৎসস্থল হিসেবে নতুন প্রজন্মের কাছে সমুজ্জ্বলভাবে তুলে ধরতে হবে। এ রকম আরও অনেক গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা আছে যেগুলো নিয়ে এখনো বিভ্রান্তি ছড়ানো অব্যাহত আছে। সবগুলোকে একটি লেখার মধ্যে আনা যাবে না। অপশাসন বা একনায়কতন্ত্র রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর, তবে তার থেকে শতগুণ ক্ষতিকর জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের বিকৃতি।

ইংরেজদের হাতে ভারতবর্ষের যে ইতিহাস বিকৃতি সে সম্পর্কে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু একবার মন্তব্য করেছিলেন 'ব্রিটিশ শাসকরা ভারতবর্ষ দুইশ' বছর ধরে শাসন করেছে, তাতে যতটা ক্ষতি হয়েছে, তার থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে ব্রিটিশ কর্তৃক ভারতবর্ষের ইতিহাস ও জাতীয় চরিত্রকে বিকৃতির কারণে' (ইতিহাসের রক্তপলাশ আবদুল গাফ্ফার চৌধরী, পৃ-৮৪)। আজকের বাংলাদেশ সম্পর্কেও এ কথাটি আরও বড় সত্য। তাই তারুণ্যকে সত্য জানায় আগ্রহী হতে হবে এবং বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে বিকৃতিমুক্ত রাখার জন্য অবিরত সংগ্রাম জারি রাখতে হবে।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

ই-মেইল : sikder52@gmail.com

 



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।