আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্যানভাসে কতিপয় মুখ

ডায়রীর পাতা থেকে:
দু' দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই আমি। প্রথমবারের চেষ্টা প্রায়ই সফল হতে বসেছিল। যদি না হঠাৎ আমার মধ্যে মাতৃত্বের ব্যাপারটা প্রবল হয়ে না উঠতো। ঘুমের পিলগুলো খাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই যখন মনে পড়লো এই পৃথিবীতে আমি ছাড়া আমার বাচ্চাকে দেখবার কেউ থাকবে না। তখন মরিয়া হয়েই সাহায্যকারী সংশ্লিষ্ট সংস্হাকে ফোন দিয়েছিলাম।

তারপর সপ্তাহ তিনেক নানান প্রশ্ন আর তার জবাবদিহিতে এতটাই নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ি যে সে চাপ সহ্য করতে না পেরে দ্বিতীয় দফায় আত্মহত্যার চেষ্টা চালাই। এবার আর ঘুমের ওষুধ খেয়ে নয়। ভাঙাগ্লাসের টুকরো দিয়ে হাতে বার কয়েক পোঁচ দেই। আমার বাচ্চাটাকে নিয়ে গেছে সোস্যাল সাভির্সের লোকেরা। তাদের ভাষ্য সন্তান লালন পালনে আমি সক্ষম নই ।

কিছুটা অন্যভাবে বললেও সাব্বিরের মতই যেন ঘোষণা করে জানিয়ে দেয়া হলো মা হিসেবে আমি কতটা অযোগ্য। বলাই বাহুল্য আত্মহত্যার দ্বিতীয় চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। ওটা নিয়ে আর বিস্তারিত বলতে ইচ্ছে করছে না।
এমন জীবন বয়ে বেড়ানোর আর কোন মানে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। চাইলেই আত্মহত্যা করার পেছনে সাব্বিরের ভূমিকা যে অনেক গুরুতর সেটা ওদের জানিয়ে দিয়ে তাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারতাম।

কিন্তু অপ্রতিরোধ্য একটা ঘৃণা এসে আমাকে এতটাই মুঢ় করে দিয়েছিল যে এসব নিয়ে আমার কিছু বলতে ইচ্ছেই করেনি।
সবাই জানলো আমিই অপরাধী। নইলে স্বামী কেন পরিত্যাগ করে? উচ্চশিক্ষিত আর উচ্চাভিলাষী সাব্বির মনে মনে আমাদের একমাত্র কন্যা সন্তানের শারীরিক অক্ষমতার জটিল ব্যাপারগুলো বুঝলেও বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারেনি। তাই মুক্তির পথ বেছে নেয়। সব দায় আমার উপর দিব্বি চাপিয়ে দিয়ে সম্পর্কের ইতি টানে।

বাবা হয়ে হয়ত বা সন্তানের দায় দায়িত্ব এড়ানো সম্ভব ছিল তারপক্ষে। কিন্তু যে সন্তানকে দশমাস দশদিন পেটে ধরলাম তাকে অস্বীকার করবার শক্তি হয়নি আমার।
আমাদের ডিভোর্স হয়েছে প্রায় মাসছয়েক হলো। ডিভোর্সের কারণ হিসেবে সাব্বির এক তরফা আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে। আমি তা নিয়ে কোন প্রতিবাদ করিনি।

একারণে আমার ভাইবোন সবাই আমার উপরে ক্ষিপ্ত। ভাইবোনদের বোঝাতে চরমভাবেই ব্যর্থ হই যে এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত বিষয় এখানে তাদের নাক গলানো অনুচিৎ। ফলশ্রুতিতে যা হবার তাই হলো। চিরদিনের জন্যই তাদের সাথে আমার সম্পর্কের বাঁধনটা ছিঁড়ে গেল। বিয়ের কারণে সৃষ্টি হওয়া তিক্ততা সামান্য ম্লান হয়ে আসলেও সম্পর্কের ভাঙনের দায়ভার নিজের উপরে নেয়ার ব্যাপরটা কেউই সহজে নিতে পারলো না।

বরাবরই আমি একটু স্বাধীনচেতা। বিয়েও করেছিলাম নিজের পছন্দে। ভালোবেসে যে মানুষটিকে বিয়ে করেছিলাম, যার জন্য নিজের ধর্মীয় পরিচয় পালটে নিয়েছিলাম, তার কাছ থেকে এভাবে আঘাত আসতে পারে আমি কল্পনাতেও ভাবিনি!
হয়ত বড়দি'র কথাই ঠিক, পরিবার পরিজনদের আঘাত দিয়ে শান্তিতে থাকা যায় না।
এখন আমি মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। নিয়ম করে ডায়রীর পাতায় নিজের কথা যখন যা মনে আসে লিখে রাখছি।

এমন একটা আশায় এসব লিখে রাখা, হয়ত আমার কন্যাটি একদিন এটি পড়বে। তখন সে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে মা তাকে সত্যিই ভালোবাসতো। নিজের উপর আস্হা হারিয়েই আত্মহননের পথে পা বাড়িয়েছিল তার মা। কোনভাবেই তার কারণে নয়।
থাকে শুধু অন্ধকার:
ভাগ্যের দোষেই বলা যায় বাধ্য হয়ে এক ধনী দম্পতির চার বছর বয়সী বাচ্চার ন্যানী ভালো বাংলায় যাকে আয়া বলা হয় সেধরণের একটি কাজে যোগ দেই।

আমার মায়ের মরন ব্যাধি হয়েছে। চিকিৎসার জন্য টাকার দরকার। তাঁকে বাঁচাতে পারবো কিনা জানিনা, তবে চিকিৎসার ত্রুটি জনিত কারণে আমার মা মারা যান এ আমি কিছুতেই চাইনা। প্রথমে মা কে জানাতে চাইনি এই কাজের কথা। কিন্তু ন্যানীর সার্বক্ষনিক দায়িত্ব পালন করতে হলে আমাকে সেখানে গিয়েই থাকতে হবে।

অনেক চেষ্টা করেছিলাম এ ব্যাপরটি এড়াতে। কিন্তু মিষ্টার ও মিসেস গোমেজ তাতে রাজী নন। বেতনটা মাত্রাতিক্ত লোভনীয় আর নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতায় এমন বেতন পাওয়া সম্ভব না বিধায় তাদের প্রস্তাবে রাজী না হয়ে থাকা গেল না।
মা'কে ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলেই কাজটির বিষয়ে বলতেই হলো। আমার স্বল্পবাক মা তেমন কোন উচ্চবাচ্য করেনি তা শুনে।

কিন্তু তার নীরব চোখ জোড়ায় যে ব্যথার ঢেউ খেলে যেতে দেখেছি সেটা বুকে শেলের মতই বিঁধে আছে। আমার এক দুসম্পর্কের আন্টিকে মায়ের কাছে রেখে কাজে যোগ দেই। পিউ নামের ছোট্ট মিষ্টি মেয়েটাকে দেখাশোনার দায়িত্ব আমার। এত ছোট্ট বয়সে মেয়েটা এত আদব কায়দা জানে যে মাঝে মাঝে অবাক হতে হয়। জিজ্ঞেস করে জানতে পারি ওর বাবা ওকে এসব শিক্ষা দিয়ে থাকেন।

পিউয়ের বাবার প্রতি আগের চেয়েও বেশি শ্রদ্ধা এসে যায় এতে করে।
কাজে যোগ দেবার দুদিনের মধ্যেই পিউ আমার ভীষণ ন্যাওটা হয়ে যায়। ওর মা মিসেস গোমেজ দুর্দান্ত সুন্দরী বছর পঁচিশের এক তরুণী।
আমার চেয়ে বছর ছয়েকের বড়। আরো একটি সন্তানের জন্ম দেবেন বলে অপেক্ষা করছেন।

পিউয়ের যেন কিছুতেই অযত্ন না হয় সে কথা পইপই করে আমাকে বলা হয়েছে প্রথম দিনেই। মেয়েটা এত লক্ষী আর বুঝদার যে ওর অযত্ন চাইলেও করা সম্ভব না। মাঝে মাঝে আমার খুব ইচ্ছে করে পিউকে বুকে চেপে ধরে রাখি অনেকক্ষণ। অবাক হয়ে একটা সময় লক্ষ্য করলাম পিউয়ের মত একটা সন্তানের কামনা আমার ভেতরে দানা বাঁধছে। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে এভাবে ভাবনাটা আসেনি কখনো।

আসলে অভাব অনটনে এতটাই জেরবার হতে হয়েছে বাবা মারা যাবার পর আমাকে আর মাকে যে ভবিষ্যৎ বলে কিছু আছে সেটাই ভুলে গেয়েছিলাম। বর্তমানের ভুলভুলাইয়াতেই ঘুরপাক খেয়েছি কেবল।
পিউয়ের বাবা মিঃ গোমেজ স্বল্পভাষী এবং ভীষণ অমায়িক একজন মানুষ। এত মোলায়েম ভঙ্গিতে তিনি কথা বলেন তাতে মনে হয় তিনি যেন সর্বক্ষণই সর্তক থাকেন তার বিন্দুমাত্র রূঢ় শব্দের আঘাতে কেউ যেন আহত না হয়ে বসে। মাঝে মাঝে দোতলার করিডোর থেকে আমি উঁকি দিয়ে দেখি ওদের গল্পরত অবস্হায়।


ওদের জুটির চেহারা ব্যবহার সব কিছুতেই প্রচণ্ড রুচির ছাপ। তাদের ব্যবহারের কারণেই আমাকে বিন্দুমাত্র অস্বস্তিতে থাকতে হয়নি কাজটা নিয়ে। বাবা বেঁচে থাকতে আমাদের বাড়িতেও কাজের লোক এসে কাজ করে যেত এই ভাবনা যে কারণে আর হীনমন্যতা ছড়াতে উৎসাহ পায়নি। সপ্তাহ দুয়েক পর একদিন রাতে পিউ কে ঘুম পাড়িয়ে নিজের জন্য নির্দিষ্ট ঘরে চলে আসি। সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি আমাকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমে তলিয়ে যেতে সাহায্য করে।

রাত তখন ঠিক ক'টা বাজে জানি না। হঠাৎ সম্পূর্ণ অপরিচিত এক স্পর্শে চমকে উঠি। আলোআধারিতে একটা মুখ আমার মুখের কাছে ফিসফিসিয়ে কিছু বলছে। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে।
প্রথমে দুঃস্বপ্ন দেখছি ভেবেছি।

কিন্তু একটা উষ্ণ নিঃশ্বাসে পুড়ে যেতে যেতে বুঝলাম স্বপ্ন নয় সত্যি! এরপর প্রায় প্রতি রাতেই মিঃ গোমেজ আসতে শুরু করলেন আমার ঘরে। সত্যি বলতে কী, আমিও একটা পর্যায়ে গিয়ে রাতের ঐ সময়টার জন্য অপেক্ষা করা শুরু করলাম। দিনের আলোতে আমার পক্ষে যা পাওয়া কখনোই সম্ভব না রাতের অন্ধকারে সেটা অনায়াস হয়ে যাওয়াতেই যেন আমার সব উৎসাহ। ভালো মন্দের বিচারবুদ্ধি আমার তখন পুরোপুরিই লোপ পেয়েছে।
দেড় মাসের মাথায় টের পেলাম আমার ভেতরে ছোট্ট একটা পিউয়ের অস্তিত্ব।

কোন রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই আমি কেমন স্হির সিদ্ধান্তে এসে গেলাম ভ্রুণটি কন্যা সন্তানের। আর সে দেখতেও হবে অবিকল পিউয়ের মত। এই ভাবনাটা আমাকে কেমন এক অসম্ভবের ছবি আঁকতে প্রলুব্ধ করে রাখছে সারাক্ষণ। মায়ের কাছে ভয়ে যাওয়া ছেড়েই দিলাম প্রায়। মা ঠিক ধরে ফেলবেন আমার এই অধঃপাত! অসুখে মারা যাবার আগেই হয়ত তিনি মারা যাবেন।

যে কারণে মানি অর্ডারেই টাকা পাঠিয়ে দায়িত্ব পালন শুরু করে দেই। গত পরশু মিসেস গোমেজ আরেকটি কন্যার জন্ম দিয়েছেন। আরো দিন দুয়েক পর বাড়ি ফিরবেন নার্সিংহোম থেকে। ঠিক করি আজই জানাবো মিঃ গোমেজ কে।
আমি ঠিক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

আসলে আমার এই ব্যাপারটি মেনে নেয়া যে কারো জন্যই অসম্ভব এই বোধটুকুই তখন আমার মধ্যে নেই। নিজের একটা অবাস্তব স্বপ্নকে মুঠোয় পুরে আমি তাই বেপোরয়ার মত ব্যবহার শুরু করলাম। কিছুতেই মানতে রাজী হচ্ছি না তাই মিঃ গোমেজের লোভনীয় প্রস্তাবে।
ওর কথা মত যদি ভ্রুণটিকে নষ্ট করে ফেলি তবে টাকার জন্য বাকী জীবনটাতে সেরকম ভাবতে হবে না। অত্যন্ত মমতা ভরেই তিনি জানালেন, তিনি তার স্ত্রীকে সত্যিই খুব ভালোবাসেন নইলে আমার ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন।

যাতে আমি তার সন্তানের গর্বিত মা হতে পারি। 'যে জন্মের স্বীকৃতি নেই সেটা তো কোনভাবেই সম্মানের নয় বলো তুমি?' তার এমন কথার কোন জবাব হতে পারেনা। আমি মিঃ গোমেজের একটা কথা‌ও অবিশ্বাস করতে পারিনা। তার আন্তরিকতায় যেন কোন খাদ নেই।
রাত এখন অনেক গভীর।

এমনই কোন এক রাতের গভীরে আমার সন্তানটির জন্মের সূচনা হয়েছিল। যে সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে হলে অনেক অনেক বাধা পেরুতে হবে আর সেসব বাধা অতিক্রমের মত শক্তি বা সাধ্য কোনটিই আমার নেই। তাই ঠিক করে ফেলি যে পৃথিবীতে আমার সন্তান আসতে পারবে না সেখান থেকে আমারও বিদায় নেয়া উচিৎ। শেষবারের মত মা'কে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। চোখ বুজে মায়ের মুখ স্মরণ করি।

ব্যথাভরা একটা বিষন্ন মুখ ভেসে ওঠে। অজান্তেই পেটের ওপর হাত রাখি। নিজের ভেতরে একটা ছোট্ট পিউয়ের অস্তিত্ব অনুভব করতে করতে মিঃ ও মিসেস গোমেজের প্রসাদসম বাড়ির চারতলার ছাদ থেকে ঝাপিয়ে পড়ি নীচে। যেখানে হামুখো অন্ধকার একটা খাঁদ ওৎ পেতে আছে আমাকে খাবে বলে।
রাতভর বৃষ্টি:
একটি মধ্যবিত্ত সংসার যেমন হয় মোমেনা বেগম আর জামালউদ্দিন সাহেবের সংসারটাও সেরকম ছিল।

বর্তমানে মাঝে মধ্যেই তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাবার দশায় পড়তে হয়। জামালউদ্দিন সাহেব সোনালী ব্যাংকের গোড়ান শাখায় এসিসট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। মোমেনা বেগম স্হানীয় একটি বেসরকারী কলেজে পড়াতেন বছর খানেক আগে। দু'জনের আয়ে ভালোই চলছিল তাদের চারজনের সংসার। হঠাৎ করেই রোগটি ধরা পড়ে মোমেনা বেগমের।

কলেজের চাকরিটি ছাড়তে হয় বাধ্য হয়েই। একার আয়ে স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ যোগাতে দিশেহারা অবস্হায় পড়ে গেছেন জামালউদ্দিন সাহেব।
ব্যাংক থেকে লোন, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে সাধ্যমত ধারকর্জ করে এপর্যন্ত দুটো সার্জারী, ছয়টি কেমো দেয়া সম্ভব হয়েছে। এখন তারা কোনভাবেই আর চিকিৎসার টাকা যোগাড় করতে পারছেন না। এ অবস্হায় জামালউদ্দিন সাহেব স্হির করেন তাদের এই বসত ভিটেটা বিক্রি করে দেবেন।

মোমেনা বেগমের এতে কিছুতেই সায় নেই। দুই সন্তানকে নিয়ে তবে তাদের পথে বসতে হবে। জামালউদ্দিন সাহেবের কথা হলো পথে বসতে হলে সবাই মিলেই বসতে রাজী। কিন্তু মোমেনা বেগম কে বিনা চিৎকাসায় মরতে দিয়ে এ বাড়িতে কোনভাবেই তিনি বসবাস করতে পারবেন না।
'স্বামী সোহাগী হবে তুমি' দাদীর দেয়া আর্শিবাদের এমন চাক্ষুস প্রমাণের সাক্ষ্যি মোমেনা বেগম এই প্রথম হলেন এমন নয়।

দ্বিতীয়বার সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রায় মরতে বসেছিলেন তিনি। সেসময় ছেলেমানুসির চূড়ান্ত করেছিলেন জামালউদ্দিন সাহেব। 'সন্তান যায় যাক, তার স্ত্রীর যেন কিছু না হয়' এই ছিল তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এমন গোঁয়ার গোবিন্দ স্বামীকে মোমেনা বেগম কিভাবে বুঝাবেন 'হায়াত মওতের মালিক আল্লাহ। তুমি এত পেরেশান হয়ো না দিলুর বাবা।

'
দিলু তাদের বড় মেয়ের নাম। ছোটটি ছেলে, মিলু। একজন নবম শ্রেণীতে বাকিজন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে। পড়াশোনায় দু'জনের মাথা খুব ভালো। বাচ্চাগুলোকে ভালোমন্দ খেতে দেবার সামর্থ্য যখন ছিল তখন দিয়েছেন।

বলা ভালো সামর্থ্যের বেশিই দিয়েছেন। কিন্তু এখন পরিবর্তিত পরিস্হিতিতে এমনও দিন যায় সারাদিনে একবেলা ভরপেট খায় হয়ত। যদিও তারা এসব নিয়ে একদমই উচ্চবাচ্য করেনা। কিন্তু সন্তানের মুখ দেখেই বলে দিতে পারেন যেন সত্যিটা।
পনেরো বছরের বিবাহিত জীবনে খুব একটা কেঁদেছেন তিনি এমনটা মনে করতে পারেন না।

কিন্তু এখন প্রায় তিনি গোপনে চোখের পানি ঝরান। মোমেনা বেগমের পক্ষে দিন দিন সংসারের কাজ করা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। দিলু যতটুকু পারে করে। ছোটভাইটি বোনকে বিনাবাক্য ব্যয়ে সাহায্য করে যায়। খুব অল্প দিনেই যেন ওরা অনেক বড়টি হয়ে গেছে।

কিছু কিছু পরিস্হিতি শিশুদের শৈশব এভাবেই লুট করে নেয় অজান্তে। তা নিয়ে ওদের কোন রকমের নালিশ অভিযোগ নেই। মা বাবার ভালোসব গুণগুলোই যেন ওদের মধ্যে আছে।
মোমেনা বেগম এখন হেজাবের মত করে একটা স্কার্ফ বেঁধে রাখেন মাথায়। কেমোর কারণে মাথায় চুল প্রায় নেই বললেই চলে।

কে বলবে এককালে তার ঘনকালো একঢাল চুল ছিল? মাত্র বেয়াল্লিশ বছর বয়সেই তাকে ষাটার্দ্ধ মনে হয়। ফেসবুকে ওর হেজাবওয়ালা একটা ছবি আপলোড করেছিলেন জামালউদ্দিন সাহেব। ওদের যেসব বন্ধু বান্ধবেরা বিদেশে আছেন, যারা জানতেনই না মোমেনা বেগম কে কী বিষাক্ত রোগে ধরেছে তারা কেউ কেউ হাসিঠাট্টা করেছে হিজাব নিয়ে। প্রত্যত্তোরে মোমেনা বেগমও কৌতুক করতে ছাড়েননি। অফিস ফেরত স্বামীর সাথে সেকথা নিয়ে হাসিঠাট্টাও হয়েছে যথা সময়ে।


বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে স্ত্রীকে রাজী করানো নিয়ে জামালউদ্দিন সাহেব বেশ আশাবাদী। আজ পর্যন্ত এমন হয়নি যে মোমেনা বেগম তার মতের সাথে মত মেলাননি। কিন্তু মোমেনা বেগম জীবনের এই প্রান্তে এসে স্বামীকে আঘাত দিয়ে হলেও সেটাতে রাজী না হবার সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন ঠিক করেছেন। সন্তানদের মুখ চেয়ে হলেও তার মরে যেতে তাই তেমন কষ্ট হবেনা। যদিও তাকে ছাড়া তার গোয়ার গোবিন্দ স্বামীর কিভাবে দিন চলবে ভাবতেই কেমন উলট পালট লাগে সবকিছু।

দুদিন হয় জামালউদ্দিন সাহেব মোমেনা বেগমকে নানান ভাবে রাজী করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সময় মত পরবর্তী কেমোর টাকা জমা করতে না পারলে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাবে। যা কিছুতেই হতে দিতে রাজী নন জামালউদ্দিন সাহেব। অফিস ফেরত জামালউদ্দিন বিকেলের সামান্য চা মুড়ি খেয়ে স্ত্রীর বিছানার পাশে এসে বসেন।
শুয়ে থাকা মোমেনা বেগমের একটা হাত পরম মমতায় বুকের কাছে ধরে থাকেন নীরবে।

চিকিৎসার টাকা যোগাড়ের চিন্তায় ক্লিষ্ট স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে মমতা মাখানো একটা হাসি ছুঁড়ে দেন মোমেনা বেগম। দু'জন মানুষের একই দুঃখে দুঃখী দু'জোড়া চোখ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। অভাব নাকি ভালোবাসা কেড়ে নেয়? কই তাদের ভালোবাসা কেড়ে নিতে পারছে কই? ছেলে মেয়েরা পাশের ঘরে খুব নীরবে তাদের কাজ সারছে। বাইরের পৃথিবীও তাদের নীরবতায় ছন্দপতন না ঘটে যায় এমন নিশ্চুপে শিশিরশব্দে সন্ধ্যাকে আলিঙ্গনের তোড়জোড় করছে।
এমন সময় পাশের বাড়ি থেকে তলব আসে মোমেনা বেগমের ফোন এসেছে জানিয়ে।

আমেরিকার ওহায়ো থেকে তাসনুভা নামের কেউ একজন চাইছে তাকে। মোমেনা বেগমের হাঁটাচলা এখন বেশ কষ্টকর। কেমো দেবার দিন বেশ ভালো থাকেন। পরের দিন থেকে শুরু হয় শরীরিক যন্ত্রণা। যথাসাধ্য চেস্টা করেন সেসব হজমের।

কিন্তু এবারের কেমোর পর তিনি বেশ অসুস্হ বোধ করছেন। যেকারণে ফোন ধরতে যাওয়া তারপক্ষে সম্ভব হয়না। তার হয়ে জামালউদ্দিন সাহেবকেই যেতে হয়।
ফিরে এসে জানান তার যেসব সহপাঠী বন্ধুরা বিদেশে আছেন তারা সবাই মিলে মোমেনা বেগমের চিকিৎসার জন্য ফেসবুকে একটি ইভেন্টের আয়োজন করেছেন। সে ব্যাপারে কিছু ইনফরমেশন দরকার।

শারীরিক যন্ত্রণায় যে মানুষ পারতপক্ষে টুঁশব্দে নারাজ সেই মানুষটি এমন প্রস্তাবে খানিকটা আর্ত চিৎকারের মত শব্দ করে ওঠেন। অভাব তাদের ভালোবাসাকে নিস্তার দিলেও আত্মসম্মানের দিকে হাত বাড়িয়েছে এই নিষ্ঠুর সত্যিটা হজম করতে সে রাতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে এবাড়ির চারটি প্রাণ চারদিকে মুখ ফিরিয়ে। অসহায় একটা বেদনার ভারে এবাড়ির প্রতিটি ইটকাঠও বুঝি হাহাকার করেছে রাতভর।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.