আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নীরব বিনিয়োগ

আমি তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি; আমাদের গ্রামে ৫-৭ জনের একটা দল ছিল যারা প্রায় প্রতি সপ্তাহে হলে গিয়ে ছবি দেখত। কোন কোন সময় একই ছবি দুই-তিনবারও দেখা হত। তারা বাংলা ছবিই দেখত এবং অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী সম্পর্কে তাদের বেশ কিছু মজার মন্তব্যও ছিল। এরকম একটি মন্তব্য হল, “সে (কোন একজন অভিনেতা) পেটে-ভাতে অভিনয় করে। ” এরকম আরো বেশ কিছু মন্তব্য চালু ছিল তখন।

অর্থাৎ এরা ছবি দেখত এবং নিজেদের মধ্যে সমলোচনাও করত তবে বেশিরভাগই নেতিবাচক মন্তব্য ছিল; কিন্তু তারপরও তারা ছবি দেখত। তাদের এই ছবি দেখার চলটা অনেক দিন চালু ছিল, তিন-চার বছরের মতো; এটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ অবশ্য একেকজনের একেকদিকে ছড়িয়ে পড়া।
এদের কথা বলার একটা বিশেষ কারণ আছে, সে ব্যাপারে পরে আসছি। এরা যে সময়ে পেক্ষাগৃহে আসা-যাওয়া শুরু করে ততদিনে বাংলা চলচ্চিত্রের বেহাল দশা। দেশের মধ্যবিত্ত দর্শকশ্রেণী বহু আগেই বাংলা চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সম্ভবত গুণগত মানের অভাবের অজুহাতে।

অর্থাৎ ইতিমধ্যে তারা গুণসম্পন্ন হিন্দি ও ইংরেজি চলচ্চিত্রে মজে গেছে। আমি এখানে কারো সমালোচনা করতে বসিনি, কিন্তু আমার কাছে এই ধরণের যুক্তি অদ্ভুত মনে হয় যে খারাপ বলে দেশীয় শিল্পকে ফেলে দিয়েছি। আমি বলছি না যে ভিনদেশী চলচ্চিত্র দেখা যাবে না বা উচিৎ না, বরঞ্চ মনে করি বাইরের চলচ্চিত্র দেখলে তবেই গুণগত মানের একটা তুলনা করা যাবে। কিন্তু দেশীয় চলচ্চিত্রকে ত্যাগ করে সতর্কতা বার্তা দেওয়ার আগে সমগুণসম্পন্ন করে তোলার জন্য যে সমর্থন দেওয়া উচিৎ ছিল, তা করা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। একটা ছবির ভোক্তা হল দর্শকরা, আর বাংলা ছবির দর্শক তো বাংলাদেশিরাই, আর তারা যদি এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে ভালো কিছু করার উৎসাহ থাকে কিভাবে? আমি সমাজকে কিছু বলছি না, কিন্তু এই শ্রেণীর এই বৈশিষ্ট্যকে যদি সুবিধাবাদী বলি তবে ভুল হবে বলে মনে হয় না।

তবে এরা শুধু নিজেরাই বিমুখ হয়েছে তাই না, চারপাশকেও বিমুখ করেছে- জ্ঞাতসরে বা অজ্ঞাতসরে।
এবার সাম্প্রতিক সময়ে আসি- বাংলাদেশের পেক্ষাগৃহগুলোতে ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যাপারে কথা চলছে। জানিনা ইতিমধ্যে আনুমোদন দিয়ে দেওয়া হয়েছে কিনা? তবে আমি মনে করি এটা বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের জন্য সুখকর কোন সংবাদ হবে না। কিন্তু সে বিতর্কে আমি যাব না। আমি যে ব্যাপারটি বলতে চাই তা হল, ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে আগ্রহটা আমাদের মধ্যে কার বা কাদের বেশি? বোধ করি হল মালিকদের।

কিন্তু কেন? যদি তাদের দিক থেকে ব্যাপারটা বিবেচনা করে দেখি তবে এ ব্যাবসা টিকিয়ে রাখতে হলে তাদের লাভ দরকার। শিল্প সংশ্লিষ্ট হলেও নিশ্চিত করে এটার একটা ব্যাবসায়িক দিক আছে আর সে কারণে বছরের পর বছর দর্শকশূন্য হল-এ চলচ্চিত্র প্রদর্শন করাটা তাদের জন্য সুখের কোন সংবাদ না। আর এখন তাদের বিশ্বাস যে তারা যদি হিন্দী ছবি প্রদর্শন করতে পারে তবে তারা লাভের মুখ দেখবে; এবং এ সত্যটা স্বীকার করতেই হবে যে আমরাই তাদেরকে এ বিশ্বাসটা দিয়েছি। এখন তারা যদি আমাদের পাল্টা প্রশ্ন করে আমরা তো ছবি দেখতে হল’এ যাই-ই না, বাংলা, ইংরেজি কিংবা হিন্দি ছবি চললে আমাদের তাতে কি আসে যায়? উত্তরটা দিতে পারি এইভাবে যে আমাদের কিছু ক্ষতি না হলেও দেশের চলচ্চিত্রের ক্ষতি তো হবে। উত্তরটা দেওয়া যায় কিন্তু সমস্যার সমাধান তাতে হয় না।

ব্যাবসার ক্ষতি দিয়ে কেউ ব্যাবসা চালায় না, তাই পেক্ষাগৃহ বন্ধ হবে, চলচ্চিত্র শিল্প আরো থুবড়ে পড়বে।

তাহলে সমাধানটা কোথায়? এজন্যই শুরুর গল্পটা বলা। আমাদের হলে গিয়ে বাংলা ছবি দেখতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই। ছবি ভালো হোক, খারাপ হোক তা হলে গিয়ে দেখেই বলতে হবে। শুরুতে যে গ্রুপটার কথা বলেছি এদের মতো নীরবে বিনিয়োগ করে যেতে হবে টানা কিছুদিন- তিন থেকে চার বছরই যথেষ্ট।

আর সবারও যেতে হবে না, দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা দুই-তিন ভাগ লোকই যথেষ্ট। প্রতি সপ্তাহে বা প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে বাংলা ছবি। পরবর্তী হিসাবটা সবাই বুঝতে পারবেন- হলের ব্যাবসায় লাভ আসবে, প্রযোজকের টাকা উঠে আসবে, বাজার সরব হবে, আগ্রহীর সংখ্যা বাড়বে, ভালো ছবির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
হিসাবটা সহজ এবং সম্ভব। সম্ভব বলছি বাস্তব একটা পর্যবেক্ষণ থেকে।

একই ধরণের কাজ আমরা আগেও করেছি। – ক্রিকেটের ক্ষেত্রে। খুব বেশি দিন আগের ব্যাপার না, যখন বাংলাদেশে ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবলের অবস্থান বেশ ভালো ছিল। কিন্তু ১৯৯৭ সালের পর থেকে চেহারা বদলে গেছে। এর কারণ দর্শক, বাংলাদেশ যত খারাপই খেলুক না কেন মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে দর্শকের অভাব হয় নি দেশে কিংবা দেশের বাইরে।

ফলশ্রুতিতে বিসিবি-কে ট্যুর্নামেন্ট আয়োজন বা ক্রিকেটের প্রসারের জন্য শুধু আইসিসির বা সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়নি, যে সমস্যাটায় আছে বাফুফে- বাজেটের জন্য হা করে তাকিয়ে থাকতে হয়, খেলার আয়োজন করতে পারে না নিয়মিত অর্থের অভাবে, বাইরে খেলতে যেতে চাইলে অনেক চিন্তা করতে হয়। কিন্তু ক্রিকেটে এ সমস্যাটা নেই। আমরা, বাংলাদেশ খুব খারাপ ভাবে হারবে জেনেও মাঠে গেছি খেলা দেখতে সমর্থন জানাতে আর এখন আমরা যেকোন দেশের বিরুদ্ধেই জয়ের আশা নিয়ে খেলা দেখতে যাই। অতএব সম্ভব; আর যদি বলি ’৯৭ এর মতো ঘটনা ঘটেছে কি না চলচ্চিত্রে, তাহলে বলব অবশ্যই ঘটেছে, আমাদের চলচ্চিত্র বাইরে থেকে পুরস্কার নিয়ে আসছে দেশের জন্য, আমরা এখন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছি ছবি তৈরি করার জন্য; এখন শুধু ক্রিকেটের মতো ভালোবেসে জড়িয়ে ধরতে হবে চলচ্চিত্র শিল্পকে- সুদিন আসবেই।
কুণ্ঠিত পান্থ


সোর্স: http://www.sachalayatan.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।