আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান

আইয়ুব বাচ্চু খেপে গেলেন। বিসিবি সেলিব্রেশন কনসার্টে বাংলাদেশের শিল্পীদের প্রতি বাংলাদেশের দর্শকদের নিরাসক্ত আচরণ দেখে তিনি উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া দেখালেন। চরম উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, 'তালিগুলো আপনারা উনাদের [বিদেশি শিল্পীদের প্রতি ইঙ্গিত করে] জন্য জমিয়ে রাখেন। আমাদের তালি না দিলেও চলবে। শুধু চোখ-কান খোলা রেখে আমাদের গানগুলো শুনে গেলেই হবে'।

এ প্রতিক্রিয়া হয়তো আইয়ুব বাচ্চুর মানের শিল্পীদের সঙ্গে মানানসই হয়নি। কিন্তু এ প্রতিক্রিয়াটা কোত্থেকে এসেছে তা অনুমান করতে পারলেই আমরা আমাদের এক গভীর অসুখের দেখা পাব।

কেউ কেউ এ বিষয়ে আমার ফেসবুক পোস্ট দেখে ইনবক্সে লিখছেন- 'কিন্তু বস, বাচ্চু ভাইয়ের গলাটা আজকে ভালো অবস্থায় ছিল না'। আমি তাদের উত্তর দিয়েছি এই বলে- 'ধরা যাক আজ থেকে আরও পাঁচ বছর পরের কথা। লতা মুঙ্গেশকর আর ঠিকমতো গান গাইতে পারেন না।

দম পড়ে আসে। সেই সময়ে মুম্বাইয়ে কোনো অনুষ্ঠানে তিনি এসেছেন গান গাইতে। তাকে মঞ্চে দেখামাত্র দর্শকদের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, অনুমান করতে পারেন? প্রতিটি ভাঙা ভাঙা গানের পর দর্শকদের হর্ষধ্বনি বা চিৎকার কোন স্তরে গিয়ে পৌঁছাতে পারে, ভাবতে পারেন? ভারতের দর্শকদের ওই রকম সকৃতজ্ঞ প্রতিক্রিয়ার কারণ একটাই- দেশপ্রেম আর স্বাজাত্যাভিমান। নিজের গুণীজনকে সম্মান করার মধ্য দিয়ে একটা জাতি নিজেকে বড় করে তোলে'। আমাদের দেশেও এ রকম দেশপ্রেমিক মানুষের অভাব নেই।

সে জন্যই দেশটা এখনো চলছে। কিন্তু আমাদের দেশে এ রকম মানুষেরও অভাব নেই যারা জগতের সব মাধুর্য খুঁজে পায় কেবল পরের বাগানের ফুলে। আমি বলছি না, পরের বাগানের ফুলের রূপ আমি ভালোই বাসব না। আমি এও বলছি না, পরের বাগানের ফুলকে নিন্দা করার মধ্য দিয়ে আমরা বড় হয়ে উঠব। আমি কেবল বলছি, আমার নিজের বাগানের ফুলের রূপ-রস ভোগ করতে যদি আমার কুণ্ঠা হয়, যদি আমার নিজের দেশের গুণীদের সম্মান জানাতে আমি সংকোচ করি, আমার নিজের পণ্য কিনতে হীনমন্যতায় ভুগি; তাহলে ভাইজান এবং বোনজান, আমাদের কপালে দুর্গতি আছে।

এ দেশে জন্ম নিয়ে, এ দেশের জল-হাওয়ায় বেড়ে উঠে, এ দেশের মানুষের মানচিত্র পড়তে পড়তে আমার একটা উপলব্ধি হচ্ছে- আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় এ মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় বাধা- নিজেদের সম্মান করতে না পারা। এ দেশে ওপরে ওপরে রাজনীতির সে াত যত বিচিত্র ধারারই থাকুক, ভেতরে ভেতরে আমি যে ক্ষতিকর সে াতগুলোকে সক্রিয় দেখি সেগুলোর একটাও একটি স্বাধীন জাতির জন্য কোনো শুভসংকেত দেয় না। মোটের ওপর আমি রাজনৈতিক শক্তির মাঝে ক্ষতিকর যে সে াতগুলো সক্রিয় দেখি সেগুলো হলো- অন্ধ ভারতপ্রেম, অন্ধ ভারতবিরোধিতা, অন্ধ পাকিস্তানপ্রেম, অন্ধ পাকিস্তানবিরোধিতা। এর বাইরেও অনেক শক্তিশালী সে াত আছে ঠিকই। কিন্তু ওপরের চারটা সে াতই আমার মনে হয় এই জাতি ও দেশের বিকাশের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর।

অন্যের প্রতি অহেতুক প্রেম বা অহেতুক নিন্দায় আমরা মত্ত থাকলে নিজেরে ভালোবাসার ফুরসত পাব কোথায়? আমরা যদি ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী হবে, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী হবে, এমনকি আমাদের নিজেদের সঙ্গেই বা আমাদের সম্পর্ক কী হবে- এগুলো নির্ধারণ করতে না পারি তাহলে যতই কয়েক লাখ লোক দিয়ে জাতীয় সংগীত গাইয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়ে ওপরে ওপরে একধরনের আত্দতুষ্টি লাভ করি, তাতে আসল কাজ খুব বেশি কিছু হবে না। আমি বলছি না জাতীয় সংগীত গাওয়ার বা পতাকা ওড়ানোর এ কাজগুলো মন্দ কিছু। এসব কাজকর্মের একটা মূল্য তো আছেই। কিন্তু এর চেয়েও জরুরি কাজ হলো দেশবান্ধব একটা জাতীয় মানস গড়ে তোলা। যে মানসের প্রভাবে কোরিয়ানরা বিদেশি গাড়ি কেনার সামর্থ্য থাকার পরও হুন্দাই গাড়ি বেশি কেনে, ভারতীয়দের কাছে সবার আগে থাকে নিজের পণ্য বা নিজের সংস্কৃতি।

এখন আমি ছোট করে ভারত এবং পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে একটু বলতে চাই। ভারত আমাদের পাশের বন্ধুরাষ্ট্র। আমাদের রাষ্ট্রের জন্মের সময় সবচেয়ে বড় সাহায্য করেছে তারা। তারা অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বাঘে পরিণত হওয়ার চেষ্টায় আছে। একটা ছোট রাষ্ট্রের পাশে একটা বড় রাষ্ট্র যখন সুপারপাওয়ার হওয়ার পথে থাকে তখন ছোট রাষ্ট্রকে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ ও আন্তরিকতার সঙ্গে কিছু কৌশল নির্ধারণ করতে হয় যা থেকে বড় রাষ্ট্র বুঝতে পারে ছোট রাষ্ট্রটি তার জন্য কোনো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে না।

একই সঙ্গে ছোট রাষ্ট্রকে নিজের বাজার, নিজের সাংস্কৃতিক পরিচয়- এগুলো বাঁচিয়ে রাখার জন্য দেশবান্ধব পরিকল্পনা নিতে হয়। আমরা কি তা নিচ্ছি? মনে রাখতে হবে, ভারতের কাছ থেকে আমাদের নেওয়ার বা শেখার আছে অনেক কিছু এবং আমাদের ভালোটা আমাদেরই সবার আগে বুঝতে হবে। ভারতের সঙ্গে বিরোধ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র কত দূর ভালো অবস্থানে থাকতে পারবে আমি জানি না। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নই। আমার রাষ্ট্রভাবনা দেশের প্রতি ভালোবাসা আর উৎকণ্ঠা থেকে আসা কিছু চিন্তামাত্র।

একই সঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী হবে, এ বিষয়েও যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত চিন্তা থাকতে হবে। পাকিস্তান শুনলেই বিনা শর্তে কবুল বা গালি- দুটোই কাছাকাছি মাত্রার বিপজ্জনক। পাকিস্তান হোক বা ভারত হোক আমাদের সমর্থন বা সমালোচনা হওয়া উচিত ইস্যুভিত্তিক, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। ওপরের কথাগুলো তো বললাম রাষ্ট্রীয় নীতি কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে, এবার আসি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা- জনমন। আমাদের জনমনে কখনো কখনো দেখি নিজের দেশ নিয়ে ভাবনার চেয়েও বেশি জায়গা জুড়ে থাকে ভারতপ্রেম আর ভারতঘৃণা, পাকিস্তানপ্রেম আর পাকিস্তানঘৃণা।

এ চক্র থেকে বের হওয়ার উপায় কী? নিজেদের বেশি বেশি ভালোবাসা। নিজেরে বেশি বেশি শ্রদ্ধা করা। এটা কি মেলোড্রামার মতো শোনাচ্ছে? দেশপ্রেম তো মেলোড্রামাই, ভাই। এ মেলোড্রামা ছিল বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন এই এক মেলোড্রামাই পারে আমাদের জাতি হিসেবে এক শক্তিশালী জায়গায় নিয়ে যেতে।

তবে এই মেলোড্রামা যেন শুধু ক্রিকেট মাঠে 'বাংলাদেশ'-কে সমর্থন করায় আবদ্ধ না থাকে। নিজেদের বাজার, নিজেদের পণ্য, নিজেদের গান, নিজেদের সিনেমা, নিজেদের প্রযুক্তি- এসবের পাশে থেকে যদি আমরা ধন্য বোধ করি, যদি আবেগে আমাদের গলা ধরে আসে, তবেই সে মেলোড্রামা এই জাতির কাজে আসবে।

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।