আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বসন্তের বর্ষন বেলা-৩

কখনো সুরের ছন্দ মেলেনা,তো কখনো তাল তবু গেয়ে যেতে হয় মিলিয়ে সাথে সময়ের সুর-তাল!

মায়ের মুখে কথাটা শুনে আমরা দু'বোনই অদ্ভুদ ভাবে পরস্পরের দিকে তাকালাম!আমি অবাক হয়ে বললাম,
-মা তুমি এসবে কবে থেকে যোগ দিলে?
মা খুব আগ্রহ নিয় বললেন,
-তোর মেঝ মামী বললেন,তার এক বোনেরও নাকি এমন বাচ্চা না হওয়ার সমস্যা ছিলো,বাট এই তদবির করার পর আল্লাহর রহমতে বাচ্চা হয়েছে,চেষ্টা করতে দোষ কি?চল না মিতু একবার!
আপু মুচকি হেসে বলল,
-মা,তোমার কি মনে হয়?এসবে কিছু হয়? সন্তান দেয়ার মালিক আল্লাহ,যদি তিনি আমাকে দিতে চান তাহলে কোন তাবিজ-তদবির ছাড়াই দিবেন,তুমি শুধু শুধু এসবে কান দিও না।
-তোরা তো বেশিই বুঝে আসলি সব সময়!একটা বাচ্চার জন্য লোকে কত কিছুই না করে,কত মানত-তাবিজ-তদবির,কতো জায়গায় যায়,আর তুই?এভাবে হাল ছেড়ে বসে থাকলেই কি হবে?
আমি বললাম,
-মা শোন,আল্লাহর কাছে তো আমরা কেউ কম চাইছি না,আপু,ভাইয়া,আমরা সবাই ই দোয়া করছি,ডাক্তারের কাছেও তো কম যাওয়া হচ্ছে না এর চাইতে আর বেশি কি করবে ওরা?এসব তাবিজ-তদবির কিছুই না,শুধু টাকা নষ্ট!এগুলো তুমিও ভালো করে জানো,তবুও কেন এখন খামোখা এসবে কান দিচ্ছো?বাদ দাও,ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।
মা হঠাত করে খুব রেগে গেলেন,
-ঠিক আছে,আমি কিছুই বলবো না!আমি বলার কে?যেদিন তোদের বাবা মারা গেলেন আমিও তো সেদিন ই মরে গেছি তোদের জন্য!যার যা যেভাবে খুশী এতোদিন তো সেভাবেই করেছিস,আত্নীয়-স্বজনরা কত ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতো নাহ,কোন কথাই কানে তুলেনি,করলো গিয়ে বিয়ে ঐ হতচ্ছাড়াটাকে,না ছিলো চাল-চূলো না ছিলো পয়সা,এখন যেই সব হলো ওমনি বাচ্চা না হওয়ার অজুহাতে পর করে দিলো!
-মা প্লিজ...চুপ করো!'
-হ্যা চুপ করেই তো আছি!এজন্যই লোকে বলে,মেয়ে মানুষকে এতো ছাড় দিতে নেই,অতো স্বাধীনতা দিতে নেই!কিন্তু আমার তো কপাল খারাপ,যার জন্য তোরা যা খুশী তাই করেছিস আর এখন আবার আমার চোখের সামনেই ভুগছিস!
শোন মিতু,তোর তো যা হওয়ার হলো,এবার বোনটার দিকে তাকা,এর কোন গতি কর,আত্নীয়-স্বজনরা কিন্তু কম কথা বলছে না,আর হয়েছে তো তোর মতোই,এখনো সময় আছে কিছু কর না হলে কিন্তু দেখবি নিজের হাল ই হবে!''
আমি আর সহ্য করতে পারলাম না,উঠে নিজের রুমে চলে আসলাম। মুপ্পু ওখানে বসেই নীরবে চোখের পানি ফেলতে লাগল! সে রাতে আমরা কেউ ই ঘুমোতে পারিনি।

ভোরে নামাজ শেষ করে গাছে পানি দিয়ে এসে দেখি,কিচেনে মুপ্পু নাশতা বানাচ্ছে,মা এখনো তার রুমেই আছেন।


আমি চুপচাপ আপুর পাশে যেয়ে দাড়ালাম,ওর বানানো পরোটা ভাজতে ভাজতে বললাম,
-তুই কি মায়ের কথায় খুব মন খারাপ করেছি আপু?
মুপ্পু একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
-নাহ,এসব কথা শুনতে শুনতে আমি এখন অভ্যস্থ!অতো খারাপ লাগেনা আর।
-শুনতে শুনতে মানে?আর কে বলতো এসব কথা?!!মুহিন ভাই?
সাথে সাথে আপু কিছু বলল না,খানিক পর বলল,
-আগে আড়াল আড়ালে আমার শ্বশুড় বাড়ির লোকজন বলতো!কিন্তু দু'বছর তোর ভাই আমাকে এমন কথা উঠতে বসতে শতবার শুনিয়েছে!কখনো চুপ করে থাকতাম,বলতো অহংকার দেখাই,কিসের এতো দেমাগ আমার!আবার কিছু বললেও বলতো,মুখে মুখে তর্ক করি!এ জন্যই লোকে বলে,বউকে অতো আদর-সম্মান দিতে নেই ইত্যাদি।
ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচ কাটতে কাটতে বললাম,
-সে কি চাইতো আসলে?এমন খারাপ ব্যবহার করলে যাতে তুই চলে আসিস?
-অনেকটা তেমনই!ওর কথা গুলো শুনলেই বুঝা যেতো মুখস্থ বুলি!যখন জানলো,বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা কম,তখন থেকেই সে হতাশ ছিলো!তার মনে হতো,আমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়াটাই ভুল ছিলো,আ\আবার ভাবতো,আমি যেমন শক্ত-ক্যারিয়ারিস্ট মাইন্ডের মেয়ে নিশ্চয়ই বাচ্চা পছন্দ করি না,তাই আল্লাহ আমাকে বাচ্চা দেন না! এইসব আর কি।
আমি আর কিছু বললাম না। কিন্তু আমার ভেতরে চিন্তার হিসেব গুলো মিলছিলো না!

মুহিন ভাইয়ের সাথে আপুর বিয়েটা হুট করে হয়নি,বেশ ক'মাস সময় লেগেছে!আত্নীয়-স্বজনরা কেউ ই এই প্রস্তাব পছন্দ করছিলো না,গ্রাম থেকে আসা,বাবা নেই,মাথার উপর ছোট চার ভাই-বোনের দায়িত্ব তার উপর ইনকাম বলতে,দুটো কোচিং এ পড়ানোর পাশাপাশি টিউশনি! মা একবার হ্যা বলতো তো একবার না।

সে সময়ের দেখা,আর বিয়ের পর প্রায় বছর খানেকের চেনা-জানার সাথে এই মুহিন ভাইয়ের কোন মিল ই পাচ্ছি না! মানুষ এতো বদলে যায়?
জীবনের এই কঠিন সময়ে তো উচিত ছিলো,দু'জনের ই দু'জনের পাশে থাকা,কষ্ট তো কারোরই কম না,তেমনি এই কষ্টের লাঘব কাঠিটাও তো দু'জনের হাতেই থাকার কথা,তা না করে হতাশা-রাগ-ক্ষোভ দেখিয়ে এভাবে আলাদা হয়ে যাওয়ার মাঝে কি সমাধান থাকে?কি গ্যারান্টি আছে,যে সে আবারো বিয়ে করলেই সন্তানের বাবা হতে পারবে?
মনে পড়ে গেলো,আশফাক মামার কথা,মায়ের দু'সম্পর্কের ভাই ছিলো,প্রথম স্ত্রীর ঘরে সন্তান হয় না বলে,কতো উঠেপড়ে আবারো বিয়ে করলেন,তার প্রথম স্ত্রী অনেক ভালো একটা মানুষ ছিলেন,অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন মামার এমন সিদ্ধান্তে! কিছু কি কপাল!পরের সাত বছরেও আর বাচ্চার মুখ দেখার ভাগ্য হলো না,দ্বিতীয় বউ ডিভোর্স দিয়ে চলে গেলো,মামা-মামী এখন দুটো অনাথ মেয়েকে নিজেদের পরিচয়ে বড় করছেন।
আবার আমার বাশার স্যার,১৯বছর ধরে একটা সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে কেঁদেছেন,কতোবার লোকজন ২য় বিয়ের কথা বলেছে,কিন্তু নাহ,স্যার তেমন কিছুই করেননি। শেষে ক'বছর আগে ম্যাম একটা গরীব ঘরের বাচ্চাকে এডপ্ট করেছেন,আর সেই বাচ্চাকে নিয়ে স্যার এর সে কি খুশী!
জীবন টা এমন কেন হয় না?যে মানুষ গুলো নিজের চাইতে অন্যের জন্য এতো করে যায় তার জন্য করার সময় আসলে কেন মানুষ গুলো বদলে যায়?
৬বছর আগে টোকিওতে স্কলারশীপ পেয়ে যখন আপু ওখানে ভাইয়া কে নিয়ে গেলেন,কই এ নিয়ে তো কোনদিন আপুকে একটা শব্দ করতে শুনিনি!আপুর দেবর-ননদের পড়াশুনা,বিয়ে থেকে শুরু করে শ্বাশুড়ির চিকিৎসা,ঢাকায় ফ্ল্যাট সব কিছুর ক্ষেত্রে আপু হাত খুলে যেভাবে পেরেছে দিয়েছে,কোন দিন এই নিয়ে মা কে ফোন করেও আফসোস করতে শুনিনি! আর আজ?সময় বদলাতেই সবাই এক ঝাটকায় বদলে গেলো,আর সব দোষ এসে পড়লো আমার বোনের উপর!হায়রে!

মুপ্পুর মোবাইলে আজকাল অদ্ভুদ সব কল আসে!কখনো যদি ও ব্যস্ত থাকে তাহলে আমি ফোন ধরি,আর ধরলেই শুনি,কেউ বলছে,
-হ্যালোওওও,টিচার মিস!আপনি কাল স্কুলে আসবেন না?!
ওরে বাব্বাহ!পিচ্চিরা কত্ত কনসার্ন আজকাল!!মিস ক্লাসে যাবে কি না,সেটা কনফার্ম হচ্ছে!আবার কখনো শোনা যায়,
-হ্যাল্লো,মিস...আপনি কি চকলেট কেক খান?আমার মামণি আজ বানিয়েছি,আপনার জন্য নিয়ে আসিইইই??
কথা শুনে আমি মোবাইলটা মুপ্পুর দিকে দিতে দিতে বলি,
-কি আহ্লাদরে বাবা!এই মেয়ে কি আসলেই পিচ্চি না কি কন্ঠ পিচ্চি!
দিনে দিনে আমি আর মা টের পেলাম,বাচ্চাদের সাথে মুপ্পুর অসম্ভব দারুন সম্পর্ক হতে পারে,যা আমরা আগে কখনো জানতাম না। প্রায় দিন ই দেখা যায়,তার কোন না কোন স্টুডেন্টের মা এটা-সেটা তৈরী করে বাসায় পাঠিয়েছে! কিংবা স্টুডেন্ট স্কুলেই নিয়ে এসেছে,ও আবার সেটা বাসায় নিয়ে এসেছে। হাস্যকর কিন্তু সবার সব কাজ করে ওর স্টুডেন্টরা!

সেদিন ঘটল তেমনি এক কান্ড!মা গেছেন বড় খালার বাসায়,মুপ্পু ছাদে,আমি টিভিতে খেলা দেখায় ব্যস্ত।

এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো! আমি অবাক হলাম,দরজা তো লক করে যায়নি আপু!তো বেল দিচ্ছে কে?খুলে দেখি
দেড় ফুটের এক ব্যাটারী সাইজের পিচ্চি পরী দাড়িয়ে আছে!আশে পাশে আর কাউকে চোখে পড়ছে না,পাশের ফ্ল্যাটের দরজাও বন্ধ!আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম! নিচু হয়ে বললাম,
-কে গো তুমি?কাকে চাও?
পিচ্চি ডানে-বামে ঘুরে বলে,
-সিনড্রা কে চাই!
আমি এবার ভ্রু কুঁচকালাম!
-সিনড্রা!সিনড্রা কে?তুমি কার সাথে এসেছো?
-তাচ্চুর সাথে!
-চাচ্চুর সাথে?কোথায় চাচ্ছু?
সে আঙ্গুল দিয়ে একবার বাইরে,আরেকবার নিচের সিঁড়ির দিকে ইশারা করলো! আমি ঠিক ভাবে ধরতে পারলাম না!
-আচ্ছা,বুঝলাম,বাট এই বাসায় তো কোন সিন্ড্রা থাকে না!
-না থাকে তো!
পিচ্চি ভেতরে আসার জন্য উঁকি দিচ্ছে!কিন্তু কে,কার সাথে এসেছে না বুঝে কিভাবে ঢুকাই!এমন সময় সিঁড়িতে আওয়াজ পেলাম কারো,দেখি লাল চুল ওয়ালা এক লোক উঠছে!উমম,না ছেলেই বলা চলে,আইমিন লাস্ট স্টেজে আছে!!
আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
-এটা কি শারমিন ম্যামের বাসা?
আমি মাথা দুলিয়ে বললাম,
-জ্বি,ও কি আপনার সাথেই এসেছে?
-জ্বি হ্যাঁ,আমার ভাইয়ের মেয়ে,নবনী !শারমিন ম্যামের প্রচন্ড ভক্ত সে,আজ এক কারণে স্কুলে যায়নি,তাই দুপুর থেকে জেদ ধরেছে তাকে যেনো তার সিন্ড্রেলা ম্যামের কাছে নিয়ে আসা হয়!সে জন্যই স্কুল থেকে এড্ড্রেস নিয়ে আসলাম,তা আপনি ই কি শারমিন ম্যাম?
আমি মাথা নেড়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বললাম,
-ভেতরে আসুন আপনারা,আপু ছাদে গেছে,আমি ডেকে দিচ্ছি!
ওদেরকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে আমার রুমে এসে দেখি,আপু মোবাইল চার্জে দিয়ে গেছে!অগ্যাত কি আর করা,তাদেরকে বাসায় রেখেই আমি ধুপধাপ সিঁড়ি ভেঙ্গে ছাদ থেকে আপুকে ডেকে আনলাম।
নবনী সেদিন খুব বেশি সময় ছিলো না,তবে সেদিনের পর থেকে পিচ্চি প্রায় ছুটির দিনেই চাচা কিংবা মা,কারো না কারো সাথে বিকেল বেলা চলে আসে। মাঝে মাঝে আপুর আর ওর সাথে আমিও যোগ দেই!কিন্তু আমি কেন জানি অতো মজা পাই না!আর নবনী যথেস্ট কথা বলতে জানে,ওর সাথে তাল মিলিয়ে বেশিক্ষন কথা বলতে পারিনা। তবে ওদের কথা-কান্ড গুলোতে বেশ মজা পাই।
চলবে...


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।