আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অকৃত্রিম উৎসবে কৃত্রিম মেহেদী পরিহার করুন;গাঢ় টুকটুকে রং পেতে মেহেদী টার্পি করুন


অার মাত্র ২সপ্তাহ পর পহেলা বৈশাখ। অনেকেই মেহেদীতে হাত রাঙ্গাবেন। মেহেদী লাগানো এখন আর বিয়ে আর ঈদ উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর ব্যবহারের ব্যাপকতা বেড়েছে। খোদ মার্কিন মুল্লুকের ললনারাও এখন কেমিক্যাল টাট্টুর পরিবর্তে প্রাকৃতিক মেহেদী ব্যবহার শুরু করছেন।

কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে ফরমালিনযুক্ত মাছ-মাংস-দুধ-ফল-জুস,ইউরিয়া ও হাইড্রোজ মিশ্রিত মুড়ি,কারবাইড দিয়ে পাকানো ফলের সাথে এখন মহোৎসবে যুক্ত হয়েছে কেমিক্যালযুক্ত মেহেদী। আমরা সবাই খুব অল্প সময়ে গাঢ় টকটকে রং চাই। আমাদের এ দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে ও মেহেদী সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে এবং সর্বোপরি মান নিয়ন্ত্রণ ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর উদাসীনতায় অসাধু ব্যবসায়ীরা ক্ষতিকর কেমিক্যাল মেশানো মেহেদীতে বাজার সয়লাব করে দিয়েছে। আসুন এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেষ্টা করিঃ-


কেমিক্যাল মিশ্রিত মেহেদী চিনবো কী করে?-একমাত্র ল্যাব টেষ্টেই নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব মেহেদীতে কোন কোন কেমিক্যাল কী কী মাত্রায় মেশানো আছে। তবে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় মেহেদী ভেজাল মিশ্রিতঃ

১।

খাঁটি মেহেদী কখনোই কালো রং এর হয়না। সকল কালো মেহেদীই ভেজাল বা কেমিক্যাল মিশ্রিত।

২। প্রাকৃতিক মেহেদী কখনোই ৫মিনিটে গাঢ় টুকটুকে রং দেয়না। মেহেদীর রং হাতে ঢুকতে কয়েকঘন্টা সময় লাগে এবং পরবর্তী ২৪-৪৮ঘন্টায় তা অক্সিডাইজড(বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে) হয়ে গাঢ় রং হয়।



৩। মেহেদীর রসের স্বাভাবিক রং ন্যাচারাল কমলা(CI-75480)। মেহেদী হাত দিয়ে ধরা মাত্রই যদি হাত লাল বা খয়েরী লাল হয়ে যায়,তাহলে জানবেন রেড অক্সাইড বা টেক্সটাইল ডাই মেশানো আছে।

৪ মেহেদীতে কেরোসিন বা তার্পিন বা কর্পুরের দন্ধ পাওয়া গেলে।


মেহেদীতে কী কী ভেজাল মেশানো হয়ঃ-মেহেদীতে অনেক ধরণের ভেজাল মেশানো হয়।

তারমধ্যে প্রধান প্রধান ক্ষতিকর কেমিক্যালগুলোর বর্ণনা দেওয়া হলোঃ---

১। কার্বোলিক এসিডঃএটা ফেনল বা সাপ তাড়ানোর ঔষধ হিসাবে বেশী পরিচিত। এটা ত্বকের কোষগুলোকে মেরে ফেলে এবং এর প্রতিরোধক ক্ষমতাকে ধ্বংস করে;ফলে মেহেদীর রং সহজেই ত্বকে প্রবেশ করে ও দ্রুত রং দেয়। ত্বক থেকে শোষিত হয়ে এ বিষ সারাদেহে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষতঃ কিডনী ও লিভারের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।



২। পিপিডিঃPara-Phenylene-Diamine এটা কালির রং। সকল কালো রং এর মেহেদীতে পিপিডি আছে। ন্যাচারাল মেহেদী কখনোই কালো রং এর হয়না। পিপিডি মারাত্মক অ্যালার্জি তৈরী করতে পারে।



৩। রেড অক্সাইডঃএটা ফার্নিচারের রং করার কাজে ব্যবহৃত লালচে খয়েরী রং এর পাউডার।

৪। ক্ষতিকর দ্রাবকঃকেরোসিন,গ্যাসোলিন,তার্পিন তেল,কর্পুর...ইত্যাদি। এসব দ্রাবক মেহেদীর রঞ্জক লসোনের ঘনত্ব বাড়ায়,ফলে মেহেদীর রং গাঢ় হয়।



৫। টেক্সটাইল ডাইঃমেহেদীর রং গাঢ় ও দ্রুত করার জন্য কাল,লাল বা খয়েরী লাল রং এর টেক্স ডাই ব্যবহার করা হচ্ছে।


এসব কেমিক্যালের ক্ষতিকর দিকগুলো কী কী?-

১। ত্বকের অ্যালার্জিঃ-এই ক্ষতিটা সবচেয়ে বেশী দেখা যায়। এতে ত্বক চুলকায়,লাল হয়,ফুলে উঠে,চামড়া উঠে যায় বা ফোস্কা পড়ে(contact dermatitis)।

পরবর্তীতে ত্বকে কালো দাগ(post inflammatory hyperpigmentation) ও scarring হতে পারে। অনেক সময় তাৎক্ষণিক কোন সমস্যা না হলেও ১-৬ সপ্তাহ পরও সমস্যা হতে পারে(delayed hypersensitivity reaction)। এমনকি প্রথমবার লাগিয়ে কিছু না হলেও দ্বিতীয়বার লাগানোর পরে প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে(sensitization)।


২। ত্বক পুড়ে যাওয়াঃ-ফেনল ত্বক পুড়িয়ে দিতে পারে।

কম ঘনত্বের ফেনল ত্বক না পুড়ালেও ত্বকের কোষকে মেরে ফেলতে পারে।

৩। ফেনল,কেরোসিন,তারপিন,পিপিডি ইত্যাদি ত্বক থেকে দ্রুত শোষিত হয়ে সারাদেহে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষতঃ কিডনী ও লিভারের জন্য এরা মারাত্মক ক্ষতিকর।

৪।

কর্পুরের ঘ্রাণ তাৎক্ষণিকভাবে শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি করে। বমিও হতে পারে।

৫। টেক্সটাইল ডাই ক্যান্সারসহ নানারকম অসুখ তৈরী করে বলে খাদ্য ও প্রসাধনীতে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ।

৬।

মৃত্যুঃAnaphylactic reaction বা তীব্র মাত্রার অ্যালার্জি হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মানুষ মারা য়েতে পারে। পিপিডির কারণে এভাবে রোগী মারা যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে।


এতক্ষণ ভেজাল মেহেদী নিয়ে আলাপ করলাম। আসুন এবার আমরা খাঁটি মেহেদী সম্পর্কে কিছুটা জানার চেষ্টা করিঃ-


মেহেদীর রঞ্জকঃমেহেদী পাতায় কমলা রং এর এক ধরণের রঞ্জক পদার্থ থাকে যাকে লসোন(Lawsone/Hennotannic acid) বলে। এই লসোনই ত্বককে রঙ্গীন করে।

লসোনের কতকগুলো বৈশিষ্ট্য আছেঃ-

১। এটা পানিতে অদ্রবণীয়। কিন্তু ত্বক পানিনিরোধী;তাই এ রঞ্জক খুব ধীরে ধীরে ত্বকে প্রবেশ করে। এজন্য মেহেদী কয়েকঘন্টা হাতে লাগিয়ে রাখতে হয়।

২।

এটা খুব ধীরে ধীরে অক্সিডাইজড হয়(বাতাসের সাথে বিক্রিয়া করে) এবং যত বেশী অক্সিডাইজড হয় রং ও তত গাঢ় হয়। পূর্ণ অক্সিডাইজড হলে কালচে লাল বর্ণ ধারণ করে। অক্সিডাইজড হতে মোটামুটি ২৪-৪৮ঘন্টা সময় লাগে। তাই হাতে লাগানোর পর হালকা থাকলেও সময়ের সাথে সাথে মেহেদীর রং গাঢ় হতে থাকে।

৩।

লসোন এসিড মিডিয়ায় সবচেয়ে গাঢ় রং দেয়। ৩-৪পি.এইচ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী কার্যকরী। এজন্যই মেহেদী পেষ্টে লেবুর রস মেশানো হয়। লেবুর রসের পি.এইচ ২.৫ এর কাছকাছি।

৪।

অধিক তাপমাত্রায় লসোন দ্রুত ও অধিক পরিমাণে ত্বকে প্রবেশ করে। এজন্য শীতকাল অপেক্ষা গ্রীষ্মকালে মেহেদীর রং বেশী গাঢ় হয়।

৫। ত্বকের বর্ণহীন কেরাটিনের প্রতি লসোনের আসক্তি রয়েছে। মোটা চামড়ায় সবচেয়ে বেশী কেরাটিন থাকে বলে হাত-পায়ের তালুতে মেহেদীর রং সবচেয়ে গাঢ় হয়।




মেহেদীর “টার্পিং” কী?-মেহেদীর রং কতটা গাঢ় হবে তা অনেকটাই নির্ভর করে মেহেদীর পাতা থেকে কতটা লসোন বের হলো তার ঘনত্বের উপর। ভেজাল পর্বেই বলেছি কিছু কিছু জৈব দ্রাবক আছে যারা লসোন কে গলিয়ে বের করে আনতে পারে(যেমন তার্পিন তেল/কেরোসিন/কর্পূর)। এর মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকরী দ্রাবক হলো টার্পিনিওল(terpineol)। সবচেয়ে বেশী টার্পিনিওল পাওয়া যায় tea tree oil,cajeput oil & ravensara oil-এ যা আমাদের দেশে পাওয়া মুশকিল হতে পারে। তবে ল্যাভেন্ডার ওয়েলও বেশ ভাল কাজ করে এবং আমাদের দেশে পাওয়া যায়।

লবঙ্গেও অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণে টার্পিনিওল আছে। “টার্পিং” হলো তাজা মেহেদী পেষ্টের সাথে টার্পিনিওলযুক্ত তেল মিশিয়ে পলিথিনে মুড়িয়ে কমপক্ষে ৪-১২ঘন্টা রেখে তারপর ব্যবহার করা। “টাপিং” করলে মেহেদীতে দ্রবীভূত লসোনের মাত্রা বেড়ে যায় এবং ত্বকে দ্রুত ও অধিকহারে লসোন প্রবেশ করে গাঢ় রং এর নিশ্চায়তা দেয়। কোন মেহেদীতে ২%(শুকনো ওজন হিসাবে)এর নীচে লসোন থাকলে ত্বকে মেহেদীর রং খুবই হালকা হয়;আর ৩% এর বেশী থাকলে খুব গাঢ় রং হয়।


প্রাকৃতিক উপায়ে মেহেদীর গাঢ় ও টুকটুকে রং পেতে নিন্মোক্ত ধাপগুলো অনুসরণ করুনঃ-


১।

তাজা মেহেদী পাতা ভালভাবে ধূয়ে( মাটিতে বেশী আয়রন আছে এমন এলাকার মেহেদী পাতায় বেশী লসোন থাকে) পানি ঝরিয়ে নিন। এবার ভালভাবে বেঁটে পেষ্ট তৈরী করুন।

২। এবার একটা বাটি(ঢাকনাযুক্ত রঙ্গীন কাঁচের বৈয়াম হলে ভাল হয়)-তে মেহেদী পেষ্ট নিয়ে তাতে সামান্য লেবুর রস ও কয়েকফোটা tea tree oil বা lavender oil মেশান(এসব তেল হাতের কাছে না থাকলে কয়েকটা লবঙ্গ বেঁটে মিশিয়ে দিন;তাতেও কিছুটা উপকৃত হবেন। সাবধান অতিরিক্ত লবঙ্গের তেল ত্বকের ক্ষতি করতে পারে)।

খুব ভালভাবে নেড়েচেড়ে ঢাকনা বা পলিথিন দিয়ে এয়ারটাইট করে রাখুন। বাতাসের সংষ্পর্শে অক্সিডাইজড হয়ে গেলে মেহেদীর রং ভালো হবেনা।

৩। শীতের দিন হলে বাটিটা রান্নাঘরে দুই চুলার মাঝে(খুব অল্প আগুন জ্বালিয়ে রাখবেন) সারারাত রেখে দিবেন। এর ফলে প্রচুর পরিমাণে লসোন বের হয়ে আসবে।



৪। হাতে মেহেদী লাগানোর পূর্বে কুসুম গরম পানি দিয়ে(সাবান/সোডা দিয়ে নয়) হাতটা ভালভাবে ধূয়ে নিন।

৫। এবার বাটির পেষ্টে অল্প পরিমাণে চিনি মেশান। চিনি খুব ভাল ময়শ্চারাইজার যা মেহেদীকে তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে এবং আঠালো হওয়ায় মেহেদী পেষ্টকে হাতে লেগে থাকতে সাহায্য করবে।



৬। এবার মনের মাধূরী মিশিয়ে ইচ্ছামত ডিজাইনে মেহেদী লাগান।

৭। রোদে যতটা সময় সম্ভব হাত দুটো রাখতে চেষ্টা করুন অথবা হেয়ার ড্রাইয়ার বা চুলার হালকা হিটে হাতটা গরম রাখতে চেষ্টা করুন। এখনকার সময়টা গরম বিধায় এমনিতেই গাঢ় রং পাওয়া যাবে।



৮। সম্ভব হলে ১২ঘন্টা পর্যন্ত মেহেদী হাতে লাগিয়ে রাখুন। তবে টার্পিং করা মেহেদী মাত্র ৩ঘন্টা লাগিয়ে রাখলেও ভাল রং পাওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে শুকিয়ে গেলে চিনির শরবত হাতে স্প্রে করুন।

৯।

মেহেদী হাত থেকে তোলার সময় চামচ বা ছুরির ভোতা প্রান্ত দিয়ে হালকাভাবে ঘষে তুলুন। পানি দিয়ে ধূলে লসোন বের হয়ে যাবে। তবে সামান্য পানি দিয়ে খুব দ্রুত হাত ধূয়ে ফেলা যেতে পারে।

১০। মেহেদী অক্সিডাইজড হতে(অর্থাৎ রং গাঢ় হতে) ২৪-৪৮ঘন্টা সময় লাগে।

এসময়টুকু হাতে পানির ব্যবহার যথাসম্ভব সীমিত রাখুন(মুসলমানরা অবশ্যই ওজু করবেন;নামাজ না পড়লে আল্লাহর গজব পড়বে)। পানির কাজ করলে হাতে সার্জিক্যাল গ্লাভস ব্যবহার করতে পারেন।


মেহেদীর রং হাতে কতদিন গাঢ় থাকে?-মেহেদীর রং ত্বকের উপরিভাগের কোষের কেরাটিনের সাথে লেগে থাকে। আমাদের পুরো ত্বক ৩ সপ্তাহ পর পর পাল্টে যায়। তাই মেহেদীর রং ১-২সপ্তাহের বেশী গাঢ় থাকেনা।

তবে ভেজাল ও ক্ষতিকর কালো মেহেদীর পিপিডি ত্বকের গভীরে ডার্মিসে প্রবেশ করে বিধায় এটা অনেকদিন পর্যন্ত গাঢ় থাকে।


হাতে মেহেদী লাগানো একটা শৈল্পিকচর্চ্চা। ধৈর্য্ধারণ ও নির্ভেজাল হওয়া শিল্পচর্চ্চার পূর্ব শর্ত। আসুন আমরা তাজা মেহেদী হাতে লাগাই আর কেমিক্যালযুক্ত মেহেদী বর্জন করি। ধন্যবাদ সবাইকে।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.