আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আরব্য রজনীর মহানায়ক (প্রথম পর্ব)

অসাধারণ এক আনন্দময় অনুভূতির মধ্য দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন আমিরুল মুমেনিন। তৎকালীন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি 'বাইত আল হাকিমে' বসে তিনি পবিত্র কোরআনের কয়েকটি আয়াতের তফসির দেখে নিচ্ছিলেন। কারণ আর কিছুক্ষণ পরই তাকে যেতে হবে সম্রাজ্ঞী জুবাইদার শাহী প্রাসাদে। সময়টা ছিল ৭৯৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের পড়ন্ত দুপুর বেলা। মুসলিম জাহানের মহামতি খলিফা যখনই সম্রাজ্ঞীর প্রাসাদে যান তখনই তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হয়।

তার বিদুষী স্ত্রী কেবল মুসলিম জাহানের সম্রাজ্ঞীই নন, বিশ্বনবী (সা.)-এর রক্তের ধারক। সম্পর্কে তার চাচাতো বোন এবং খলিফা আল মুনসুরের নাতি। সমসাময়িক দুনিয়ায় তার মতো বিদ্বান, সুন্দরী, ধর্মপরায়ণা, পরোপকারী এবং বুদ্ধিমতী নারী দ্বিতীয়জন ছিলেন না। কোরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস, ইতিহাস, ভূগোল, জ্যামিতি এবং ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে সম্রাজ্ঞীর পাণ্ডিত্যের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র- এশিয়া থেকে ইউরোপ, চীন থেকে ভারত কিংবা আফ্রিকা থেকে রাশিয়া অবধি।

মহান খলিফা হারুন আল রশিদ তার রাজকীয় লাইব্রেরিতে বসে পড়ছিলেন এবং মাঝে-মধ্যে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়ছিলেন।

লাইব্রেরির দোতলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের একটি সুবিশাল কামরার ততধিক সুবিশাল বেলকনিতে বসে তিনি মাঝে-মধ্যে হুঁকোতে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছিলেন এবং বেলকনির নিচে প্রবহমান ইউফ্রেতিস নদীর স্বচ্ছ পানিতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের লাফালাফি লক্ষ্য করছিলেন। ৭ দিন আগে তিনি বাগদাদ থেকে এই প্রাসাদে এসেছেন। নতুন রাজধানী, সবকিছুই নতুন। মনের মাধুরী দিয়ে খলিফা তার নতুন রাজধানীকে সাজিয়েছেন। তিনি যখন বাগদাদ থেকে তার রাজধানী রাক্কাতে স্থানান্তর করতে চাইলেন তখন আব্বাসীয় বংশের উজির-নাজির, পাত্র-মিত্র এবং রাজ-আমাত্যরা প্রবল বিরোধিতা শুরু করল।

খলিফা তার পরিকল্পনার কথা সম্রাজ্ঞী জুবাইদাকে বললেন। সম্রাজ্ঞী শাহী খান্দানের সবচেয়ে প্রভাবশালী অংশের নিয়ন্ত্রক। তার পিতা জাফরই ছিলেন মূলত খিলাফতের দাবিদার। খলিফা মুনসুরেরও তাতে আপত্তি ছিল না। কিন্তু খলিফার অপর পুত্র মাহদী, যিনি ছিলেন খলিফা হারুনের পিতা।

খেললেন অসাধারণ এক কূট-কৌশল। তিনি প্রস্তাব করলেন হারুন ও জুবাইদার শাদী মোবারকের জন্য। উভয়েই তখন শিশু। দুই ভাইয়ের মধ্যে আপন পুত্র-কন্যার শাদিনামার অঙ্গীকারের মাধ্যমে চমৎকার একটি সম্পর্কের সূচনা হলো।

জাফর ছিলেন অসাধারণ মেধাবী, উদার এবং তুলনামূলক কম উচ্চাকাঙ্ক্ষী।

তিনিই মাহদীকে খলিফা বানানোর জন্য সবরকম আয়োজন করলেন। তিনি চিন্তা করলেন- মাহদীর পর হারুন খলিফা হলে তিনি হবেন খিলাফতের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিদের একজন। অন্যদিকে তিনি যদি নিজে খলিফা হন সেক্ষেত্রে আব্বাসীয় রীতি অনুযায়ী পরবর্তী খলিফা হয়ে যাবেন অন্য কেউ। কারণ তার জ্যেষ্ঠ সন্তান জুবাইদা মেয়ে হওয়ার কারণে খলিফা হতে পারবে না। সার্বিক বিবেচনায় তার জন্য খিলাফত ত্যাগ করাই ছিল লাভজনক।

পরবর্তীকালে মাহদী যখন খলিফা হলেন তখন তিনি তার ভাই জাফরের আত্দত্যাগকে অত্যন্ত সম্মান এবং তাজিমের সঙ্গে স্মরণ করতে থাকলেন। আর খলিফা হারুন তো তাকে নিজের পিতার মতো মান্য করে চলতেন। খলিফার রাজকীয় উপাধির সঙ্গেও তার শ্বশুরের নাম সংযু্ক্ত করে দিয়েছিলেন। আবু জাফর হারুন আল রশিদ। অর্থাৎ জাফরের পুত্র হারুন আল রশিদ।

অন্যদিকে সম্রাজ্ঞীর উপাধির সঙ্গেও তার পিতার নাম সংযুক্ত থাকত সব সময়। রাজকীয় দলিলপত্রে তিনি সর্বদা লিখতেন- জুবাইদা বিনতে জাফর।

বেলকনিতে সুন্দর করে যাজিম পাতা হয়েছিল, তার উপর মখমলের চাদর। মিসর দেশীয় সুতার তৈরি নরম ও মসৃণ কাপড়ে আবৃত বড় বড় কয়েকটি কোলবালিশ এবং বালিশে হেলান দিয়ে আমিরুল মুমেনিন এলোমেলো চিন্তা করছিলেন। কিছুক্ষণ আগে তিনি পড়ছিলেন পবিত্র কোরআনের ৯৫নং সূরা।

ছোট্ট একটি সূরা, মাত্র ৮টি আয়াত এবং একটি রুকু। আজকের এই শুভদিনের এবং শুভক্ষণের কোনো এক সময় তিনি সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে সূরাটি নিয়ে আলোচনা করবেন। এ জন্য প্রয়োজনীয় তাফসির বোঝার জন্য তিনি মধ্যাহ্নভোজের পর দিবানিদ্রায় না গিয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকেছিলেন।

লাইব্রেরির কাজ সারা হলে তিনি বেলকনিতে বসে আরাম করতে করতে নানা রকম এলোমেলো চিন্তা করছিলেন। সবাই তাকে প্রশ্ন করেন এত্তবড় একটি রাজধানী যা কিনা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারই মহান দাদা হুজুর খলিফাতুল মুসলেমিন আল মুনসুর ৩০ জুলাই ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে।

তার জীবন আর বাগদাদের ইতিহাস যেন একাকার হয়ে আছে। কারণ বাগদাদ প্রতিষ্ঠা হওয়ার মাত্র ৭ মাসের মাথায় তার জন্ম হয়েছিল। ১৭ মার্চ ৭৬৩ সালে তার জন্মদিনে খলিফা আল মুনসুর মনের আনন্দে নগরীর সব সিংহদরজা খুলে দিয়েছিলেন। ফলে লাখ লাখ বেদুইন খ্রিস্টান এবং ইহুদি একদিনের জন্য রাজধানীতে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিলেন। খুলে দেওয়া হয়েছিল মূল শাহী প্রাসাদের সিংহদরজাও।

প্রতিটি সরাইখানার মালিকের প্রতি রাজদরবারের হুকুম ছিল উটের মাংস রান্না করে সবাইকে খাওয়াও, যে যত খেতে পারে খাওয়াও। সব খরচ দেওয়া হবে রাজকোষ থেকে।

সালতানাত এ মুসলমান বা খিলাফতে মুসলমানের রাজধানী ছিল দামেস্ক নগরীতে। মহান সাহাবি আমির মুয়াবিয়া প্রথম থেকেই সিরিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি যখন পরিপূর্ণভাবে খিলাফতের দায়িত্ব করায়ত্ত করলেন তখন তামাম খিলাফতের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করল দামেস্ক নগরী।

এটি অনেক পুরনো নগরী। আরব উপদ্বীপে রাজ্য রাজা রাজধানীর ধারণা চালু হওয়ার পর থেকেই দামেস্ক নগরীর নামডাক বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে রোমানরা এটি করায়ত্ত করে রাখে ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাস অবধি। খলিফা ওমরের শাসনামলে খালিদ বিন ওয়ালিদ সিরিয়ার অন্যান্য অঞ্চল জয়লাভের পর দামেস্ক দখল করেন।

দামেস্কের বাতাসে কেমন যেন শয়তানির গন্ধ বিরাজ করছে সেই অনাদিকাল থেকে।

কোনো রাজা বা রাজবংশই কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে দামেস্ককে নিয়ে সুখী হতে পারেননি। আর এই কাহিনী তো আর একদিন বা দুইদিনের নয়, হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে। হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের ১১০০ বছর আগে মেসোপটেমীয় (আজকের ইরাক) এলাকা থেকে অ্যারামানিস ও সেমেটিক জাতির লোকেরা দামেস্কে আসেন এবং অ্যারাম ড্যামাসকাস নামের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। এরপর শুরু হয় শহরটির উত্থান-পতন; কত রাজা এলো আর কত রাজা গেল কেইবা এত্তসবের হিসাব রাখে? কিন্তু আমিরুল মুমেনিন খলিফা হারুন আল রশিদকে তো হিসাব রাখতেই হবে। তা না হলে তিনি রাজ্য চালাবেন কি করে।

দামেস্ক নগরীর খবর রেখেছিলেন খলিফা আল মুনসুরও। আব্বাসীয় বংশের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আব্বাস আস সাফফাহ তার প্রতিদ্বন্দ্বী উমাইয়াদের তাড়িয়ে এটির দখল নেন ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ আগস্ট। ছোট একটি যুদ্ধ, যাকে বলা হয় 'যাবের যুদ্ধ'_ কোনো রকম প্রতিরোধ ছাড়াই যুদ্ধে জয়লাভ করে আব্বাসীয়রা। কিন্তু দামেস্কের শয়তানি বাতাস যুদ্ধজয়ী বীর সেনানীদের মনে বিষবাষ্প ঢুকিয়ে দেয়। শহরে ঢোকার পরপরই তারা শুরু করে নির্বিচার গণহত্যা।

একজন উমাইয়া বংশীয় নর-নারী কিংবা শিশুকে সেদিন জীবিত রাখা হয়নি। উমাইয়া বংশের একজন মাত্র লোক বহুকষ্টে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে স্পেন পালাতে পেরেছিলেন। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের জন্যই আবুল আব্বাসকে বলা হয় আস সাফফাহ, অর্থাৎ রক্তপিপাসু।

দামেস্ক দখলের পর বিভিন্ন কারণে নগরীটির ওপর বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন যুবরাজ আল মুনসুর। তিনি খিলাফতের দায়িত্ব লাভের পরপরই রাজধানী পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন।

তিনি দেখলেন দামেস্ক নগরী এবং এর আশপাশের লোকজন বড়ই বজ্জাত এবং চক্রান্তকারী। তারা চাপে পড়ে ইসলাম গ্রহণ করলেও মনে মনে খ্রিস্টবাদের ধারণাকে পোষণ করে। অন্যদিকে শত শত বছর রোমান শাসনের অধীনে থাকার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের উচ্চাভিলাষী মনোভব কাজ করে। মুসলমান খলিফাদের সাদামাঠা জীবন তারা একদম পছন্দ করে না। অন্যদিকে রোমান সম্রাটের অধীনে থাকার কারণে আরব উপদ্বীপে তারা সারা জীবন পারস্য সম্রাট এবং সেই সাম্রাজ্যের অধিবাসীদের শত শত বছর ধরে বংশপরম্পরায় ঘৃণা করে আসছিল।

মুসলমান শাসনামলে এই অঞ্চলের রোমান শাসনাধীন রাজ্যসমূহ এবং পুরো পারস্য সাম্রাজ্য এক হয়ে যায় এবং রাজধানী হয় দামেস্ক। ফলে সাম্রাজ্যের পূর্বতন পারস্যবলয়ের লোকজন রাজধানীতে এলেই দামেস্কবাসী ফ্যাতনা-ফ্যাসাদের সৃষ্টি করত।

খলিফা মুনসুর আরও দেখলেন যে, নগরীটি রোমান সম্রাটের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের একদম কাছে। অন্যদিকে গত প্রায় ১৬০০ বছর ধরে বহু আগ্রাসী জাতি নগরীটির ওপর হামলা চালিয়ে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। বনি ইসরাইল, বনু আমালিক এবং আরও অনেক পাহাড়ি উপজাতি বারবার শহরটি আক্রমণ করেছে।

৮৮০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে প্রথম বেন হাদাদ এবং তার পুত্র হাজায়েলের কাহিনী এখনো মানুষ মনে রেখেছে। ৩২৩ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে সম্রাট আলেকজান্ডার নগরীটি দখল করেন। তার মৃত্যুর পর সেনাপতি সেলকাস এটির মালিক হন। এরপর ৬৪ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে রোমান সেনাপতি পম্পে দি গ্রেট শহরটি দখল করে রোমান সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত করেন। এর পরপর মুসলমানরা যখন এটি দখল করেন তখন সম্রাট ছিলেন হিরাক্লিয়াস।

আমিরুল মুমেনিন খলিফা হারুন আল রশিদ যখন দামেস্ক- বাগদাদ এবং তার প্রতিষ্ঠিত নতুন রাজধানী রাক্কা নিয়ে ভাবছিলেন ঠিক তখনই তার প্রিয় দাসী সুরাইয়া সেখানে ঢুকলেন। আবিসিনিয়ার মেয়ে সুরাইয়া সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। চেহারা-সুরতও অন্যান্য সাধারণ কাফ্রি মেয়েদের মতো। কিন্তু তিনি ছিলেন বেশ লম্বা-চওড়া এবং পটলচেরা চোখের অধিকারিণী, খলিফা তাকে অসম্ভব ভালো বাসতেন এবং অনেক সময় বড় বড় উজির-নাজিরের ওপর সুরাইয়াকে প্রাধান্য দিতেন। এ নিয়ে অভিজাত মহলে কানাঘুষার শেষ ছিল না।

কিন্তু কোনো কিছুতেই খলিফার ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তার মনে হতো তিনি বোধ হয় সুরাইয়াকে ছাড়া বাঁচবেনই না। সুরাইয়া খলিফার পায়ের কাছে বসে অতীব যত্নের সঙ্গে তার পা টিপতে আরম্ভ করলেন। খলিফা জিজ্ঞাসা করলেন ওদিকের খবর কি? সুরাইয়া পা টিপতে টিপতে খলিফার মুখ পানে তাকালেন, অনিন্দ্য সুন্দর যুবা পুরুষ। আরব ভূমিতে এত সুন্দর পুরুষ আর নেই।

মুখভর্তি লম্বা এবং ঘন কালো দাড়ি। দাড়ির সঙ্গে মানানসই গোঁফ এবং লম্বা চুলের কারণে দুনিয়ার সবচেয়ে নামকরা মহান বাদশাহকে যে কি রকম ভালো লাগছিল তা প্রকাশ করার ভাষা সুরাইয়ার জানা ছিল না। মনে হচ্ছিল আহা এখনই যদি রাত নেমে আসত আর খলিফা যদি আজকের রাতটি আমার সঙ্গে কাটাতেন! খলিফা মৃদু কাশি দিয়ে সুরাইয়ার মোহ ভঙ্গ করে বোঝাতে চাইলেন, তিনি একটি প্রশ্ন করেছিলেন। স্বম্বিৎ ফিরে পেয়ে সুরাইয়া বললেন, আমিরুল মুমেনিন- আজ সকালেই সম্রাজ্ঞী বাগদাদ থেকে রাক্কাতে এসে পেঁৗছেছেন। তার জন্য নির্মিত প্রাসাদ এবং নতুন এই শহরটি তার খুবই পছন্দ হয়েছে।

তিনি আজ বাদ মাগরিব তার প্রাসাদে আপনাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য মহাআয়োজন করেছেন।

আরও কোনো নতুন সংবাদ- খলিফা জিজ্ঞাসা করলেন। নতুন সংবাদ হলো সম্রাজ্ঞী বাগদাদ থেকে তার পুরনো ১০০ দাসীকে নিয়ে এসেছেন, যারা কিনা সবাই কোরআনের হাফেজা। এসব মহিলা সমস্বরে কোরআন তেলাওয়াত করছেন আর কাজ করছেন। ফলে নতুন প্রাসাদে এক ধরনের বেহেশতি পরিবেশ বিরাজ করছে।

আজকের রজনীকে মোহময় এবং সুখময় করার জন্য সব আয়োজনই সম্রাজ্ঞী করে রেখেছেন। এখন শুধু সূর্য ডোবার অপেক্ষা। খলিফা খুবই তৃপ্তি পেলেন সুরাইয়ার কথা শুনে। তারপর স্মিতহাস্যে প্রিয় বাঁদির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝাতে চাইলেন- তিনি এখন একা থাকতে পছন্দ করছেন। সুরাইয়া উঠে দাঁড়ালেন এবং কুর্নিশ করে সেখান থেকে বিদায় নিলেন।

খলিফা এবার ইউফ্রেতিস নদীর দিকে তাকালেন। নদীর এপাড়ে গড়ে উঠেছে সুবিশাল নতুন নগরী। আর অপর প্রান্তে শুধু ধু ধু মরুভূমি। সম্পূর্ণ জনমানবহীন। আগামী দিনগুলোতে হয়তো এরূপ থাকবে না।

দামেস্ক-আলেপ্পো, বাগদাদ প্রভৃতি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে হয়তো হাজার হাজার লোক চলে আসবে। তারপর শুরু হবে নতুন এক ইতিহাস। খলিফার ভাবনা আবার ফিরে গেল দামেস্ক নগরীতে। কেনইবা নগরীটি এত প্রসিদ্ধ! বারবার শত শত আক্রমণ, ধ্বংসযজ্ঞ আর অগি্নকাণ্ডের পরও কেন রাজা বাদশাহরা এখানেই তাদের রাজধানী বহাল রেখেছেন প্রায় সাত হাজার বছর ধরে। ইয়ারমুক নদীটিকে ঘিরেই সর্বদা এই অঞ্চলের ভাগ্য নির্ধারণ হয়েছে।

এই নদীর তীরেই সংঘটিত হয়েছে বেশিরভাগ যুদ্ধ-বিগ্রহ। খলিফা নিজে একবার ইয়ারমুক নদীতে বজরা চালিয়ে কয়েকশত মাইল ভ্রমণ করেছিলেন নদীর তীরের সভ্যতা এবং জীবনযাত্রা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভের জন্য। আরব বেদুইনদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন, ধনাঢ্য রাজপুরুষদের বিকৃতিমূলক কার্যকলাপ এবং সর্বহারা মানুষের হাহাকার নিয়ে ইয়ারমুক নদীর পানি নিরন্তর বয়ে চলছে সাগরের পানে- সেই অনাদীকাল থেকে।

আমিরুল মুমেনিন বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন আর ভাবছিলেন- কখন সূর্য অস্ত যাবে আর কখন তিনি প্রিয়তমা সম্রাজ্ঞীর সানি্নধ্যে যাবেন। কয়েক বছর যাবৎ তিনি রাজ্যের তাবৎ জ্ঞানী-গুণী প্রকৌশলীদের পরামর্শ নিয়ে নতুন রাজধানী রাক্কাকে গড়ে তুলেছেন।

সম্রাজ্ঞীর প্রাসাদটিও তিনি পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হেরেমের মর্যাদা দিতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। রাজকোষ থেকে বেহিসাবি অর্থ ব্যয় করেছেন কেবল প্রিয়তমার মুখে একটু কৃতজ্ঞতা ও সন্তুষ্টির হাসি দেখার জন্য। তার সম্রাজ্ঞী অবশ্য দুনিয়ার জাঁকজমক ও জৌলুসের তুলনায় আখেরাতকে বেশি পছন্দ করেন। অন্যদিকে তিনি নিজে দুনিয়া এবং আখেরাত দুটোই সমানভাবে উপভোগের পক্ষপাতী।

সম্রাজ্ঞী জুবাইদার সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মতো।

চারপাশে এত নারী, রাজ্যের সব সুন্দরী তার শাহী হেরেমে বাস করছে কেবল তাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য। আরব মুলুকের সুন্দরীরা ছাড়াও আফ্রিকা, ইউরোপ এবং ভারতবর্ষ থেকেও সুন্দরীদের সংগ্রহ করা হয়েছে। অন্যদিকে আমিরুল মুমেনিনের বন্ধু রাজন্যবর্গ নিজ নিজ দেশের অভিজাত পরিবারের সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী কন্যাদেরও উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে- কেবলমাত্র ওই দেশের সঙ্গে সুন্দর একটি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য। এসব অভিজাত কুমারীকে রাখা হয়েছে স্বতন্ত্র এবং বিলাসবহুল হেরেমে। এত্তসব আয়োজনের মধ্যেও আমিরুল মুমেনিন কোনো সুখ বা শান্তি খুঁজে পান না।

তার সব চিন্তাচেতনা, কেবল সম্রাজ্ঞী জুবাইদাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু কেন, কেন তার এই দুর্বলতা কিংবা কিসের এমন মোহ রয়েছে সম্রাজ্ঞীর মধ্যে!

খলিফা আবার আকাশের দিকে তাকালেন। গোধূলি লগন শুরু হয়েছে। আকাশে হরেক রকম পাখি অদ্ভুত ডাকে কিচিরমিচির শুরু করেছে। এ সময় মানুষের মনও যেন কেমন উদাসীন হয়ে ওঠে।

তিনি একমাস আগে রাক্কায় এসেছেন। বাগদাদ ত্যাগের আগের রাতে তিনি ছদ্মবেশে নগরীতে বের হয়েছিলেন নগরবাসীর সুখ-দুঃখ স্বচক্ষে অবলোকন করার জন্য। অন্যান্য দিন তার সঙ্গে থাকেন প্রধানমন্ত্রী জাফর। কিন্তু সে রাতে তিনি সম্রাজ্ঞী জুবাইদাকে অনুরোধ করলেন তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য। কোনো রকম আপত্তি না জানিয়ে সম্রাজ্ঞীও শাহেনশাহর মতো ছদ্মবেশ ধারণ করলেন এবং সঙ্গোপনে বের হয়ে পড়লেন রাজপ্রাসাদ থেকে।

প্রাসাদ দুর্গে তখন রাত দ্বিপ্রহরের ঘণ্টা বেজে উঠল। কয়েকটি নিশাচর পাখি পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে যাচ্ছিল হয়তো কোনো শিকারের উদ্দেশে। অমাবশ্যার রাত, ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমিরুল মুমেনিন এবং সম্রাজ্ঞী দুইটি দুর্বল গাধার পিঠে চড়ে ধীরে ধীরে পথ চলতে থাকলেন আকাশের তারার আলোর ওপর ভরসা করে। চলতে চলতে তারা টাইগ্রিস নদীর কিনারে চলে এলেন।

নদীর স্বচ্ছ পানিতে আকাশের তারারা সব ঝিলমিল করছিল। নদীর দুইপাশে ছিল সাম্রাজ্যের উজির-নাজিরদের বিলাসবহুল সব প্রাসাদ। এসব প্রাসাদের সম্মুখভাগে ছিল সুবিশাল বাগান। বাগানের পর বিশালাকার দেয়াল। আর দেয়ালের সামনেই প্রশস্ত রাজপথ।

অন্যদিকে পেছনদিকে ছিল নদী। প্রাসাদ বেদী থেকে পাকা শান বাঁধানো ঘাট নেমে গেছে নদীতে। সেই ঘাটে বাঁধা রয়েছে নানারকম বিলাসবহুল সব বজরা। প্রতিটি বজরার মাঝি-মাল্লারা সারা রাত ঘুমায় না। কারণ উজির-নাজিররা রাতের যে কোনো সময় প্রাসাদ ভ্রমণে বের হতে পারেন।

ফলে রাতে তারা নির্ঘুম সময় পার করেন এবং দিনের বেলায় নাক ডেকে ঘুমান।

আমিরুল মুমেনিন এবং সম্রাজ্ঞী ছদ্মবেশে গাধার পিঠে চড়ে ভ্রমণ করছেন এবং ইশারায় কথাবার্তা বলছেন। অনেকক্ষণ হলো তারা ভ্রমণে বের হয়েছেন। কোনো জনমানবের সাক্ষাৎ মিলল না। মাঝে মধ্যে মশাল হাতে প্রহরীরা দুরন্ত বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যাচ্ছে আর মুখে উচ্চারণ করছে হুঁশিয়ার- সাবধান।

এভাবে চলতে চলতে রাজদম্পতি তাদের শাহী প্রাসাদ থেকে বহুদূর চলে এলেন। হঠাৎ করেই আমিরুল মুমেনিনের গাধাটি অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসল। বলা নেই, কওয়া নেই গাধাটি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর মাটির দিকে নাক নিয়ে কিসের যেন ঘ্রাণ নিল এবং এরপরই শাহেনশাহকে এতটুকু সময় না দিয়ে রাস্তার ওপর ধপাস করে শুয়ে পড়ল। (চলবে)

 



সোর্স: http://www.bd-pratidin.com

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।