আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অনুগল্পঃ রূপাজীবা

সুজলা সুফলা শস্য শ্যামল আমাদের এই বাংলাদেশ। এখানে যেদিকে চোখ যায় শুধু সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। যেদিকে তাঁকাই সেদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। যেন সবুজের বন্যায় ভাসছে পুরো দেশ। পাখির গান, নদীর কুলুকুলু ধ্বনি, রাখালের বাঁশি, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া পর্যটকদেরকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে।

হাজার বছরের ঐহিহ্যে সমৃদ্ধ এই বাংলাদেশে সংস্কৃতি। ফেনী বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলা। এ জেলাকে বাংলাদেশের নাভি বলা হয়। ফেনীর উত্তরে কুমিল্লা দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা আর খাগড়াছড়ি জেলা পশ্চিমে নোয়াখালী জেলা অবস্থিত। সোনাগাজীকে ফেনীর রানী বলা হয়।

সোনাগাজীর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বুকে আঁচড়ে পড়া অগণিত ঢেউ আর অবারিত সবুজ গাছ-গাছালি সোনাগাজীকে ফেনীর রানী হতে সহযোগিতা করেছে। সোনাগাজী মুহুরী প্রকল্প বাংলাদেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই প্রকল্পকে ঘিরে হাজার হাজার কৃষকের ভাগ্য আবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

প্রকৃতি তার অকৃপণ হাতে সকল সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে ফেনী ও মুহুরী নদীর মোহনায় সৃষ্ট মুহুরী প্রকল্প এলাকায়, আর এই সৌন্দর্য বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকা হয়ে সীতাকুন্ড পেরিয়ে পতেঙ্গা অবধি বিস্তৃত। খ্রিস্টিয় সপ্তম শতাব্দীতে বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এই অঞ্চল নিয়ে মন্তব্য করেছিলেনন ‘পানি ও কুয়াশার মাঝে সৃষ্ট ঘুমন্ত এক সৌন্দর্য’।





বৃহত্তর চট্টগ্রামের সোনাগাজীতে অবস্থিত মুহুরী প্রকল্প দেশের ষষ্ঠ বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে এর অবদান বিশাল, পাশাপাশি মুহুরী সেচ প্রকল্প হতে পারে একটি অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। প্রকল্পের বিভিন্ন অংশ এবং এর পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক-অনাবিল-নৈসর্গিক শোভা যেকোন পর্যটককেই আকর্ষণ করে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে গৃহীত যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে এটিকে গড়ে তোলা যায় একটি অনন্য আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র রূপে, যা থেকে কর্পোরেশন প্রতি বছর পর্যটন খাতে আয় করতে পারে প্রচুর দেশী-বিদেশী বৈদেশিক মুদ্রা।

প্রকল্প পরিচিতি

এক সময় মুহুরী প্রকল্পের স্থানে ছিল দেড় দুই মাইল প্রশস্ত একটি নদী।

নদী এপার-ওপার ছিল বিচ্ছিন্ন। পরে ফেনী নদী এবং মুহুরী নদীর দুই তীরকে সেচ সুবিধার আওতায় আনার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গৃহীত পরিকল্পনা মোতাবেক ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়।


চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলার সীমান্ত বরাবর বয়ে যাওয়া ফেনী নদী এবং মুহুরী নদীর মোহনার ভাটি অঞ্চলে নির্মিত মুহুরী সেচ প্রকল্পের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিল ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড। মহুরী প্রকল্পের অধীনে রয়েছে ফেনী সদর, সোনাগাজী, ছাগলনাইয়া, পরশুরাম থানার আংশিক এবং মিরসরাই থানার উত্তরাঞ্চলের বিশাল এলাকা। প্রকল্পাধীন এলাকার আয়তন ৪০ হাজার ৮০.৯২ হেক্টর।

এই এলাকায় আবাদযোগ্য জমির মোট পরিমাণ ২৭ লাখ ৯২ হাজার ৫০৬ হেক্টর, এর মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার ৭৬.৯৩ হেক্টর জমিই হলো ফসলি জমি।

এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার বার্ষিক অতিরিক্ত ফসল উৎপাদিত হয় ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। মুহুরী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে খরচ হয়েছিল ৯৫ লাখ ৬৮ হাজার ৬২৪ টাকা। প্রকল্প পরিচালনায় বর্তমান কর্তৃপক্ষের বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ভর্তুকির পরিমাণ ২১ হাজার ৩১৮ লক্ষ টাকা। আয়-ব্যয়ের বার্ষিক হিসাব অনুযায়ী লাভের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩২.১৩ শতাংশ।





মুহুরী প্রকল্পের নির্মাণ কাজ ১৯৭৭-৭৮ সালে শুরু হলেও এর প্রাথমিক কাজ শেষ হতে সময় লাগে তিন বছর এবং সম্পূর্ণ কাজ শেষ হতে হতে ১৯৮৫-৮৬ সাল পার হয়ে যায়।

প্রকল্পের প্রধান অংশসমূহ হচ্ছে ইমারত সাত হাজার ৬৪৬ বর্গমিটার, ক্লোজার ড্যাম একটি তিন হাজার ৪১১ কিলোমিটার, রেগুলেটর একটি, ৪০ দরজা বিশিষ্ট নিষ্কাশন কাঠামো নতুন একটি এবং পূর্ণ সংস্কার ছয়টি।

খাল পুনঃখনন ২৮৬.৬ কিলোমিটার রেগুলেটর প্রবাহের পরিমাণ প্রতি সেকেন্ডে দুই হাজার ৭১৮.৭৭৬ ঘনমিটার। প্রকল্পাধীন নদীতে সেচের জন্য সংরক্ষিত পানির পরিমাণ সর্বনিম্ন ২.৫৯ মিটার ও সর্বোচ্চ ৩.৮১ মিটার এবং সর্বোচ্চ প্রকল্পের ফলে বাঁধের দক্ষিণে উদ্ধারকৃত পানির পরিমাণ চার হাজার ৮৫৮.২৯৯ হেক্টরের কিছু বেশী।


যোগাযোগ এবং ভ্রমণ

দেশের যেকোন স্থান থেকে মুহুরী প্রজেক্টের সড়ক যোগাযোগ তথা যাতায়াত ব্যবস্থা যথেষ্ঠ সুবিধাজনক।

ঢাকা-চট্টগ্রাম লালপোল হয়ে সোনাগাজী উপজেলায়। সোনাগাজী থেকে সিএনজি-বাস কিংবা রিকশায় করেও যাওয়া যায় মুহুরী প্রকল্পে। বাঁধের উত্তরের নীল জলরাশি আর দক্ষিণের দিগন্ত বিস্তৃত চর এবং প্রাকৃতির নৈসর্গিক শোভামন্ডিত পরিবেশ, পাইন গাছের সারি, ঝাউবন, কাশফুল, সবুজ ঘাসের মিশেলে প্রকৃতির নৈসর্গিক শোভামন্ডিত পরিবেশ যেকোন পর্যটককেই আকর্ষণ করবে।

দর্শনার্থীদের জন্য অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ৪০ দরজাবিশিষ্ট সারিবদ্ধ রেগুলেটর। এছাড়া বাঁধের মূলগোড়া থেকে প্রকল্পে প্রবেশ না করে বেড়িবাঁধ দিয়ে সোজা দক্ষিণে এলেই রয়েছে উপকূলীয় বনবিভাগের সাজানো কৃত্রিম সুন্দরবন।

এখানে বনের ফাঁকে ফাঁকে সর্পিল আকারে বয়ে গেছে ছোট ছোট নদী, বনে রয়েছে হরিণ, বানরসহ অনেক বন্য পশুপাখি।

এখানে পর্যটকদের জন্যে কোন হোটেল রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থা নেই। ফাঁকে ফাঁকে বিক্ষিপ্ত কয়েকটি রেস্টুরেন্ট আছে। তাই নিজ দায়িত্বেই খাবারের আয়োজনের জন্যে রেগুলেটরের উত্তর পশ্চিমের ছোট বনে রান্নাবান্না ও ভোজের আয়োজন করা যেতে পারে। দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে দু’একটি অস্থায়ী ভাসমান চা’র দোকান বসে।

এখানে রাতযাপন করার কোন সুব্যবস্থা নেই।


পর্যটন কেন্দ্র

পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে মুহুরী সেচ প্রকল্প একটি অন্যতম সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। পর্যটন কর্পোরেশন মুহুরী প্রকল্পকে ঘিরে এখনো পর্যন্ত কোন বৃহত্তর পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। প্রতিদিন শত শত মানুষ দূর-দূরান্ত থের কে এখানে আসেন এবং অঞ্চলটআকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে রোমাঞ্চিত হন।

উন্নত ও আধুনিক ব্যবস্থা, রাতযাপন ও খাবারের আয়োজন থাকলে এই স্থান আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে।

সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিলেই পুরো প্রকল্প এলাকাটিকে সবুজ অরণ্যে রূপান্তর করা যায়। বাঁধের উত্তরপার্শ্বে ঝাড় ও পাইনসহ সুদৃশ্য গাছ লাগানো যেতে পারে, আর দক্ষিণে অন্তত এক কিলোমিটার এলাকায় সৃষ্টি করা যেতে পারে সবুজের সমারোহ।

বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করার মত প্রাকৃতিক উপাদান এখানে বিপুল পরিমাণেই বিদ্যমান। মহিষ খামার, ভেড়ার খামার, হ্যাচারি, মৎস্য ঘের, চারণভূমি ইত্যাদির পাশাপাশি জলজ প্রাণীসমৃদ্ধ একটি আধুনিক মিউজিয়াম গড়ে তুললে স্থানটির আকর্ষণ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। উত্তরের বিশাল হ্রদে স্পিড বোটে করে ভ্রমণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

নৌ-পথে সহজ যোগাযোগের জন্যে বঙ্গোপসাগর থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে তথা প্রকল্প এলাকায় একটি নৌবন্দর প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

তবে মাঝে মাঝে পাশ্ববর্তী থানাগুলো থেকে কয়েকটি সক্রিয় জলদস্যু গ্রুপ এবং মাস্তানদের দ্বারা সাধারণ মানুষকে আক্রান্ত হবার খবর পাওয়া যায়। এ অবস্থায় স্থানীয় এবং বহিরাগত মান্তানদের দৌরাত্ন বন্ধে কার্যকরী প্রদক্ষেপ নেয়া জরুরী বলে মনে করেন স্থানীয় এলাকাবাসী। মাস্তান এবং জলদস্যুদের হাত থেকে পর্যটকদের নিরাপদ রাখার জন্য পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পর্যটন কর্পোরেশন যদি মুহুরী সেচ প্রকল্পকে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে এটি হতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।

যার ফলে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করতে পারবে এই মুহুরী প্রকল্পের সৌন্দর্য থেকে। ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।