আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যে দেশে মোজা পড়ে মাথায়!



দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ সম্পর্কে কিছু মজার ও অদ্ভুত তথ্য আজ তুলে ধরবো। চীনের পূর্ব দিকে দেশটির অবস্থান। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জের ধরে জাপান থেকে পৃথক হয়েছে। ভাষা ও সংস্কৃতিতে তাদের সাথে আছে আমাদের এক নিবিড় সম্পর্ক। গুরুজন তথা পরিবারের বয়স্কদেরকে শ্রদ্ধা এবং পারিবারিক সম্পর্কের ব্যাপারে তাদের সাথে আমাদের খুব একটা পার্থক্য নেই।

তারাও মাকে অম্মা, বাবাকে আব্বা বলে এবং ‘সাল’ রান্না করে ‘ভাপ’ খায় - বাংলায় আমরা যাকে বলি যথাক্রমে চাল ও ভাত। ভাষা এবং স্বাধীনতা নিয়েও তাদের আছে ভিনদেশী শাসকের সাথে বেদনাময় স্মৃতি। কিন্তু মজার বিষয়টি হলো আমরা যখন মাথায় পড়ি টুপি বা ক্যাপ, তারা পড়ে মোজা! সে বিষয়ে পড়ে আসছি।


নিজ ভাষায় দেশটির নাম হানগুক - আমরা বলি কোরিয়া। আরও সুস্পষ্টভাবে বললে, দক্ষিণ কোরিয়া।

অর্থনৈতিকভাবে জাপানের মতোই উন্নয়ন সাধন করেছে এই পরিশ্রমী জাতি। আমি বলি জিদি জাতি - সবকিছুতেই তাদের আছেে এগিয়ে যাবার অজেয় জেদ। কোরিয়ানদের উন্নয়নের মাধ্যমও অনেকটা জাপানের মতোই অটোমোবাইল, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি এবং মেশিনারি রপ্তানি তাদের প্রধান আয়ের ‍উৎস। তবে এই যে আমি জাপানের সাথে তাদের তুলনা করছি, এটিই তাদের কাছে অপমানকর মনে হবে। কারণ, জাপান তাদের চিরশত্রু, যেমন আমাদের জন্য পাকিস্তান।

শত্রুতার কারণও আমাদের মতোই অভিন্ন। ঘটনাও প্রায় আমাদেরই মতো।


‘আমার’ নয় - ‘আমাদের’

এক জাতির দেশ হানগুক - আদিবাসী বা অনাদিবাসী বলে আলাদা কোন এথনেসিটি বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নেই। সবকিছুতেই এক এবং অভিন্ন থাকার একটি প্রবণতা আছে তাদের মধ্যে। দেশের জন্য উপোস করা, নিজের সম্পদ দান করা এবং সর্বোপরি দেশের জন্য যুদ্ধ করার ঐতিহ্য তাদের আছে।

প্রত্যেক কোরিয়ানকে একটি নির্দিষ্ট বয়সে সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এর দু’টি উদ্দেশ্য: ১) দেশের জন্য দায়িত্ব নিতে অভ্যাস করানো এবং ২) সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ দিয়ে রাখা, যেন দুঃসময়ে অস্ত্র ধরতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ানদের দুঃসময় প্রধানত: দু’টি ভাগে বিভক্ত - উত্তর কোরিয়ার সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধ এবং জাপানের সাথে দ্বীপের মালিকানা নিয়ে স্বাভাবিক যুদ্ধ। ‘আমি’ অথবা ‘আমার’ শব্দটির বহুল ব্যবহার অনেক সময় আত্মঅহমিকা প্রকাশ করে। কোনকিছুকে ‘আমার’ বলা মানে হলো এর মালিকানা আর কারও নেই।

ছোটবেলায় আমরা ‘এটা আমার’ বলে নিজের জিনিসের অধিকার প্রকাশ করতাম। কিন্তু হানগুগীয়রা এদিক দিয়ে অত্যন্ত উদার। নিজের জাঙ্গিয়াটিকেও ‘আমাদের জাঙ্গিয়া’ বলতে তারা রাজি। বিষয়টি সত্যিই মজার। কন্যা সন্তানটি ‘আমাদের স্বামী’ বলে তার স্বামীকে আত্মীয় বা বন্ধুদের কাছে পরিচিত করিয়ে দেবে নির্দ্বিধায় - তাতে কেউ তার স্বামীর ওপর মালিকানা প্রকাশ করবে না।

তেমনি ‘আমাদের মা’, ‘আমাদের বাবা’ ইত্যাদি। তাদের একটি বৃহৎ ব্যাংকের নাম ‘উরি উনহেং’ - মানে হলো আমাদের ব্যাংক। আমাদের দেশেও ‘উরি ব্যাংক’ নামে তাদের একটি শাখা আছে ঢাকায়।



দেশি বস, বিদেশি শ্রমিক: বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নয়ন

আত্মসম্মানবোধ, তীব্র স্বদেশ প্রেম, পরিচ্ছন্নতা বোধ, জেষ্ঠ্য নাগরিকের প্রতি শ্রদ্ধা, ধর্ম বিশ্বাস ইত্যাদি প্রসঙ্গে আধুনিক মানসিকতা এবং সর্বোপরি অমানুষিক শ্রম দেবার অভ্যাস কোরিনদেরকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক দশকের সামগ্রিক প্রচেষ্টার ফলে এই উন্নয়ন প্রক্রিয়াটি এখন অনেকটা স্বয়ংক্রিয় হয়ে গেছে।

সামান্য রাজনৈতিক অস্থিরতায়ও তাতে প্রভাব ফেলতে পারে না। কোরিয়ার গ্রামগুলোতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খালি পড়ে আছে, শিক্ষার্থী নেই। কারণ তারা সকলেই মা-বাবার সাথে শহরে বাস করে আর উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করছে। কৃষিকাজ একটি আদি পেশা হিসেবে টিকে আছে বয়স্ক নাগরিকদের হাতে। সত্তর আশি কোন বয়সই না কোরিয়ান কৃষকদের কাছে।

শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে অথবা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করছে অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বের মানুষগুলো, যাদের নেতারা রাজনীতির সাথে পলিটিক্স মেশায়! ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এমন কি চিনের মানুষগুলোও কোরিয়ায় প্রবেশের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। কোরিয়ান ভাষায় ‘আমায় মেরো না’ ধরণের সারভাইভাল ল্যাংগুয়েজ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে তারা ওই দেশে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করার জন্য দীর্ঘ
লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। শ্রমিকের কাজ করার জন্য কোরিয়ানদেরকে আর পাওয়া যায় না, কারণ অফিসের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কাজ করার জন্য তাদের অধিকাংশই যোগ্য হয়ে থাকে। শ্রমিকের কাজ সব ভিনদেশীদের হাতে।



ভালো খাবো এবং ভালো খেয়েছি

খাবার আগে আমরা সাধারণত রাধুনীর খবর রাখি না।

অথবা গৃহকর্তাকে ধন্যবাদ জানাবার বিষয়টি তত গুরুত্ব দেই না, এবং দেবার রীতিও নেই। হানগুগের লোকদের আদব-কায়দার শেষ নেই। ওঠতে বসতে শুভেচ্ছা, অভিনন্দন, আনুষ্ঠানিকতা। খাবার সময় মায়ের রান্না হলেও ‘ভালো খাবো’ অথবা ‘মজা করে খাবো’ বলে মাকে আশ্বস্ত করা হয়। আবার খাবার শেষে ‘ভালো খেয়েছি’ বলে শুভেচ্ছা জানানো হয়।

আমাদের মায়েরা খাবার দিলে তো আগে বিচার করি সেটি আমি খাবো কিনা, তারপর অন্য কথা।

ট্রেনে আরাম করে বসে আছি। আমার পাশে একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক বসে আছেন। হঠাৎ তিনি ওঠে দাঁড়িয়ে গেলেন - চমকে ওঠে দেখলাম একজন বুড়ো লোক স্মিত হাস্যে এসে বসলেন আমার পাশে। এতটুকু ভদ্রতা আমাদের দেশেও হয়।

কিন্তু আবার বিস্মিত হলাম, যখন পাশের বুড়ো মানুষটি যখন আরও বৃ্দ্ধ একজন যাত্রীকে জায়গা করে দিতে নির্দ্বিধায় ওঠে হাতল ধরলেন। কাঁপতে কাঁপতে ক্রাচ ধরে বসতে বসতে প্রায় পড়ে গেলেন আমার পাসের সিটটিতে! এবার আমি অপ্রস্তুত হলাম - তবে কি আমারও উচিত ছিলো না ওঠে দাঁড়ানো? আমি দাঁড়ালামও, কিন্তু তা গ্রহণ করা হয় নি। হয়তো তামাটে রঙের আমাকে বিদেশি হিসেবে আদব-কায়দার বাইরে রাখা হয়েছে।

মা দিলেন মাংস আর বাবা দিলেন হাড়, এসব নিয়েই আমার জীবন সংসার। মা এবং বাবার প্রতি কোরিয়ানদের ঐতিহ্যগত বিশ্বাসটি এরকমই।

মা হলেন মাংস, অর্থাৎ কোমলতা ও অস্থায়ীত্বের প্রতীক অন্যদিকে বাবা হলেন হাড়, কঠিন আর স্থায়িত্বের প্রতীক। এজন্যই বাবার মাধ্যমে তাদের বংশ পরম্পরা এগিয়ে চলে। তারপরও মাতৃপ্রধান ধারাটি দেখতে পাওয়া যায়, কোরিয়ান পরিবারে। বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর নামের অংশ নেয় না। তবে সন্তানেরা বাবার নামের অংশ ধারণ করে।



নববর্ষের প্রথম দিনে প্রায় উবুর হয়ে মস্তকাবনত দেহে মা-বাবা অথবা দাদা-দাদিকে ‘শুভ নববর্ষ’ জানায় হানগুগিয়রা। কোন অপরাধ করলেও একই রীতিতে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়। ভালোবেসে বিয়ে করুন, কিন্তু মা-বাবাকে একমত করেই তবে বিয়ে! সন্তানের সবটুকু আনুগত্য তারা চায় যতটুকু তারাও দিয়ে এসেছেন তাদের পূর্বপুরুষদেরকে। এটি একটি দেওয়া-নেওয়ার বিষয় বটে!



চার সংখ্যা বলতে মানা!

মজার কিছু সংস্কার আছে উন্নত কোরিয়ান সমাজেও। তার একটি হলো, চার সংখ্যাটি নিয়ে।

চার সংখ্যাটি হানগুগিয়দের কাছে অপয়া। বিষয়টি কুসংস্কার হলেও তারা এটি বিশ্বাস করেই চলেছে। এখন বলে, এটা তাদের সংস্কার! রাস্তা নম্বর, বাড়ি নম্বর, ক্রমিক নম্বর ইত্যাদিতে আপনি ১-২-৩ এর পর পাবেন ৫! চার এর হানগুগীয় ভাষা হলো, সা - চীনা থেকে উদ্ভুত শব্দটির অর্থ হলো, মরে যাওয়া। এবার বুঝুন কে মরতে চায়! আজকাল বিদেশী মাধ্যমে তারা চার সংখ্যাটিকে ‘এফ’ দিয়ে বুঝিয়ে কাজ উদ্ধার করে।



“আন্নিয়ং হাসেইয়ো - কেমন আছেন”

আন্নিয়ং হাসেইয়ো - কোরিয়ান ভাষায় প্রথম শুভেচ্ছা।

সালামও এটি ‘কেমন আছেন’ বললেও এটিই। যত স্বাভাবিক এবং যত তাৎক্ষণিকভাবে এটি বলতে পারবেন, তত তাৎক্ষণিকভাবে কোরিয়ান হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারবেন! উত্তরও দিতে হয় একই কথা দিয়ে।

আরও কয়েকটি জরুরি কথা:

পানগাপ সুমনিদা - পরিচিত হয়ে খুশি হলাম
খামসা হামনিদা - ধন্যবাদ
মিয়ান হামনিদা - দুঃখিত
কোয়েন্চা নাইয়ো - ঠিক আছে/ চিন্তা করবেন না (দুঃখিত’র উত্তর)
সারাং হেইয়ো - ভালোবাসি
বোগো শিপ্পইয়ো - দেখতে চাই/ আপনার কথা মনে পড়ে
হানগুংমাল আন্আরাইয়ো - কোরিয়ান বুঝি না
ইত্যাদি...



মাথায় পড়ে মোজা!

দক্ষিণ এশিয়ার ভাষাগুলোতে অন্তমিল আছে অবিশ্বাস করার মতো! ভারত এবং পাকিস্তানের সাথে তো আমাদের ভাষায় অনেক মিল আছেই। শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ান ভাষার সাথেও আমাদের আছে মিল। কোরিয়ান ভাষার সাথে কিছু মিল তো ওপরেই বললাম।

এবার বলছি অমিলের কথা। বেইসবল কোরিয়ানদের প্রিয় খেলা। তারপরই ফুটবল। বাংলায় আমরা যাকে বলি মোজা, সেটা তারা পায়েই পরে - নাম হলো ইয়াংমাল। কিন্তু আমরা যেটা মাথায় পরি ‘টুপি/ক্যাপ’ নামে, তারা সেটার নাম দিয়েছে, মোজা! এভাবে মাথায় মোজা পড়ে দিব্বি তারা বেইসবল খেলে







-------------
পুনশ্চ: এলোমেলো লেখাগুলো পাঠক গুছিয়ে পড়ে নেবেন! কোরিয়ায় এযাবত দু’বার যাবার সুযোগ হয়েছে। অফিসের প্রাত্যাহিক কাজের চাপে দু’সপ্তাহের বেশি থাকার সুযোগ হয় নি কোন বারেই। সময় পেলে কোরিয়া সম্পর্কে আরও অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চেষ্টা করবো, যে পর্যন্ত ঝুলিতে কুলোয়!  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.