আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাছন রাজার গান: মিস্টিক বাঙালির মরমি ইশতেহার

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ ‘উড়িয়া যাইব শুয়া পাখি/পড়িয়া রইব ছায়া ...’ আজ হাছন রাজার (১৮৫৪-১৯২২ খ্রিস্টাব্দ) জন্মদিন। যিনি তাঁর গানে একটি অনিবার্য প্রশ্ন রেখেছিলেন: ‘কী ঘর বানাইমু আমি/ শূন্যেরও মাঝার। ’ বোঝা যায়, এক অমোঘ শূন্যতা বোধে আক্রান্ত হয়েছিলেন বাংলার ওই মরমি গীতিকার।

ঘরসংসার -এমন কী- খোদ অস্তিত্বই যেখানে অর্থহীন, অসার - তাহলে জীবন কেন? কেন ক্ষণিকের এই শূন্য জীবনে এত আনন্দের উপকরণ? সুনামগঞ্জের মরমি গীতিকার এই তিক্ত ভাবনায় বিস্মিত ও ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন সন্দেহ নেই। অবশ্য পরিনত বয়সে পৌঁছনোর আগে হাছনের মনে গভীরতরো মরমি ভাবনার উদয় হয়নি। পরিবেশও অবশ্য অনুকূলে ছিল না। বিত্তশালী পরিবারের সন্তান ছিলেন হাছন। যৌবন ছিল ইয়ার-দোস্তদের সঙ্গে মৌজ-ফুর্তিতে ভরপুর।

বিলাসবহুল সৌখিন জীবনে অভ্যস্ত হাছন আসক্ত ছিলেন নারীসঙ্গে। বামাচারী তন্ত্রের চর্চা, অর্থাৎ বেসামাল যৌনাকাঙ্খার নিবৃত্তিই ছিল যে জীবনের একমাত্র লক্ষ। সেকালের ওপরতলার পুরুষদের এহেন প্রবৃত্তি করবার সর্বজনসম্মত সামাজিক প্রথারও চল ছিল বৈ কী। হাছনের জন্ম সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে। বর্ষার মরশুমে হাওর অঞ্চলের সম্পদশালী পরিবারের পুরুষরা ঘেটু গানের দলবল নিয়ে আমোদের বিলাসী নৌকা ভাসাত হাওরের জলে।

(হুমায়ুন আহমেদ- এর ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ ছবিতে এরকম দৃশ্য আমরা দেখেছি বৈকী। ) যৌবনে হাছন রাজা অনুরূপ জীবনই কাটিয়েছেন। তবে হাছন রসের হাওরে ভেসেও তাঁর হৃদয় নামক ‘পিঞ্জিরা’র মধ্যে ‘প্রাণ’ নামক মন-মনিয়া পাখির ছটফটানি টের পেয়েছিলেন ঠিকই। কাজেই হাছনের পুর্নজ্জাগরণ ঘটতে সময়ও লাগেনি। তিনি সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন ।

একদা যিনি ছিলেন ভোগী, তিনি হয়ে উঠলেন ত্যাগী। পূর্বজীবনের পাঁক-পঙ্কিলতা স্মরণ করে অনেকটা আক্ষেপ করেই হাছন লিখলেন ‘ও যৌবন ঘুমেরই স্বপন/ সাধন বিনে নারীর সনে হারাইলাম মূলধন। ’ মিস্টিক বাঙালির আরেক ইশতেহার রচয়িতা লালন যেমন বলেছেন: যে ধনে উৎপত্তি প্রাণধন সে ধনের হল না যতন অকালের ফল পাকায় লালন দেখেশুনে জ্ঞান হল না। বাংলার মরমি সাধকদের এই আত্মসমালোচনা আমাদের জন্য ইঙ্গিপূর্ণ। সে যাই হোক।

হাসন রাজা জেগে উঠলেন। পরিবর্তিত মানুষটি জমিদারের ঝলমলে পোশাক ছুড়ে ফেলে সংসার ত্যাগী মুছাফির-এর আলখাল্লা পড়লেন । তারপর তুরস্কের কোনিয়ায় মাওলানা রুমির মাজারের ঘূর্নায়মান দরবেশদের মতন দু’হাত তুলে ঘুরে- ঘুরে গাইতে লাগলেন: আমি যাইমু রে যাইমু আল্লারও সঙ্গে হাছন রাজা আল্লা বিনা কিছু নাহি মাঙ্গে ... সত্তার এই আমূল পরিবর্তনে হাছন নিজেও অভিভূত । তার প্রমাণ তিনি রেখে গিয়েছেন। কেননা, তাঁর প্রাণমন থেকে স্ফূরিত হয়েছিল একটি গান: বাউলা কে বানাইলো রে/ হাছন রাজারে বাউলা কে বানাই লো ... হাছনের জীবনের এ পর্যায়ে আমরা তাঁর পরিশুদ্ধ হৃদয়ে পবিত্র প্রেমময় বোধের উদ্বোধনও দেখতে পাই: নেশা লাগিল রে / বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল রে/ হাছন রাজা পিয়ারীর প্রেমে মজিল রে/ এই মানবীয় প্রেমই আবার হাছনের অমলিন অন্তরলোকের রসরসায়নে সঞ্জীবিত হয়ে ঐশী চেতানায় উত্তীর্ণ হয়ে যায়: সোনা বন্ধে আমারে পাগল করিল/ না জানি কোন মন্ত্র পড়ি যাদু করিল ... এই প্রেম এখন আর অসংযত নয়, বহুগামী নয়।

কেননা, প্রেমসাধনার কেন্দ্রে এখন রয়েছেন মহামহিম ঈশ্বর -যিনি এক। ঈশ্বর স্বয়ং বিশ্বব্রহ্মান্ডেরও মূল এক অনির্বচনীয় চিরন্তন সত্য। যিনি ব্যক্তি হাছনের কাছে ‘দয়াময়’। যে হাছনের উপলব্দিতে ঐশ্বরিক সত্তায় আচ্ছন্ন অনাদি অনন্তলোক যেমন সত্য ও বাস্তব, অনন্তকালের তুলনায় ক্ষুদ্র, তুচ্ছ এই সংসারও সত্য ও বাস্তব। সে কন্ঠক আকীর্ণ ঘাত-প্রতিঘাতময় সংসারে রয়েছে দুঃখের অবিরাম আবর্তন এবং মানবসত্তার বন্দিদশা।

দুঃখার্ত এই সংসারের প্রতীক হাছনের কাছে খাঁচা। খাঁচায় বন্দি হাছন গাইলেন: মায়ে বাপে করলা বন্দি খুশির মাঝারে/ লালে ধলায় হইলাম বন্দি পিঞ্জিরার ভিতরে রে/ কান্দে হাছন রাজার মনমনিয়ায় রে ... ‘হৃদয়’ নামক ‘পিঞ্জিরা’র মধ্যে ‘প্রাণ’ নামক ‘মন-মনিয়া’ পক্ষির ছটফটানি টের পেয়ে বিষন্ন হাছন। এই বিষন্নতার নামই বিবেকবোধ; যা মানুষে-মানুষে সমভাবে প্রজ্জ্বলিত নয়। এ রাতভর জ্বলে থাকা দেবালয়ের মিটিমিটি প্রদীপ, কখনও যা নেভে না। এই বিষন্ন যন্ত্রণাকাতর প্রেমিক হাছন-এর সুফিপ্রাণকে বাঙালি তার হৃদয়ে গ্রহন করেছে বহুবছর আগেই।

আশ্চর্য এই যে- হাছন রাজা ১৯২২ সনে পরলোক গমন করলেও তাঁর গান আমাদের সমকালীন বলেই মনে হয়। একটা সময় ছিল যখন হাছন রাজার গান মিডিয়ায় ‘লোকগান’ বলে প্রচারিত হত। কুড়ি শতক ধরে বাঙালির চেতনা সূক্ষ্ম হয়েছে, শানিত হয়েছে, পরিনত হয়েছে। যার ফলে আজ হাছন রাজার গান কেবলই নিছক ‘লোকগান’ নয়, তার চেয়েও অধিক কিছু, এ গান আজ মিস্টিক বাঙালির মরমি ইশতেহার। হাছন রাজার গান অনিবার্যভাবেই বাঙালি হৃদয়ের প্রতিনিধিত্ব করে।

যে কারণে হাছন রাজার গানের দিনদিন বাঙালির আগ্রহ বাড়ছে; বিশেষ করে অসাম্প্রদায়িক বোধে অনুপ্রাণিত তরুণ প্রজন্মে। এটি আশ্চর্যের কিছু না। আর এটিও বিস্ময়কর নয় যে, হাসনের গানে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ। হাছন রাজা মূলত সুফি ঘরনার সাধক ছিলেন। আমরা জানি সিলেট অঞ্চলটি মধ্যযুগ থেকেই সুফিবাদী ঐতিহ্যের পাশাপাশি ঐতিহাসিকভাবেই বৈষ্ণব-ভাবতত্ত্বেরও অনুশীলন হয়েছে।

শিল্পী হিসেবে হাছন নিজস্ব মাটির বিভিন্ন ধারা ভাব ও সুর সমৃদ্ধ চেতনায় ধারণ করবেন লালন করবেন (আমাদেরও উদ্বুদ্ধ করবেন তেমনটি করতে) এটাই তো স্বাভাবিক। হাছন যে কারণে অনায়াসে লিখেছেন: আমি মরিয়া পাই যদি শ্যামের রাঙ্গা চরণ তবে সে রঙ্গিনী রাধার সাফল্য জীবন। তবে সুফি বলেই হাছনের আত্মদর্শনের মূল ঝোঁকটি যেন বৈরাগ্যের, এবং একই সঙ্গে দয়াময় ঈশ্বরের সঙ্গে অভিন্নতার। যে কারণে তাঁরই এক গানে এই বিশেষ সুফি দৃষ্টিভঙ্গির এক সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষ্য আমরা পাই - হাছন রাজায় কয়/ আমি কিছু নয় রে আমি কিছু নয় ভিতরে-বাহিরে দেখি শুধু দয়াময়... এই নিগূঢ় উপলব্দি এক বৃহৎবোধের ইঙ্গিত দেয়। পরিশুদ্ধ মানব চেতনার এ এক মহত্তম দিক।

তাহলে জগতে অন্যের সুখই আমারই সুখ, অন্যের দুঃখই আমারই একান্ত দুঃখ? এই পৃথিবীর একটি পাখির কি একটি পাতার একান্ত দুঃখ ... উপকূলের নিরন্ন জেলেপাড়ায় কিংবা সিলেটের চা-বাগানে শীতার্ত পল্লীর যন্ত্রণা আসলে আমারই একান্ত যন্ত্রণা ... তাহলে কখন আমরা উপদ্রুত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারব? যখন আমরা শূন্যতায় দাঁড়িয়ে বলতে পারব: ‘কী ঘর বানাইমু আমি/ শূন্যেরও মাঝার। ’ এই গানই তো মিস্টিক বাঙালির মরমি ইশতেহার ... ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.