আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অনাহূত সেই মানুষের জন্য কেউ অপেক্ষা করেনি

আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা । হবে চৈত্র মাসের কোন এক বিকাল । দিন - তারিখ ঠিক ঠাহর করতে পারেনি জহির মিয়া । পাক্কা ৬ বছর বেগার জেলে খাটার পর অবশেষে জেলের ফটক থেকে বের হতে পেরেছিলো । ৬ বছর আগের মাঘ মাসের কথা বাপের জন্মে ভুলবেনা সে ।

আয়েশ করে বিড় টানতে টানতে সন্ধ্যায় গিয়ে কোথায় তার ন্যাওটা ভাইঝিটাকে আদর করবে , সবার চোখের সামনে পুলিশে ধরে নিয়ে গেলো । না সে নিজে পারলো ঠাহর করতে না পারলো অন্যরা । পুলিশে ধরে এমন কিছু জহির করবে গ্রামের কেউই বিশ্বাস করতোনা , কিন্তু কিছুতেই কিছু হলোনা । বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা , পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা সূত্র ফলেছিলো অক্ষরে অক্ষরে । পুলিশ চাবকে সব গোলমাল করে দিয়েছিলো ।

কাঁধের হাড় নড়ে গিয়েছিলো , বাঁ পায়ের পেছনের হাড় ফ্র্যাকচার্ড হয়েছিলো । প্রতিদিন পুলিশে মনে করিয়ে দিতো গ্রামাঞ্চলে সেই জমিদার । চ - বর্গীয় শব্দ ছাড়া একটা বাক্যও ব্যবহার করতোনা । সকালে এসে ' বল চুদির পোলা বশীরের শালাকে পিটিয়েছিলি কেন ? ' - তার গ্রামের বশীরের সাথে তার যোজন যোজন দূরত্ব । কোথায় গ্রামের জমিদার সোবহানের খাস লোক বশীর আর কোথায় এককালে মসজিদে ইমামতি করা বাপের পোলা জহির ।

বশীরের বস্তা বস্তা গম চুরির কিচ্ছা ধামাচাপা দিতেই যে তাকে বানোয়াট কেসে ফাঁসিয়ে দিবে জানতে পেরেছিলো অনেক পরে । বদলী হয়ে এখানে আসা নতুন ওসিটাই আস্ত খচ্চর । ব্যাটা বশীরের কাছ থেকে পয়সা খেয়ে গেছে বছরের পর বছর , পয়সা খেয়ে তাকে পেঁদিয়েছে প্রতিদিন । জহিরের বড় ভাইয়ের কাছ থেকেও ফাঁকে - ফুঁকে পয়সা খেতে ভোলেনি হারামজাদা । বড় ভাই নিজেও বুঝে নিয়েছিলো হুদাই পয়সা দিয়ে যাচ্ছে ।

একসময় পয়সা দেওয়া বন্ধ হলো , কিছুদিন প্রকান্ড পেঁদানোর পরে ওসিও ক্লান্ত হয়ে তাকে ভাগাড়ে রেখে দিলো । পাড়ার খোঁড়া কুকুরটার কথাও মানুষ একসময় ভুলে যায় , তাকেও ভুলে গেলো সবাই । জেলে পঁচতে লাগলো কেউ খবর রাখেনি । বড় ভাই একসময় বুড়া বাপ - মা থেকে বউ আর মেয়ে নিয়ে সটকে পড়লো । কেউ এসে বাপ - মায়ের খোঁজ এনে দেবে ত্রিভুবনেও তার এমন কেউ নেই ।

৬ বছর পর বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে জহিরের মনে হচ্ছে ন্যাংটাকালের ঘেয়ো কুকুরটাই তার অনেক আপন ছিলো । বাড়ির চারপাশের রাস্তা বদলেছে অনেক । শহরের মেলা কিছু এসেছে গ্রামে । টিভি - ভিসিয়ার এসেছে বেশ আগেই । মিনি প্যাক শ্যাম্পুও চলে আসছে দেখছে আর অবাক হচ্ছে জহির ।

সাথে শহরের পোলাপানরা খায় চিপস না কি বলে সেটার প্যাকেট হাতেও ময়লা জামা পরা আন্ডাবাচ্চাদের হাতে হাঁটতে দেখছে সে । এমন কতকিছু বদলালো তবু জমিদারের চ্যালাদের শাসানী , জমিদারের মুখের তেলতেলা হাসি আর গরীবের উপর পুলিশের পেঁদানী বদলালো না । বদলায়ওনা সেটা স্বল্প বুদ্ধির জহিরও ভালো বুঝে । ৬ বছর যাবত মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে না পেরে অনেক কিছু তার ছোট্ট মাথায় ঢুকে গেছে । জহির আর কিছুর জন্যই প্রতীক্ষা করেনা ।

কেবল বাড়ি গিয়ে কাঠাল গাছটা আছে কিনা দেখতে উদ্গ্রীব হয়ে আছে । বুড়া মা তাকে দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকাবে দিব্বি কল্পনা করতে পারছে সে । মুর্খ মহিলা অবাক হলে কেবল ফ্যালফ্যাল করে চারপাশে সবার দিকে তাকায় । তখন কি বলে উঠবে তাও বুঝ করে উঠতে পারেনা । বাপটার কথা মনে করেও হাঁটতে হাঁটতেই একটু কেঁপে উঠলো জহির ।

বয়সকালে কম মার খায়নি বাপের কাছে সে । নির্বুদ্ধিতার জন্য উঠতে - বসতে বাপের মার খেতো সে , গালাগালও শুনতো প্রচুর । তারপর মায়ের সাথে গজগজ করতো লোকটা ' তোর এই ছোট ছাওয়ালটারে মানুষে খালি কিনবো আর বেঁচবো , কিচ্ছু করবার পারবোনা সে । ' সেই লোকও প্রতিবার জহির বাইরে থেকে ঘরে এলে জায়নামাজ নিয়ে বসে যেতো । নামাজ শেষে আবার শুরু করতো হইচই ।

জহির ভাবে , হাঁটতে হাঁটতে পথ কমে আসে । ৬টা বছর চলে গেছে , আর কিছুর জন্যই তার অপেক্ষা করার নেই । কেবল বাড়ির সামনের কাঠালগাছটা আছে কিনা , বুড়া বাপ - মা আছে কিনা । হাঁটতে হাঁটতে আর নানাকিছু ভাবতে ভাবতে চৈত্র মাসের এক সন্ধ্যায় জহির অবশেষে জেল থেকে আড়াই মাইল পার হয়ে সেই চেনা পরিচিত ঘরে এসে দাঁড়ালো । কাঠালগাছটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আগের মতই , কেবল চারপাশ খাঁ খাঁ করছে ।

কোন ঘরে সে প্রবেশ করেনি কিন্তু নিশ্চিত বলে দিতে পারে ঘরগুলোয় কোন মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করে নেই । চারদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকানো সেই মুর্খ মহিলা নেই , নেই তাকে ঘরে ফিরতে দেখা মাত্র জায়নামাজ নিয়ে বসে যাওয়া সেই বদমেজাজী মানুষটাও । জহির চারদিকে তাকায় , নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে কাঁঠালগাছটার সামনে । মনে মনে কিছু ভাবতে থাকে । সে মনে মনে কি ভেবেছিলো তা তখন টের পাওয়া যায়নি ।

পরদিন কাঁঠালগাছটায় তাকে ঝুলে থাকতে দেখার সময় অবশেষে আঁচ করতে পারা যায় সে কি ভেবেছিলো । আশেপাশের মানুষগুলোর চেয়েও সেখানে উপস্থিত কিছু নীল মাছি জহিরকে তাদের বেশী আপন মনে করেছিলো । সেই কারনে শেষ মুহূর্ত্বে জহিরের চারপাশে তাদের দেখা গিয়েছিলো । মাছিগুলো বুঝে নিয়েছিলো জহিরের আর অপেক্ষার কিছু ছিলোনা । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।